পিঞ্জরে শরীর ঘ’ষে
চিন্তিত ব্যক্তি সে আজো, উদ্বেগের পীড়িত শিকার।
অতীত, আগামী ভাবীকাল-যেন কয়েকটি বল-
নিয়ে যারপরনাই ক্রীড়পরায়ণ সে সদাই।
তখনো নিদ্রার থেকে উত্থিত, ব্যথিত কথঞ্চিৎ,
দ্যাখে অপসৃয়মান স্বপ্ন তাকে দিচ্ছে টিট্রিকার।
পিঞ্জরে পাখায় ঘুন, ম্রিয়মান পাখিটির গীত
প্রবঞ্চিত সৌন্দর্যের মতো কথাও উধা; তাই
পিঞ্জরে শরীর ঘ’ষে হ’তে চায় কিছু শব্দোচ্ছল।
অপরাহ্ন হৃদয়েরও, নিঃসঙ্গতা এলানো মগজে-
সে ভাবে, শব্দের মায়া কতকাল এভাবে গীতের
বনস্থলী ব্যেপে খুব মধুরতা, কিছুবা অস্থির
বিষণ্নতা বওয়াবে? এখন তো সকলেই ভজে
সমুন্নত সিংহাসন। সে একাকী বেজায় শীতের
মরশুমে বুভুক্ষায় গরম রুটির মতো তাপ।
খোঁজে অসহায় শব্দের নিবাসে, কী অধীর
রৌদ্রের পরিখা আর জ্যোৎস্নার বাসর, লোকালয়,
মুখচ্ছবি গ’ড়ে যায়। চেনে না নিজেরই পদচ্ছাপ
রক্তচোষা সিঁড়ি আর পথে; হাঁটে কর্কশ আলোয়,
ছাড়িয়ে গাছের শীর্ষ নক্ষত্রের আড়ালে সে থাকে;
অকস্মাৎ গীত পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে তাকে।
তার মনে প’ড়ে যায় সড়কে কিসের দাগ, ঘরে
কারা ছিলো গাছ তার মাথার ভিতর কিংবা মাথা
স্তব্ধ মনুমেন্টের ভিতর ঢুকে গিয়েছিলো আস্তে।
এখন প্রচুর দৃশ্য ভাসমান মনের নানান স্তরে
এলেবেলে, লুকাচুরি চলে। খাঁ খাঁ বাড়ি, বৃক্ষ পাতা,
তস্তরিতে জলপাই-সে আনত স্বপ্নের ওয়াস্তে।
স্বপ্নে কি পিঞ্জর থাকে? দীর্ঘ পথ চুর্ণ হয়? স্মৃতি
মৃত্যুর অনেক কাছে চ’লে যায়? ধ্বস্ত সেতু চোখে
নিয়ে কেউ কথোপকথন সারে কফিনের পাশে?
পিঞ্জরে শরীর ঘ’ষে ঘ’ষে অবরুদ্ধ শোকগীতি
বুকে পুষে ঠিকঠাক থাকা চুলে ভুতুড়ে আলোকে?
সে ভাবে, এখন স্মৃতি যাক ব’য়ে আপন নিশ্বাসে।
প্রজাপতি
প্রজাপতি সারারাত আমার ঘরেই ছিলো খুব
চুপচাপ দেয়ালের এক কোণে বিন্দুর মতন।
আমি তো না জেনে তাকে এই ঘরে দিয়েছি আশ্রয়।
সারারাত বই প’ড়ে কিছু লিখে এবং ঘুমিয়ে
কেটেছে আমার, আমি তাকে লক্ষ্য করিনি মোটেই।
আমরা পরস্পরের অস্তিত্ব বিষয়ে অচেতন
ছিলাম সমস্ত রাত একই ঘরে। অকস্মাৎ ভোরে
পিতার প্রাচীন ফটোগ্রাফের সান্নিধ্যে প্রজাপতি
তরঙ্গিত, দেখলাম; এখন সে আমার নিজস্ব
ভাবনায় অন্তর্ভুক্ত অতিশয় সাবলীলভাবে।
সে-ও কি আমার কথা সমস্ত শরীর দিয়ে তার
চিন্তা করে? প্রজাপতি নড়ে হৃৎস্পন্দনের মতো।
প্রতীক্ষা
এতদিনে জেনে গেছি, সে তোমার পরিহাস ছিলো
পুরোপুরি, হয়তো কোনোদিন
দেখা হবে,-কতবার ভেবেছি আবেগভরে আর
তোমার আসার পথে দিয়েছি বিছিয়ে স্বপ্নময়
বাসনার রক্তিম গালিচা।
কিন্তু অলিখিত কবিতার মতো তুমি থেকে গেছো
অদ্যাবধি চেতনায়। সে কোন্ রহস্যময় প্রাণী
পরম সোহাগে করে পান সারাবেলা
আমার আপন
হৃদয়ে জল, কোনো কোনো দিন বিছুবা শোণিত!
এখন তোমাকে দেখি (মনে হয় দেখি) পথে পথে,
গাছের ছায়ায় পার্কে, স্মৃতির মতন গোধূলির ছোপ-লাগা
বারান্দায়, বাস টার্মিনালে,
প্রত্যেক নারীর মধ্যে তোমাকেই দেখি, মানে খুঁজি
ইতস্তত বারবার। এখনো তোমার রূপ নিতান্ত অচেনা
আমার নিকট?
অস্পষ্ট ধারণা তুমি এক? স্বপ্নকুয়াশায় ঢাকা?
যখন তোমার মুখে চিবুকে গ্রীবায় স্তনমূলে
নামে জলধারা,
তখন তোমাকে কী রকম মনে হয়,
পারবো না বলতে কখনো;
যখন তোমার পিঠে শ্যাম্পুকরা চুল একরাশ
গীতিকবিতার মতো শুয়ে থাকে কোমল-উজ্জ্বল,
তখন তোমার মুখে কতটুকু তুমিত্ব বিরাজে,
জানি না, অথবা
কারো অভিযানপ্রিয় হাত তোমার স্তনের দিকে
অগ্রসর হ’লে তুমি কেমন বিহ্বল হ’য়ে যাও,
এবং তোমার ওষ্ঠে কেউ চুমু খেলে
তোমার চোখের পাতা অতি দ্রুত নেমে আসে কিনা-
আমি তা’ জানি না।
এখন তোমাকে খুঁজে বেড়ানোর অসুখ নিয়ত
ভোগাচ্ছে আমাকে।
যে কানো নারীর মুখ হঠাৎ দেখলে
ধুক ধ্বক ক’রে ওঠে-সে কি তুমি? হৃৎস্পন্দন, ওষ্ঠ, বাহু-
চোখ হয়ে যায় সবই একটি নিমেষে। সে কি তুমি?
কোনোখানে তোমাকে না দেখে বারংবার
কেবলি আমার মন ভীষণ খারাপ হ’য়ে যায়।
তবে কি স্বপ্নের ঘোরে আজীবন জ্বলন্ত রাত্তিরে
তোমার উদ্দেশে আমি বিষণ্ণ কবিতা লিখে যাবো?
এক্ষুণি আমাকে এসে ব’লে দাও সাফ-
তুমি আর প্রতীক্ষায় থেকো না নির্বোধ।
প্রশ্নোত্তর
যখন আড়ালে পথ চলি,
‘কি খবর, আরে, বলুনতো কী খবর’,
প্রশ্ন করে গাছপালা, পাখি, আমি বলি-
প্রেরণাবিহীন কবি রুদ্ধশ্বাস বন্ধ ডাকঘর।
প্রেমের কবিতা হ’য়ে যায়
কিছুদিন হলো ভারি বদরাগী ব’লে বদনাম
রটেছে আমার।
অথচ বন্ধুরা জানে যখন তখন
দেলশাইয়ের কাঠির মতন ফস ক’রে
বিযম ওঠে না জ্ব’লে আমার মেজাজ।
হঠাৎ সেদিন
আপিস ফেরত আমি ক্রোধের বিকারে সারা পথে
ছড়িয়ে এসেছি কাঁটা অবলীলাক্রমে। স্বপ্নে দেখি,
পথের বেবাক কাঁটা রাশি রাশি হ’য়ে সুখে
দোল খায় নিশীথের তন্দ্রিল হাওয়ায়।
কী-যে হয়, অকস্মাৎ আমার দু’হাত
কোত্থেকে মুখোশ এনে আমার নিজেরই মুখে ঠিক
দেয় সেঁটে, পরমুহূর্তেই,
কী অবাক কান্ড,
কালো সে মুখোশ
তন্বী হয়ে নেচে দূর স্বর্গপথে চ’লে যায়।
দুর্নিবার ক্ষোভে একরাশ অন্ধকার নিয়ে দ্রুত
বানাই আদিম গুহা চতুর্দিকে, অপদেবতার
মতো হাসি ক্ষণে ক্ষণে, শাবাস শাবাস ব’লে করি
প্রস্থান নিদ্রায়, জেগে দেখি উৎফুল্ল জ্যোৎস্নার তোড়ে
আঁধার গিয়েছে ভেসে, নিশ্চিহ্ন সে-গুহা
প্রেতের বদলে
বিপুল জ্যোৎস্নায় তৈরী রাজহাঁস হাঁটে প্রতিবেশে।
কেন যে এমন রেগে যাই বারবার? কেন দাঁতে দাঁত ঘষি?
লেখার টেবিলে ব’সে রাত জেগে সাজাই কেবলি
ঘৃণায় অক্ষরমালা, কী জাদুতে ওরা সহজেই
প্রেমের কবিতা হ’য়ে যায়।