নকশা
নকশা আছে মনোব্যাপী, ছন্দোময় নিঝুম গড়ন-
প্রাচীন সুরাই যেন, যৌথ কারুকর্মে কান্তিমান।
এই নকশা জ্বলজ্বলে, প্রাণবান কখনো নিতান্ত
চেনা, কখনো বা মায়া, বহুমুখী রহস্যে অচেনা।
ফুলের কেয়ারি বুঝি এই নকশা, যেখানে পাখির
ছায়া পড়ে, রৌদ্রানন্দ ঘন হয়, জ্যোছনা গহন
গীতধারা, নিরিবিলি সৃজনপ্রবণ আর মালী
অলস অমনোযোগী হ’লে কেবলি উৎপন্ন হয়
রাশি রাশি পরগাছা, কোনো কোনো ঋতু ভয়ানক
নিষ্ফলা, রোরুদ্যামান দিনরাত্রি, পত্রপুষ্পহীন
ডাল কাঁপে বিরান হাওয়ায়। কারো কারো বেলা যায়
সুরাইয়ে একটি রেখা এঁকে, ভাগ্যবান হ’লে কেউ
মুখচ্ছবি আঁকে কোনো; নকশা বড়ো শোণিত পিপাসু,
ক্রমাগত সত্তার বিশদ ক্ষয়ে নকশা জায়মান।
অন্তর্গত এই নকশা বিশ্বপ্লাবী তুমুল আঁধারে
নিত্য প্রাণ জাগানিয়া সুগভীর সংকেত নিরালা-
সে সংকেতে একটি মানুষ অন্য মানুষের কাছে,
খুব কাছে চলে আসে, যদিও পরস্পরের দেখা
হয় না কখনো; এভাবেই অন্তরালে পরিচয়
প্রসারিত চিরদিন মানুষের মধ্যে দিকে দিকে।
সে এক আশ্রয় বটে ভ্রান্তিহীনরুপে মানসিক।
যেমন ওষ্ঠের সঙ্গে চুম্বনের, আপেলের সাথে
তার অন্তর্গত গুঢ় রসসিক্ত মাংসের সম্পর্ক,
বলা যায়, তেমনি এক সম্পর্ক মনের চিরকাল
নকশার সহিত। এই নকশা থেকে দূরে কেউ কেউ
সহসা পালাতে চায়, তছনছ করে দিতে চায়
তাকে, বড়ো বেশি এলোমেলো, তবু নকশা থেকে যায়
রূপান্তরে, অস্তিত্বের গীতময়তায় বন্দনীয়।
নিঃসঙ্গতা
মেঘে ঝুলে থাকা
তরঙ্গ-মা লায়
ভাসমান পুণ্য
দেবদুতগণ এই
স্তব্ধতাকে খুব
সস্মানিত ক’রে
সুস্পষ্ট বলুন
আমার হৃদয় কার কাছে তুলে ধরবো এখন দ্বিধাহীন
কার কাছে হৃদয় তো জামা নয় কোনো দড়িতে টাঙিয়ে দেবো
ক্লিপ এঁটে খোলামেলা হাওয়ায় দুলবে কাছে এসে কেউ কেউ
বিহ্বল তাকাবে কেউ মাথা নেড়ে চ’লে যাবে হেঁটে বহু দূরে
আমার হৃদয়
ভীষণ নৈঃসঙ্গ্যে
মোড়া প্রতিদিন
কম্পমান আমি
দুঃস্বপ্নের খুব
অভ্যন্তরে নিজে
একাকী দুঃস্বপ্ন
জন্মান্ধ পেরেক
মাথায় ঠুকবে
যারা তারা বন্ধ
ঘরে খেলে পাশা
তীব্র পচা মাছ
যন্ত্র ণা-কা ত র
মুখের রেখার
মতো রাস্তা শুধু
সস্মুখে আমার
উন্মাদের চোখ
দ্যায় সিগন্যাল
পাখিরে তুই
পাখিরে তুমি ডাকিস কেন আজ?
অমন ক’রে ডাকা তো ভালো নয়।
পাখিরে তোর জিগির ছায়াময়।
কেমনতরো দিলি যে সুর পেতে,
গেরস্তের হবে না ভালো এতে।
জিগিরে তোর ভয়ের ছায়া মেশে,
পাখিরে তুই উড়ে যা দূর দেশে।
দুঃখ হ’য়ে স্তব্ধতায় যদি
বেড়াস উড়ে এখানে নিরবধি,
তোর কী ক্ষতি? পারিস যদি তুই
ডাকের ফাঁকে ঝরিয়ে দেনা যুঁই।
পাখিরে তোর কেমনতরো কাজ?
শহরময় ছড়ালি কী বিলাপ,
অন্ধকারে মরুভূমির তাপ।
দিলি তো ছেড়ে বিভীষিকার ঝাঁক-
পাখিরে তুই দিসনে আর ডাক।
জিগিরে তোর মৃত্যু আসে ভেসে,
পাখিরে তুই উড়ে যা দূর দেশে।
পারিপার্শ্বিকের আড়ালে
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, যার
জন্যে মধ্যরাতে কোনো নদী,
মাছের মতন চকচকে কোনো স্বপ্নাবৃত প্রখর শবীর
বিছানায় একা
অপেক্ষা করছে কিনা, সে জানে না। কোথাও এখন
দরজা জানালা র্তার জন্যে খোলা আছে কিনা কিংবা
অন্ধের ইস্কুলে আলো জ্বেলে কেউ চক্ষুষ্মান খুব
ধৈর্য ভরে ব’সে আছে কিনা,
সে জানে না। জানে তার মনের নিভৃত ছায়াচ্ছন্ন
ঘাটে কী সুদূর
অরণ্যের প্রাণীর মতন পানি খেতে আসে স্মৃতি। জানে তাকে
সারারাত এলোমেলো জাগিয়ে রাখবে অলৌকিক হুইশিল।
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, নিজের কাছেই
বন্দী সর্বক্ষণ।
প্রতিদিন শহরের সবচেয়ে করুণ গলির মুখচ্ছবি
মুখের রেখায় নিয়ে হাঁটে ফুটপাতে,
সুনিবিড় রিশ্তা তার রহস্য নামক অতিশয়
লতাগুল্মময় প্রান্তরের সঙ্গে, কেমন অচিন
দৃশ্যাবলি সমেত বিপুল
অদৃশ্যের সাথে।
একদিন মরে যাবে ভেবে তার মনের ভেতরে
আবর ঘনায় একরাশ, মনোবেদনার রেখা
ফোটে মুখমন্ডলে গভীর,
কিছুকাল এভাবেই কাটে, ফের চকিতে আনন্দে নেড়ে দেয়
সময়ের থুতনি ঈষৎ।
বয়স বাড়ছে তার, বাঁচলে কার না বেড়ে যায়?
নিজেকে জপায় সে-ও প্রায়শই-হৃদয় সতেজ রাখা চাই,
নইলে কবিতার সুক্ষ্ম শিকড় কংকালসার হবে।
কবিতার জন্যে তাকে উন্মাদ হতেই হবে, আজো মানে না সে;
অবশ্য একথা ঠিক, কোনো কোনো কবি মানসিক
ব্যাধিতে ভুগেও কাগজের শূন্যতায় এনেছেন
পাখির বুকের তাপ, দুপুরের হলুদ নিশ্বাস,
তন্দ্রিল সঙ্ঘীতময় দ্বীপপুঞ্জ, বাঘের পায়ের ছাপ আর
প্রাচীন দুর্গের সিঁড়ি, দেবদূত, অজানার দ্যুতি;
জীবনকে দিয়েছেন বাস্তবিক স্বপ্নের গড়ন।
শৈল্পিক ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ঘোরে দিগ্ধিদিক;
নিজেকে লুকিয়ে রাখে স্বরচিত কুয়াশায় আর
করে সে উজাড় পাত্র বারবার ইয়ারের সাথে।
নিজের আড়ালে তার একজন স্বতন্ত্র মানুষ
স্বপ্নের রঙের মতো মুখ নিয়ে ব’সে থাকে একা,
জানে না কখন উঠে যাবে ফের আপন পুশিদা
আস্তানায়; জানে না সে কোথায় যে নিরাময় তার
হাসপাতালের বেডে নাকি কোনো নারীর হৃদয়ে।
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, যার
প্রতি ইদানীং
বিমুখ নারীর ওষ্ঠ, শিল্পকলা, বাগানের ফুল।
সবাই দরজা বন্ধ ক’রে দেয় একে একে মুখের ওপর,
শুধু মধ্যরাতে ঢাকা তার রহস্যের অন্তর্বাস খুলে বলে-
ফিরে এসো তুমি।
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হ’য়ে যায়,
অতিকায় টেলিফোন নেমে আসে গহন রাস্তায়, জনহীন
দীর্ঘ ফুটপাত
ছেয়ে যায় উঁচু উঁচু ঘাসে আর সাইনবোর্ডের বর্ণমালা
কী সুন্দর পাখি হ’য়ে রেস্তোরাঁর আশেপাশে ছড়ায় সংকেত।
একজন্ন পরী হ্যালো ব’লে ডায়াল করছে অবিরাম,
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হ’য়ে যায়
খোলা পথে ঝলসিত সরোবর, রাজহাঁস যেন
টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না,
স্পর্শাতীত হাঁটে
ঝরিয়ে জটিল স্বপ্ন চতুষ্পার্শ্বে, একজন বামন চার্চের
চূড়ায় চুরুট ফোঁকে, দঙ্ঘা-হাঙ্ঘামায় খোয়া গেছে
একটি সপ্রাণ চোখ তার, মধ্যরাতে বুড়িগঙ্ঘা নদীটির বুকে
জলজ প্রাসাদ জাগে,
রেডক্রস চিহ্নিত বাড়ির ছাদে ফেরেশতামন্ডলী
অলীক কনফারেন্সে মাতে, ত্র্যাম্বুলেন্সে স্বর্গীয় মদ্যপ
গান গায়, নাচে
এবং টহলদার পুলিশ কখন অর্ফিয়ুস বনে যায় চমৎকার;
মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হ’য়ে যায়।
শামসুর রাহমান ব’লে আছে একজন, যার চক্ষুদ্বয়
কখনো কোমল হ’য়ে আসে হৃদ্স্পর্শে, কখনো-বা
শিরাপুঞ্জে কাঁটাঝোপ হ’য়ে কাঁপে বন্য নিষ্ঠুরতা!
মগজে প্রবেশ করে কালপুরুষের তলোয়ার,
চোখে তার গাঢ় হয় সম্রাজ্ঞীর আংটির ঝলক,
রুপবান সিংহ ডাকে বারবার চুলের জঙ্ঘলে,
বনদেবী ছুটোছুটি করেন নিভৃতে, ঝোপঝাড়ে,
বৃক্ষশ্রেণী চেয়ে থাকে অপলক, দেবীর বাকল
লুটায় গাছের নিচে। শামসুর রাহমান ব’লে
আছে একজন, যার পাশে হেনরী মুরের এক
সর্বদা এলিয়ে-থাকা নারীমূর্তি গুহার মতন
খুব ফাঁকা উদরসমেত শুয়ে থাকে, বাউলের
একতারা স্বপ্ন দ্যাখে নিরালা শিয়রে; চতুর্দিকে
পাখির মতন দৃষ্টি মেলে কিছু দেখে তাকে
অত্যন্ত নিকট থেকে বিষাদ, অসুখ, গৃহত্যাগ।
এবং আপনকার রক্তমাংসে লোভ আছে তার,
মানে সেই লোকটির, সহজেই ব’লে দিতে পারি।