তুমি চলে গেলে
যখন আমার কাছে এসে বসো, করো পায়চারি,
কাতাও আমার দিকে আড়চোখে, গালগল্পে মেতে
কাটাও অনেক বেলা, কখনো ওল্টাও তাড়াতাড়ি
সাহিত্যপত্রের পাতা এলোমেলো অথবা মেঝেতে
রাখো চোখ, কী যে ভাবো-আমি অতিশয় নিরুত্তাপ
ঘড়িতে সময় পড়ি, যেন তুমি নেই কাছাকাছি,
যেন হৃদয়ের ঘরে পড়েনি তোমার পদচ্ছাপ।
নিজের আড়ালে আমি নিজের বৈরিতা নিয়ে বাঁচি।
তুমি চলে গেলে অস্থিরতা জেগে ওঠে, অকস্মাৎ
আমার ভিতরকার একাকী পুরুষ শব্দ নিয়ে
খেলা করে, অদৃশ্যের প্রতি ব্যগ্র বাড়ায় সে হাত,
লুকিয়ে নিশীথে মুখ কাঁদে খুব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
তোমাকেই ভাবে
আমার দরজা আমার জানালা তোমাকেই ভাবে
সারাদিনমান,
তোমার স্বপ্নে বিভোর আমার লেখার টেবিল।
কোনোদিন তুমি আসেনি এঘরে, দাঁড়াওনি হেসে
দরজার কাছে, র্যা ক থেকে তুলে নাওনি নতুন
কবিতার বই
কিংবা বসোনি কাঠের চেয়ারে, শরীর তোমার
দাওনি এলিয়ে এই শয্যায়। তোমাকেই ভাবে
আমার রুক্ষ জেগে-থাকা আর উচ্ছুংখল
রাত্রির ঘুম।
তোমাকেই ভাবে আমার উঠোন, সন্ধ্যালোকের
রক্তগোলাপ, রান্নাঘরের ফোকরে উষ্ণ
পায়রার বুক, শূন্য রেকাবি এবং আমার
কবিতার খাতা।
আমার আঙুল, আমার চোখের অভিজ্ঞ পাতা,
পাঁজরের হাড় প্রতি রোমকূপ তোমাকেই ভাবে।
কোনোদিন তুমি
আসোনি এখানে, বসোনি আমার পাশে কতকাল
তুমি আসো তবু মধ্যরাত্রি পেরুনো প্রহরে
চিত্রকল্পে,
হৃদয়ের কত অন্তরঙ্গ ধ্বনির মতন
শব্দমালায় স্বপ্নের মতো পংক্তিপুঞ্জে।
কে যেন সহসা বলে রাত্তিরে এভাই তুমি
এভাবেই থাকো-
নীরবতা ভালো, নীরবতা ভালো, নীরবতা ভালো।
কিন্তু তবুও পাথরের নিচে স্পন্দিত একা
টিকটিকিটার
মতো কিছু কথা সাবলীলভাবে জন্মাতে চায়।
সুনীল তোয়ালে ঢউয়ের মতন পড়ে আছে চুপ,
মুখস্থ করি তোমার মুখের রেখা কালো চুল,
যে-ফুল তোমার খুব ভালো লাগে, ভাবি তার কথা,
আমার ত্বকের
ভেতরে চকিতে কোমল পাপড়ি ঢুকে যেতে দেখি,
অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে ক্ল্যারিওনেটের
খুব পুরু সুর-
জান্লায় হাত রাখে দেবদূত, ঢেকে ফেলে মুখ-
বস্তুত স্মৃতি এক ধরনের জীবন যাপন।
তোমার নীরবতার কাছে
এ কেমন আচরণ? এ কেমন ধরন তোমার?
আমার ভেতরকার গেরস্থালি এক হলমায়
অলক্ষ্যে করেছো তুমি ওলটপালট।
অকস্মাৎ নিরিবিলি নিজস্ব নিবাস থেকে হু হু নিরাশ্রয়ে
চলে যাবে, কখনো ভাবিনি।
নিজের রহস্যে মজে আছো উদাসীন
আমার ব্যাকুলতার প্রতি।
আমার নিকট
একটি হেঁয়ালি হয়ে থাকতে কি চাও চিরদিন?
এ কেমন আচরণ? এ কেমন ধরন তোমার?
ম্যানিফেস্টো রচনার মতো দীপ্র মনোযোগে আমি
তোমাকে গড়েছি
রাত্রিদিন সুচেতন মনের ভুভাগে অনলস,
আমার নিকট থেকে তবু দূরে সরে যাচ্ছো শুধু।
তবে কি হঠাৎ কোনো বাসি পদ্য হয়ে যাবে তুমি
স্মৃতিতে আমার?
সেদিন তোমার তন্বী প্রহরের প্রতি
আমার নিজস্ব ব্যাকুলতা
ঝঁকেছিলো ভুল ক’রে, ভুল ক’রে নিজেরই অজ্ঞাতে
কিছুটা চটুল করেছিলাম নিজেকে,
তোমার কথার তাপে নিয়েছি হৃদয় সেঁকে বড়ো ভুল ক’রে।
তোমার সৌন্দর্য তুমি অন্ধকারে রেখেছো ব’লেই
আমিও সে আঁধারের অনুগত-তোমার ভাবনা
আমার রাত্তিরে অনিদ্রার ডাকটিকিট লাগায়
বিরামবিহীন।
সর্বদা তোমাকে ঘিরে ওড়ে প্রজাতির মতন
আমার স্বপ্নেরা,
এবং তোমার দিকে প্রসারিত আমার সকল পথরেখা।
তোমার গ্রীবার বাঁকে, তোমার চোখের
সুদীর্ঘ ছায়ায়
কেশর দুলিয়ে ছোটে অজস্র স্বপ্নাশ্ব দিগ্ধিদিক,
তোমার ঘুমের ঢেউয়ে সহস্র তরীর ভরাডুবি
হয় বারবার,
তোমার চুলের মেঘে অস্ত যায় হৃদয়ের সুর্য
শতবার,
বুকের চূড়ায় আকঙ্গক্ষার চন্দ্রোদয় শতবার,
তোমার ওষ্ঠের কাছে নত হয় দেবদুত কত,
তোমার নিশ্বাসে গলে যায় কত প্রাচীর, মিনার,
তোমার গোপন হ্রদে ঠোঁট রাখে শিল্পের সারস।
তোমার শাড়ির কাছে যেমন সহজ তুমি হও,
তেমনি সহজ আমি স্বপ্নের নিকট।
তোমার স্খলিত শাড়ি এক প্রস্থ স্বপ্ন হ’য়ে একা
আমার চৈতন্যে নেমে আসে।
স্বপ্ন ভেঙে গেলে
স্বপ্নের ভগ্নাংশ নিয়ে ছুটে যাবো কবিতার কাছে,
তোমাকে স্মৃতির মতো করবো লালন
গীতিকবিতায়।
আমার কবিতা এই শহুরে দেয়াল ভেদ ক’রে
উড়ে যায় ফ্যাক্টরীর চোঙে,
আমার কবিতা অন্ধকারে শিস দেয় ফুটপাতে,
আমার কবিতা মৃত্যুপথযাত্রীর অধর থেকে
অত্যন্ত রহস্যময় অনুভূতি ছেঁকে আনে,
আমার কবিতা দ্রুত নিউজপ্রিন্টকে অলৌকিক ব্যানার বানায়,
পাখিও কখনো।
আমার কবিতা গোরস্থানে চুমো খায় সাবলীল
ঘাসের ডগায়,
আমার কবিতা গূঢ় সংকেতে রূপালি এরোপ্লেনকে নামায়
বিমান বন্দরে,
আমার কবিতা রাস্তা এবং দোকানপাট, যান
ট্রাফিক পুলিশ, বাস টার্মিনাল, ব্যাংক আর পেট্রোল
পাম্প আর বাণিজ্যক এলাকাকে করে নৃত্যপর-
প্রতিটি বস্তুকে সহজেই অনুবাদ করে গানে।
তোমার নীরবতার কাছে আমার কবিতা বড়ো
অসহায়, কী দারুণ পতনপ্রবণ ইকারুস।
দেখার ধরন
কোনো কোনোদিন প্রাত্যহিক আচ্ছাদন কী প্রবল
বিস্ফোরিত হ’লে অস্তিত্বের কিছু খোসা ঝ’রে যায়,
অনেক গভীর থেকে ছবি উঠে আসে কতিপয়,
চোখের ভেতরে অন্য চোখ গান গায়, ওষ্ঠে ভিন্ন
দৃষ্টি ফোটে বসন্ত দিনের মতো, সব বড়ো বেশি
ওলট-পালট হয়ে যায়। মাথার ভেতরে কত
পেঁচানো জটিল দৃশ্য ভাসমান-আগুনের ধারে
যৌথ নৃত্য গাছে নড়ে অনেক মুখোশ, জলাশয়ে
বিম্বিত চুম্বন আর গোধূলি-জোয়ারে ভেজা এক
প্রাচীন প্রাসাদে কলরোল, নগ্ন পাত্রে সন্ন্যাসীর
কী দিব্য খন্ডিত মাথা, নর্তকী বিভ্রমে পাক খায়,
যেন সে লাটিম। কোনো কোনোদিন এরকমভাবে
অনেক গভীর থেকে ছবি উঠে আসে-মনে হয়
যেন আমি দূর গলগোথায় ছিলাম সেই ক্ষণে,
যখন মাধ্যাহ্নে দ্রুত সন্ধ্যা নেমেছিলো; মনে পড়ে
কোন্ সে নিশীথে সুরভিত ঘরে ম্যাগডালীনের
উত্তপ্ত অধরে আমি ওষ্ঠ রেখেছিলাম এবং
মনে পড়ে আমার বাঁশির সুরে পশু-পাখি এসে
জমতো আমার চতুষ্পার্শে কী বিহ্বল, নদীতীরে
আমার আপন ছিন্ন শিরে বয়ে যেতো গীতধারা।
নিজেরই অজান্তে এক দেখার ধরন জন্মে যায়
বেলাবেলি, স্বপ্নে হাঁটে গোধূলিতে দেখা
বৃক্ষশ্রণী, ভাসে বলাকার প্রেত, অভ্রের মতন
গুঁড়ো হ’য়ে নড়ে ক্লিওপেট্রার কবর, ফসলের
ক্ষেতে ওড়ে ডন জুয়ানের প্রস্তরিত ডান হাত;
পেছনে পেছনে আসে প্যানের স্পন্দিত কর্ণমূল।।
কোনো কোনোদিন প্রত্যহের অন্তরালে এরকম
মোহ তৈরি হয়, যেন আমার নিজের থেকে আমি
সহজে বেরিয়ে গিয়ে শজারুর মতো অন্ধকারে
করে ফেলি সাবলীল তারার আঞ্জাম। তাকালেই
দৃশ্যাবলি-আমার গতায়, পিতা আবরে বিছিয়ে
কোমল জায়নামাজ উদাস ভ্রমণকারী, তিনি
কী যেন আঁকেন আসমানে। তাঁর হস্তধৃত নীল
তশ্তরিতে সেজানের ফল। চকিতে কুকুরীগুলি
জলকন্যা হ’য়ে নামে শহুরে নদীতে; নিশীথের
শূন্য ডাকঘর বোধিদ্রুম যেন, আনন্দ, সুজাতা
চেয়ে থাকে অপলক। সুদূর শতক আজকের
রবিবার বুধবার হ’য়ে রাজহাঁসের গ্রীবায়,
বাস টার্মিনালে, কলোনীতে, তরুণীর ন্ত্রেপাতে
আর গিরগিটির নিশ্বাসে হু হু দীর্ঘ বয়ে যায়।