গাড়ল
কোন দেশী গাড়ল এ লোক? কোন দেশী?
গোত্র নেই, দেশ নেই তার। সে কি ছদ্মবেশী
শৃঙ্খলিত কিন্তু করজোড়ে তোতা পাখির মতন
ধন্যবাদ ধন্যবাদ বলে সারাক্ষণ।
কখনো বুকলতলা, নদী, ছেলেবেলা,
যৌবন মুখস্থ করে, কখনো দেখায় কত খেলা-
অতিশয় সরু
দড়ির ওপর হেঁটে যায় বারবার। বুকে মরু,
তবু শূন্যে গর্ত খুঁড়ে কী স্নিগ্ধ ফোয়ারা দ্যায় খুলে।
কখনো হোঁচট খেয়ে প’ড়ে গেলে, ভুলে
হঠাৎ বেরিয়ে এলে চক্ষুদ্বয়ে জল,
সকলের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চায় সে গাড়ল।
গোলাপের কাছে তার ঋণ আছে; সঙ্গীতে, সে জানে
ঋণের চেয়েও বেশি কিছু থাকে। রমণীর টানে
বেলাবেলি ঘরে ফিরে দেখেছে সে বস্তুত শূন্যতা সীমাহীন।
দক্ষ ত্র্যাক্রোবেটের মতই কতদিন
ঘূর্ণ্যমান গোলকের ভেতরে দিয়েছে লাফ আর
ঘোড়ার পেছনে ছুটে, স্বেচ্ছায় মাটিতে প’ড়ে গিয়ে বারংবার
বাড়িয়েছে ফুর্তি দর্শকের; এভাবেই বেলা যায়।
নিঃসঙ্গতা নিত্যসঙ্গী, বিষাদের পাশে ব’সে বেহালা বাজায়।
খেলা শেষ হ’লেই সে শৃঙ্খলিত পুনরায় কেউ তার
চুল ধরে টানে কেউ কেউ ছোঁড়ে লাথি, যন্ত্রণার
রেখাবলী ফোটে মুখে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ভারি
মজা পায় নানা পথচারী,
ছুঁড়ে দ্যায় ছোলা কিংবা বাদামের খোসা কত ছলে,
সে শুধু ধ্যানীর মতো সর্বক্ষণ ধন্যবাদ ধন্যবাদ বলে।
গুপ্ত সেতু
একটু হাঁটলেই লুপ্ত পথ,
কোথাও সাড়া নেই, বন্ধ দ্বার।
এভাবে দিনগুলি ফুরিয়ে যাক,
ফুরিয়ে যাক রাত প্রতীক্ষার।
কবর খুঁড়ে নিজে সেখানে থাকি,
প্রেতের সহবাসে দুঃখ বই।
এভাবে দিন যায়, রাত্রি যায়,
স্মৃতির দাঁতে রোজ বিদ্ধ হই।
আমার রক্তের ফেনিলতায়
নৌকো হ’য়ে ভাসে দু’চোখ তার।
আমার সত্তার প্রান্তে বয়
মোহন নিশ্বাস কামুকতার।
তাকেই মুখস্থ করছি শুধু
উষ্ণ থরো থরো উচ্চারণে।
আমার ঠোঁটে তার নগ্ন ছোঁয়া
একদা নেমেছিলো, পড়লো মনে।
হঠাৎ তার কথা পড়লে মনে
ধড়মড়িয়ে উঠি জীর্ণ খাটে,
কী ঘোর অনিদ্রা রাত্রিভর
জ্বালার সাথে ষড়যন্ত্র আঁটে।
আমার চিন্তার ছিন্ন মেঘে
জরির মতো হাসি ঝলমলালো।
অকুল রিক্ততা করলে গ্রাস,
আমার কংকাল হয় কাতর।
গোপন নিশ্বাস লাগলে মুখে
দু’চোখ হ’য়ে যায় নীল পাথর।
সে যদি আসে তবে পাথর হবে
ঝর্না সাবলীল প্রাণের গানে।
কিন্তু তার আসা হবে না আর,
গুপ্ত সেতু ভেসে গিয়েছে বানে।
গোপনতা
সকলের মধ্যেই কিছু না কিছু গোপনতা থাকে-
নেত্রপাতে কারো, কারো মগজের কোষে, অন্ত্রপুঞ্জে,
শোণিত প্রবাহ্নে নববধূর দৃষ্টির মতো খুব
সংগোপনে গোপনতা ব’য়ে যায় সারা দিনমান।
গোপনতা ঘাতকের মারণাস্ত্র ডাগর আঁধারে,
কখনো প্রবল উত্তেজক স্রাব সত্তাময় আর
গোপনতা হিংস্র শ্বাপদের অগোচরে নম্রপ্রাণ
নিরীহ প্রাণীর জলাশয়ে অবতরণ যেন বা।
কবিরও সম্পদ বটে অফুরান, যখন আড়ালে
সে হাঁটে একাকী মনে বনভূমি, জনপদ নিয়ে,
পারস্পর্যহীন কত বস্তুতে বস্তুতে যোগাযোগ
রচনায় অনলস। গোপন্তা চুমু খায় তাকে।
চকিতে একটি বাক্য
চকিতে একটি বাক্য মগজের কোষ থেকে একা
সারসের মতো উড়ে গেলো ডালিম গাছের
শীর্ষ ছুঁয়ে দূরবর্তী ছাদের ওপারে, তারপর
কোথায় যে। শুধু ডানা ঝাপটানি স্মৃতি
এ মুহূর্তে; সেই বাক্যে নিশি ছিলো, সমুদ্র গর্ভের
লতাগুল্ম স্মৃতি-বিস্মৃতির অনুরণন, কিছু বা
ঢাকির কাঠির নৃত্য, জলকেলি, শোভাযাত্রা ছিলো।
সেই বাক্যে পূর্বপুরুষের মুখচ্ছবি, নারীঘ্রাণ,
সৈনিকের আর্তনাদ, প্রেমিকের হৃদয়স্পন্দন,
তিতিরের কীটাহারকালীন নজর, তৃষাতুর
সাপের চলন, দীর্ঘ পথ, সান্থশালা আভাসিত।
সেই বাক্য মধ্যরাত্রি, অকপট গহন বিহান।
সেই বাক্য অকস্মাৎ আমার নিজস্ব চোখ হ’য়ে
তাকায় আমার দিকে, বলে, চলো যাই, উড়ে উড়ে
বনস্থলী, যা’ শ্যামল অনুভূতি, শহরের সব
বাড়িঘর, যা’ প্রচুর স্মৃতিময়, মাথার ভিতর
নিয়ে চলো উড়ে যাই। সেই বাক্য ইশারায় ডাকে,
আমিও কী মোহাবিষ্ট পাখার আশ্রয় পেয়ে যাই।
আমরা দু’জন-আমি সেই মগজ উদ্ভুত বাক্য,
চন্দ্রালোকে শহরের অনেক উঁচুতে উড়ে উড়ে
দূর শতাব্দীর রূপরসগন্ধ পাই, অস্তমিত
শতাব্দী কখনো হই। সকালের নাবালক আলো
স্ফুরিত হাওয়ার আগে আমার কোমল পাখা দু’টি
কাষ্ঠবৎ ভয়ানক নিঃস্পন্দ, নিশ্চল। দিকগুলি
ভয়াবহ প্রতিধ্বনি, আমাকে গিলতে আসে, আমি
ভীষণ পতনশীল, তবু আমাকেই লুফে নেয়
নারীর বুকের মতো ফুলের কেয়ারি ভালোবেসে।
একা সেই বাক্য পরিযায়ী পখিদের ছন্দোময়
মালার একটি ফুল হ’য়ে উড়ে গেলো, উড়ে গেলো।
বাক্যটির জন্যে আমি কেবলি দুঃখিত হতে থাকি।
তার ঘুড়ি
সকালসন্ধ্যা বালক ঘুড়ির প্রতি ছুটে যায়, প্রায় উড়ে যায়,
কখনো দীর্ঘ সুতো ছেড়ে দিয়ে লাল নীল ঘুড়ি নিজেই ওড়ায়।
কখনো নিহত ঘুড়ির পেছনে দ্রুত ধাবমান কখনো বা শুধু
অপলক ধুধু
আকাশের দিকে চেয়ে থাকে কিছু রঙের ঈষৎ কম্পন হেতু।
হয়তো আকাশে দ্যাখে সরোবর, ফুলময় সেতু,
হারানো বোনের পরবের ফ্রক। বিস্মিত দেখি
শাদা চোখে একি
বালকের চোখ নাক কান মুখ ঘন চুল থেকে বেরোয়া কেবলি
সাতটি রঙের ঘুড়ি অবিরত-চমকিত ছাদ, বিকেলের গলি-
বংশাবলির স্মৃতির ভিতরকার স্মৃতিগুলি যেন ভাসমান।
রাত্রে ক্লান্ত বালক ঘুমোলে বেবাক রঙিন ঘুড়ি পাখি হয়,
ছায়া দেয় তাকে, স্নেহের মতন ঘোরে ঘরময়।
আচানক ওরা ভীষণ ঝাঁঝালো মেশিনগানের শব্দে পাগল;
ঘরের চালায়,
মেঝেতে, কাঁথায় প’ড়ে থাকে কিছু অধরা পালক।
ঘুমের ভিতর চম্কে উঠেও ঘুড়ির স্বপ্ন দ্যাখে সে বালক।