কবিতা আমার ওষ্ঠে
কবিতা আমার ওষ্ঠে চুম্বন এঁকেছে ব’লে আমি
কেবলি আপনকার অস্তিত্বের বালিতে (যা কষ্ট)
কাঁকড়ার মতন গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে কেমন একাকী
হয়ে গেছি অতিশয়। কী যে ভয় সর্বক্ষণ, পষ্ট
বোঝা দায়, কেন আমি নীল ঘোড়াটির অনুগামী
সেই ঘোড়া, যে কেশরে দুলিয়ে সময় দ্রুত পাখি
হয়ে উড়ে যায় দূরে, ঘাসে ঘাসে নক্শা রেখে যায়,
বলা মুশকিল খুব। কবিতা আমার অস্তিত্বের
প্রতি রেণু কী তুমুল উড়ায় হাওয়ায়, পুনরায়
বেদাগ সংহত করে। মুহূর্তে মুহূর্তে মাছ-পড়া
ছিপের মতন হই এবং প্রকৃত মানুষের
নিকটে আসার জন্যে স্নেহজাত নিভৃত ডেরায়
করি বাস, মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকি।
কবিতা চৈতন্যে জন্ম-জন্মান্তর, পাতা, পাতা ঝরা।
কাতরতা বেড়ে যায়
কাতরতা বেড়ে যায়, মধ্যপথে বেড়ে যায় ব’লে
থমকে দাঁড়াতে হয় কিছুক্ষণ, এদিকে ওদিকে,
বিশেষত ছায়াচ্ছন্ন সুদীর্ঘ পেছনে কী উৎসুক
দৃষ্টি মেলে দিতে হয়। কত কিছু খসে হাত থেকে,
কী এক অস্পষ্ট কষ্ট অবশেষে শ্বাসকষ্ট হয়ে যায়
নিমেষেই, কুকুরের মতো কিছু দেখা যায় কিনা
আশে পাশে জনশূন্যতায়, দেখে নিতে চাই।
মধ্যপথে নিজেকেই দেখে আমি হয়েছি কাতর।
এখন পাথর বলে, এখানে মাথাটা রেখে তুমি
খানিক ঘুমাও, গাছতলা ডাকে ছায়া নেড়ে নেড়ে,
নদীতীর টলটলে আতিথেয়তার মখমল
হ’য়ে থাকে, পাখিগুলি ডানা মেলে বলে, পথচারী
এখানে ঘুমাও এসে কিছুকাল, পালকেরও আছে
স্বপ্ন বুননের শিল্প। মাথায় নিসর্গ গলে যায়।
মাথার ভেতর সূর্যোদয় ক্ষীয়মান, অস্তাচল
অত্যন্ত করুণ হ’য়ে আসে, একেকটি রাজহাঁস
আমার নিকট এসে গলে যযায় তুষারের মতো
পেছনে অনেক কণ্ঠ বেজে ওঠে, অলীক ঝংকার,
কখনো বা দীর্ঘশ্বাস, কান্না আমাকে স্বজন ভেবে
ঘিরে ধরে, বলে দূরে যেও না, সেখানে মিনারের
চূড়ায় শ্যাওলা আছে, শতাব্দীর কাতরতা আছে।
আমার বেবাক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলগা হ’য়ে আসে।
কোত্থেকে এমন ক্লান্তি উড়ে এলো? তবে কি আমিও
শূন্য, কাতরতাময় প্রান্তের তৃষ্ণায় পানি ভেবে
রুক্ষ মাটি খাবো শুধু? দেখবো ওপরে লোভাতুর
পাখিদের ক্রুর চক্র বারবার? এক্ষুণি আমাকে
আহত পাঁজর খুঁড়ে ফোয়ারা জাগাতে হবে আর
দশটি আঙুল থেকে ছেড়ে দিতে হবে শত পাখি।
কী ক’রে কেবলি স্বরময়ী
কী ক’রে কেবলি স্বরময় হ’য়ে যাও নিরালায়?
আমার মানসে তুমি মাঝে-মাঝে হ’য়ে ওঠো ধ্বনির প্রতিমা।
তোমার অমন কণ্ঠস্বরে একটি সামান্য যন্ত্র
কী মোহন পরীর খেলনা
হ’য়ে যায় নিমেষেই, কেমন সঙ্গীতময় হয় অগোচরে।
কম্পিত আঙুলে হ’য়ে, ঠোঁট হ’য়ে তোমার ব্যাকুল কণ্ঠস্বর
নিভৃত আমাকে ছোঁয় আমার এ ক্ষয়িষ্ণু বেলায়।
মুহূর্তের ঢেউগুলি তোমাকে অনেক দূরে সরিয়ে কোথায়
নিয়ে যায় ব’লেই আমার
এত কাছে এসে যাও। যখন হঠাৎ একা রুঢ় সমাজের
কাছ থেকে, তোমার নিজস্ব নাম থেকে নিজেকে লুকিয়ে তুমি
শুধু স্বর হ’য়ে
শুধু স্বর হ’য়ে
শুধু স্বর হ’য়ে
আমার অস্তিত্বে তুমি পূরবীর নির্জন সুরভি,
তখন আমিও লোকচক্ষুর আড়ালে গ্রন্থ আর
টেবিল চেয়ার থেকে, ডায়েরীর পাতা থেকে নিজেকে সরিয়ে
নিজস্ব চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার মতো
পান করি একটু সময়,
পান করি অবিরল তোমার শিশিরগন্ধী স্বর।
শুনেছি তোমার কণ্ঠস্বরে যেন কোনো একাকিনী
দূর কারাবাসিনীর কাতর প্রার্থনা
পাথরে পাথরে গুমরানো,
কখনো বা মধ্য সমুদ্রের
স্পর্শাতীত মৌনে জেগে ওঠা জলকিন্নরীর গান।
হে সুদূরতমা, শোনো, তুমি-ধন্য তোমার নিবাস
আমার আপনকার মৃত্যুহীন স্বপ্নের প্রদেশ।
ক্ষয়িষ্ণ, বেলায় একা বসে থাকি উৎকর্ণ, অধীর-
ফের বাজাবে কি সেই কণ্ঠস্বর স্বপ্নের জ্যোৎস্নায়?
কোনো একজনের কথা ভেবে
বুকের ভেতর মেঘের মতো
একটা কিছু বেড়ায় ভেসে,
অনেক আগে দেখা কোনো
গাছের পাতা স্বন হ’য়ে
কাঁপতে থাকে চোখের বনে-
এই কি আমার চাওয়া?
যখন তুমি কাছে আসো,
নগ্নতাকে প্রখর জ্বেলে
আমার পাশে শুয়ে থাকো,
শূন্যতারই ছায়া দেখি।
একলা মনে প্রশ্ন করি-
একেই বলে পাওয়া?
কিন্তু তুমি আমায় ফেলে
একটু শুধু দূরে গেলেই,
তোমার জন্যে হৃদয় জুড়ে
কেমন যেন তৃষ্ণা বাড়ে,
বুকের মধ্যে যায় ব’য়ে যায়।
মরুভূমির হাওয়া।
ক্লিষ্ট স্মৃতি
যখন তোমাকে পথে ছেড়ে ফিরে আসি, ফুটপাতে
কেবল আমার সঙ্গে আমি হাঁটি স্মৃতির ভিতর।
ভয়ানক একা লাগে, মনে হয় আমার শরীরময় ঘাস
গজিয়ে উঠেছে এক লহমায়। উদ্বেগ সর্বদা থরথর,
পথকে বান্ধব ভেবে একা হাঁটি তবু অন্ধ রাতে।
ফুরোতে চায় না পথ, প্রতি পদক্ষেপে জাগে খাদ;
চতুর্দিক থেকে ডাকে অবিরাম ক্ষুধিত পাতাল,
হঠাৎ তাকায় নিচে কটমট ঐ বৈরী আকাশ।
পুড়িয়ে বিস্তর স্বপ্ন জানালার কাছে ভাবি, সে কোন্ নিষাদ
অন্তরালে জেগে আছে? ভাবি, দূরের একাকী তালগাছটার
দিকে চোখ রেখে ভাবি, আবার হবে কি দেখা তার
সঙ্গে মানে তোমার সঙ্গেই? এই ব্যাপ্ত ঊর্ণাজাল
অতিশয় রূপময় হয় ক্রমান্বয়ে। ঠোঁটে পোড়ে শীর্ণ স্টার,
কিছু ক্লিষ্ট স্মৃতির মতন জেগে রয় কটু স্বাদ।
ভাবি যদি আর
কখনো না হয় দেখা, যদি ভোরে মৃত্যুস্পৃষ্ট শরীর আমার
পড়ে থাকে খাটে, যদি ভোরে
দুঃস্বপ্নের ঘোরে
জেগে উঠে পোকা-মাকড়ের রূপে শীতল পাটির খুব কাছে
ঘষি শুঁড়ে মেঝেতে যেমন কাফকার গল্পে আছে।