একজন মানুষকে নিয়ে
একজন মানুষকে নিয়ে কত গল্প করা যায়
চায়ের আসরে।
যে মানুষ খায় দায় এবং ঘুমায়, ক্যামেরায়
ছবি তোলে, দিনে
অন্তর কয়েকবার চুল আঁচড়ায়, রাত জেগে বই পড়ে,
একা একা বারান্দায় করে পায়চারি, ঘন ঘন
ডাকঘরে যায়, কথা বলে পাথরের কানে কানে,
তার হাতে গোধূলির রঙ ক্রীড়াপরায়ণ হ’লে
চকিতে নিজস্ব হাত তার ভিন্ন হাত হ’য়ে যায়,
কবিতা সহজে মেলে চোখ।
একজন মানুষকে নিয়ে এরকম কিছুউ গল্প হ’তে থাকে।
অথবা আলাদাভাবে বললে দাঁড়ায় এইমতো-
একজন মানুষের মগজের কোষে নিরিবিলি
ফুলের কেয়ারি থাকে, থাকে
পলকে কোমল ঢেকে মুখ পাখির সুনিদ্রা,
চেয়ারে বৃদ্ধের ব’সে-থাকা,
তরুণীর চুল-মেলে-দেয়া, তরুশ্রেণী, বনশোভা,
আবছায়া থাকে, যা’ সৃজনে উন্মুখর।
একজন মানুষের মগজের কোষে থাকে প্রাচীনকালের
চিত্রিত সুনীল জালা, জালার ভেতরে মৃতদেহ।
করিণের মাথা
ভেসে আসে তার কাছে কোন্ দূর থেকে, বালিহাঁস
আঁধারে উদ্ধৃতি দ্যায় চরের জ্যোৎস্নার,
তার প্রত্যাবর্তনের পথে গেট খুলে রাখে স্বপ্নমগ্ন বাড়ি।
একজন মানুষের এরকম কিছু গল্প থাকে এলেবেলে।
এরকম গল্প থেকে নিভৃতে বেরিয়ে এসে একটি মানুষ
বারবার নগ্ন হয় নিজের কাছেই, কখনো সে
নীলকাশে গর্ত খোঁড়ে নখে,
কখনো আবার মেঘে মেঘে
কতিপয় কালো
পুরোনো কবর দ্যাখে, হাতের লোমের মতো ঘাস
দীপ ঢেকে দ্যায়,
স্বপ্নে দ্যাখে বৃষ্টিপাত, দ্যাখে
ছুরির মতন
একটি আঙুল দ্রুত কী নগ্ন প্রবেশ করে মাথার ভেতয়ে।
একজন মানুষের মগজের কোষে জেগে থাকে
অন্তহীন ধূলিরঙ পথ, নাম যার ‘মনে রেখো।
একজন রূপালি কবির কাছে
একজন কী সুদূর রূপালি কবির কাছে আমি
প্রায়শ যেতাম অগোচরে, যন্ত্রণা গভীর হ’লে
হৃদয়ের; দেখতাম রাজহাঁস তাঁর অনুগামী
মোহন অভ্রের কুটিরের কাছাকাছি; কথাচ্ছলে
পাখিকে ডাকার মতো ডাকতেন কবিতাকে, তাঁর
পায়ের তলার নুড়ি কী আনন্দে হতো হৃৎস্পন্দন।
নক্ষত্রের বাক্সে পায়রার মতো ব্যালট পেপার
ফেলেছেন বারবার। ছিঁড়ে-খুঁড়ে রীতির বন্ধন
নিজের ভেতরে তীব্র দিয়েছেন ভেটো সর্বদাই
ধ্বংসের বিপক্ষে, রেখেছেন বাক্য অর্ধবাক্য আর
বিশেষ্য ও বিশেষণ শুইয়ে দিঘিতে, ঘাসে ঘাসে।
কখনো চালান মেঘে মেঘে মেরুন মোটরকার
এবং জুতোর নাকে জ্বলে স্বপ্ন সুদূর নিশ্বাসে
তাঁর প্রান্তরের আর সুপ্ত পাতালের ঘ্রাণ পাই।
অন্তরালে থাকা ছিলো সে রূপালি কবির স্বভাব।
নিভৃত আস্তানা থেকে তাঁর দূরে চলে গেলে কানে
মধুর বাজতো সুর, স্পন্দমান অদৃশ্য রবার।
বয়স বুঝিনি তাঁর, এমনকি তাকেও বুঝিনি
কোনোদিন; সবুজ আয়ত তাঁর চোখে কী যে আছে,
কী যে আছে হাতে, ক্ষিপ্র পারেন লাগাতে ছিটকিনি
অন্তর্গত দরজার। চৈতন্যের অত্যন্ত গহনে
অক্লান্ত সাঁতারু তিনি, নিজেই নিজের অন্তর্যামী।
মাঝে মাজেহ মনে হয়, সত্যি কি গিয়েছি তার কাছে?
বলতেন, তুমি ঐ হরিণের পেছনে পেছনে
ছুটে যাও, তার স্পর্শ যদি পাও, বিশুষ্ক বাগানে
জাগবে বর্ণিল শোভা, আমি পথ ছেড়ে বনে নামি-
সর্বত্র বেড়াই ছুটে, অথচ হরিণ পলাতক
সে কোন অরণ্যে। হরিণের পদধ্বনি যত দূরে
যায় তত স্পষ্ট হয় আপনার সমাধি ফলক।
একটি জীবন বাজে ক্রমাগত হরিণের খুরে।
এমন থাকতে পারি
কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আমি দীর্ঘকাল অপেক্ষায়
এমন থাকতে পারি অবিচল। ক্লান্তি করবে কি
আহার আমাকে কোনোদিন? কিংবা আমাকে ভীষণ
ম্রিয়মান, সদ্য মৃত ভেবে আকাশে রচিত হবে
পক্ষীচক্র? পোকা-মাকড়ের ঝাঁক অসেবে কি ধেয়ে
নিষ্পলক চোখ আর ওষ্ঠের উদ্দেশে? নাভিমূলে
ঘুরবে পিঁপড়ের দল? চাঞ্চল্য আমাকে আর বেশী
ঘোরায় না চোরা পথে, দীর্ঘ বন-বাদাড়ে অথবা
বলে না দেখতে মুখ সারাক্ষণ স্বচ্ছ নগ্ন জলাশয়ে।
ব্যস্ততার পরপারে আমি দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকি।
কী এক পাখির গানে তরঙ্গিত হৃদয়ের ঝোপ,
চোখ বিস্ফারিত, সুরে সুরে অতীত ও বর্তমান
বড় বেশি মেশামেশি করে; কাল টুকরো টুকরো হয়ে
ঝরে চারপাশে আর কেমন মদির ঘ্রাণ হয়
দিকগুলি অকস্মাৎ কোত্থেকে একটি নীল ঘোড়া
মন্থর বাড়ায় গ্রীবা ডেরায় আমার প্রতি, যেন
ভালোবাস চায় শান্ত এখানে আশ্রয় কিছুকাল।
ভয় হয়-এ অতিথি হবে না তো উধাও এক্ষুণি?
গোলাপ গন্ধের মধ্যে স্মৃতি, স্মৃতির ভেতরে কিছু
মুখচ্ছবি, পদধ্বনি হাতের ঈষৎ নড়া, সাঁকো
এবং ঝর্নার পাশে নিদ্রাতুর নিরালা শরীর।
স্বপ্নেরা স্মৃতিরই অন্তর্গত, বুঝি তাই স্বপ্নস্থিত
আমার শরীর কোন বিশাল উদ্যান, শূন্য বাড়ি,
মৃত পাখি, স্বর্ণরেণু বিবর্ণ বেহালাসহ স্মৃতি।
শূন্যে হাত ছুঁড়বো না অথবা মাটিতে এলোবিলি
করবো না পদাঘাত। এমন থাকতে পারি আমি…
দীর্ঘকাল এই মতো অস্থিরতা-রহিত সর্বদা
অবচেতনায় ঘরে অপেক্ষায় বুদ্ধমূর্তি প্রায়।
এয়ারপোর্ট বিষয়ক পংক্তিমালা
প্রায় চোখ-মুখ বুঁজে ছুটছি, ছুটছি ঊধ্বর্শ্বাসে,
এক্ষুণি পৌঁছুতে হবে বিমান বন্দরে। রাস্তাঘাট
কেবলি পিছলে যাচ্ছে পায়ের তলায়। গাছপালা,
ভিখিরী, দোকানপাট, রিক্সঅলা, আইসক্রীমের
বাক্স, হকারের মুখ এবং বিজ্ঞাপনের ফুল্ল
ব্রা-পরা তরুণী গ’লে যাচ্ছে ক্রমাগত এলেবেলে
আমার চোখের মধ্যে; আমি শুধু ছুটছি ছুটছি
কুকুর ট্রাফিক আইল্যান্ড, নারী স্মৃতি হয়ে যায়।
এইতো আমার মুখ আমার মুখের কাছ থেকে
এবং আমার হাত আমার হাতের কাছ থেকে
এবং আমার চোখ আমার চোখের কাছ থেকে
বারবার সরে যাচ্ছে অতিদ্রুত, বড় নৈর্ব্যক্তিক।
দেখছি আমার মুখ একটি মৌচক হ’য়ে ভাসে,
এবং আমার হাত ছায়ার ক্ল্যারিওনেট হ’য়ে
বাজতে বাজতে শূন্যে লীন হয়ে যায়, মেঘ হয়
এবং আমার চোখ পাখি হ’য়ে হাওয়ায় উড্ডীন।
এয়ারপোর্টের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ,
এয়ারপোর্টের প্রতি ছুঁড়ে দিই গোলাপের তোড়া,
এয়ারপোর্টের সঙ্গে খুনসুটি ভালো লাগে খুব,
তার ওষ্ঠে ওষ্ঠ রাখি, তাকে নিয়ে ঘুমাই গভীর,
কখনো সাজাই তাকে স্বপ্নময় প্রধান ঝালরে,
কখনোবা গাঢ় গোধূলির মতো মনো-বেদনায়।
এক্ষুণি পৌঁছেতে হবে, কিন্তু পথ দীর্ঘ হ’য়ে যায়,
শুধু দীর্ঘ হ’য়ে যায়, তবু আমি ছুটছি ছুটছি।
প্লেনের সিঁড়ির কাছে ছিমছাম স্টুয়ার্ড অথবা
সুস্মিতা এয়ারহোস্টেসকে বলবো কায়দা ক’রে-
তোমার স্বাগত সম্ভাষণের প্রত্যাশী নই আর
আমার নিজস্ব সীট আমি নিজে খুঁজে নিতে জানি।
বস্তুত এয়ারপোর্ট হন্তদন্ত, ক্লান্ত পৌঁছে দেখি-
আমাকে ফেলেই প্লেন নীলিমায় ধাতব মরাল।