- বইয়ের নামঃ শূন্যতায় তুমি শোকসভা
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্য কেউ
আমার উদ্দেশে কেন এই স্তব, এই শোভাষাত্রা?
আমিতো দীনাতিদিন, আমার সুকৃতি নেই কোনো।
আমি কি দিয়েছি ডাক যে তোমরা করো ভিড়
এখন আমাকে ঘিরে? তোমাদের চন্দনের ফোঁটা,
বরমালা গ্রহণের যোগ্যতা আমার নেই, আমি
যে গান বানাই তার সুর তরঙ্গিত ব্যর্থতায়।
তোমাদের জন্যে হাঁটি দীর্ঘ পথ, কত রাত্রি আজো
নির্ঘুম কাটাই, দ্যাখো, কেবলি আমার রক্ত ঝরে
পথের নুড়িতে, নদীতীরে, কাঁটাবনে তোমাদের
উদ্দেশেই, কিন্তু নই পরিত্রাতা। বস্তুত আমার
মাথার পেছনে নেই আলোর মন্ডল। আমি শুধু
বিজন প্রান্তরে এক দুঃখিত, নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বর।
তোমাদের অভ্যর্থনা আর প্রতীক্ষার যোগ্য যিনি,
অমাবস্যা ফুঁড়ে তিনি স্বপ্নেশ্বর আসবেন পরে।
আমিও তোমারই মতো
আমিও তোমারই মতো রাত্রি জাগি, করি পায়চারি
ঘরময় প্রায়শই, জানালার বাইরে তাকাই,
হাওয়ায় হাওয়ায় কান পাতি, অদূরে গাছের পাতা
মর্মরিত হ’লে ফের অত্যন্ত উৎকর্ণ হই, দেখি
রাত্রির ভেতরে অন্য রাত্রি, তোমার মতোই হু হু
সত্তা জুড়ে তৃষ্ণা জাগে কেবলি শব্দের জন্যে আর
মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্ত লিখে ফেলি চতুর্দশপদী,
শেষ করি অসমাপ্ত কবিতা কখনো ক্ষিপ্র ঝোঁকে।
কোনো কোনোদিন বন্ধ্যা প্রহরের তুমুল ব্লিজার্ডে
ভুরুতে তুষার জমে, হয়ে যাই নিষ্প্রাণ, জমাট
রাজহাঁস যেন, দিকগুলি আর হয় না সঙগীত।
অবশ্য তোমার তটে উজ্জ্বল জোয়ার রেখে গেছে
রত্নাবলী বারবার। যখনই তোমার কথা ভাবি,
প্রাচীন রাজার সুবিশাল তৈলচিত্র মনে পড়ে।
তোমার অমিত্রাক্ষর হিরন্ময় উদার প্রান্তর,
তোমার অমিত্রাক্ষর সমুদ্রের সুনীল কল্লোল,
তোমার অমিত্রাক্ষর ফসলের তরঙ্ঘিত মাঠ,
তোমার অমিত্রাক্ষর ধাবমান স্বপ্ন-অশ্বদল,
তোমার অমিত্রাক্ষর উন্মথিত ঊনিশ শতক,
তোমার অমিত্রাক্ষর নব্যতন্ত্রী দীপ্র বঙ্ঘভূমি।
হেনরিয়েটার চোখে দেখেছিলে কবিতার শিখা?
না কি কবিতাই প্রিয়তমা হেনরিয়েটার চোখ?
হাসপাতালের বেডে শুয়ে সে চোখের অস্তরাগে
তুমি কি খুঁজেছো কোনো ট্রাজেডীর মেঘ? হয়তোবা
অভ্যাসবশত বেডে অসুস্থ আঙুল ঠুকে ঠুকে
আস্তেসুস্থে বাজিয়েছো ছন্দ মাঝে-মাঝে বাষ্পাকুল
চোখে ভেসে উঠেছিলো বুঝি দূর কাব্যের কানন।
কখনো দেয়ালে ক্লান্ত চোখ রেখে হয়তো ভেবেছো-
কি কাজ বাজায়ে বীণা? এ আঁধারে কিবা মাইকেল
কি মধুসুদন কার প্রকৃত অস্তিত্ব অনন্তের
নিরুদ্দেশে রেণু হ’য়ে ঝরে, কে বলে দেবে, হায়?
আমিও তোমারই মতো প্রাদেশিক জলাভূমি ছেড়ে
দূর সমুদ্রের দিকে যাত্রা করি, যদিও হোঁচট
খেয়ে পড়ি বারংবার। রক্তে নাচে মায়াবী য়ূরোপ,
ইতালি ভ্রমণ ক’রে, সুদূর গ্রীসের জলপাই
পল্লবে বুলিয়ে চোখ, বুলেভার ছেড়ে ফিরে আসি
সতত আপন নদে তোমার মতোই কী ব্যাকুল-
আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কপোতাক্ষ আছে।
একজন কবির উদ্দেশে
একটি পংক্তির মধ্যপথে অকস্মাৎ কবেকার
দীর্ঘ গাছ ফেলে ছায়া, কার আত্মহত্যা গান গায়;
একটি শব্দের শেষে বসিয়ে কোমল কমা তুমি
দেয়ালে কী যেন খোঁজে বারবার; কিছু পথরেখা
স্মৃতিরুপ ভেসে ওঠে, কোনো কোনো রাস্তার কি নাম
কিছুতে পড়ে না মনে। একটি পংক্তির মধ্যপথে
মনে পড়ে যায় পার্কে দেশলাই ধার চেয়ে তুমি
আঁধারে ধরিয়ে ছিলে সিগারেট। একটা সন্ধ্যায়
পথে যেতে যেতে দূর থেকে দেখেছিলে পথপ্রান্তে
পুরোনো বর্ষায় কী নিসঃঙ্গ ভিজছে নতুন গণিকা
তেঁতুল গাছের নিচে, প্রসাধন তার মুছে গেছে
ব’লে তাকে বড়ো বেশি বালিকার মতো লেগেছিলো।
বাক্যের শুরুতে কিছু ডোরাকাটা প্রাণী ধেয়ে আসে,
অর্ধযতি টেনে ভাবো তোমার টাইপরাইটার
নেই, ঘরে ইঁদুরের বড়ো উপদ্রব, বর্ষাকালে
শোবার ঘরের ছাদ ভীষণ প্রস্রাব করে, ভাবো
তোমার একটি ঘড়ি চাই, শ্যার্টে বোতাম লাগানো
দরকার, তা’ছাড়া জুতোজোড়া পাল্টে নিলে ভালো হয়।
কখনো একটি পংক্তি খুব বেঁকে বসলে ভীষণ
বিরক্তিতে তড়িঘড়ি দাঁড়াও চেয়ার ছেড়ে যাও
বারান্দায়, যেন বুনো ঘোড়াটিকে বাগ মানানোর
সরঞ্জাম আছে সেখানেই; নিজেকেই প্রশ্ন করো-
তোমার জীবন কি রকম মূল্যবান? কতটুকু
প্রকৃত জীবন তুমি যাপন করেছো? কখনোবা
কলম সরিয়ে রেখে ভাবো ক্লান্ত তোমার গৃহিণী
রাঁধে বাড়ে, কোনো কোনোদিন কাঁদে অভ্যস্ত বালিশে
মাথা রেখে, যথারীতি সন্তান পালন করে, তুমি
পার্টিতে চুমুক দাও স্বপ্নের মতন গ্লাশে, শিল্প
সমালোচকের সঙ্গ ছেড়ে কথা বলো সুসজ্জিতা
মহিলার সঙ্গে, করো মুখস্থ মুখশ্রী কারো কারো।
রাত্রির পার্টিতে তুমি রাত্রির মতোই হয়ে যাও;
কখনো দাঁড়িয়ে একা এক কোণে এলেবেলে শব্দ
তুলে নাও কারো চোখ চুল কিংবা ঘরের দেয়াল
থেকে অগোচরে ধীরে সুস্থে স্বপ্নাংশ রচনা করো।
এই আসবাব, এইসব মুখ, এসবের সঙ্গে
সম্পর্ক আছে কি কিছু সরাসরি তোমার শিল্পের?
এই বাড়ি, যা বয়স্ক, বেশ জীর্ণ বটে, যা তোমার
আপন নিবাস, এই বাড়ি প্রতিদিন তোমাকেই
লক্ষ্য করে তীক্ষ্ম গুপ্তচরের নিষ্ঠায়, এ বাড়ির
থেকে ঝরে এক রাশ রঙিন পালক, পালকেরা
তোমার স্বপ্নের অভ্যন্তরে ঝরে, হয়ে যায় ফের
শিল্পের শিশির; এ বাড়ির অতিশয় নোনাধরা
দেয়ালে দেয়ালে ঠোকরায় প্রাচীন স্বপ্নের লোভে
রুক্ষ কাগজের মতো পাখি ঠোকরায় বারংবার।
টেবিলে তোমার হাত পড়ে থাকে স্তিমিত কখনো,
অলস কলম যেন; ভাবো চাঁদ উঠলেই হাতে
আবার জাগবে স্রোত প্রখর রূপালি। কোনো কোনো
মুহূর্তে একটি বাক্য লেখা হ’লে দ্যাখো সবিম্পয়ে
বৃষ্টিপাতে ডোবে চক্ষুময় নৌকা, বনস্থলী, সেতু
রত্নসম্ভারের মতো জলকন্যা, যুদ্ধের জাহাজ।
অকস্মাৎ মধ্যরাতে একটি পংক্তির মধ্যপথে
মনে পড়ে সেই কবে কারো কাছে কি যেন চাইতে
ভুলে গিয়েছিলে; অনন্তের শুভ্রতায় এ তোমার
কেমন ভিখিরিপনা? অন্ধকারে কাঙালের হাত
তোমাকে মুদ্রার মতো তুলে নিতে চায়। ফুল ফোটে
তোমার মুখের হাড়ে, বারংবার ধ্বনিপুঞ্জ তুমি।