প্রতারিত পথচারী
সারাদিন একা পথ হেঁটে হেঁটে লোকটা দাঁড়ায়
এসে এক স্নিগ্ধ সরোবরের কিনারে আর ত্বরিত বাড়ায়
দু’হাত মেটাতে তৃষ্ণা। টলটলে জল
অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ছুঁতেই নিমেষে
ঝরে যায়। অতিশয় লোনা জলরাশি খলখল
ডাইনির মতো ওঠে হেসে!
১৫.৩.২০০০
প্রতিদ্বন্দ্বী
অনেক পরে তোমার জবানিতে শুনেছি-
তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে কিয়দ্দূর থেকে
জাতীয় যাদুঘরে মৃণাল সেনের
চলচ্চিত্র উৎসবে। মিলনায়তনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম
অপেক্ষমাণ। আমার গায়ে ছিল পাঞ্জাবি, পশমি শাল আর
ট্রাউজার্স; পায়ে চপ্পল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা।
তুমি ছিলে আদূরে নিজস্ব সৌন্দর্যলীনা,
অথচ রয়ে গেলে আমার না-দেখার ওপারে।
সেদিনই আমাকে ভালো না-বেসেও
আমার একটি স্কেচ তুমি রচনা করেছিলে
মনের বুদোয়ারে, হয়তো অজান্তেই
স্কেচটির প্রতি মঞ্জরিত হয়েছিল তোমার অনুরাগ।
ক্রমান্বয়ে সেই স্কেচ হয়ে উঠল
পূর্ণাঙ্গ এক প্রন্টিং। চিত্রটি যার আদলে সৃষ্ট,
তাকে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এলো
তোমার একান্ত ঘাটে, যেখানে তার জন্যেই
অপেক্ষা করছিল ফুলশাখার দোল, বুলবুলির গান,
ময়ূরের নাচ এবং প্রেম-উদ্ভাসিত দীপাবলি।
তুমি তোমার রচিত চিত্রের সঙ্গে আমার
অবিকল মিল দেখে পৌঁছে গেলে
মনোজ এল দোরাদোয়। তোমার যৌবনের তরঙ্গভঙ্গে
আনন্দের অবিশ্বাস্য রঙধনু দেখে যুগপৎ উল্লসিত এবং
ঈষৎ শঙ্কিত হলাম। আমাদের দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমায়
রাহু কালো ছায়া ফেলবে না তো তস্করের চাতুর্যে?
এখন তুমি তোমার মনোজ যে-সৃষ্টি আমি, তাকে
আর এই প্রকৃত আমি-কে দেখছ খুঁটিয়ে; ঘুরে ফিরে
করছ তুলনা, আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছ আমার নিজেরই বিরুদ্ধে।
এখন আমি নিজেরই অসম প্রতিদ্বন্দ্বী। তোমার রচিত
চিত্রের কাছে পরাজিত হচ্ছি বারবার; মতাদর্শের সংঘর্ষে তোমার
ধিক্কার এবং ঘৃণার লুপ্তপ্রায় আমার প্রকৃতি।
তোমার রচিত আমার প্রতিকৃতি থেকে খসে খসে
পড়ছে রঙ; চোখ, নাক, কান উধাও।
এই মুহূর্তে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে
তুমি দেখছ কনিষ্কের মূর্তি-নিঃসঙ্গ, ভাঙাচোরা।
২.৯.৯৬
প্রশ্ন
ঠিকানা কই? দিন তো গেল,
এদিকে যে লাফ দিয়েছে সন্ধে।
বেলা গেল মনের সঙ্গে
বিড়বিড়িয়ে কথা বলেই ছন্দে।
কোথায় যাবো? নাড়বো কড়া
খোলা মনে কোন্ সে পথের প্রান্তে?
তাহলে কি ব্যর্থ হবোই
সত্য এবং সুন্দরকে জানতে?
১৬.৩.২০০০
বাগবানের গান
আমাকে অকালবৃদ্ধ অনেকেই ভাবছে এখন
এবং কেমন করুণার ভঙ্গি থাকে,
তাদের আচার, আচরণে যেন আমার দুর্দশা
সহমর্মীদের রাত্তিরের ঘুম করেছে হারাম!
একটি বাগান আমি বানিয়েছি ঢের খেটেখুটে, আস্তেসুস্থে
নানান ফুলের চারা লাগিয়েছিলাম
সুন্দরের সাধনায় মগ্ন হয়ে। ডালে ডালে রূপ
ঝরিয়ে ফুটেছে মহানন্দে অগণিত ফুল, সুঘ্রাণে হয়েছে
প্রগাঢ় মাতাল দশদিক। কিন্তু হায়, আচানক
কিছু ফুল অকারণ অতি দ্রুত শুকায় এবং কিছু ফুল
পোকার দখলে চলে যায়। বাকিগুলো
ছিন্নভিন্ন মুর্দা হয়ে মাটিতে লুটায় তুফানের আস্ফালনে।
আমাকে বিষণ্ন করে সুন্দরের মহাদান এবং আমার
শ্রমের অনন্য প্রসূনের
এমন করুণ পরিণতি। তা’হলে কি শেষমেশ
মাথায় অবশ হাত রেখে
থাকবো নিশ্চুপ বসে না, তা কস্মিনকালেও
ঘটতে দেবো না। ফের বিধ্বস্ত জমিনে
চালাবো খুরপি পুরোদমে, ফের সাজাবো বাগান অপরূপ,
ধুলোয় মিশিয়ে দিলে ঝড় ফুলগুলো পুনরায়, তবুও থাকবো বাগবান।
১২.৪.২০০০
বিনিদ্র রাত
বিনিদ্র রাত, তোমার কাছেই কৃতজ্ঞ আমি
জানি তুমি সেই ভীষণ কাফ্রি সুন্দরী, যার
ওষ্ঠে রয়েছে তরল গরল, যার ছোঁয়া পেলে
সহজে কখনও হারায় না কেউ জীবনের তাপ।
কিন্তু তোমার সঙ্গে নিত্য মিলনে হঠাৎ
হয়ে যেতে পারে ঘোর উন্মাদ, বিড়বিড় করা;
কেউ দিনরাত টকটকে লাল চোখ নিয়ে শুধু
বড় নিশ্চুপ থাকবে বন্দী জাগরণে, একা।
বিনিদ্র রাত, তোমাকেই তবু মেনেছি প্রেমিকা,
আমার নৌকা ডোবার জেনেও তোমার দু’হাতে
সঁপেছি বৈঠা, মেতেছি ভীষণ নৈশভ্রমণে-
তোমার চুমোই আনে কবিতার প্রবল জোয়ার।
৭.৪.২০০০
বেদনার্ত কবি
সামান্য কজন লোক বিংবা মত্ত ভিড়
কখনও কবির জামা ছিঁড়েছুড়ে অথবা শরীর
জখ্মি করে কেল্লা ফতে হলো ভেবে হয় মশগুল,
ভব্যতার আসর ভণ্ডুল
করে হৈ হৈ গর্বের চূড়ায় বসে তুড়ি
বাজায় বাজারে আর সন্ত্রাসী হাতুড়ি
নিয়ে মেতে থাকে সারাক্ষণ,
বেদনার্ত হন কবি আর হয় পীড়িত মনন।
১৫.৩.২০০০
ভাষাশহীদের রক্তধারায় পুষ্পবৃষ্টি
আন্দোলনে সমর্পিত ছিল মনপ্রাণ, অথচ শরীর ছিল
ভয়ঙ্কর থাবার দখলে বহুদিন। ফলে সভা,
মিছিল, শ্লোগান থেকে দূরে, বহুদূরে
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হুহু কেটে গেছে। বারান্নোর ফেব্রুয়ারি জুড়ে
শয্যাগত ছিলাম একাকী; ঘন ঘন জ্বরে পুড়েছে শরীর। অসহায়
দেখেছি জ্বরের ঘোরে আমার নিজের ঘরে ন’জন রূপসী
আসেন নিভৃতে কিছু নাচের স্বর্গীয় মুদ্রা দেখিয়ে এবং
গান গেয়ে মিশে যান মেঘের রেশমে। দেখতাম
পিতা গায়ে শেরওয়ানি চাপিয়ে, মাথায় মখমলী টুপি পরে
যাচ্ছেন নিজস্ব প্রেসে, মা হেঁসেলে রান্নাবান্না সেরে
আমার কপালে হাত রাখছেন জ্বরের সন্ত্রাস বুঝে নিতে।
দেখতাম বারান্দায় কখনও কখনও বসে আছে
একটি কি দুটি কাক, মাঝেমাঝে হঠাৎ দুপুর-চেরা ডাক
দুপুরকে আরও বেশি ঝাঁঝালো বানিয়ে দেয় আর
ক্ষয়িষ্ণু দেয়াল বেয়ে পিঁপড়ের কারাভাঁ চলে যায়,
যেন দীর্ঘ কালো রেখা শিল্পীর তুলির। ট্যাবলেট,
ওষুধের ফ্যাকাশে ফাইল,
চকিতে ঘুলিয়ে তোলে হরিদ্রাভ বিবমিষা আমার ভেতর।
চোখ বুজে থাকি কিছুক্ষণ, হাবিজাবি
কীসব বেয়াড়া ঘোরে করোটিতে। কিয়দ্দূরে যেন
ডেকে ওঠে ফাল্গুনের প্রচ্ছন্ন কোকিল।
তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম, হঠাৎ ঝাঁকুনিতে চোখ খুলি-
আমার চৌকির পাশে জননী জায়নামাজে মগ্ন সিজদায়। বারান্দায়,
হায়, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’
কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে ছয়টি লোমশ হাত, দেখি
কালজয়ী বাগানকে ভাগাড় বানাবে বলে যারা তারা নিজ
গর্ভধারিণীকে কলঙ্কিত করে দ্বিধাহীন প্রহরে প্রহরে।
জ্বরে পুড়ি দিনরাত; আমার প্রথম প্রেমদাহ, ভস্মরাশি,
প্রণয়ের পদাবলি, ছাত্রদের দৃপ্ত সভা, শ্লোগান, গ্রেপ্তারি
পরোয়ানা, মিছিল, বুলেটসম্বলিত ডায়েরি পুড়িয়ে ফেলি
বোবা ক্রোধে। প্রেস থেকে ফিরে বাবা বলেন জ্বলন্ত গোধূলিতে,-
“বাংলাভাষা রক্তচেলি পরে হাঁটে রাজপথে নক্ষত্রখচিত
পোস্টার-শোভিত হাতে, হাওয়ায় উদ্দাম অগ্নিশিখা-কেশরাশি!”
কারা যেন আমাকে সফেদ মেঘে মুড়ে
রক্তপোশসহ আসমানে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে,
নজরুলী গজলের তানে, লালনের
একতারা-সৃষ্ট সুরে কী কুসুম ফোটে
মেঘের নানান স্তরে, শূন্যের মাঝার-
দেখে দেখে চোখ হয় বসন্তবাহার
এবং হৃদয় শান্তিনিকেতন।ঘোর কেটে গেলে
শুক্নো গলা, জিভে তেতো স্বাদ, মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেতে চায়।
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিময় বড় বেশি জ্বর ছিল; বন্ধ্যা ক্রোধে,
ঘেন্নায়, কম্পনে বন্দী আমি, আমার ভায়ের তাজা রক্তধারা
রাজপথ থেকে ছুটে এসে আমার সে চৌকিটিকে
নিমেষেই ভাসানে পাঠায় আর বিদ্যাসাগরের
‘বর্ণ পরিচয়’ আর ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ শহীদের শোণিতধারায়
অবিরাম পুষ্পবৃষ্টি করে।
১২.২.২০০০