পথ জাগে
নিজের জীবন নিয়ে মেতেছি জুয়োয় বারবার;
খোলামকুচির মতো দিনগুলি কীভাবে উড়িয়ে
দিয়েছি, পাইনি টের। আজ
বসে আছি এককোণে সহায়সম্বলহীন শ্রান্ত
পথিকের মতো
ভীষণ একাকী; হাত বেয়ে ওঠে পোকামাকড়েরা,
কখনও কুকুর এসে গা শোঁকে, নীরবে
চলে যায়, কয়েকটি পাখি মাঝে-মধ্যে গান গায়।
ফতুর জুয়াড়িটিকে মৃত্যু আড়চোখে
দেখে নেয় কখনও সখনও। আচানক
কী খেয়ালে খুব কাছে ঘেঁষে
সম্মুখে বিছিয়ে দেয় পাশা আর ঘুঁটি। এ খেলায়
প্রায় হেরে যেতে যেতে জিতে
নিই দান, জানি না কখন
পরাজয় মেনে নিতে হবে কোন্ ঘাটে। অকস্মাৎ
কী এক ঝাঁকুনি দেহমন থেকে শ্রান্তির সকল
ধুলোবালি ঝেড়ে ফ্যালে। উঠে
দাঁড়াই, দৃষ্টীতে আভাময় পথ জাগে।
১৫.২.৯৭
পথের পাঁচালি
অনেকেই যারা নানা পথে হাঁটে, তারা সকলেই
এতদিনে জেনে গেছে একাকী লোকটা, একমাথা
শাদা চুল যার, এই একটি পথেই হাঁটছেন বহুকাল।
অন্য কোনও পথে তাঁকে কখনও যায় না দেখা। তা’হলে কি তিনি
আলাদা রাস্তার খোঁজ রাখেন না? না কি বৈচিত্র্যের
প্রতি নেই কোনও টান? আখেরে উৎসুক এক যুবা
গোধূলি-রঙিন সেই প্রবীণকে পথের কিনারে প্রশ্ন করে
সম্ভ্রমে সালাম জানাবার পর, ‘জনাব, কেবল একই পথে
পথচারী হয়ে রইলেন কেন? কেন ভিন্ন কোনও পথ খুঁজে
চিনে নিতে এরকম অনাগ্রহ আপনার?’ সে প্রবীণ ধীর কণ্ঠস্বরে
নবীনের উদ্দেশে বলেন, ‘শোনো বন্ধু, আমার এখনও ঢের
কিছু অপঠিত রয়ে গেছে এ পথের; মন-আলো-করা কত
গহন সুন্দর এতকাল পরেও দৃষ্টির অগোচরে, হায়,
করছে বিরাজ। এ জীবনে দেখাই হবে না সম্ভবত। তবু
নিত্য হাঁটি বড় একা একটি পথেই ঝুঁকে ঝুঁকে
নিষ্প্রভ দু’চোখ, যতদূর পারি, অতিশয় কষ্টে জ্বেলে রেখে।‘
১০.৪.২০০০
পাশা খেলা
দীর্ঘকাল আগে এক পড়ন্ত বেলায়
কে যেন আমাকে আচমকা
ছুঁড়ে দিয়েছিল জাফরানি মেঘের ভেতর।
ভেসে যাচ্ছিলাম কোন্ অচিন এলাকায়, তার নাম
বলা অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে। মেঘের বানে
ভিজে যাচ্ছিল আমার সত্তা।
তারপর কী-যে হলো, স্থৈর্যের আঁচলের, আড়াল থেকে
আমাকে বের করার নীরব উৎসবের
উপক্রমণিকার আয়োজন। আমার ভেতর সকালসন্ধ্যা,
এমনকি মধ্যরাতের স্তব্ধতার মুহূর্তেও
প্রবল ছটফটানি। গাছের পাতা, পথের ধুলো,
দমকা হাওয়া আমার সঙ্গে কীসব কথা বলতে শুরু করে।
এরই মধ্যে একদিন দূর থেকে এক অপরূপা রূপসী,
যার চোখে কৌতুকমিশ্রিত নির্দয়তা
খেলা করছে, আমাকে ডেকে বললেন,
‘এসো, আমরা দ্যূতক্রীড়ায় কিছু সময় কাটাই’। আমি যে
এ খেলায় একেবারেই আনাড়ি, তাকে
তোতলাতে তোতলাতে জানালাম।
সেই অনন্তযৌবনা রূপসীর হাতে আশ্চর্য এক বীণা,
পায়ের কাছে অনুপম শাদা হাঁস। তিনি হাসিমুখে
আমার সামনে বিছিয়ে দিলেন পাশা খেলার
সরঞ্জাম। চোখ-ধাঁধানো ছক আর ঘুঁটি দেখে
আমার প্রায় মূর্ছা যাওয়ার হাল। কী করে
খেলবো আমি যে এ খেলার কোনও রীতিনীতিই জানি না!
প্রতিপদে লেজেগেবরে করে ফেলছি, লজ্জায়
কাটা যাচ্ছে মাথা, নিমেষে বারবার
হার মেনে নিতে হচ্ছে ভুল চালহেতু। বহুদূর
থেকে এক জ্যোতির্ময় আস্তানায় বসে হাসছেন
চণ্ডীদাস, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ
এবং আরও কজন। কারও কারও মুখে বেদনার রেখা।
এই পাশা খেলার হারতে হারতে আমার কালো চুল
কবে যে ধবধবে শাদা হয়ে গেল,
মুখের চামড়া গেল ভীষণ কুঁচকে , টেরই
পেলাম না। বুঝতে এতটুকু ভুল হলো না,
সেই নিষ্ঠুরা, অপরূপ রূপসীর হাত থেকে
নিস্তার নেই। পাশা খেলা চলতেই থাকবে
ঘুমে ডুবে না-যাওয়া অব্দি। শেষ খেলার
বিজয় আমার মাথায় চুমো খাবে কিনা, অজানা রয়ে যাবে?
হার জিৎ যা-ই হোক, বিলাপ অথবা উল্লাস
কারও পথে হাঁটবো না। অন্তত
গৌরবের কিছু গুঁড়ো সত্তায় ছিটানো
রয়েছে ভেবে বাইবো বিনীত খেয়া।
৪.৫.২০০০
প্রণতি জানাই
এই যে আমার দু’চোখের ক্লান্তি মুছে ফেলে
সবুজ গাছপালা, ফসলের মাঠ,
নানা রঙেন পথ, পালতোলা নাওয়ের এগিয়ে চলা
হাওয়া-স্পন্দিত বাঁশপাতা,
সর্ষে ক্ষেতে গ্রামীণ কিশোরীর প্রজাপতি ধরার জন্যে
আভাময় ছোটাছুটি, দিঘির ঘাটে
তৃষ্ণার্ত পাখির জলপান, কী করে ভুলব এদের
বদান্যতা! এই নিসর্গ, এই জীবনের স্পন্দন,
যে দেশে প্রস্ফুটিত, আমি সে দেশের অধিবাসী।
যে দেশে বইছে মেঘনা পদ্মা, সুরমা,কর্ণফুলি,
যে দেশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গারো পাহাড়,
যে দেশে গাড়িয়াল ভাইয়ের কণ্ঠে
মঞ্জরিত ভাওয়াইয়া, যে দেশের মাঝি জোৎস্নারাতে
গায় ভাটিয়ালি, যে দেশে ঝঙ্কৃত হয়েছে
লালন ফকিরের একতারা, বেজেছে হাসন রাজার ঢোল,
যে দেশের বাতাসে ভাসে রাধারমণের গান,
আমিসে দেশের মানুষ।
যে দেশে সূর্য সেন জন্ম নেন,
যে দেশে সালাম বরকত প্রাণ দেয়
মাতৃভাষার জন্যে, যে দেশে আসাদের শার্ট
ভিজে যায় রক্তে, যে দেশে নূর হোসেনের বুক
ঝাঁঝরা হয়ে যায় বুলেটে,
যে দেশে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে তিরিশ লক্ষ শহীদের
রক্তের ছোপ, যে দেশের মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তির গান গেয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশের হৃদয়ে
আমি সে দেশের মানুষ।
আমার স্বদেশ যখন সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী মৌলবাদীদের
হুঙ্কারে প্রকম্পিত, যখন ফতোয়াবাজদের
নিপীড়নে প্রাণ হারায় বাংলা-মায়ের দুহিতারা,
তখন ঘৃণায়, ক্ষোভে নিজেরই হাত কামড়াই, এবং
সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের ফণা
কচলে দেওয়ার জন্যে যার কণ্ঠস্বর
আগুনের অক্ষরের মতো ঝলসে ওঠে, তাকে জানাই প্রণতি,
তার বয়স আঠারো হোক কিংবা আশি।
২.১.৯৬