নববর্ষের শুভেচ্ছা
দুনিয়াটি প্রতিদিন তাঁর কেমন নতুন লাগে,
আসমান, মাটি, নদী, নক্ষত্রের দল
যদিও প্রকৃত একই, একই পাখির কোরাস, তবু
নতুনের ছোঁয়া থাকে প্রত্যেকের আপন সত্তায়। তিনি
সকালে হাঁটার কালে সুস্নিগ্ধ হাওয়ায়
দুলে-ওঠা গাছ, বাগানের নানা ফুলের যৌবন,
শ্রমজীবী মানুষের পথচলা গভীর আগ্রহে দেখে নেন
প্রায় প্রতিদিন, আর পাখির উড়ালে
নিবিড় করেন পাঠ প্রগাঢ় গ্রামীণ কোনও গাথা।
যতদূর জানি নববর্ষের প্রথম দিনে তিনি
আনন্দিত ঢেউয়ে ভেসে নিকট অথবা
কিয়দ্দূর থেকে আন্দোলিত গাছপালা, ফুল-পাখি,
চেনা কি অচেনা সবাইকে স্মিত মুখে
জানান অভিবাদন, তাঁর
সুন্দর শুভেচ্ছা পৌঁছে যায় দোরে দোরে এমনকি
হাসপাতালের প্রত্যেকটি বেডে, কুষ্ঠরোগীদের
দগদগে ক্ষতে!
বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি
এবং মুসলমান, যারা নির্বিবাদী, সকলেই
ছিলেন প্রণত তাঁর সদাচারী মনুষ্যত্বে। যেদিন ব্যক্তিটি
রইলেন পড়ে একা রক্তমাখা পথের ধুলায় বছরের
প্রথম দিবসে, হায়, আনন্দবিহ্বল কোনও মানবসন্তান
আসেনি কিনটে তাঁর, শুধু গাছপালা, আসমান, মেঘমালা,
একঝাঁক পাখি, ধুলোমাটি, দীর্ঘ গলি,-
জানালো অভিবাদন বছরের প্রথম দিনের শুভেচ্ছার
কিছু বাণী অলক্ষ্যে সবার।
এবং ব্যথিত মূক বস্তুজগতের প্রাণে প্রশ্ন জেগে রয়-
কারা ওরা, কোন্ পশুদল যারা, হায়,
করেছে হরণ তাঁর মহান জীবন,
যিনি কারও বাড়া ভাতে কোনওদিন ছিটোননি ছাই!
৬.৪.২০০০
নাকি শুধু হিমযুগ
তাকে কি নিশুতি রাত ডেকেছিল? নাকি সমুদ্রের
তরঙ্গের ধ্বনি তার কানে ঢেলেছিল
জলকন্যাদের কোনও মোহময় গান?
নইলে কেন শহুরে বাড়ির সুসজ্জিত বড় ঘরে
কাউকে কিছু না ব’লে মধ্যরাতে কেমন নিশ্চুপ
নিঃসাড়, শীতল হয়ে গেলেন হঠাৎ?
আঙুলের ফাঁকে ছিল আধপোড়া, নেভা সিগারেট,
টিপয়ে ফতুর গ্লাশ, ঈষৎ কুঞ্চিত নিরুপায়
রাতের পোশাক গায়ে। নানান হুইস্কি, ওয়াইন,
ভদকা, বীয়ার ইত্যাদির সারি সারি
সাজানো বোতল ছিল মাথার ওপারে,
পারেনি বাড়াতে ওরা সাহায্যের হাত তার দিকে,
এরমই নৈর্ব্যক্তিক সহচর তারা।
বাড়ির বাসিন্দা যারা তারাও নিদ্রার
সাগরে ছিলেন ডুবে, কিছুতে পাননি টের তার
প্রস্থানের নিঝুম প্রহর।
বিবাহিত সেই পুরুষের পুত্রেরাও বিবাহিত, কেউ কেউ
সন্তানের পিতা আর উপার্জনক্ষম।
নিশ্চুপ গেলেন যিনি গভীর নিশীথে,
সমর্থ শরীরে তার মিশেছিল গৃহিণী ছাড়াও
ভিন্ন নারীদের স্বেদকণা দিব্যি রমণের কালে- প্রকৃতই
সংসারে ছিলেন সুখী, না কি
ভীষণ অসুখী-
বোঝা ছিল দায়। তার ঠোঁটে অনেকেই
দেখেছে হাসির রেখা খেলে যেতে বহুবার আর
প্রিয় বন্ধুমহলে আমুদে লোক বলে ছিল খ্যাতি।
যখন গেলেন তিনি অকস্মাৎ, তখন দু’চোখে তার কোন্
দৃশ্য উঠেছিল ভেসে? ভেসে উঠেছিল
গৃহিণীর মুখ? কোনও সন্তানের মুখ?
তাকে কি অন্তিম ক্ষণে খুব আলোড়িত
করেছিল কোনও বান্ধবী চুম্বনের স্মৃতি? না কি
এসব কিছুই নয়, শুধু হিমযুগ এসেছিল নেমে চোখে?
৩.১.২০০০
নিজস্ব চাষাবাদ সম্পর্কিত
যদি খনি শ্রমিকের মতো
নিজেকে না খুঁড়ি কিংবা ডুবুরির মতো
অতলে ডুব না দিই শস্যহীন ক্ষেত হয়ে আমি
খাঁখাঁ করি সারাক্ষণ। এরকম হয় বারবার।
কখনও মুষড়ে পড়ি খুব, মনে হয়
ফসলের মরশুম আসবে না কোনওদিন আর
ভুলেও এমন বিরানায়। এরকম
যখন আমার হাল, কতিপয় বিকট শকুন
কে জানে কোত্থেকে উড়ে এসে
আমাকে ভীষণ ঠোকরাতে থাকে, যেন বা পুরনো
কোনও প্রতিশোধ নিতে চায়
হঠাৎ সুযোগ পেয়ে। যদি খরায় জবরদস্তি
ফসল ফলাতে যাই, নিশ্চিত উঠবে হাতে শুধু
অবাঞ্ছিত নুড়ি, আর আমি বিফল, ফতুর চাষী
হয়ে মাথা কুটবো জমিনে শতবার। রোদে পুড়ে
গ্রীষ্মকালে, বৃষ্টির বর্শায় বিদ্ধ হয়ে বর্ষাঋতুতে অপেক্ষা
করি একটানা বহুদিন
যদি পুনরায় হেসে ওঠে নতুন সম্ভারে পোড়ো জমি।
তখন আকাশ কালো করে নামবে না শকুনের
ঝাঁক আর আমার জমিনে,
যা আমার ঘামে নেয়ে হয়েছে উর্বরা-ধৈর্যময়
অপেক্ষাও সাধনা, জেনেছি শেষে ঢের মূল্য দিয়ে।
নিশীথের দয়াল প্রহরী
খুব রাত করে ফিরে এলে গাঢ় নিশীথের গার্ড
জানায়, সিঁড়িতে বহু ঘণ্টা হাতে একতারা নিয়ে
কে বাউল বসে বসে শেষে
খাঁচার ভিতর
অচিন পাখির গান গাইতে গাইতে নিয়েছেন
সুদূরে বিদায়। পরদিন ফের প্রগাঢ় রাত্তিরে
ফিরে শুনি নৈশপ্রহরীর
নিবিড় বয়ান এক পাঞ্জাবিতে রক্তের প্রখর দাগ নিয়ে
আলাভোলা একজন ধানসিঁড়ি নদীটির তীর,
কলকাতার হন্তারক ট্রামলাইনের চোরা মার
বয়ে নিয়ে ঢের পায়চারি করে মিলিয়ে গেছেন
আখেরে কুয়াশা-সমুদ্দুরে।
অন্যদিন পাহারাদারের হাতঘড়িতে গভীর
রাত্তির, তিনটে বাজে, ফিরে আসি বড়ই নিঃসঙ্গ
বাসার গেটের কাছে। আজ যে অতিথি অপেক্ষার
সূঁচের খোঁচায় ক্রূদ্ধ হয়ে গেলেন রিল্কের অনুবাদগ্রন্থ ভুলে
ফেলে রেখে ভেজা ঘাসে, তিনি সুনিশ্চিত
বদ্ধদের বসু।
এক রাতে প্রগাঢ় প্রহরে নিশীথের
দয়াল প্রহরী জাদুবলে অনুপম নায়ের প্রবীণ মাঝি
হয়ে বৈঠা বেয়ে আমাকে সুদূর
তটের সংকেত দিয়ে সিদ্ধির আলয়ে
নিয়ে যেতে চায়, আমি আখেরে পৌঁছুতে পারি কিনা
হিংস্র ঢেউ উজিয়ে, জানি না; জানবো না কোনওদিন।
১৯.৩.২০০০