দ্বিধারা
একঝাঁক পাতিহাঁস বদ্ধ নর্দমার কাদাজল
ভালবেসে, ডাস্টবিন খুঁটে খায় আর
জটলা পাকায় ক্ষণে ক্ষণে, প্রায়শ কলহে মাতে। একজন
রাজহাঁস, নিঃসঙ্গ, ওদের সখ্যকামী, কাছে এসে
প্রত্যাখ্যাত হয়; ধবধবে, কান্তিমান রাজহাঁস
ভারাক্রান্ত মনে হেঁটে যেতে কিছুদূরে খুব খাঁটি
দুধের নহর পেয়ে যায়, শোনে বীণার আশ্চর্য ধ্বনি আর
রাতে নক্ষত্রেরা চতুর্দিকে নেচে বলে, ‘স্বাগতম।‘
আনন্দিত রাজহাঁস আকাশের নানা স্তরে মুক্ত
ডানা মেলে সৌন্দর্যের নানা রূপ করে আবিষ্কার।
৮.৪.২০০০
দয়া করে একটু শুনুন
এই যে, শুনুন, দয়া করে একটু শুনুন।
খানিক সময় ভিক্ষা চাইছি,
জানি আপনি ব্যস্ত বেজায়,
তবু সময় চাইছি কিছু।
নই তো আমি বংশীবাদক,
মুগ্ধ করার সুর জানি না,
লোক জোটাবার কায়দা নেই,
কণ্ঠ আমার রুক্ষ খুবই,
তবু কিছু বলতে চাই।
জানি আপনি হালজমানার মানুষ বটে,
তবে কেন পেছন দিকে হাঁটেন শুধু?
তবে কেন চতুর্দিকে আঁধার ছড়ান?
এই কি সাধের চলার রীতি?
শুনি আপনি সবার নাকি ভালোই চান,
তবে কেন ডানের মোড়ে লোক জমিয়ে
অগ্রগতির মস্ত বড় শক্র সাজেন?
প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে চলেন?
ধন্য ধন্য রবে মুখরিত
মহাকালের মৃত্তিকায় স্বাক্ষর রেখে চলেছে
আমার মায়ের মুখের ভাষা,
যেমন তালপাতায় মহাকাব্য রচনা করেছেন
বাল্মীকি এবং ব্যাস।
কপোতাক্ষ নদের কিনারে পড়ন্ত বিকেলে
স্যুট-বুট পরা মাইকেল মধুসূদন
গা এলিয়ে আবৃত্তি করছেন নিল্টনের
‘প্যারাডাইস লস্ট’ কিংবা নিজের পঙ্ক্তিমালা।
শান্তিনিকেতনে ধ্যানমগ্ন রবীন্দ্রনাথ মানসে ধারণ
করছেন বিশ্বরূপ এবং অম্লান কাব্যধারা। লালন ফকির
পথেঘাটে বাজিয়ে চলেছেন একতারায়
মানবাত্মার উদার সঙ্গীত। নজরুল
অপরূপ ছন্দে নেচে চলেছেন মোহন বাবরি দুলিয়ে
জেলায় জেলায় আর তার সঙ্গে নাচছে
শাশ্বত বাংলা। এই তো দেখেছি,
ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে একান্ত
নিঃসঙ্গ দাঁড়ানো জীবনানন্দ দূরের আকাশের
নক্ষত্রমালাকে ছুঁয়ে ছেনে শুনে নিচ্ছেন জলপরীদের গান।
অনন্য এই কবিদের নির্মিত জ্যোতির্ময় পথগুলি
দেখতে দেখতে আমি স্বতন্ত্র পথ তৈরির সাধনায়
মগ্ন, যেখানে ক্লান্তির প্রহরে সবুজের সান্নিধ্যে
খানিক জিরিয়ে নেবেন পথিকগণ।
বিগত শতাব্দীর সীমা পেরিয়ে এই সামান্য অথচ
সৌভাগ্যবান আমি নবীনা একুশ শতকের থরথর
অধরে চুম্বন করছি জ্বলজ্বলে আবেগে। চতুর্দিকে
আনন্দধ্বনি। এই তো বিশ্ববাসী আমাদের আপন
একুশে ফেব্রুয়ারিকে, মানে আমাদের
মায়ের মুখের ভাষাকে বরণ করছে ফুলচন্দন দিয়ে
এবং ধন্য ধন্য রবে মুখরিত একুশ শতকের পূর্বলেখ।
৬.২.২০০০
ধুধু মন
আজও এই নব্য শতাব্দীতে মনে পড়ে-
হাজার বছর আগে ঘিয়ের প্রদীপ-জ্বলা রাতে
গভীর নিশীথে এক অন্যন্যা রূপসী নীরবতা
অজ্ঞাত ভাষায় আলোলতা
সাজিয়ে জানিয়েছিল আসবে সে পুনরায় এই
সহায় সম্বলহীন কবির ডেরায়। আমি সেই
যুগ যুগ ধরে প্রতীক্ষায় আছি তার। মধ্যরাত
অব্দি জাগরণে তীব্র পুড়ি, যদি সে হঠাৎ
কোনও রাতে এসে ফিরে যায়। মিলনের সেই ক্ষণ
ব্যর্থতায় মিশে যায়, বড় ধুধু মরুভূমি মন!
১৬.৩.২০০০
ধোঁয়াশার ভেতর যেতে যেতে
ধোঁয়াশার ভেতর যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে হাতে ছুঁয়ে ঠাওর
করতে পারিনি দরজাটা কাঠের, লোহার না পাথরের। স্পর্শ
বিলক্ষণ বুঝিয়ে দিলো দরজা খুব শক্ত কোনও পদার্থ দিয়ে তৈরি।
ভেতরে প্রবেশ করা তেমন সহজ হবে না। কোনওরকম ফাঁক-ফোকর
নেই, ওপর-চালাকিও নিষ্ফল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও ভেতরে
প্রবেশাধিকার মিলবে কিনা, বলা মুশকিল। কড়া নেই যে খুব জোরে
নাড়বো। চেঁচিয়ে মরলেও কেউ শুনবে না। এখানে ধাক্কাধাক্কি
করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা করা
ছাড়া গত্যন্তর নেই।
অনেক প্রহর নিশ্চুপ কাটাবার পর চেয়ে দেখি, দরজাটা দরাজ
দিলে খোলা, ওর অস্তিত্বে আমন্ত্রণের ভাষা। প্রবেশ করতেই
আমাকে চুম্বন করে নানা ভাষার বর্ণপরিচয়ের আদ্যাক্ষর।
আমাকে দেখে ‘অ’-র কী আনন্দ, কী নাচানাচি চারদিকে, ওর কণ্ঠে
বসন্তবাহারের তার। আমিও আমার আত্মার আত্মীয়কে দেখে
ফুটতে থাকি ফুলের মতো। হঠাৎ সেখানে হাজির হয় পশুরাজ
সিংহ, তাকায় আমার দিকে, চক্রাকারে ঘুরে আমার ধূলিধূসর
বিনীত পোশাক শুঁকে কোথায় চলে যায়।
সামনের দিকে আমার এগিয়ে চলা। আমাকে ঘিরে ধরেছে
মেঘদল, মেঘমল্লারের সুর। মেঘদল কী এক গভীর বোধ আমার
মনে জাগিয়ে তোলে। ভাসমান মেঘের পেছনে পেছনে হাঁটি আর
কিয়দ্দূরে পৌঁছে দেখি কী প্রচণ্ড ভিড়। পাঁচমিশেলী কণ্ঠস্বরে সেই
পুষ্পিত বাগান গমগম করছে। হঠাৎ এক আশ্চর্য নীরবতা। বাক্যহারা
সব ধীমান, পণ্ডিত, পদ্যকার। আমি জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে থাকি দূরে
এক কোণে। আশ্চর্য সেই উদ্যানে এক নারীর আবির্ভাব। তিনি আমাদের
চেনা এবং অচেনা। তার হাতে অনিন্দ্যসুন্দর এক বীণা, পায়ের কাছে
তুষারশুভ্র হাঁস। অপরূপ সুন্দরী সেই নারীর মুখে দেবী সরস্বতীর
আদল। ধীমান, জবরদস্ত বিদ্বান এবং পণ্ডিতদের অতিক্রম করে তিনি
এগিয়ে এলেন দীনবেশে দাঁড়ানো, বেজায় সঙ্কুচিত আমারই কাছে। মৃদু
হেসে আমাকে তাঁর হাঁসের একটি পালক দান করলেন। আমি বিস্ময়
এবং আনন্দের মাত্রাবৃত্তের মতো স্পন্দিত।
১৩.২.২০০০