ডাইনোসর উঠে এলেও
আমি তো মাঝেমাঝে বাইরেই যেতে চাই,
অথচ ঘর আমাকে আটকে রাখে।
ঘরে বসে আমি দেখতে পাই
একচিলতে আকাশ, নীলিমার বিশালতা
দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। কখনও সখনও একটি কি
দুটি পাখি চোখে পড়ে। পাশের বাড়ির
জানালার ওপরের কার্নিশে
যুগল পায়রার কোমল প্রণয় আমাকে মুগ্ধ করে,
কিন্তু ঝাঁকঝাঁক পাখির পঙ্ক্তিমালা
আমার উৎসুক দৃষ্টির আওতার
বাইরে রয়ে যায় মাসের পর মাস।
এ যেন নিঃসঙ্গ বন্দীর ক্লান্ত, দম-আটকানো সুদীর্ঘ
প্রহর কাটানো, কিংবা তীব্র সাইনাসের
দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরুদ্ধকর বেহাল প্রহর,
মাথার ভেতর ভীমরুলের অশেষ চক্কর। কখনও
মনে হয়, মাথার ভেতর, নাকে মুখে সুঁচলো কিছু ঘাস
গজিয়ে উঠেছে। জোরে জোরে ডেকে চলেছি,
কিন্তু কোনও শব্দই বেরুচ্ছে না। কণ্ঠনালীতে
মুঠো মুঠো বালির খসখসানি। আবার মুমূর্ষু দিনান্তে
দুটো চোখই আচ্ছন্ন হয়
মৃত কুয়াশায়; আক্রান্ত হই হঠাৎ
কতিপয় কঙ্কালের অদ্ভুত হিংস্রতায় এবং
ওরা আমাকে বাধ্য করে আমার নিজেরই রক্ত চেটে নিতে
দুঃস্বপ্ন এবং বাস্তবের মধ্যে কোন্টি প্রকৃত সত্য, এ নিয়ে
কী-যে ধন্দে পড়ে যাই, বোঝানো খুবই মুশকিল।
এই যে আমি আটকে আছি গুহাসদৃশ ঘরে,
নিঃশ্বাস নিতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে আমার-
শরীরে বিষাক্ত কাঁটা ফুটছে, চোখের ভিতর
ঢুকছে ঝাঁকঝাঁক লাল পিঁপড়ে, মেরুদণ্ড কারা
যেন উপড়ে নিতে চাইছে বাঁকা, আগুন-তাতানো
শিক দিয়ে। কী এমন অপরাধ করেছি যে সবাই
এরকম শক্রতা সাধতে উন্মুখ? অথচ
বন্ধ্যা মাটি চিরে আমি উদ্যান বানাতে চেয়েছিলাম,
বালিময় জমিনে ফল্লুধারা
বইয়ে দেয়ার শপথ নিয়েছিলাম সূর্যোদয়ের
দিকে মুখ রেখে। নিজেকে শুদ্ধতার
আভায় ভাস্বর করার আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার।
কতিপয় মাংসাশী পাখির অন্ধকার-ছড়ানো
পাখার দাপটে অথবা এক পাল জন্তুর
তাণ্ডবে হকচকিয়ে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে খুরপি আর
কোদাল চালানো থামিয়ে দেবো? বাগান বানানোর
কাজ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো
সত্তায় হতাশার কালো মেখে? ধূসর মাটি ফুঁড়ে
ডাইনোসর উঠে এলেও আমি পুষ্পবিকাশের
বীজ বপন করে যাবো কোনও সর্বনাশের তোয়াক্কা না-করেই।
৩০.১২.৯৯
তখন তাকে
একে একে ওরা অনেকেই
গাঁওগেরামের নারী, পুরুষ, শিশু
জড়ো হলো মাঠে। বহুদূর থেকে একজন
এসেছেন ওদের কিছু বলার জন্য।
সবাই ভালো করে দেখল তাকে। মাঝারি
গড়নের মানুষ। পরনে পাজামা, পাঞ্জাবি,
গায়ের রঙ রোদপোড়া। অসাধারণ কিছুই নয়,
খুবই সাদাসিধা। কেমন যেন
আপন মনে হয়। তিনি চোখ মেলে তাকালেন
সবার দিকে, তার চোখ থেকে ঝরে মমতার রেণু।
প্রথমে তিনি সবাইকে আমির সওদাগর আর
ভেলুয়াসুন্দরীর কাহিনী শোনলেন,
তখন তার গলার আওয়াজে
জ্যোৎস্না ফোটে, ফোটে বেলফুল, দিঘির ছলছলানি।
তারপর তিনি বললেন, যারা ফতোয়াবাজ
তারা মানুষের পক্ষে নয়;
যারা নূরজাহানকে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারে,
তারা মানুষ নয়;
যারা ইয়াসমিনের ইজ্জত লুটে ওকে হত্যা করে,
তারা পশুর চেয়েও বেশি পশু;
যারা ইশকুলে আগুন দেয়,
তারা মানুষের বিপক্ষে।
যখন তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে
সমাজের অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে
কথা বলছিলেন, তখন তার কথায়
রোদের ঝলক,
এবং সেই মুহূর্তে তাকে অনেক দীর্ঘকায় দেখাচ্ছিল।
দাঁড়ালেই টলতে থাকি
দাঁড়ালেই টলতে থাকি, খানিক হাঁটতে
চেষ্টা করলেই রুক্ষ ধূসর ধুলোয়
স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ি, আবার কখনও
খাবি খাই থকথকে কাদায়, এখন
আমার এমনই হাল। শক্ররা চৌদিকে
ফেটে পড়ে ঠা ঠা অট্রহাসিতে এবং বন্ধুবান্ধব বেজায়
মনোকষ্টে ভোগেন আমার অবাঞ্ছিত
এ দুর্দশা দেখে।
লজ্জায় কুঁকড়ে থাকি, নিজেকে লুকোতে ইচ্ছে করে,
যেমন আহত জন্তু খোঁজে অন্ধকার গুহা। এই অক্ষমতা
জানি না ভোগাবে কতদিন, কতকাল
আমাকে রাখবে ফেলে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হিংস্র,
ঘোর অমাবস্যার দখলে! কারও করুণার পাত্র
হয়ে থাকা, বুকে হেঁটে পথচলা, ব্যথিত দু’চোখে
তাকানো, কম্পিত ঠোঁটময়
করুণ অথচ তুচ্ছ আবেদন নিয়ে বেঁচে থাকা,
আত্মাময় গ্লানি সেঁটে নিত্যদিন হামাগুড়ি দেয়া,
কেবল নিজের মাংস নিজ দাঁতে ছেঁড়ারই শামিল।
যখন ভোরের আলো চুমো খায় আমাকে এবং
পূর্ণিমা সপ্রেম করে আলিঙ্গন, আমার ক্ষতের
ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলো খসে যায়, কোথাও সরোদ বেজে উঠলেই
আমার সত্তায় ঘটে রূপান্তর, আমার নমিত
কেশগুচ্ছ হয়ে ওঠে স্যামসীন দুরন্ত কেশর হলমায়
এবং মশকরা-প্রিয় লোকজন পালাবার পথ খুঁজে মরে!
০২.০১.২০০০
দীক্ষা
দৈন্যদশা বাড়িটার, অথচ সেখান থেকে চৌদিকে প্রখর
দীপ্তি হচ্ছে বিচ্ছুরিত, ভাবে মলিন তরুণ। কাছে
গিয়ে কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন
দৃশ্যত দরিদ্র প্রৌঢ় কবি, বললেন স্নেহার্দ্র প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে-
‘তোমাকে সাহায্য দান অসাধ্য আমার;
ধনীর ভবনে যাও।‘ ‘আপনার কাছে টাকাকড়ি
চাইতে আসিনি আমি’, বলে সে তরুণ, ‘চাই শুধু
কিছু সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের আভা।‘
বয়স্ক কবির চোখে আলোঝর্ণা ফোটে,
উদ্ভাসিত তরুণ সে প্রার্থী আশ্চর্য দীক্ষায়!
৭.৪.২০০০
দোয়েলমাতার জন্যে বন্দনাগীতি
আমার দোয়েল মাকে, বহুদিন হলো কী ধূসর
দূর দেশে হারিয়ে ফেলেছি। মাথা খুঁড়ে
মরলেও ঠিকানা পাবো না কোনওকালে। সেই থেকে
বারবার ভস্ম ঢেকে ফেলে
আমাকে আপাদশির। কখনও সখনও প্রাণে গান
জেগে উঠলেও কণ্ঠে ভস্মরাশি জমে যায় শুধু!
কালেভদ্রে দোয়েলমাতাকে দেখি স্বপ্নের ভিতরে
স্বর্গীয় গানের সুরে লীন নীলহ্রদের কিনারে। জেগে উঠে
গান গেয়ে অন্তত নিজেকে
শুদ্ধ করে নিতে গিয়ে স্তব্ধতায় ডুবি, যেন সুর
আমাকে আলোয় নেয় অন্ধকার থেকে
অনন্য গহন মীড়ে। আমার দোয়েলমাতা বেদনায় মিশে
ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে চকিতে মিলায়
গুণীর তানের মতো।
দোয়েলমাতার ব্যর্থ, অধম সন্তান আমি, পড়ে
আছি একা ছিন্নভিন্ন পথের ধুলায়। মাঝেমাঝে
কণ্ঠ থেকে ভস্ম ঝরে যায় অকস্মাৎ, যে গান কখনও
লতিয়ে ওঠেনি কণ্ঠে, তারই সুর জাগে, সুর শুনে
গাছের তরুণী লতা, ফুলের অনূঢ়া কুঁড়ি, প্রজাপতি আর
হলুদ ধানের শীষ নাচে, সুনসান
নিশীথের বুকে জোনাকিরা ব্যালে-নাচ জুড়ে দেয়।
কোথাও অজানা দেশে আমার দোয়েলমাতা দীর্ঘ
কোমল নিদ্রায় আনন্দের আলিঙ্গনে মিশে গিয়ে
ভস্মস্তূপে নতুন সুরের জন্ম দেয়, রেশ যার
আমাকে বাজায়, নিয়ে যেতে চায় অনন্তের তটে……
১৩.৩.২০০০