ঘাটের কথা
অনেকেই আমাকে বেশ ঘটা করে
নিজ নিজ ঘাটের কথা বলেন,
যে-ঘাটে বেলাশেষে পৌঁছে যাবেন সাড়ম্বরে,
সেখানে তাদের জন্যে অপেক্ষমাণ
সব পেয়েছির দেশ। এমন কি আমার এক
নিরীশ্বর, সঙ্গীতসিদ্ধ বন্ধুও
বললেন তার ঘাটের কথা
ঈষৎ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে আধ্যাত্মিক গীতের ধরনে।
কিন্তু বরাত খারাপ আমার। কেননা,
আমার কোথাও পৌঁছুনো নেই, কোনও ঘাটও
নেই; আছে শুধু অসীম তিমিরের
মহাশূন্যতায় চিরতরে বিলীন হওয়া।
১৩.৪.২০০০
ছুঁচো আর ইঁদুরের কথা
বেশ কিছুদিন হলো ঘরের ভেতর ছুঁচো আর ইঁদুরের
উৎপাত বেড়েছে। এইসব
মৃত্তিকা খননকারী, গর্তবাসী প্রাণী কবে আমার ঘরের
জবরদখল নিয়ে ফেলেছে, পাইনি টের। উহাদের গন্ধে এখন তো
বিবমিষা হয়, মাঝেমাঝে
বমি করে ফেলি আর কোনও কোনও রাত
ভীষণ নির্ঘুম কাটে, অসুস্থতা বুকের ভেতর
কঠিন পাথর হয়ে চেপে বসে। কখনও কখনও
মনে হয়, মূষিক ও গন্ধ মূষিকেরা বন্ধ ঘরে
আমার শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে অসীম আহ্লাদে। খাটে শুধু
কঙ্কাল থাকবে পড়ে উন্মাদের দুঃস্বপ্নের মতো,-
এ ভাবনা ছড়ায় তুষারকণা রক্তের ভিতর।
তাহলে কি ছুঁচো আর ইঁদুরেরা আখেরে আমাকে
ঠাঁইনাড়া করে দেবে? কারও বাড়া ভাতে
কখনও দিইনি ছাই, তবু কেন এই
উৎপাত এখানে দিনরাত? আমার নিজেরই ঘর
কেন ঘৃণ্য মৃত্তিকাখননকারী প্রাণীদের অধিকারে ছেড়ে
চলে যেতে হবে? কেন কেবলি বিবাগী
হয়ে হেঁটে যেতে হবে দেশ-দেশান্তরে
নিঃসঙ্গ, ব্যথিত ইহুদির মতো? অথচ আমার
আপন ঘরের
ভেতর আসতো ভেসে গোলাপ, কনকচাঁপা, চন্দ্রমল্লিকার
ঘ্রাণ; পাখি সুরে সুরে ভরিয়ে তুলত কত নিমগ্ন প্রহর
আর কবিতার মুখ প্রথম আলোর মতো জাগত হৃদয়ে।
১৪.১.৯৯
জনৈক বন্ধুর প্রতি
বন্ধু, তুমি মেঘের সঙ্গে, গাছের পাতা, পানির সঙ্গে
অনেক সময় কথা বলো। পাশের বাড়ির লাল দেয়ালে
না-লেখার সব লেখা পড়ো এবং সাঁঝের উড়ে-যাওয়া
আবছা পাখির ডানা থেকে পদ্য-ছোঁয়া পঙ্ক্তি আনো।
বন্ধু, তোমার পায়ে অনেক পথের ধুলো, কাঁটার খোঁচার
চিহ্ন দেখে বুঝতে পারি, অনেক হেঁটে অনেক বাধার
প্রহার সয়ে এখানে আজ ঈষৎ উঁচু আসন পেলে।
তোমার প্রতি লোকের প্রীতি শেষে তোমার কাল হয়েছে।
কোনও কোনও কামেল পুরুষ তোমার নামে কেচ্ছা রটান,
কারও হাতের পাথর তোমার বুকে কিছু জখম বানায়;
যাদের তুমি কোনওকালে স্বজন বলে জেনেছিলে,
তারাই দিব্যি শক্র হয়ে গলিজ বাক্য বমন করে।
বন্ধু, তুমি খেদ করো না, এমনি ধারা সর্বকালেই
সচল জেনো। বিরূপতায় পিষ্ট হয়ে কেউবা হারায়
রুটিরুজি, বাস্তুভিটা, কেউ নিমেষে স্বদেশত্যাগী।
সইতে হবে সকালসন্ধ্যা হিংস্র পাথর, কাদার গোলা।
বন্ধু, তোমার ভয় কী বলো? আঁধারঘেরা পথে তোমার
পড়বে আলো যথারীতি। রবিঠাকুর, লালন ফকির
এবং আরও মহামানব তোমায় নিত্য ছায়া দেবেন
উপরন্তু নরনারীর ভালোবাসা হবে তোমার রক্ষাকবচ।
না-ই বা হলো কালজয়ী খ্যাতি তোমার, যায় যদি যাক
মুছে তোমার নামের রেখা কালের পটের ক্ষেত্র থেকে
দুঃখ কিসের? ঘটছে অমন হরহামেশা নানা যুগে;
যে-সাধনে রইলে সেটাই অটুট থাকুক জীবন জুড়ে।
জনৈক মাঝি
নৌকাটা সত্তায় দৈন্যদশা নিয়ে নিঝুম রাত্তিরে
যাচ্ছিল নদীর বুক চিরে। প্রায় বুড়ো,
খুব রোদে-সেঁকা, জলে-ভেজা
মাঝি দাঁড় বায় অবিচল।
অকস্মাৎ মাঝগাঙে ক’জন ডাকাত ঘিরে ধরে
চলমান নাওটিকে, রত্নের সন্ধানে তছনছ
করে সব, অন্ত্রের আঘাতে বড় অসহায় মাঝি
বিপন্ন লুটিয়ে পড়ে জীর্ণ পাটাতনে।
বিফল ডাকাত দল ছিটিয়ে ঘেন্নার থুথু নিমেষে উধাও;
ভোরের প্রথম আলো পাক-খাওয়া নৌকোটিকে ছুঁলে
ভাঙা পাটাতনের তলায়
প্রচ্ছন্ন, অনন্য রত্নরাজি উঠে উসে
মাঝির বুকের ক্ষত ঢেকে দেয় শুশ্রূষায়,
আলগোছে ভেসে আসে পাখিদের বন্দনা-সঙ্গীত।
জানা নেই ভাসমান নৌকো
ভিড়বে কোথায় কোন্ ঘাটে!
১৪.২.২০০০
জানবে না কেউ
লোকটাকে, সকল সময় নয়, কখনও সখনও
দেখি, বেশি দেখি দূর থেকে, কাছে
কালেভদ্রে দেখা পাই তার আর, কি অবাক কাণ্ড,
যখন দূরত্ব ঢের বেশি থাকে, তখন অনেক
নিবিড়, গহন চেনা লাগে,
নৈকট্য অচেনা করে দেয় অতিশয়।
পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা ফতুয়া পরেন
প্রায়শই; মাঝেসাঝে শার্ট আর ট্রাউজার দিব্যি
শোভা পায় ক্ষয়িষ্ণু শরীরে তার। লোকে বলে রোদ্দুরে ভেজেন
তিনি আর তুমুল বৃষ্টিতে খটখটে।
লোকটা গভীর রাতে, কোনও অতি-কৌতূহলী
প্রতিবেশী বলে, খুব পুরনো একটি খাতা খুলে
আবিষ্কারকের মতো কী যেন খোঁজেন ঘুমটুম
বেজায় হারাম করে। কোনও কোনও রাতে কতিপয় প্রতিবেশী
কান পেতে শোনে ফিসফিসে কথা বিভিন্ন কণ্ঠের। কারা তারা?
কী ভাষায় বলে কোন কথা? লোকটা নিজেই
বোঝেন না বহু কিছু-এতটুকু বোঝে
প্রতিবেশীগণ তার মুখভঙ্গি দেখে।
রাত্রির তিমির মুছে গেলে কাঁচা রোদের চুমোয়
লোকটার ঘরে কয়েকটি চিত্রকল্প খুব অন্তরঙ্গতায়
এদিক ওদিক ঘোরে, কোনও কোনও পঙ্ক্তির ছন্দিত
ছায়া কাঁপে আলোকলতার মতো একটি লুকানো
অনেক প্রাচীন এক খাতার পাতায়। এইসব
পুশিদা অস্পষ্ট টুকরো ছবি কারা রেখে যায়
যেগুলো ফুটিয়ে তোলা লোকটার দায় হয়ে পড়ে?
সঞ্চয় কেবলি বাড়ে, কিন্তু কীভাবে নিজেই জানেন না কিছু।
কিছুকাল পরে এক মধ্যরাতে লোকটা হঠাৎ ঈর্ষাতুর,
জুয়াড়ি মৃত্যুর ছলনায় কাঁচা মাটির গভীরে
চলে যান সীমিত শোকের জলে ভেসে। ক্রমে তার
কবরে সবুজ ঘাস, কিছু জংলি ফুল ফোটে। ইতস্তত
কয়েকটি প্রজাপতি ওড়ে আর কখনও পাখির গান জাগে
ওরা সব লোকটার না-লেখা কবিতাবলি জানবে না কেউ।
৫.৪.২০০০