কবি লিখে যান জয়গাথা
মুদ্রিত তথ্যানুযায়ী জানি লোকটার জীবনের
প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মিশেছে ধূসর গোধূলিতে। ছিল না সে
কারও সাতেপাঁচে, লাঠি দিয়ে
মারেনি মাথায় বাড়ি কোনও মানবের
অথবা কখনও তাক করেনি বন্দুক
কারও বুক লক্ষ করে, এমনকি পাখিরও জীবন
করেনি হরণ কোনওকালে। যতদূর জানি,
আজ অব্দি প্রাণীহত্যা স্বচক্ষে দেখেনি, বরং সে
রেখেছে দু’হাতে মুখ ঢেকে,
যখন বাড়ির কাছে পশুর গলায় ছুরি চালানো হয়েছে।
বস্তুত লোকটা তার জীবন কাটালো বই পড়ে,
এবং কবিতা লিখে। অসুস্থতা বাগে পেয়ে তাকে ইদানীং
এদিক সেদিক থেকে নিচ্ছে প্রতিশোধ দীর্ঘকাল
নিয়মভঙ্গের শাস্তিস্বরূপ; লোকটা কিছুতেই
একরত্তি শান্তি কিংবা স্বস্তি আজ পাচ্ছে না নিজের ঘরে বসে
অথবা বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে খানিক। বাড়ি আর
খোলা পথ দুটোই বিপদাচ্ছন্ন হন্তারকের সহিংস
নিঃশ্বাসে, অস্ত্রের স্বৈরাচারে। হায়, এই তো জীবন লোকটার!
লোকটা প্রায়শ পৌরাণিক সাগরের
জলে জাল ফেলে তুলে আনে আশ্চর্য রঙিন কিছু মাছ,
খাতার পাতায় লেখে পীড়িত চোখের তীব্র বাধা সত্ত্বেও মনের
মুক্তির মুক্তোর দীপ্তি, প্রেম, কল্যাণ ও প্রগতির কথা।
তবু তার প্রাণনাশে লিপ্ত কতিপয় সভ্যতা-বিদ্বেষী লোক হানা দেয়,
ঘরে তার হানা দেয় মারণাস্ত্র নিয়ে।
চকচকে কুঠারের আঘাত দৈবাৎ ফস্কে যায়,
প্রাণরক্ষা পায় লোকটার। ভয়ঙ্কর এ ঘটনা
মুশকরার খোরাক হয়েছে কোনও পশ্চাৎপদ অধ্যাপক
এবং সম্প্রতি গোঁফ-গজানো ক’জন
মিহি পদ্যবাজ আর সত্তাময় শ্যাওলা-জড়ানো লোকদের। তবু কবি
অবিচল; নতুন যুগের সূর্যোদয়ে লিখে যায় জয়গাথা।
৫.১.২০০০
কোনও এক মধ্যরাতে
নিদ্রার নদীতে নিঝুম ভেসে যাচ্ছিলাম একটানা
প্রগাঢ় নিশীথে। হঠাৎ আশ্চর্য নিঃশব্দ
কলরবে জেগে উঠি। ঘরে নিশুত শয্যায় একলা
আমি, আশেপাশে কেউ নেই, তাহলে
এই শব্দহীন শব্দের উৎস কোথায়? বিস্ময়-বিহ্বল আমি
কান পাতি নিশীথের হৃৎস্পন্দনে।
আমার শ্রুতিতে ভেসে আসে কিছু কথা। কথাগুলো
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। সেসব
কথা উঠে আসছে আমার বড় বুকশেলফ্ থেকে।
কয়েকটি হৃষ্টপুষ্ট পুস্তক কথোপকথনে
দিব্যি মেতে উঠেছে, বুঝতে কষ্ট হলো না
আমার। ওদের অধিকাংশ বাক্যবাণের
লক্ষ্যবস্তু আমি। একটি গম্ভীর গ্রন্থ ততোধিক
গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘লোকটা অন্য কোনও শখের জিনিস
না কিনে, রেস্তোরাঁয় এটা সেটা খেয়ে পয়সা
না উড়িয়ে আমাকে চড়া দামে সেই কবে নিয়ে এসেছে
অথচ আজ অব্দি আমার পাতাগুলোয়
ভ্রমণ না করেই রেখে দিয়েছে। জ্ঞান সঞ্চয়ের
কোনও চেষ্টা করেনি। আহা,
ভারি আফসোস হয়, লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে।‘
আরেকটি ভারিক্কি পুস্তক গমগমে কণ্ঠস্বরে
আধবোজা চোখ সামনের দিকে রেখে বলে, ‘যথার্থ
বলেছ ভায়া, এই দেখ, আমাকেও দূরে
ঠেলে রেখেছে ক’বছর ধরে। অথচ
ওই যে দেখছ টিঙটিঙে কিংবা মাঝারি সাইজের,
কয়েকটি মোটাসোটাও বটে, কবিতার কেতাব, সেগুলো
দোকান থেকে এনেই দিব্যি পড়ে ফেলে
মশগুল হয়ে। একবার দু’বার নয়, বারবার। কী জ্ঞান যে
লোকটা পায় সেসব পুস্তকে, সে-ই জানে। লোকটার
আক্কেল দেখে মেজাজ ঠিক রাখাই মুশকিল।
হঠাৎ আমার পাশে-রাখা বইটির শরীরের স্পর্শ পাই;
ঘুমোবার আগে নেরুদার কবিতা পড়ছিলাম,
মনে পড়লো। অস্বীকার করবো না, কবিতার প্রতি
আকর্ষণ আমার অধিক। তা বলে অন্যান্য জ্ঞানের
আভাময় বই আদৌ উপেক্ষণীয় নয় আমার কাছে। জানি না,
বুকশেলফে সাজানো গুরুগম্ভীর পুস্তকরাজি
আমার প্রকৃত মনোভাব বুঝতে পারে কিনা। তাদের
সঙ্গেও খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠবো, যদি না মৃত্যু চুরি করে নিয়ে যায় আমাকে।
২৫.০১.২০০০
ক্ষণিকের দেখা
একটু পরেই লোক পাঠাবে শামীম কবিতার
জন্যে, আমি তার পথ চেয়ে আছি। অথচ কবিতা
দূরে, বহুদূরে মেঘ হয়ে আছে, ঝুলে
আছে আলগোছে শাখাহীন।
এখন আমি কি চুপচাপ গৃহকোণে
একলা থাকবো বসে নড়বড়ে চেয়ারে আমার? নাকি শার্ট
আর ট্রাউজার পরে পুকুরের ঘাটে
দাঁড়াবো খানিক ফুরফুরে
হাওয়ায় কিছুটা
বেঁচে থাকবার জন্যে কবিতার চুল টানা কিংবা
কানমলা থেকে? না, এভাবে
পালানো নিশ্চিত অনুচিত একেবারে। কথা দিয়ে
কথাকে হঠাৎ অক্ষরের গিলোটিনে
ফেলে চলে যাওয়া
কবিকে কাদায় ফেলে হৈ-হুল্লোড় ছাড়া কিছু নয়।
এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অকস্মাৎ চোখে পড়ে-
একটি সুনীল হ্রদে একজন নারী
পূর্ণিমার মতো পূর্ণ নগ্নতায় স্নান করে।
অথচ আমি তো একা নিজের ঘরেই বসে আছি
কেমন বিক্ষিপ্ত মনে। সে নগ্নিকা কী কোমল উঠে
আসে তীরে, আমার দিকেই চলে আসে নিরিবিলি,
‘ভয় নেই, কবিতা তোমার অন্তরেই
এখন মুদ্রিত; শুধু লিখে নাও সফেদ কাগজে,
প্রতিশ্রুতি রক্ষা হবে একটু পরেই। শোনো কবি,
এখন ঘরের বইপত্র, খাতা, ছবি-সবকিছু ভুলে যাও,
শুধু মনে রেখো,
চকিতে আমাকে তুমি ক্ষণিক দেখতে পেয়েছিলে!
২৫.৩.২০০০
গাছ, কফিন এবং নৌকা
একজন কাঠুরেকে স্বপ্নাদ্য একটি গাছ টানে
এবড়োথেবড়ো জমিনের সীমানায়,
যেখানে গাছটি অনাদরে উপেক্ষায় বেড়ে উঠে
মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে,
যেন বীর কর্ণ, যার রথের ভাস্বর চাকাদ্বয়
দেবে যাবে মাটিতে। কাঠুরে কুঠারের
আঘাতে আঘাতে গাছটিকে
কাঠে রূপান্তর করে ঘর্মাক্ত শরীরে।
একজন কাঠের মিস্তিরি বসে থাকে কয়েকটি
কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে।
সে তার নিজের ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে
কাঠের উপর আর তিনটি খেয়ালী দাঁড়কাক
ছায়াটিকে দ্রুত খণ্ড খণ্ড করে ধারালো চঞ্চুতে, ছায়াটির
বিলাপে মিস্তিরি কফিনের রূপ দ্যাখে, অবশেষে
তার শিল্পদক্ষতায় গড়ে ওঠে সাধারণ একটি কফিন
যার শূন্যতায় দীর্ঘশ্বাস, মরীচিকা, মর্সিয়ার পূর্বাভাস।
কফিনে পুরলো ওরা, ঘাতকেরা, তাঁকে
অবহেলা আর অশ্রদ্ধায়,
অথচ মহত্ত্ব আর অমরত্ব, তাঁর দুই সহচর, তাঁর
উদ্দেশে করল নিবেদন অপরূপ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঘাতকেরা সে কফিনটিকে
নিষিদ্ধ দ্রব্যের মতো পাচার করতে চেয়েছিল
বিস্মৃতির বিয়াবানে আর সে কফিন
অলৌকিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশাল
সন্তরণশীল নৌকা হয়ে ভাসমান সবখানে।
কাঠুরে ও কাঠের মিস্তিরি জনতার
বিপুল তরঙ্গে মিশে সবিস্ময়ে নৌকার আড়ালে
একটি সুদীর্ঘ গাছ, একটি কফিন
দেখে বুকে একরাশ উজ্জ্বলতা নিয়ে ঘরে ফেরে।
১৩.৮.৯৬