একটি প্রাচীন গ্রন্থ
একটি প্রাচীন গ্রন্থ কী নিঝুম শুয়ে আছে একা
নিশীথে টেবিলে, যেন তার
দু’চোখে ছিল না ঘুম বহুকাল। পুরনো নিদ্রার ঘ্রাণ
বুঝি বা ছড়ানো সারা ঘরে; সে কি ক্ষণিক তুলেছে
হাই কিংবা আড়মোড়া ভাঙলো খানিক
না কি কিছুক্ষণ
আছাড়িপিছাড়ি করে ঢলে পড়ে ঘুমে। অকস্মাৎ
প্রাচীন গ্রন্থটি যেন কারও মুখ হয়ে তীক্ষ্ণ
তাকায় আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে। পুস্তকের
পাতাগুলি কোথায় গায়েব হলো চোখের পলক
পড়তে না পড়তেই? বই থেকে জেগে-ওঠা মুখমণ্ডলের
জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে চতুর্দিকে।
টেবিল টেবিল নয় আর, যেন কোনও সাধকের
ধ্যানমগ্ন উদার আসন, যাতে ঠাঁই পেয়ে যাবে
সারা বিশ্বাব্রহ্মাণ্ড এবং
যদি স্বর্গ সত্য হয়, তা-ও। জ্যোতির্ময় সেই মুখ
রেখেছে আয়ত দৃষ্টি তার বিস্মিত আমার দিকে, ধীরে
আওড়ায় কিছু পদ উদাত্ত নিবিড় কণ্ঠস্বরে
আর কোনও নির্দেশ ছাড়াই
আমার নিজের উচ্চারণ তার উচ্চারিত শ্লোক
হয়, হয় প্রতিধ্বনি। ক্ষণকাল পরে
টেবিলের দিকে যাই, যা এখন সাধকের বিমূর্ত আসন!
প্রাচীন গ্রন্থটি খুঁজি তন্ন তন্ন করে। ক্লান্ত চোখে দেখি
হঠাৎ কোত্থেকে সেই পুশিদা পুস্তক
আমার কম্পিত হাতে এসে যায়, পাতা উল্টে-পাল্টে
পড়তে ভীষণ ব্যর্থ হই, বর্ণমালা, ভাষা, সবকিছু
অচেনা, রহস্যময় আগাগোড়া, অনন্তর কেতাব উধাও,
শুধু এক অপরূপ সুর গুঞ্জরিত হতে থাকে ঘরময় মধ্যরাতে।
৩০.১২.৯৯
একটি মামুলি সংলাপ
আমি কি আসতে পারি আপনার কাছে
এ মুহূর্তে? অবশ্য আপনি অনুমতি না দিলেও
বেজায় অপ্রতিরোধ্য আমার এ আসা। কোনও দক্ষ
চতুর পাহারাদারই পারবে না কিছুতে আমাকে
আটকে রাখতে, যদি ইচ্ছে হয় আপনার এই
অন্দরমহলে ঢুকে আপনাকে শৈত্যপ্রবাহে আচ্ছন্ন করে রাখবার।
কোনও চ্যাঁচামেচি, কোনও তিরস্কারই কাজে
আসবে না, এমনকি সব হাতিয়ার ব্যর্থতায় ভীষণ লজ্জিত হবে।
কে তুমি বেয়াড়া লোক, যে আমার সঙ্গে এমন ধৃষ্টতা
দেখাচ্ছো নিঝুম শেষরাতে? ঝাঁঝাঁ শীত
দারুণ আক্রোশে ঠোকরাচ্ছে অস্তিত্বের হাড়মাংস,
তুমি আচানক ঘরে পা রাখার পর থেকে। দোহাই তোমার,
আমাকে রেখো না ধন্দে আর,
মুখোশ সরিয়ে নাও মুখ থেকে, তোমার অচিন
কণ্ঠস্বর কিছু চেনা মনে হয়, যেন স্বদেশে শুনেছি এই
ছায়া-স্বর বহুবার, অথচ এমন
হিমেল ছিল না দূর এই প্রবাসে যেমন আজ
একা ঘরে। বলো, অনাহূত
কে তুমি অতিথি, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার,
মুক্ত করো সুতীক্ষ্ণ শীতল কুয়াশার জাল থেকে।
পূর্ণ মুক্তি পাবেন কি পাবেন না বলা মুশকিল,
তবে বলি অসঙ্কোচে, কবি আর দার্শনিকগণ
আদ্যকাল থেকে আমাকেই আলো জ্বেলে
অতি কালো নিঃসঙ্গতা বলেই শনাক্ত করেছেন।
২.৫.২০০০
এরকম ওপরে ওপরে নয়
এরকম ওপরে ওপরে নয়, অনেক গহনে
ডুব দিলে যা চেয়েছে এতকাল তুমি
পেয়ে যেতে পারো। ওপরের
স্তরে রয়ে গেলে ভেসে ভেসে যা তুমি মুঠোয় তুলে
নিচ্ছ নিত্যদিন,
আসলে এসব অতি তুচ্ছ, বলবার মতো কিছু
নয়; বুঝি তাই
সবাই তোমাকে ব্যর্থ, বড় ব্যর্থ বলে
উপহাস করে খুব। মাথা নত করে
তুমি উহাদের ব্যঙ্গ, রূঢ় পরিহাস স’য়ে যাও।
তোমাকে সইতে হবে নানা বাক্যবাণ,
ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো হয়ে যাবে অন্তর তোমার
অগণিত হুল আর তীরের আঘাতে। তবু এই
পেরেক-ছড়ানো পথে খালি পায়ে হেঁটে যেতে-যেতে
অজস্র হোঁচট খাওয়া, পা শোণিতে ভিজে-যাওয়া, শ্বাপদের তাড়া-
ইত্যাদি না সয়ে বসে পড়লে হঠাৎ মধ্যপথে
অথবা সাঁতার বন্ধ করে দিলে মাঝ গাঙে, তুমি
সার্থকতা থেকে দূরে, বহুদূরে থেকে যাবে। জানবে না, অনেক গভীরে
কী ছিল রহস্যে ঢাকা, যার
সন্ধানে অসংখ্য পথচারী আর অক্লান্ত ডুবুরি
মাইল মাইল পথ হেঁটে যায়, জলে ডুব দেয় বারবার।
ওয়াহিদুল হকের জন্যে
বান্ধব, তোমার কথা ভাবলেই এই বাংলার
পথঘাট, উদার প্রান্তরে, নদী, দিঘি, খালবিল,
পালতোলা নাও, ফিঙে শ্যামা পাখি, গ্রামীণ দুপুরে
ঘুঘুর উদাস ডাক, জ্যোৎস্নারাতে বাউলের হাতে
ঝঙ্কৃত দোতারা, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের গান
আর দেশবিদেশের সঙ্গীতসাধকদের দীর্ঘ
সাধনার রূপ জেগে ওঠে চিদাকাশে। কী ক’রে যে
নিজের ভেতরে তুমি সবকিছু করেছ ধারণ-
এ এক বিস্ময় আজও আমার নিকট। সত্য, শিব,
সুন্দরের ধ্যানে কাটে তোমার প্রহর নিত্যদিন;
তোমাকে করেনি স্পর্শ সাম্প্রদায়িকতা কোনওকালে।
প্রগতি প্রবল টানে তোমাকে এবং এই বিশ্ব-
মানবের কল্যাণ তোমার কাম্য, তাই তোমাকেই
শ্রদ্ধাঞ্জলি দিই, দিই ভালোবাসা, হে সুরসাধক।
কখনও আগুনে পোড়ে
তবে কি এখন হাল ছেড়ে দেবো? যখন তখন
শ্বাপদের পদশব্দে কেঁপে ওঠে বিবর্ণ প্রহর, পতনের
কর্কশ আওয়াজ চেতনাকে প্রায় ভোঁতা করে দিতে
চায় দিনরাত; দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে।
বুঝি না কে আততায়ী, কেই বা ত্রাণের মুদ্রা নিয়ে
অদূরে দাঁড়ানো? ফিস্ফিস্, কানাঘুষো
চতুর্দিকে; অন্ধকারে বস্তুত যায় না দেখা কিছু, কে যে কোন
পক্ষে সমর্পিত
বোঝা ভার এ মুহূর্তে। সবাই তো মিত্রের ভঙ্গিতে
কাছে আসে, অথচ শক্রতা
সাধনে বেজায় দড় অনেকেই, ঘাড়
মট্কে রক্তপানে অভিলাষী। কাছে দূরে কেবলি পাগলা ঘন্টি।
পথঘাটে, সুদৃশ্য দোকানপাটে, ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে লোকজন
বড় বেশি সমার্পিত পরকালে, স্বসৃষ্ট ধোঁয়াটে
ঘূর্ণাবর্তে ঘুরে মরে অহর্নিশ। যারা এই পথ
থেকে দূরে হাঁটে, শুধু চেনা
পৃথিবীর রৌদ্রছায়া, জোনাকি, শিশির, ঘাসপাতা, গ্রন্থগীত
দোয়েল, কনকচাঁপা-নারী ভালোবেসে
সুখী হতে চেয়ে তারা হতেছে লাঞ্ছিত পদে পদে,
কখনও আগুনে পোড়ে, কখনও বা ক্রুশবিদ্ধ হয়।
৬.১২.৯৬