শিরোপা
জনস্মৃতি থেকে উঠে-আসা
বহু লোককাহিনীর একটি এরূপ-
একদা সুফলা এক রাজ্যে দিকে দিকে
রটে গেল এই বার্তা, রাজা আর তার
সভার অমাত্যবৃন্দ ছাড়া কে সবচে’ ঐশ্বর্যশালী
তার বিচারের ভার অর্পিত দানেশমন্দ এক
প্রবীণের ওপর, ফলত এইমতো
একদিন শুরু হলো বহুপ্রতীক্ষিত সে বিচার।
লোক থৈ-থৈ বিচার-সভায় সমাসীন বিচারক,
প্রবীণ দানেশমন্দ; সেখানে এলেন একে একে
তিনজন সর্বাপেক্ষা বেশি ঐশ্বর্যের দাবিদার।
প্রথমজনের দাবি-সাতটি জাহাজ তার ভাসে
সপ্তসিন্ধুময় বাণিজ্যের টানে, টাকার পাহাড়
গড়েছেন তিনি সুখে নানান বন্দরে।
তার চেয়ে অধিক ঐশ্বর্যশালী নেই কেউ এই নগরে।
দ্বিতীয়জনের পদক্ষেপ ছিল খুব
ঠিকঠাক এবং গম্ভীর, তিনি বটে অগণিত
পুস্তকবিহারী আর টীকাভাষ্যে তার
জীবনের প্রতিটি প্রহর ভরপুর, ফলে তিনি
নারীর প্রণয় তুচ্ছ করে ঘর-গেরস্থালি
বিসর্জন দিয়ে থেকেছেন বিদ্যাপীঠে আর মাঠে
আজীবন; এখন এমন জ্ঞান-তাপসের দাবি-
কেবল তিনিই সর্বাধিক ঐশ্বর্যের অধিকারী।
অতঃপর বিচার-সভায় একজন আলাভোলা,
ঈষৎ বিব্রত লোক বলে নম্রস্বরে,
‘আমার জীবন লগ্ন শব্দরাজিতেই,
দেখুন আমার মুখে পায়রা, দোয়েল, বুলবুলি,
গোলাপ, মালতী, নিশীথের পথরেখা, নদনদী
জলকন্যা, বনরাজি, নক্ষত্রের ছায়া;
আমাকেই ভালোবেসে ভালোবেসে একজন নারী
প্রাণ দিতে প্রস্তুত, আমার কোনও দাবি-দাওয়া নেই।‘
প্রবীণ দানেশমন্দ বিচারক প্রত্যেকের কথা শুনে শেষে
নীরবে তৃতীয়জনকেই সর্বাধিক
ঐশ্বর্যবানের কাঙ্ক্ষনীয়
শিরোপা অর্পণ ক’রে নগ্নপদে হেঁটে যান দূরে, বহুদূরে।
১০.৯.৯৬
সপ্তর্ষিমন্ডল
কিশোরটি কেমন আলাদা যেন, হৈ চৈ থেকে দূরে
নিজেরই ভেতরকার অত্যন্ত সবুজ মুক্ত মাঠে হামেশাই
হুটোপুটি নয়, খুব আস্তেসুস্থে হেঁটে কিংবা মাঠের কিনারে
সহজে কাটিয়ে দিত একা-একা বহুক্ষণ ক্ষুৎপিপাসার
কথা ভুলে, কোনও কোনও মধ্যরাতে কিশোরের বিস্ফারিত চোখে
হঠাৎ পড়তো ধরা অপরূপ দৃশ্য এক-সে মাঠের মধ্যস্থলে বেশ গোল হয়ে
সাতজন কি নিবিড় স্থৈর্যে বসে আছেন যাদের ঘিরে ক’জন ঝাঁঝালো
নর্তকী ফোটায় নৃত্যকলার কলম শূন্য মাঠে। সাতজন
দেখেন কি দেখেন না, বোঝা দায়। কখনও কিশোর মুগ্ধতায়
লক্ষ করে, তারা যেন কী এক সুরায় ডুবসাঁতারে নিমগ্ন।
যখনই কিশোর মধ্যরাতে নিজের ভেতরকার মুক্ত মাঠে
সেই সাতজনের মণ্ডল দেখে, সে এক চকিত যাদুবলে
আশ্চর্য সৃজনশীল হয়ে ওঠে, কিছু ছবি আঁকে, ঝকঝকে
পদ্য লিখে ফেলে আর নিজেই বিস্ময়ে রুদ্ধবাক
হয়ে থাকে কিছুদিন। এ খেলায় ছিল না বিরাম বহুকাল
কিশোরের বার্ধক্য অবধি। অকস্মাৎ সবুজ সে মাঠ আর
অপরূপ গভীর রাতের সাতজনের আসর লুপ্ত হলো
হামেশার তরে আর দর্শকের সৃজনের সূর্যাস্ত এলো নেমে চিরতরে।
১২.৪.২০০০
সহমর্মিতা
আমাকে বিষণ্ন দেখে একটি অচিন পাখি এসে
নিঃশব্দে টেবিলে বসে নিশ্চিন্ত মুদ্রায়,
যেন তার কোনও ক্ষতি করবে না কবি, ভাবনাটা
এরকম। আমার মাথায় ওড়ে বহুদিনকার
তেলহীন চুল, নিরুনির স্পর্শ আজ
পড়েনি, পাখিটি দ্যাখে খুঁটিয়ে আমাকে।
পাখিও আমারই মতো ব্যথিত, একাকী
একজন, তারও আছে কিছু
বলবার কথা, যা গাছের
সবুজ পাতায়, মেঘে, রাঙা গোধূলিতে লেগে আছে।
যার সঙ্গ জীবনকে মোহনীয় করেছে, এখন
সে এখানে নেই-
এ-কথা পাখিটি নীলিমার, নক্ষত্রের
কাছ থেকে সহজে নিয়েছে জেনে, বুঝি তাই এসে
বসেছে টেবিলে সহমর্মিতার ভাষা
ঠোঁটে নিয়ে; বড় মানবিক আজ মনে হলো তাকে।
পাখিটির একাকিত্ব স্তব্ধ হয়ে রয়
আমার আপন ঘরে, টেবিলের কাঠে আর সাদা
বুকশেলফের পূর্ণতায় কবেকার
কিছু স্মৃতি খণ্ড খণ্ড কাহিনী ধারণ
করে আছে, পাখি
সেগুলো ডানায় নিয়ে উড়ে যাবে নক্ষত্রের দিকে-
কিছু মেঘে, কিছু সরোবরে
চূর্ণিত রইবে মিশে হাহাকার ব্যাপক ছড়িয়ে।
হরিণ এবং শজারু
এমন এক সময় ছিল যখন আমি বাড়িতে,
বলতে গেলে, থাকতামই না। সদর
রাস্তা, অলি-গলি পেরিয়ে যেতাম ঝাঁ ঝাঁ
দুপুর চাষ করতে করতে। প্রতিবার
নতুন রাস্তার সন্ধানে
চোখ চকচক করতো। স্বপ্নগুলোকে
গচ্ছিত রাখতাম পার্কের ঘাসে,
পথের কুকুরের কুণ্ডলী পাকানো নিদ্রায়।
এখন ঘরেই কাটে সময়। তন্দ্রা
চোখের পাতায় নেমে এলে হঠাৎ দেখি
চান্দ বিনোদ শিকার-করা কুড়াপাখি
আমার কাছে বিক্রি করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
আমি ধমকের স্বরে ওকে বলি, স্টুপিড,
এক্ষুণি পালার নায়ক
কুড়াপাখির বোঝা বয়ে জলের ঘাটের দিকে এগোয়।
বিকেলবেলা চায়ের পেয়ালায়-চুমুক দেয়ার সময়
এক বিদ্যার জাহাজ অধ্যাপকের একটি প্রবন্ধের
কথা মনে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠি।
গোধূলিতে লক্ষ করি, একটি কর্দমাক্ত
শজারু একজন হরিণকে খুব উত্যক্ত ক’রে
কাদায় টেনে নিতে চাইছে। অজস্র তারা
হরিণের চারপাশে ঝরতে থাকে এবং
শজারু থকথকে কাদায় মুখ ঢাকে।
২৪.৪.৯৬