ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য নিয়ে
পুলকিত বেড়ালের ঘাড়ের রোঁয়ার মতো মেঘ
আকাশকে আদর করছে দেখে আমার ঘরের
জানালাটা কেমন মদির চোখ দিয়ে
অনুরাগ পৌঁছে দিতে চায়
পাশের গাছের মর্মমূলে। অকস্মাৎ গাছটির
অস্তিত্বে মধুর আলোড়ন
এবং নিবিড় জাগরণ শূন্যতার
স্তব্ধতায় একরাশ ফুলের সুরের, কোকিলের
তানের সংগত। জানালাটা যেন ওর
বিবর্ণ প্রবীণ সত্তা ভুলে স্বপ্নাবেশে ভেসে যায়।
জানালার কাণ্ড দেখে অবাক হইনি মোটে, শুধু
চেয়ে থাকি আকাশপাতাল ভেবে ভেবে
গাছটির যৌবনের প্রেমময় রাগিনীর মতো
সংহত উচ্ছাস লক্ষ করি, হৃদয়ের
অনেক গভীরে ভেসে ওঠে একটি ময়ূরপঙ্খী নাও,
কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর মাছ, কামিনীর হাতে
প্রস্ফুটিত অজস্র গোলাপ, তিনজন
কোকিল কাউকে ডেকে আনার তাগিদে
ক্রমাগত সুর হয়ে প্রবল নাচিয়ে তোলে ময়ূরপাঙ্খীর
ইতিহাসটিকে, আমি সেই ইতিহাসে
কী করে যে মিশে যাই, হয়ে উঠি অন্য কেউ দূর
অতিদূর কোনও এক আলাদা কালের।
এ আমি কোথায়, হায় কোথায় এলাম? অতিদূর
হলেও সুদূর নয়। খরাপীড়িত চৌচির ধুধু মাটি, যেন
একফোঁটা পানিও পায়নি বহুকাল। কোথাও কোথাও তার
প্রখর হলুদ ঘাস জেগে আছে ফাল্গুনের আগুনের মতো।
হলুদ ঘাসের অন্তরাল ভেদ করে
অজস্র কঙ্কাল জেগে আছে অনন্য উৎসবে এক, সবদিকে
অদৃশ্য হরফে যেন আছে লেখা বসন্ত-উৎসব। অগণিত
কঙ্কাল জাগ্রত খুব, করোটির চক্ষুহীন চক্ষু নিয়ে,
তাদের অত্যন্ত ঋজু শুকনো খটখটে হাড়ে আছে
অবিশ্বাস্য শস্যরাশি স্বপ্নের ধরনে আর মুঠোর ভেতর
বাংলার বসন্ত ঋতু দোলে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে এবং
দুলতে থাকবে ইতিহাসে নব্য ফাল্গুনের দীর্ঘ প্রতীক্ষায়।
৩.৪.২০০০
মহাপৃথিবীর রাগমালা
প্যারিসের জনস্রোত, যানস্রোত, ইতিহাস-দীপ্ত হর্ম্যমালা,
পথঘাট, মিউজিয়ামের ঘটা, বোবস্পীয়ার,
বোদলেয়ার ও জাঁ-পল সার্ত্রের নানা স্মৃতি-উন্মুখর
রেস্তোরাঁ, শেনের জলধারা থেকে দূরে সিমুরের
সবুজের অকৃপণ স্নেহস্পর্শে প্রকৃতি আপন অন্তর্বাস
অসঙ্কোচে উন্মোচন করে।
লোকটা এখানে ছিল কোনওদিন, ছিল
প্রকৃতির খুব কাছে, ঈষৎ আলাদা
পাথরের মাঝে ছিল দিনরাত, কেটে গেছে তার
জীবনের বেশ কিছু দিন ছেনি আর হাতুড়ির
তন্ময় আঘাত হেনে পাথরের বুকে খুঁজে নিতে সুন্দরের
নানা মূর্তি। গুহাবাসী মন গড়ে তোলে
পাথরেই নান্দনিক ভিন্ন রূপ মানসের আর কী বিপুল
সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকে নিত্য বেপরোয়া মাতালের মতো।
লোকটা দেখতে ছিল টাইটান, সুপ্রচুর খাদ্য আর
অঢেল মদিরা রোজ হতো জঠরস্থ
অথচ সচল ছিল প্রায় হামেশাই
হাতুড়ি ও ছেনি, চার বছরের প্রতি দিনরাত্রি একাকার
লোকটার। একটানা এভাবেই কেটে যায়
কয়েকটি আশ্চর্য বছর। অবশেষে একদিন অবেলায়
শিল্প নেয় বলি, টাইটানের প্রদীপ্ত দু’টি চোখ অতি শ্রমে
বুজে আসে, থেকে যায় বুকের স্পন্দন। আর সেই
বুভুক্ষু পাহাড়ি গুহা থেকে থেকে করে উচ্চারণ,
‘শিল্প তো আদায় করে কড়ায় গণ্ডায় তার সকল পাওনা’।
সে গুহায় এখন প্রত্যহ অনেকেই যায়, কখনও কখনও
শিল্পতীর্থ ভিড় জমে খুব; কেউ কেউ বাঁকা ধোঁয়া-ওঠা
চায়ের পেয়ালা কিংবা মদিরার গ্লাস হাতে সেই
গতায়ু শিল্পীর কথা বলাবলি করে, কেউ কেউ
নোট নেয় খবরের কাগজের অতৃপ্ত উদর
ভরাট করার জন্য। শিল্পীর বিধবা পত্নী কারও কারও হাতে
কটি গুহাচিত্র গুঁজে দেন
তাজা ব্যাঙ্কনোটের সহজ বিনিময়ে। দূরে পাখি কেঁদে যায়;
গুহাস্থিত পাথরের বুক চিরে কিছু
অনন্য ভাস্কর্য ক্ষণে ক্ষণে গায় মহাপৃথিবীর রাগমালা।
১২.৫.২০০০
যখন আমি
যখন আমি গোলাপ ফুটতে দেখি,
পথ চলতে চলতে
কোকিলের গান শুনতে পাই,
যখন রাতে অনেক তারার আলো জ্বলতে দেখি,
আমার মনে জাগে আনন্দের ঢেউ,
আমার খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়।
যখন আমি মেঘনা নদীর বুকে
নাওয়ের দাঁড় টানতে দেখি মাঝিকে,
যখন সর্ষেক্ষেতে গ্রাম্য কিশোরীকে রঙিন
প্রজাপতির দিকে ছুটতে দেখি,
যখন কৃষককে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে
জমিতে লাঙল চালাতে, বীজ বুনতে দেখি,
যখন চাষীর বউ শানকিতে লাল চালের ভাত,
কাঁচামরিচ আর নুন নিয়ে খেতে বসে,
যখন কুমোর আর কামার খেটে খেটে হয়রান হয়,
যখন একদল তরুণ-তরুণী
অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে মিছিল করে,
তখন আমি বাংলাদেশের হৃদয়ের ধ্বনি শুনতে পাই।
রঙধনু থেকে যাত্রা শুরু করে
তোমার নিকট থেকে ক’টি রাজহাঁস বহুদূরে
কোথায় মিলিয়ে গেছে, অথচ তোমার
সত্তার গহনে রয়ে যায় কতিপয় ঘন ছায়া
সবার অজ্ঞাতসারে। সেইসব ছায়া গভীর নিশীথে কত
কথা বলে রূপকথা-স্বরে
নিরিবিলি একান্ত তোমার কাছে-সেসব শোনার সাধ হয়।
কখনও সেসব কথা টলটলে উচ্চারণে ঠিক
বন্দী করা অসম্ভব। ঠারেঠোরে অথবা নিঝুম
কিছু প্রকাশের কুয়াশার কাছ ঘেঁষে আনা যায়
বেলাবেলি; মরণপুরীর কিছু শৈত্যছোঁয়া নিয়ে
বারবার নতুন জন্মের ঘ্রাণসহ
হ্রদের জলজ স্মৃতি ছুঁয়ে ছেনে জাগরণ
আমাকে বিহ্বল করে। অভিনব রঙধনু থেকে
যাত্রা শুরু করে আমি মানবীর নিরালা আলয়ে
সত্বর পৌঁছুতে গিয়ে দীঘল বিলম্ব করে ফেলি। তার হাতে
হাত রাখবার মগ্ন বাসনায় নিজের কাছেই পৌঁছে যাই।
শব্দেশ্বরীর গঞ্জনা
অপরূপ পারিজাত ঝলসাচ্ছে বহু দূরে, যাকে,
ছুঁতে পারবো না সুনিশ্চিত এ জীবনে, জেনে গেছি।
এবার আমার চাই অবসব। রাত জেগে জেগে ক্লান্ত আমি আজ,
আমার মাথায় এলোমেলো চুলে পড়ে ক্রূদ্ধ টান, চোখ
কচলাতে কচলাতে দেখি শব্দেশ্বরী জ্বলজ্বলে রূপ নিয়ে
দাঁড়ান আমার পাশে। বলেন উত্তপ্ত স্বরে, পারিসনি তুই
আমার পায়ের নখও ঠিকঠাক কাটতে, হাতের
দশ আঙুলের নখ আজ অব্দি তুই
একটিও দেখিসনি ছুঁয়ে, আমার মুখের সূক্ষ্ম
এবং দুরূহতম রূপচর্চার ব্যাপার আর
উল্লেখ নাই বা করি! শব্দেশ্বরীর বক্তব্যশেষে
অবসাদগ্রস্ত ব্যর্থ আমি তার সকল গঞ্জনা
মাথা পেতে নিই। দূরবর্তী পারিজাত
অনন্য রূপের আভা নিয়ে ক্রমে অধিক সুদূর হতে থাকে
এবং আমার ঘুম পায়, বড় বেশি ঘুম পেতে থাকে।
১২.৪.২০০০