- বইয়ের নামঃ শুনি হৃদয়ের ধ্বনি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ আনন্দগীতি
যে পাখি দেহের খাঁচায় নাচে, কখনও সখনও ঝিমায়,
প্রায়শ গান গায়, সে যে অচিন বড়, বেজায় খামখেয়ালী।
তার দিকে কেউ কেউ ঢিল ছুঁড়ে আমোদে গড়াগড়ি যায়,
কেউ কেউ তাকে লক্ষ করে কুড়ালের আঘাত হানে। অনেকেই
মশ্করা ভেবে তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দেয়। দেহঘড়ি কখন
তার ক্ষীণ আওয়াজ বন্ধ করে দেয়, এই দুর্ভাবনা লোকটাকে
বিষণ্ন করে। অথচ তাকে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, এখনই
থামলে খাতাটা বেজায় শূন্য থেকে যাবে। যেসব শব্দ বুক চিরে
বেরিয়ে আসার জন্যে ব্যাকুল, দিশেহারা ওদের আমি কীভাবে
আশ্বস্ত করবো? নিজেকে বড়ই বোকা-সোকা লাগে এবং
এক ধরনের অক্ষম প্রবোধ দেয়ার চেষ্টায় মেতে উঠি এই
ভঙ্গুর দেহ-খাঁচাটিকে আর না-লেখা কবিতাবলিকে। দুঃখের
মেঘগুলোকে সরিয়ে আমার মনের ভেতরকার নানা পথে
বিপথে আমার ঘুরাঘুরি, আতশবাজি পোড়ানো, আন্ধারে
প্রদীপ জ্বালানো। প্রিয়জনদের ছেড়ে যেতে ভারী কষ্ট হয়
দেহখাঁচার পাখিটার। কান্না পায়, অথচ গাইতে হয় আনন্দগীতি।
১৪.২.২০০
অর্ফিয়ুস হওয়ার জন্যে
এখন ঘন ঘন আমার চারপাশে আজরাইলের
চিরতরে দু’চোখ-বোজানো কৃষ্ণ ডানা
ঝলসে উঠছে। একে একে অন্তর্হিত হচ্ছেন
আমার চেনাজানা অনেকেই। তাদের
কেউ কেউ খুবই ঘনিষ্ঠজন। এই তো সেদিন সেই
কৃষ্ণ ডানা আমাকেও ঝাপ্টা মারতে চেয়েছিল। এবার
ফাঁড়া কেটেছে, আবার কবে ডানা ছড়িয়ে
হাজির হয় আজরাইল, কে জানে!
মিস্টার ডেথ, জনাব মওত সম্প্রতি
আমার কথাবার্তায় এবং লেখায়
ঘুরে ফিরে আসছেন বলে আমার মনোনীতা
বেশ রুষ্ট, অভিমান-ক্ষুব্ধ। আমার এই মনোভাব
তাকে আহত করে, তখনও বা করে বিষণ্ন। সে আমার
কণ্ঠ, কলমে তার জীবনের গান, প্রাণে
আনন্দধ্বনি শুনতে আগ্রহী। জীবনের বন্দনা
আমার ভেতর অনিন্দ্য সুর হয়ে বেজে উঠুক,
এ তার একান্ত কামনা। তার আপন কবির কবিতায়
মর্গ অথবা কবরের গন্ধ পেতে চায় না।
তার এই মনোভঙ্গি আমাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে
ফিরিয়ে এনেছে কঙ্কাল, অমাবস্যাময় রাতের
গোরস্তান এবং আজরাইলের রক্তহিম-করা
তুষারাবৃত দৃষ্টি থেকে। আমি এখন
দরাজ গলায় জীবনের দীপ্তি-ঝরানো গান গাইবার
সংকল্প গ্রহণ করেছি। আমার সময়
উৎসর্গ করব মানবের মহামিলনের বন্দনার প্রতি এবং
পুতিগন্ধময় নালাকে রূপান্তরিত করবো
খরস্রোতা নদীতে। একালের অর্ফিয়ুস হওয়ার
সাধনা আমার চেতনায় নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান।
৪.১.২০০০
আমার পূর্বপুরুষগণ
শুনেছি, আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন
বেশ লম্বাচওড়া। আমার বাবাকে দেখেছি
মাথা উঁচু করে পথে দীঘল ছায়া ফেলে যখন
হেঁটে যেতেন, দাঁড়াতেন আমাদের
গ্রামের বাড়ির পুকুরের ধারে, তখন সবাই
তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।
এখন তিনি ঘুমিয়ে আছেন পাড়াতলী গ্রামে
তাঁর বাপদাদার পাশাপাশি
আমাদের গ্রামাণী পারিবারিক কবরস্তানে,
আমি কখনও কখনও পূর্বপুরুষদের কবরের কাছে দাঁড়াই।
আমার পূর্বপুরুষগণ পুকুর কাটিয়েছেন,
মসজিদ তৈরি করেছেন,
প্রতিষ্ঠা করেছেন ইশকুল, লাগিয়েছেন অনেক ফলের গাছ।
আমার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন
সত্যিকারের উদার এবং পরোপকারী। তাঁদের
কথা স্মরণ করলে
শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে আমার;
চলে যাই আলাদা কালে, শুনি কত যে পদধ্বনি।
এ তুমি আমাকে কোন্ হাটে
এ তুমি আমাকে কোন্ হাটে
হঠাৎ বসিয়ে দিলে? ছিলাম নিজস্ব শূন্য ঘাটে,
ফিকে অন্ধকার ছিল চক্ষুময়, থাকতেই পারে;
সেই অন্ধকারে
রাত্তিরে উঠুক জেগে জ্যোতির্কণা-তোমার নিকট
নিভৃতে চেয়েছিলাম। পট
আচমকা পাল্টে গেলে খটোমটো লাগে
সোফা সেট, দবিজ কার্পেট, অনুরাগে
ভরপুর মন বিরাগের কাঁটায় জখম হয়
ক্ষণে ক্ষণে, হতে থাকে শুধু হৃদয়ের তন্তুক্ষয়।
আসলে নিজেকে নিয়ে খুব জড়োসড়ো
থাকি একা, সামাজিকতায় নই দড়
সে রকম; কীভাবে করবো খুশি কাকে
সহজে বুঝি না। মেকি হাসি কিংবা স্তুতির তবকে
কাউকে নিভাঁজ মুড়ে ভণ্ডদের ঝাঁকে
মিশে যেতে অপারগ; চটপটে আর ঝকঝকে
কায়দায় খেল দেখাবার সাধ্য নেই
এতটুকু; ছন্নছাড়া এই
আমি আজ বরং লুকিয়ে থাকি স্বরচিত খোলে,
অন্যেরা থাকুক মেতে হৈ-হল্লা এবং ঢাকঢোলা।
তোমাকে দিই না দোষ, তোমার ভেতর
স্বাভাবিক প্রসন্নতা আছে,
ফলত তোমার এই ঘর
গোছানোর মতো কী সহজে রোজ সকলের কাছে
রমণীয়, প্রিয় হতে পারো। আমি মাটি
করে দিই সাজানো আসর,
সযত্নে লাগায় সুর তোমার মধুর কণ্ঠস্বর
ধূসর কর্কশতায়, সংলাপকে করো পরিপাটি।
অনেক আগেই জানি বড় বেমানান
আমি হাটে আর সাতবাজারে উদ্ভ্রান্ত ঘুরে ঘুরে
আখেরে ফেরার পথে উদাস কুড়াই
মুঠি মুঠি ছাই;
আমি কি তোমাকে ছোঁবো দিনশেষে? নীল
অন্তঃপুরে
থাকো তুমি ছায়াবৃতা। আমার হৃদয়-ছেঁড়া গান
তোমার উদ্দেশে বেদনার টানে ধায়;
চেয়ে দেখি, তোমার যৌবন ছুঁয়ে শীতের সুরুজ
অস্ত যায়।
২৮.০১.৯৬
একটি অপমৃত্যু
খাম ছিঁড়ে কোন্ খেয়ালে
চিঠিটা ফেলে দিয়ে দেখি হাতে খাম
নড়ছে হাওয়ায় এবং
বাজে কাগজের ঝুড়ি থেকে কেমন
আর্তনাদ উঠে এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে। মনে হলো,
সেই চিঠি শোক হয়ে ঝুলছে অক্ষর হারিয়ে।
হারিয়ে-যাওয়া অক্ষরগুলোকে
খুঁজতে থাকি এদিক ওদিক। হোঁচটা খাই
বারবার। টেবিলের কিনার ধরে
নিজেকে সামলে নিই। হারিয়ে-যাওয়া অক্ষরগুলো
আমাকে ঠোকরায় অবহেলিত
অস্তিত্বের জ্বালা জুড়োবার হিংস্রতায়।
ওদের জড়ো করে বসাই আমার টেবিলে,
কিন্তু কিছুতেই ওদের ঠিক গোছাতে
পারছিলাম না। একটা বিদঘুটে নক্শা হয়ে
ওরা আমার দিকে তাকায় বাঁকা চোখে,
যেন আমাকে খুব জব্দ করার প্রক্রিয়া
ওদের আয়ত্তে এসে গেছে। হেমন্ত-সন্ধ্যায় অচিন
কে পাখি ঘুরে ঘুরে ডাকে জানালা ঘেঁষে এবং
একটি কবিতার অপমৃত্যুর বেদনা ওর ডানায় কম্পমান।
১৯.১১.৯৬