সাঁতার
খরায় ছিলাম আমি দীর্ঘকাল, গূঢ় চাষাবাদ
হয়নি কিছুঁই ; ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরেছে এবং
ঘাম মুছে, বারংবার ছায়া খুঁজে এখানে সেখানে
গেছে বেলা কায়ক্লেশে। কখনো বিধ্বস্ত মূর্তি দেখে
চমকে উঠেছি কোজাগরী পূর্ণিমায়, রক্তে ছিল
মহরমী সুর সর্বক্ষণ ছিলাম উদাস বসে
বড় একা সর্বস্বান্ত ভূমিহীন চাষির মতন;
সন্ন্যাস পারিনি নিতে, যদিও সন্ন্যাসী এক করে
বসত আমার অভ্যন্তরে, জ্বালায় ধুনুচি আর
ফেলে যায় খড়কুটো, ছেঁড়া কানি, ভস্ম একরাশ।
অকস্মাৎ মধ্যরাতে দিগন্ত ডুবিয়ে কী প্রবল
বৃষ্টিপাত, জলে চোখ, মুখ, চুল খুব ফেটে-যাওয়া
ক্ষেতের মতন আর্ত হৃদয় আমূল ভিজে যায়
এ কেমন ব্যাপক কুহক এলো দু’কূল ছাপিয়ে?
মাথার উপর দিয়ে বয় জলধারা অবিরল;
চোরা টানে কোথায় চলেছি ভেসে? নানা জলচর
প্রাণী আসে ধেয়ে প্রতিষ্ঠিত হিংস্রতায়, হাবুডুবু
খাচ্ছি ক্রমাগত, কুটো নেই আশেপাশে, কোনো তীর
পড়ে না নজরে আর। তবে কি তলিয়ে যাবো শেষে?
কতকাল গেল, তবু আমি আজো সাঁতার শিখিনি।
সিঁড়ির পর সিঁড়ি
সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আমি অনেক দূরে।
দিন দুপুরে রাত দুপুরে
তন্ন তন্ন করে খুঁজি ঘরের পর ঘর।
চামচিকে আর টিকটিকিরা এদিক ওদিক
এলেবেলে করছে বেবাক
গেরস্থালি।
সিঁড়ির ধাপে, কুলুঙ্গিতে নজর রাখি, সারাবেলা
খেলতে দেখি শূন্যতাকে।
হঠাৎ কখন চমকে উঠি, শ্মশান ছেড়ে
চাঁড়াল কেন এখানে এই অন্ধকারে একলা দাঁড়ায়?
কাঁচাপাকা দাঁড়ি-ঝাঁঝাঁ তাড়ির রসে সিক্ত, এবং
চক্ষুজোড়া গোধুলিময় মিনি আকাশ।
কিন্তু কোথায়? যায় না দেখা তাকে এখন,
এক নিমেষে নিরুদ্দেশে দ্রবীভূত।
নিষ্প্রদীপ এই দরদালানে খুঁজছি আমি
স্বর্ণ প্রদীপ? তা নয়, তা নয়,
এমনতো নয়। বনকবুতর ছড়িয়ে গতর বসে থাকে
ফাঁক ফোকরে। হঠাৎ কেমন বাঁশির ডাকে
চট্কা ভাঙে। পানির নিচে
শ্বতপাথরের ভাঙা সিঁড়ি কোন পাতালে
নেমে গেছে? সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙে নামছি আমি,
উঠছি আবার, ঘুরছি
শুধু বারংবার।
কাছে-পিঠে জনমনিষ্যি নেইতো কোথাও নিজের কাছেই
নিজেকে আর মানুষ বলে
হয় না মনে।
অন্বেষণে আছি মেতে; কিন্তু কী-যে
অষ্ট প্রহর খুঁজে বেড়াই চক্ষুহীনের মতো আমি-
কার কাছে তার হদিশ পাবো?
সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে তাকিয়ে দেখি
এমন আঁধার শূন্য ক’রে
কোথায় গেল বাসিন্দারা? হাতড়ে ফিরি
একলা শুধু আশেপাশে,
যেন আমি অন্তবিহীন বন্দীদশায় পুরাণ-পুরুষ,
পায়ের কাছে মৃত ঈগল। নিজের নখে
ইতস্তত ছিঁড়ছি নিজের মাংসপেশী,
সোনার মূর্তির কাহিনী
একটি সোনার মূর্তি দেখি মেহগনি বাক্সটির
তালা খুলে কারো সহযোগিতাবিহীন
সহজে বেরিয়ে আসে এবং সম্ভ্রমবোধে সব
গাছপালা নত হয়, দশদিক থেকে অবিরত
ফুল ঝরে। সেই মূর্তি কিছুক্ষণ শরণার্থীদের
ভিড়ে মাথা নেড়ে, নিষ্পলক তাকিয়ে তাঁবুর চৌহদ্দিতে,
ঘুমে কাদা সান্নাটা বস্তির
আশে পাশে ঘুরে, কিছু প্রাক্তন বিবর্ণ ভোটকেন্দ্র, পৌরসভা,
চলে যায় প্রধান সড়কে।
সোনার মূর্তিটি
কখনো আমার কাছে কমলালেবুর রস চায়,
কখনো বা আমার হাতের
চেটোয় সহজে তুলে দেয় কিছু সুকান্ত অক্ষর,
যেমন নিপুণ যাদুকর চকচকে মুদ্রা দেয়
মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকের হাতে।
মোবারক মিস্তিরির ঘরে
সেই কবে থেকে লাশ পড়ে আছে একাকিনী, তাকে
বাস্তুসাপ স্নেহ করে আপাদমস্তক,-
মোবারক মেথর পট্রিতে খুব যাচ্ছে গড়াগড়ি
বেসামাল খেলনার মতো। পাঁশুটে চান্নির পানি
ভেঙে ভেঙে
নিঃসঙ্গ সোনার মূর্তি একবার লাশের নিকটে,
একবার মিস্তিরির কাছে যায়।
আমাদের এই প্রিয় শহর নিশুত রাতে আজ
আত্মহত্যা করবে নিশ্চিত ব’লে এক
উলঙ্গ উম্মাদ হেঁকে যায়
অলিতে গলিতে, তার চুলের জটায় মোরগের পালকের শোভা,
সে-কথা তোলে না কেউ কানে;
উম্মাদ কেবলি মাতে পুনরাবৃত্তিতে-
চায়ের ক্যান্টিন ছেড়ে বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারে চলে যেতে
তার কোনো দ্বিধা নেই,
এবং যুবক-যুবতীরা শ্লিপিং পিলের গাঢ়
অভিজ্ঞতা মেনে নেয়
অবলীলাক্রমে আর বুড়োরা ভীষণ কাশে,
ক্রমাগত ওগরায় প্রবীণ গয়ের,
সোনার মূর্তিটি রোবটের ভঙ্গিমায় লোকালয়ে
করে পর্যটন।
প্রকৃত মানুষ নয়, কতিপয় কর্কশ শকুনমুখো লোক
আমাদের জাতীয় পতাকাটিকে ঠোকরাচ্ছে সকল সময়।
এই মতো দৃশ্যাবলি দেখে
এই দশকের প্রমেথিউসের হাত
শেকল ছোঁড়ার গানে সঞ্জীবিত হয় পুনরায়।
সোনার মূর্তিটি
আমার উদ্দেশে অকস্মাৎ কিছু শ্লোক
উদাত্ত আবৃত্তি করে, যেন রত্নাকর
দস্যুর ভরাট কণ্ঠে বাল্মিকীর স্বর, নবজাত, অনশ্বর।
আমি শুধু, বিশ্বস্ত স্টেনোর মতো উচ্চারিত বাণী
টুকে নিই নোটবুকে, দেখি
মূর্তিটি গলতে থাকে, গলে গলে হয় লাভাস্রোত।
স্নায়ুর আঙুর
আনিনি এমন ভাগ্য, তার সঙ্গে কোনো এক প্রসন্ন বিকেলে
প্রকৃতি সাক্ষাৎ হবে ফের।
তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও প্রসন্নতা
কোথাও পাবে না কেউ ইদানীং। উপরন্তু সে-ও
নিরুদ্দিষ্ট বহুদিন থেকে
এবং তলিয়ে যাচ্ছি আমি একাকীত্বে ক্রমাগত।
কোনো কোনো বন্ধু মৃত, কেউ কেউ গড়েছে নিবাস
প্রবাসে উৎসাহভরে। এ শহরে যারা
করে বসবাস, তারা একে একে সরে যাচ্ছে দূরে।
যাদের আত্মীয় বলে জানি তাদের পরের চেয়ে
বেশি পর বলে মনে হয়। নির্মুখ ভিড়ের মধ্যে
নিদারুণ অসহায়ভাবে বড় একা থাকি আমি।
নিজস্ব ধরনে কিছু কথা নিচু স্বরে
হাওয়ায় ছড়িয়ে দিই। শ্রোতাহীন ঘরে একা একা
কথা বলা, এই কি নিয়তি?
কিছুই বিশ্বাসযোগ্য আজ মনে হয় না আমার,
কোথাও পাইনা শান্তি, দুঃস্বপ্ন-সংকুল
অন্ধ রাত্রি নেমে আসে, ফেটে যায় ক্রমাগত স্নায়ুর আঙর।