- বইয়ের নামঃ রৌদ্র করোটিতে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনুস্মৃতি
এমন একলা এই পথ, কোনোখানে সাড়া নেই
জনমানবের। বুঝি বাতাসের স্বরে
গলে গিয়ে মিশে যাবে আমাদের সত্তার সুরভি,
এমন নিঃসঙ্গ এই পথ!
‘এখানে আসে না কেউ’ তুমি বলেছিলে, ‘খরগোশ,
প্রজাপতি, জোনাকি অথবা ঝিঁঝি হরেক রকম
নানারঙা পাখ্পাখালি, কাঠবিড়ালী ছাড়া
এখানে আসে না কেউ। রৌদ্র ওঠে, মেঘ ফেলে ছায়া,
গাছাপালা আর্দ্র হয় বৃষ্টির আদরে। আর দ্যাখো
সোনালি-হলুদ ফুল গুচ্ছ অর্পিত স্তবকে
বিন্দু বিন্দু আনন্দের সমবায় শুধু।
তোমার পায়ের নিচে শুক্নো পাতাগুলো
উঠল বেজে, তুমি ছোট গাছটার ডাল ধরে দেখি,
দাঁড়ালে, রইলে মাথা নিচু করে ক্ষণকাল, আমি
বললাম, ‘সবকিছু বদ্লে গেছে তুমি আছ বলে।
আর তুমি
‘ঘুরে-বেড়ানোর মতো বেশ জায়গা। নেই
উঁকি-দেয়া চোখ, উদ্যত তর্জনী আশে-পাশে,
এবং দূরের আকাশকে
মনে হয় এখানে আকাশ অবিকল।
এরোপ্লেন উড়ে গেল মাথার উপর এক ঝাঁক
শব্দের মৌমাছি উঁচু উঁচু গাছ স্পর্শ করে
আমাদের স্তব্ধতাকে করেছে গুঞ্জিত।
তোমার আমার মধ্যে যে-শিল্পিত দূরত্ব অটুট
চিরদিন, তারই রূপ রইল এখানে ধরা এই
জনহীন পথপ্রান্তে গুচ্ছ ফুলের স্তবকে।
কোনো দিন মফস্বলে একরত্তি অখ্যাত স্টেশনে
থামলে রাত্রির ট্রেন, শেষ রাতে মরা জ্যোৎস্না ঠেলে
চা খেয়ে মাটির খুড়ি ছুড়ে ফেলে দেব প্লাটফর্মে,
(হুইসিলে পাড়াগাঁর ছবি দূরে হবে সচকিত)
হঠাৎ ধরাব সিগারেট, ভাবব কতদিনকার
সেই নদী, বন, সাঁকো, আর
তোমার পায়ের নিচে কত শুকনো পাতার মর্মর।
অস্তিত্বের তন্ময় দেয়ালে
মনের খেয়ালে গেঁথে অগণন তারা
অস্তিত্বের তন্ময় দেয়ালে
স্মৃতিকে করেছি আমি সীমাহীন সুনীল আকাশ।
সেখানে কয়টি হাঁস শৈবালের আর
বন্ধ্যা তুষারের গণ্ডি ছেড়ে পেতে চায়
রৌদ্রের জোয়ার আজও, আজও
নিরুদ্বেগ সাহসী ডানায়।
মনে পড়ে আমিও একদা পড়েছি ঝাঁপিয়ে অন্তহীন
নীলিমায়, কতদিন মেঘের প্রাসাদে
কাটিয়েছি মায়াবী প্রহর
আমি আশ্চর্যের যুবরাজ।
সেদিন আননে ছিল আঁকা
ত্রিলোকের রূপাভাস, আর
স্বপ্নের কাননে তুলে বাসনার ফুল
যথারীতি পেয়েছি মদির সঙ্গ কত
এবং বেসেছি ভালো-আস্থা রেখে সেই
দ্রাক্ষাবনে, অনন্তের প্রীত গুঞ্জরণে-
স্বপ্নের সুন্দরীদের। কাটিয়েছি কত যুগ সেই
নীলিমা-খচিত মায়ালোকে।
তাড়াতাড়ি হঠাৎ রাত্রির শেষ বাসে
উঠে প’ড়ে ভাবি এই
নেশার খোঁয়ারি কেটে গেলে
নামব কোথায় তবে, এখানে কোথায়?
থাক থাক, ক্ষতি নেই কিছু,
ভাবব পরে।
এখন দু’চোখ ভরে শুধু
দেখা যাক-কী দেখব? নিশ্চল, নিরেট
অন্ধকারে হাতড়িয়ে পথ কাকে ছোঁব শেষে? কাকে?
ডিঙিয়ে মর্ত্যের বেড়া পাব কি স্বর্গের
অবতরণিকা?
সাফল্যের গাছ যত পাখি পুচ্ছ তুলে নাচে, আজ
তাদের স্বপ্নের ঘোরে বুঝি
আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে
এ-রাত্রির শেষ বাসে! ও কিছুই নয়
আসলে হৃদয় মাঝে-মাঝে
হয়ে পড়ে নেহাত অবুঝ নাবালক
নেশার খোঁয়ারি কেটে গেলে পৃথিবীকে
নির্বোধের হাসির মতোই মনে হয়।
শূন্য প্রহরের দীর্ঘশ্বাস বৃথা প্যানিক ছড়ায়
এবং নড়ায় স্তব্ধ আদর্শের ভিত।
জানি এই ভিড় ঠেলে, ঢিলে-ঢালা সস্তা স্যুট প’রে
রাস্তার দাম্ভিক শত বিজ্ঞাপন প’ড়ে, পুঁইশাক
ডাঁটার চচ্চড়ি,
নিরীহ মাছের ঝোলে ডুবিয়ে জীবন
থাকব, বাঁচব আমি দিনের চিৎকারে
রাত্রির করুণ স্তব্ধতায়।
মাঝে-মাঝে কারো
অস্তিত্বের সুরভির জন্য হয়তোবা
ধমনী চঞ্চল হবে স্পন্দিত নদীর মতো ফের,
সত্তার মিনারে চাঁদ জ্বলবে তখন।
আজ শুধু
স্মৃতিকে করেছি আমি বিশাল আকাশ।
আজীবন আমি
আমার হৃদয়ে ছিল লোকোত্তর সফল বাগান
তর্কাতীত ঐশ্বর্যে ভাস্বর।
কোনো দিন সময়ের সিংহবর্ণ মরুভূমি তাকে
পারেনি ডোবাতে তরঙ্গিত বালির কবরে,
অথবা উটের দীর্ঘ কোনো
বেঢপ পায়ের নিচে হয়নি দলিত
বাগানের কোমল পরাগ।
বরং সেখানে বহু চৈত্রসন্ধ্যা তার
সুরভিত প্রশান্ত চিকুর
দিয়েছে এলিয়ে বারবার, আর কত
চকিত রাত্রির নীলিমায়
আকাশের বাঁকা সিঁড়ি বেয়ে
এসেছে তো রক্তকরবীর ডালে শব্দহীন চাঁদ
সে-চাঁদ দু’জনে মিলে দেখেছি অনেক
সপ্রেম প্রহরে; কতবার সে চাঁদের স্মৃতি-ছবি
এঁকেছি নিভৃত মনে শিল্পীর প্রজ্ঞায়।
তুমিও দেখেছ
রাত্রির মুকুরে ভাসে অগণন তারার বিস্ময়;
হৃদয়ের হ্রদে নীল তারা
জলের শয্যায় শুয়ে দেখে কত স্বপ্ন অলৌকিক।
আমরা দু’জন সেই স্বপ্নের মেদুর
অংশ হয়ে নিয়েছি প্রাণের উন্মীলনে
জীবনের দান-আর এ বাগান আজও
মুঞ্জরিত, আজও।
এখানে বাগানে
আমার প্রভাত হয়, রাত্রি নামে, উৎসারিত কথা
হৃদয়ের সোনালি রুপালি
মাছ হয়ে ভাসে আর বসন্তের আরক্ত প্রস্তাবে
প্রজ্বলিত, উন্মোচিত তুমি।
বাগানে আবার ঐ বর্ষার সঙ্গীত
সমস্ত সত্তায় আনে অপরূপ শ্যামল আবেগ।
জ্যোৎস্নার লাবণ্যে আর রৌদ্রের স্বতন্ত্র মহিমায়
তুমি তন্বী গাছের বিন্যাসে আছ এই
বাগানে আমার গানে গানে
জীবনের দানে উল্লসিত।
এবং তোমার প্রাণ প্রতিটি ফুলের
উন্মোচনে শিহরিত আর
উত্তপ্ত তামার মতো বাস্তবের পরিধি পেরিয়ে
অভীপ্সা তোমার প্রসারিত, মনে হয়,
সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো জীবনের দিকে
যে-জীবন পৃথিবীর প্রথম দিনের
মতোই বিস্মিত চোখ রাখে
আগন্তুক ভবিষ্যের চোখে
অথবা প্রেমের মতো উজ্জ্বল সাহসে
ভাঙা-চোরা পথে,
আবর্তে আবর্তে খোঁজে চির-অচেনাকে,
এমনকি হাত রাখে নিশ্চিন্তে অকল্যাণের হাতে।
যখন জীবনে সেই বাগানের সঞ্চারী সুরভি
ধ্রুপদী গানের মতো, সন্ধ্যার ধূপের মতো অর্পিত আবেগে
করে স্তব ঈপ্সিতের, সেই ক্ষণে তোমাকেই খুঁজি
বাগানের মধুর উপমা
তোমার অস্তিত্বে সুরভিত
আজীবন আমি।
আত্মপ্রতিকৃতি
আমি তো বিদেশী নই, নই ছদ্মবেশী বাসভূমে-
তবে কেন পরিচয় অন্ধকার ঘরে রাজা, কেন
দেশের দশের কাছে সারাটা জীবন ডুগডুগি
বাজিয়ে শোনাব কথা, নাচাব বানর ফুটপাতে?
কেন তবে হরবোলা সেজে সারাক্ষণ হাটে মাঠে
বাহবা কুড়াব কিংবা স্টেজে খালি কালো রুমালের
গেরো খুলে দেখাব জীবন্ত খরগোশ দর্শকের
সকৌতুক ভিড়ে? কেন মুখে রঙ মেখে হব সঙ?
না, তারা জানে না কেউ আমার একান্ত পরিচয়
আমি কে? কী করি সারাক্ষণ সমাজের চৌহদ্দিতে?
কেন যাই চিত্রপ্রদর্শনী, বারে, বইয়ের দোকানে,
তর্কের তুফান তুলি বুদ্ধিজীবী বন্ধুর ডেরায়?
না, তারা জানে না কেউ।
অথচ নিঃসঙ্গ বারান্দায়
সন্ধ্যা, এভেন্যুর মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা, সার্কাসের
আহত ক্লাউন আর প্রাচীনের অতন্দ্র বিড়াল,
কলোনির জীবনমথিত ঐকতান, অপ্সরীর
তারাবেঁধা কাঁচুলি, গলির অন্ধ বেহালাবাদক
ব্রাকের সুস্থির মাছ, সেঁজার আপেল জানে কত।
সহজে আমাকে, জানে কবরের দুর্বিনীত ফুল।
আত্মহত্যার আগে
শয্যাত্যাগ, প্রাতরাশ, বাস, ছ’ঘণ্টার কাজ, আড্ডা,
খাদ্য, প্রেম, ঘুম, জাগরণ; সোমবার এবং মঙ্গলবার
বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি আর রবিবার একই
বৃত্তে আবর্তিত আর আকাশ তো মস্ত একটা গর্ত-
সেখানে ঢুকব নেংটি ইঁদুরের মতো। থরথর
হৃদয়ে প্রতীক্ষা করি, স্বপ্ন দেখি আগামীকালের
সারাক্ষণ, অনেক আগামীকাল্য উজিয়ে দেখেছি
তবু থাকে আরেক আগামীকাল। সহসা আয়নায়
নিজের ছায়াকে দেখি একদিন-উত্তীর্ণ তিরিশ।
পূর্ণিমা চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে, অস্তিত্বকে মুড়ে
খবরের কাগজে ছড়াই দৃষ্টি যত্রতত্র, নড়ি,
মাঝে-মাঝে ন’ড়ে বসি, সত্তার স্থাপত্যে অবিরল
অলক্ষ্যে গড়িয়ে পড়ে মাছের ঝোলের মত জ্যোৎস্না
আর আমি বিজ্ঞাপন পড়ি, হাত-পা ছড়িয়ে পড়ি
এবার কলপ দিন, আপনি তো জানেন অকাল-
পক্ব চুলে কলপ লাগালে অনায়াসে ফিরে আসে
ফেরারি যৌবন… আর এই ফলপ্রদ টনিকটা
খাবেন প্রত্যহ তিনবার ঠিকঠাক দাগ মেপে
অর্থাৎ চায়ের চামচের দু’চামচ এবং খাবার আগে
কিংবা পরে, তাহলে বাড়বে ক্ষিদে আর স্নায়ুগুলি
নিশ্চিত সবল হবে, যদি খান সুস্বাদু টনিক।
ধরা যাক যা-কিছু লিখেছি সবি পড়ে লোকে, প’ড়ে
প্রচুর তারিফ করে, ব্যাংকের খাতাও স্ফীতকায়;
উন্নতির সবগুলি গোল ধাপ পেয়েছে আমার
সুকৃতী পায়ের ছাপ, ইচ্ছাপূরণের যত গান
হৃদয়ের সাতটি মহলে পেলো খুঁজে সফলতা;
জীবনের প্রতিটি সুন্দর স্বপ্ন পাপড়ি মেলে
চেয়েছ আমার দিকে পত্নীর গার্হস্থ্য প্রণয়ের
পরিণাম পুত্র-কন্যা সহজে এসেছে যথারীতি
এবং নিজের বাড়ি, সাজানো বাগান, ধরা যাক,
গাজরের ক্ষেত, মুরগি ইত্যাদির স্বচ্ছন্দ বিন্যাসে
মানবজীবন ধন্য। শৈশবের সাধের কল্পনা
নকশা অনুসারে, ধরা যাক, একে একে ঘটল সবি।
অনেক সমুদ্র ঘুরে কত বন্দরের গন্ধ মেখে
একদিন সার্থবাহ বার্ধক্যের অবসন্ন ঘটে
ফিরে আসে পণ্যবাহী সার্থক জাহাজ, পালতোলা,
গলাফোলা নাবিকের গানে গুঞ্জরিত। মূর্খ যত
চেঁচিয়ে মরুক তারা, পূর্ণতার স্তবে রাত্রিদিন
জপেছি ভীষণ মন্ত্র ক্ষয়ে ক্ষয়ে… কিন্তু তারপর?
আড় হয়ে বিকেলের রোদ পড়ে চায়ের আসরে;
কয়েকটি সুবেশ তরুণ-তরুণীর সংগত সংলাপে
গোলাপ বাগান জ্বলে রক্তিম কুঁড়ির জাগরণে
মুহূর্তের অতন্দ্র মালঞ্চে। টেবিলের ফুলদানি
জ্যোৎস্নার বিস্ময়ে ফোটে মহিলার অন্ধকার ঘরে।
নিয়ন আলোর মতো কারুর হাসির শত কণা
জাগায় স্মৃতির শব, হাড়হিম দেহে লাগে তাপ।
আমি নই ইডিপাস, তাহলে কী করে উচ্চরোলে
সভাসদ মাঝে করি উচ্চারণ ‘অবশেষে বলি
ভালো সবকিছু ভালো?’
অসংগতি, না আমার মধ্যে নেই, রয়েছে সেখানে
রেস্তোরাঁয়, অন্ধকারে দেয়ালে আমার চতুর্দিকে,
বলতে পারো বরং নিজেই আমি নিমজ্জিত, ওহে,
এ-অসংগতির মধ্যে। লিপস্টিক ঘষে মুছে-ফেলা
ঠোঁটের মতন আত্মা নিয়ে কী আশ্বাসে বাঁচায় যায়
যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডে, বিরক্তির মাছির জ্বালায়?
যেহেতু উপায় নেই ফেরবার, আমার সম্মুখে
দুটি পথ অবারিত, আমন্ত্রণে প্রকট চটুল-
গলায় বিশ্বস্ত ক্ষুর কিংবা অলৌকিক বিশ্বাসের
রাজ্যে শুধু অন্ধের স্বভাবে বিচরণ, সায় দেয়া
কবন্ধের শাস্ত্রের শাসনে, পরচুলা খ’সে পড়া
ক্রমাগত অনর্থক যুক্তিহীন মাথা নেড়ে-নেড়ে।
ঈশ্বর কি শিউরে ওঠেন মলভাণ্ডে? উনুনের
কড়াইয়ের তীব্র জ্বালে কুঁকড়ে যান কাগজের মতো?
যদি বলি প্রবঞ্চনা ঈশ্বরের অন্য নাম তবে
সত্য থেকে সঠিক ক’গজ দূরে আমার সংশয়ী
পদক্ষেপ? তা হলে বিশ্বস্ত ক্ষুর গলায় ছোঁয়ালে
অথবা ক’ফোঁটা বিষ কণ্ঠ বেয়ে নেমে গেলে এই
জ্বঠরের পাকে পাকে, পার্থক্যের কী জটিল সূত্র
উন্মোচিত হবে পরিণামে?
আমার মাকে
মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে
ছায়াবৃতা আপন সংসারে। তাকে চিনে
নিতে পারি সহজেই যখন নিভৃত অনুভবে বারবার
একটি ভাস্বর নদী, ফলের বাগান, মাঠ আর
শস্যক্ষেত, দূরের পাহাড়
গলে গিয়ে একই স্রোতে বয়ে যায়, সীমা
মুছে যায় চরাচরে স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা
অনন্য উপমা তাঁর। কে যেন চকিতে চেনা স্বরে
বলে শুনি, পাল্কি চড়ে, বেনারসি পরে
যদিন এলেন তিনি আমার ঘরে
চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধরে-
তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে,
সোনার কলসে আর সাঁঝ-নামা দিঘির গহনে।
মার চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চ দ্বীপ ভাসে?
চোখে বেনেবউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি
শঙ্কিত আভাসে আঁকা-ভাবি
রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে
এখনও কি স্বপ্ন বোনে ঊর্ণনাভ চাঁদ
নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরি ফাঁদ।
চেয়েছে বুকের সূক্ষ্ণ সোনালি সুতোয় চিরদিন
সমস্ত জীবন হোক নকশিকাঁথা সে ইচ্ছার ঋণ
শুধে দিতে বুঝি হতে হয়
গাছের মতোই এই রৌদ্রজলে মৃন্ময়, তন্ময়।
মাকে দেখি। আজও দেখি কী এক মায়ায়
পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায়
দু’বেলা আবেগ ভরে। দেখি তসবি গুনে
সত্তার মিনারে
সত্তার কিনারে
ঐ দূরায়নী আজানের ধ্বনি শুনে
আর সুবে-সাদেকের তীব্র শুভ্রতায় নির্মেঘ আনন্দে শোকে
আজীবন সমর্পিতা কোরানের শ্লোকে।
আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশ্বাসের অনড় জমিনে
দেখি না প্রোথিত কোনো অলীক পর্বত-যাকে চিনে
দ্বন্দ্বহীন জীবনের কাছে আত্মবিসর্জনে পাব স্বর্গসুখ।
মাঝে-মাঝে সংশয়ের গলিতে বিমুখ
প্রশ্ন তুলে ধরে ফণা
আমি কি সঠিক জানি ভদ্রমহিলাকে
-আমি যার একান্ত বিস্তার অনন্তের শুভ্রলোকে-
চিনি তাকে?
ব্যথা হয়ে বাজে মাঝে-মাঝে তারও চোখ
আমার অস্তিত্ব-পটে ‘কে এই অচেনা ভদ্রলোক?’
ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে
সূর্য আকাশে রৌদ্র ছড়ায়,
দুপুরের রোদ বিকেলে গড়ায়,
অনাবৃষ্টিতে শস্যের ক্ষেত জ্ব’লেপুড়ে যায়
খালবিল সব নিমেষে শুকায়,
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
মারিতে মড়কে দেশ ছারখার,
নব সংসারে ওঠে হাহাকার,
মেঘচেরা রোদে বাতাসে নড়ছে গাছের ডালটা,
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
জীর্ণ দেয়ালে শুধু থেকে থেকে
বেয়াড়া একটা কাক ওঠে ডেকে,
চৌধুরীদের বউটা শরীরে জড়ায় আগুন
ষোড়শীর মনে জ্বলছে ফাল্গুন
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
রাত্রি ফুরোলে জ্ব’লে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ;
কালবোশেখীর তাণ্ডবে কাঁপে পড়ো-পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
বাতিল কেরানি চেয়ে নিয়ে ক্ষমা
মৃত্যুতে খোঁজে ত্রাণে উপমা।
ধ্বংসের মুখে গ্রাম আর কত নগর পোড়ালি,
মুষড়ে পড়ল জুতোর গোড়ালি।
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
ইতিহাস, তোমাকে
করাতের অসংখ্য দাঁতের মতো মুহূর্তগুলো
আমাকে কামড়ে ধরেছিল, আর সেই মরণ-কামড়ে
আমি ঝাঁঝরা শরীরটাকে দু’ একবার নেড়েচেড়ে
পৃথিবীর বন্ধ দরজা নখ দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে
নিঃসাড় হয়ে যেতে পারতাম।
কিন্তু আমার দুঃখ-চর্চিত ললাটে
অন্য সম্মানের আভাস ছিল বলেই
বেঁচে রইলাম। তৃষ্ণার দুপুরে কোনো আহত সাপের মতো
এক সীমাহীন ক্রোধে, মূর্খ যন্ত্রণায় নিজেকে টেনেহেঁচড়ে
বেঁচে রইলাম সর্বনাশের পাশ কাটিয়ে
সমস্ত দুর্দশার মুখের ওপর আমার প্রবল থাবা মেলে দিয়ে।
জীবনকে খণ্ড খণ্ড চিত্রে দেখেছি-কখনো সুন্দর
কখনো কুৎসিত। যুবককে দেখেছি
দুপুর সন্ধ্যা আর রাত্রিকে রেণুর মতো
উড়িয়ে দিতে হাওয়ায় আর বৃদ্ধকে দেখেছি তার
খাটো মোমবাতিটাকে হিংসুক বাতাসের
বিরোধিতা থেকে রক্ষা করার জন্য কী ব্যস্তবাগীশ।
কখনো অশেষ হঠকারিতায় জীবনকে একটা
আংটির মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চেয়েছি,-কখনো
সময়ের জরায়ু ছিঁড়ে নিতে চেয়েছি
কয়েকটি টসটসে নিটোল কালো আঙুর,
যাদের আমি ঠোঁটে নিয়ে থেঁতলে দিতে, পিষে ফেলতে
ভালবাসি, ভালবাসি যাদের মাংসল কণাগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে
ইতিহাসের হলুদ জঞ্জালে।
পেঁজা তুলোর মতো তুষারে অশ্বেতরের
পায়ের ছাপ, সোনালি গমের মাঠ
আগুনের লকলকে জিভ কিংবা ধোঁয়াটে
সন্ধ্যার প্রান্তরে খণ্ডিত সৈনিক
একেই বলবে কি ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবৃতি?
একটি আলোকিত দেহকে বিনাশ করবে বলে যারা
ক্রুশকাঠে পেরেক ঠুকেছিল, তাদের
উৎসব, ব্যভিচার কিংবা যারা বালিতে, অন্ধকার
গুহার দেয়ালে মাছের চিত্র এঁকে
ক্রুশবিদ্ধ অস্তিত্বের মহাপ্রয়াণে চোখ মুছেছিল,
তাদের ঘরকন্না, প্রেমের ব্যাপ্ত বলয়, তা-ও কি
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় প্রতারক ইতিহাসের?
ইতিহাস সরোদের মতো বেড়ে উঠলে
আমি সুখী, দামামার মতো গর্জে উঠলে
দুঃখ আমাকে বিবর্ণ করে। জীবন যখন বর্বরের মুঠোয়
কপোতের নরম বুকের মতো কেঁপে ওঠে,
গহন পাতালের প্রাগৈতিহাসিক শীতল জল
নিভিয়ে দিতে চায় হৃদয়ের আগুন,
আমার সমস্ত সম্ভ্রম আর উল্লাস
অর্পণ করি আগামীর অঞ্জলিতে
‘কেননা ভবিষ্যৎ এক
জলদমন্দ্র সুর ইতিহাসের ধ্রুপদী আলাপে।
উদয়াস্ত দেখি ছায়া
কোথায় ভাসাব ভেলা? দূরন্ত জলের ধ্বনি শুনে
কত বেলা গেল,
তবুও আপন
মাটির বিরাগ মূর্ত, ঠাঁই নেই ভাই
প্রাণের পাড়ায় তাই জানি না কখন কে হারায়।
ভয়ে চোখে চোখ রাখি, হাঁটুর বিবরে ঢাকি মুখ,
বাঁচার ভাবনা
ক্লান্ত হয়ে ফেরে মনে। যাবো না যেখানে
কোনোদিন স্বপ্ন তার তেড়ে আসে কুকুরের মতো,
মাচার সংসারে রাতে (নিজেকে শুনিয়ে বলি) যতটুকু পারো
দেখে নাও মুখ,
কে জানে কখন হবে ভোর, কেউ হয়তো তোমার
ঝিমানো দুপুরে খুলবে না দোর।
কলাইয়ের শূন্য মাঠে কাঁপে সাদা ঢেউ,
কে যাবি ঘরের পানে সূর্য-নেভা টানে
গোধূলির গরু-ডাকাপথ
খরস্রোতা নদী, ফাঁকা সাঁঝে
কে দেখাবে আলো?
বাজে শুধু
ধু-ধু জলধ্বনি
ওরে
নেই ফিরে যাওয়ার উঠোন।
উদয়াস্ত দেখি ছায়া বন্ধ্যা জলে, কাকে পেতে চায়
এ হাওয়ার ক্ষুধা।
প্রত্যহের পথ
প্রাণের তৃষ্ণায় কেঁদে তারা সমকালীন দু’জন
তবু উঠল গাছ বেয়ে মানুষ শঙ্খিনী।
প্রতিযোগিতার শ্রমে যার দুটি আর্ত ক্লান্ত চোখ।
দেখে নিল অন্তিম আকাশ,
তার নীল হাহাকার যাবে কতদূর?
ভাসমান পশু আর নির্বাক মানুষ
ক্যামেরার স্বদেশী খোরাক,
অনেক অনেক দূরে শস্যের শিবির…
নির্বোধ আশায় আর মজে না যে মন,
কত বেলা গেল…
কী করে ফিরব ঘরে,
কোন ঘাটে ভিড়ে
আবার চাঁদের অভিবাদন গ্রহণ?
বৈঠায় মারিনি পাখি, শোনো
ভুলে কোনো অমোঘ প্রহরে,
তবু কেন
তবু কেন এই
জলের মরণ?
একজন লোক
লোকটার নেই কোন নামডাক।
তবু তার কথা অষ্টপ্রহর
ভেবে লোকজন অবাক বেবাক।
লোকটার নেই কোনোখানে ঠাঁই।
জীবন লগ্ন পথের ধুলায়,
হাতে ঘোরে তার অলীক লাটাই।
লোকটা কারুর সাতে-পাঁচে নেই।
গাঁয়ের মোড়ল, মিলের মালিক-
তবু ঘুম নেই কারুর চোখেই;
লোকটার কাঁধে অচিন শালিক।
বলে দশজনে এবং আমিও
রোদ্দুর খায় লোকটা চিবিয়ে,
জ্যোৎস্নাও তার সাধের পানীয়।
হাজার প্রদীপ জ্বালায় আবার
মনের খেয়ালে দেয় তা নিবিয়ে।
মেঘের কামিজ শরীরে চাপিয়ে
হাঁটে, এসে বসে ভদ্রপাড়ায়।
পাথুরে গুহায় পড়ে না হাঁপিয়ে
সে-ও সাড়া দেয় কড়ার নাড়ায়।
তবু দশজনে জানায় নালিশ
লোকটা ঘুমায় সারাদিনমান,
কাছে টেনে নিয়ে চাঁদের বালিশ।
একটি জীবনচরিত
যিনি ওই পোড়াবাড়িটায়
থাকতেন নিরিবিলি কোনো কোনো দিন
রোদে পিঠ দিয়ে আর শ্রাবণের ধারাজ্বলে ঠায়
সারাদিনমান সঙ্গীহীন
কাটাতেন গোলকচাঁপার নিচে, চোখ-ছলছল
তিনি ভাবতেন তার চুল
ঘাসের সবুজ শিখা, হাত অবিকল
মৃন্ময় গাছের ডাল, চোখ ফাল্গুনের কোনো ফুল,
ঠোঁটের কিনারে কালো শ্রাবণের মসৃণ লবণ
(ভাবতেন তিনি) আছে লেগে সারাক্ষণ।
কখনো কোটর থেকে কাঠবিড়ালিটা নেমে এলে
পাতাঝরা তন্ময় বিকেলে
দিতেন মাথাটা তার আদরে বুলিয়ে,
এবং ভুলিয়ে
রাখতেন ওকে ঘাসে বাদামের কৌতুকী খেলায়
গরুর খুরের রাঙা ধূলিওড়া নিমগ্ন বেলায়।
চুপচাপ সে অস্তিত্ব রোজনামচায় চিরন্তন
সুখে রাখতেন টুকে অভ্রের গুঁড়োর মতো মৌমাছি-গুঞ্জন,
বসন্তের বর্ণালি বর্ষার ভরা রাত্রির ক্রন্দন
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের সূক্ষ্ম রসায়ন
কুয়াশায় পতঙ্গের জীবন বয়ন।
পাখির নীরব মৃত্যু, প্রতিটি ফুলের জন্মমুহূর্ত এবং
ফড়িঙের চঞ্চলতা, আকাশের সবগুলো রং
সবই তো পড়েছে ধরা চেতন-ঊষার মতো প্রাণে,
জার্নালের পাতায় যেখানে প্রাত্যহিক ঐকতানে
লিপিবদ্ধ আরো কিছু-গভীর গ্রন্থের নয়-জীবনের ভাষা
“হে সবুজ গাছ, হে আমার প্রিয় বন্ধু, মেঘেভাসা
পাখির মতোই চাই আজও তোমার ছায়ায় চাই কিছুক্ষণ
পূর্ণতায় নানান লতাগুল্মের প্রাণের রণন।
যেদিন গেলেন তিনি কে যেন বলল নিচু স্বরে,
“আমাদের রৌদ্রছায়াময় এ প্রান্তরে কখন গেছেন ঝ’র
একটি বয়েসী বৃক্ষ। অন্য কোন বোকা প্রতিবেশী
আওড়ালো শোকের চলতি শ্লোক ক’টি বড় বেশি।
রোদের ছুরির ঘায়ে, বৃষ্টির ধারালো নখে, হলুদ পাতায়
ওই পোড়াবাড়িটার স্মৃতি
হ’ল বাতাসের সহচরী শূন্যতায়,
নির্বিকার রইলেন শুধু, শুধু শ্রীমতী প্রকৃতি।
একটি দৃশ্যের আড়ালে
এখনও আকাশ আছে, এই খোলা জানালার বাইরে
রাস্তায় অটুট ট্রাফিকের ঐকতান। বাতাসের
টোকায় খড়খড়ি জেগে ওঠে স্বপ্ন থেকে, বারান্দায়
যুগল পায়রা প্রেমে নিমজ্জিত, গলির বুড়োটা
তারাভরা আকাশের মতো শতচ্ছিন্ন তালিমারা
কোট গায়ে বিড়ি টানে, বোষ্টমির গানে
মাথা নাড়ে, দূরের শূন্যতা শব্দময়
প্লেনের গুঞ্জনে।
কিন্তু তার শোক নেই, পরিতাপ নেই,
তৃষিত বাসনা নেই, নেই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া
স্থির চোখে। আমি শুধু লাশ নিয়ে বসে আছি পাশে
হলুদ চাঁদের নিচে-আর যারা ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর
ঘুমভরা ঢুলুঢুলু চোখে গেছে দোকানে চা খেতে।
নিস্পন্দ শরীর এক পাশে আছে প’ড়ে, জমে-যাওয়া
দশটি আঙুল প্রসারিত দেখছি আমার দিকে-
যেন আঁকড়ে ধরবে তারা এখনি আমার স্তব্ধতাকে।
নির্বাপিত সত্তার আড়ালে
চকিতে উঠল জ্ব’লে গ্রীষ্মের সেঁকা দপদপে কোনো
তরুণ ফলের মতো তোমার মুখের
প্রখর যৌবন।
একটি মৃত্যুবার্ষিকী
হয়নি খুঁজতে বেশি, সেই অতদিনের অভ্যাস,
কী করে সহজে ভুলি? এখনও গলির মোড়ে একা
গাছ সাক্ষী অনেক দিনে লঘু-গুরু ঘটনার
আর এই কামারশালার আগুনের ফুলকি ওড়ে
রাত্রিদিন হাপরের টানে। কে জানত স্মৃতি এত
অন্তরঙ্গ চিরদিন? জানতাম তুমি নেই তবু
আঠারো সাতে কড়া নেড়ে দাঁড়ালাম
দরজার পাশে। মনে হলো হয়তো আসবে তুমি,
মৃদু হেসে তাকাবে আমার চোখে, মসৃণ কপালে,
ছোঁয়াবে আলতো হাত, বলবে ‘কী ভাগ্যি আরে
আপনি? আসুন। কী আশ্চর্য। ভেতরে আসুন। দেখি
অন্ধকারে বন্ধ দরোজায় দুটি চোখ আজও দেখি
উঠল জ্ব’লে। কতদিনকার সেই চেনা মৃদু স্বর
আমার সত্তাকে ছুঁয়ে বাতাসে ছড়াল
স্মৃতির আতর।
শূন্য ঘরে সোফাটার নিষ্প্রাণ হাতল
কী করে জাগল এইক্ষণে? একটি হাতের নড়া
দেখলাম যেন, চা খেলাম যথারীতি
পুরানো সোনালি কাপে, ধরালাম সিগারেট, তবু
সবটাই ঘটল যেন অলৌকিক
যুক্তি-অনুসারে।
মেঝের কার্পেটে দেখি পশমের চটি
চুপচাপ, তোমার পায়ের ছাপ খুঁজি
সবখানে, কৌচে শুনি আলস্যের মধুর রাগিণী
নিঃশব্দ সুরের ধ্যানে শিল্পিত তন্দ্রায়।
জানালায় সিল্ক নড়ে, ভাবি কত সহজেই তারা
তোমাকে কীটের উপজীব্য করেছিল,
সারাক্ষণ তোমার সান্নিধ্যে পেত যারা
অনন্তের স্বাদ।
বারান্দায় এলাম কী ভেবে অন্যমনে, পারব না
বলতে আজ। জানতাম তুমি নেই, তবু
কাদের জন্যে
লিখতে কহ যে দিনরাত্তির
কাদের জন্যে লিখব?
কাদের জন্যে দুঃখের পাঠ
করুণ ভাষ্যে শিখব?
ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার আর
মোক্তার আর রাজনীতিবিদ
আদার ব্যাপারী আর ব্যাংকার
পেডেন্ডো আর মিহি কলাবিদ
খুঁটবে আমার কাব্য।
তাদের জন্যে লিখব এবং
তাদের জন্যে ভাবব?
শকুন-উকিল ঘোর ঠিকাদার
আর নিধিরাম সর্দার আর
হুজুরের জি-হাঁ হুঁকোবরদার
বৈদ্য এবং বৈশ্য
ঘাঁটব আমার প্রাণ-নিংড়ানো
সাধের অনেক শস্য।
তাদের জন্যে সকাল সন্ধে
গাধার খাটুনি খাটব?
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি-লাগা
সরু দড়িটায় হাঁটব?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এদেশে হায়েনা, নেকড়ের পাল,
গোখরো, শকুন, জিন কি বেতাল
জটলা পাকায় রাস্তার ধারে।
জ্যান্ত মানুষ ঘুমায় ভাগাড়ে।
অথচ তোমার চুল খুলে দাও তুমি।
এদেশে কতো যে ফাঁকির আছিলা,
কালোবাজারের অপরূপ লীলা।
আত্মহত্যা গুম খুন আর
ফটকা বাজার-সব একাকার।
এখনও খোঁপায় ফুল গুঁড়ে দাও তুমি।
মড়ক-মারির কান্নার রোল
সারা দেশটার পাল্টায় ভোল।
হা-ভাতে ছোঁড়ারা হুজুরের দোরে
সোনালি আমের মরশুমে ঘোরে।
এখনও তোমার বাহু মেলে দাও তুমি।
এদেশে আ’মরি যখন-তখন
বারো ভূতে খায় বেশ্যার ধন।
পান নাকো হুঁকো জ্ঞানীণ্ডণীজন,
প্রভুরা রাখেন ঠগেদের মন।
এখনও গানের সুরে ভেসে যাও তুমি।
এদেশে নেতারা হাওদায় চ’ড়ে
শিকার গাঁথেন বাক্যের শরে,
আসলের চেয়ে মেকিটাই দামি।
বিচিত্র দেশ, কৃতজ্ঞ আমি
এখনও যে মেয়ে হাসি জ্বেলে দাও তুমি।
ক্ষয়
পুবের আকাশে প্রতিদিন একই
সূর্য সকালে আবির মাখে।
কীর্তিনাশার প্রমত্তা রূপ
আজও খেলে যায় চরের বাঁকে।
আমি শুধু আমি বদলে যাচ্ছি,
মানে মোট কথা হচ্ছি বুড়ো।
গতকল্যের কিছু নেই বাকি,
বিগত যুগের স্বপ্ন গুঁড়ো।
দেয়ালের এই পিকাসো মাতিস
চির অক্ষয় থাকবে বটে;
অথচ আমার দেহের চিত্রে
কত কী-যে শুধু নিত্য ঘটে।
চোখ ফেরালেই বছর ফুরায়,
কমে ক্রমাগত দেহের তাপ।
চোখের তলায় ত্বকে অঙ্কিত
কাকের পায়ের শীর্ণ ছাপ।
খুপরির গান
ধুলো গিলে ভিড় ছেনে উকুনের উৎপাত উজিয়ে
ক্লান্তি ঠেলে রাত্তিরে ঘুমোতে যাই মাথাব্যথা নিয়ে।
না-জ্বেলে ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতি স্বপ্নচারী বিছানায়
গড়াই, লড়াই করি ভাবনার শক্রদের সাথে-
হাত নাড়ি লাথি ছুড়ি পৃথিবীর গোলগালা মুখ
লক্ষ্য করে। বিবেকের পিঁপড়ে যদি সত্যি হেঁটে যায়
পিচ্ছিল দেয়ালে, মন থেকে মুছে নেব ছোটখাটো
পাপবোধ অল্পবিস্তরেণ…পোষমানা মূল্যায়নে
পাব সুখ দেখব কি নেড়েচেড়ে এক টুকরো হলদে
নিষ্প্রাণ কাগজে মোড়া আত্মা, সত্যি একরত্তি সেই
আধ্যাত্মিক পিণ্ড…আর পরাবিদ্যা ভাসাব জ্যোৎস্নায়?
দিনে কৃষ্ণচূড়া রাতে রজনীগন্ধার স্পর্শ যারা
পেতে চায় অন্তরঙ্গ সাহচর্যে, যদি বলে তারা
‘গুনে-গুনে রেজগি দিয়ে প্রতিদিন অভ্যাসবশত
ছুঁয়েছি লাভের বুড়ি, লোকসান বলে কাকে জানি না ইয়ার’
‘কী দেবে জবাব তবে অসংখ্য তারার ব্যালেরিনা,
ভ্যানগগ রক্তে তার কালো কাক ফসলের ক্ষেত
সূর্যমুখী এক জোড়া জীর্ণ বুটজুড়ো কেবলি মথিত করে
রোদে সূচ্যগ্রে বিদ্ধ হল শাশ্বতীর আকাঙ্ক্ষায়,
সহযাত্রী বন্ধু তার হলুদ যেসাস খোঁজে আরেক প্রান্তরে
নতজানু, ঊর্ধ্ববাহু, কণ্ঠে কালো বৃষ্টির আরক।
এ-পাড়ায় ১৭টি উজবুক ৫ জন বোবা
৭টি মাতাল আর ৩ জন কালা বেঁচেবর্তে
আছে আজও দুর্দশার নাকের তলায়। মাঝে-মাঝে
দুর্লভ আঙুর চেয়ে কেউ-কেউ তারা বলে থাকে
‘টক সব টক-তার চেয়ে তাড়ির ঝাঁঝালো ঢোঁক
ঢের ভালো, ভালো সেই গলির মোড়ে জ্বলজ্বলে
পানের দোকান আর বাইজির নাচের ঘুঙুর।
বমির নোংরায় ভাসে মেঝে, রুটির বাদামি টুকরো
চড়ুই পালাল নিয়ে। তাকাব না কখনো বাইরে…
ঘরে জানলা নেই…হলুদ যেসাস বিদ্ধ কড়িকাঠে…
রৌদ্রঝলসিত কাক ওড়ে মত্ত রক্তে কাঠফাটা
আত্মার প্রান্তরে। সারারাত
অনিদ্রা দুঃস্বপ্ন আর
ছারপোকা, ছিদ্রান্বেষী ইঁদুরের উৎপাত উজিয়ে
ময়লা চাদর ছেড়ে উঠি ফের মাথাব্যথা নিয়ে।
খেলনার দোকানের সামনে ভিখিরি
বড় রাস্তা, ঘুপচি গলি, ঘিঞ্জি বস্তি, ভদ্রপাড়া আর
ফলের বাজার ঘুরে খেলনার দোকানের সামনে
দাঁড়ালাম। কাচের আড়ালে দেখি কাঠের পুতুল,
রেলগাড়ি, ছক-কাটা বাড়ি, আরবি ঘোড়া এক জোড়া,
উড়ন্ত পাখির মতো এরোপ্লেন, টিনের সেপাই।
ভালুক বাজায় ব্যান্ড, বাঁকা-শিং হরিণের পাশে
বাঘের অঙ্গার জ্বলে, বিকট হা করে আছে সিংহ
সারি সারি রয়েছে সাজানো ওহো হরেক রকম
বাজনা বাঁশি বাদশা বেগম আর উজির নাজির।
আমার পিরান নেই, পাগড়ি নেই লালমুখো সেই
উজিরের ম’তো, নাগরা নেই পায়। এখন দুপুরে
লেপ্টে আছে পৃথিবীর গায়। কয়েকটি যুবককে
ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা-লোকে বলে রাত্রিদিন তারা
নেহাই হাতুড়ি দিয়ে ইচ্ছেমতো চেয়েছে গড়তে
কত কিছু, দেশকে নতুন করে গড়ে পিটে নিতে
চেয়েছে হুজ্জত সব জ্বলন্ত জোয়ান। বুঝি তাই
ঢিট করে দেবে ওরা যৌবনের গোঁয়ার ইচ্ছাকে।
“গান বন্ধ কর্ তোরা, নর্তকী নাচের মুদ্রা ভোল”-
“এমন হুকুমনামা জারী হলে সংস্কৃতি সদনে
আমরা গোল্লায় যাব এবং দাঁতাল বর্বরতা
সদর্পে তুলবে মাথা প্রাগৈতিহাসিক কূপ থেকে”
হেঁটে যেতে যেতে বলব কয়েকটি সুবেশ যুবক।
ইচ্ছে হয় মুখ ঘষি খেলনার দোকানের কাচে
বড় ইচ্ছে হয় ঘষি দুটি চোখ। যে-বিড়িটা কানে
গুঁজে ভোরে বেরিয়ে পড়েছি পথে তাই টানি সুখে
এখানে দাঁড়িয়ে ঠায় দুপুরের ঠাঠা রোদে। যদি
ছুঁয়ে দেখি স্বচ্ছ কাচ সূর্যসেঁকা আত্মায় আরাম
পাবো কিছু মনে হয়; দেখি মেঘেরা পালায় দৌড়ে
যেমন ছেলের দল ছুটে যায় পাঠশালা ছুটি
হয়ে গেলে। এ দুপুরে নিজের ছায়াকে দেখে কাচে
ঘুরে-ফিরে কেন শুধু গাঁয়ের নদীকে মনে পড়ে?
গাঁয়ের নদীর তীরে একজন বাউল আমাকে
একদিন ‘এদেশে আলোর কথা ভুলে থাকে লোক;
বড় বেশি অন্ধকার ঘাঁটে আর নখের আঁচড়ে
গোলাপ-কলিজা ছেঁড়ে পরস্পর’-বলেছিল হেসে।
নৌকোর গলুইয়ে বসে বুঝিনি সেদিন তার কথা,
আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম তাকিয়ে
তার দুটি উদাস চোখের দিকে; শুনতে পেলাম
নদীর শব্দের সাথে মিশে গেছে বাউলের স্বর।
ডেপুটি হাকিম নই, নই কোনো ভবঘুরে কবি;
পথের গোলাম আমি, বুঝেছ হে, অলীক হুকুমে
চৈত্ররাতে ফুটপাতে শুই। ঠ্যাং দুটি একতারা
হয়ে বাজে তারাপুঞ্জে, মর্মরিত স্বপ্নের মহলে
বাউলের কথামৃত স্বপ্নে হয় আমের বউল।
‘দ্যাখো দ্যাখো হাড্ডিসার লোকটার মুখের কী ছিরি,
কেতমন বিচ্ছিরি লাগে, দ্যাখো কত নোংরা’ বলে দুটি
তরুণী কলের পুতুলের মতো হেঁটে গেল চলে।
উঁচু বুক দেখে ভাবি পেশোয়ারি উজ্জ্বল দোকানে
দূর থেকে দেখছি তাজ্জব হয়ে টসটসে ফল।
নিজেকে কুচ্ছিত ভেবে লজ্জা পেলে সদর রাস্তায়
আমাদের চলে? উপরে আকাশ জ্বলে নির্বিকার।
যে ভদ্দরলোক এ মুহূর্তে এক খিলি পান কিনে
পুরল শৌখিন মুখে সে অশ্লীল গল্পের নায়ক
হতে পারে সহজেই। হতে পারে বেশ্যার দালাল।
বেইমান দুনিয়ায় খুনসুটি, ভালবাসাবাসি
বুঝি না কিছুই-নাকি বিলকুল বুড় হাবড়া আমি
হয়ে গেছি এতদিনে। কী যে ভাবি এত হাবিজাবি!
আমার জীবন নয় সুখের পানসি ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ভেসে যাবে অথবা নেইকো’ কোনো তালুক মুলুক
দু’হাতে ওড়াব ব’সে। পুণ্যলোভী দাতার দয়ায়
জীবনে সম্বল শুধু কয়েকটি তামার পয়সা।
গতকাল ফ্রকপরা যে-মেয়েটি একটি দু’আনি
হাসিমুখে দিয়েছিল এই হতচ্ছাড়া ভিখিরিকে,
কাচের আড়ালে রাখা ফুটফুটে পুতুলের মুখে
হঠাৎ পেলাম খুঁজে রাঙা তার মুখের আদল
-আমার মাবুদ তাকে খোশহাল বেগম করুন।
যে লোকটা সারাদিন পাখি বেচে গড়েছে সংসার,
হলুদ পাখির মতো যার বউ, সে কেন গলায়
পরে ফাঁস? সে লাশ পচার আগে মৃত এক পাখি
বউটিকে নিশীথে কাঁদাতে এসে দ্যাখে, হা কপাল,
আনন্দে উচ্ছল নারী হয়েছে উৎসব দ্বিধাহীন,
আয়নায় কাজল পরা দুটি চোখ ক্ষুধায় উজ্জ্বল।
‘দূর হ এখান থেকে হা-ভাতে ভিখিরি কোথাকার
আঁস্তাকুড়ে বেছেন আস্তানা, নোংরা খুঁটে খা-গে’-
দোকানি খেঁকিয়ে ওঠে। খেলনা ফেলনা নয় জানি,
এখন এখান থেকে, আল্লা, যাব কোন জাহান্নামে!
খেলনা ফেলনা নয়। ফলের বাজার, পুতুলের
স্থির চোখ…পীরের মাজার হৈচৈ মানুষের ভিড়,
গাঁয়ের নদীর তীর গুঞ্জরিত বাউলের স্বরে…
গেরস্তপাড়ায় বেশ্যাবৃত্তি, ভালুক বাজায় ব্যান্ড,
খেলনা ফেলনা নয়… বাজনা বাজে, ফলের বাজার,
ফ্রকপরা ফুটফুটে মেয়েটির একটি দু’আনি
হাতের চেটোয় নাচে, কাচের আড়ালে দুই যোদ্ধা,
সেপাই রাঙায় চোখ, ভদ্দপাড়ায় বাজনা বাজে,
“আস্তাকুড়ে বেছে নে আস্তানা’, খেলনা ফেলনা নয়…
চেনা অচেনার সঙ্গত
The stars rang like silver coins in my hand.
RIMBAUD
সবাই দেখল তাকে বিস্ময়ের উন্মুখ চৌকাঠে,
দাঁড়িয়ে দেখল তার শীর্ণ হাতে একমুঠো তারা,
খেলছে সে-যেন কতগুলো ঝকঝকে টাকা
নেড়েচেড়ে দেখছে তন্ময় হয়ে মুগ্ধতার ঘুলঘুলি দিয়ে।
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা দশজন
দেখল সে শুয়ে-শুয়ে বৃষ্টির ঝাঁঝালো মদে ডুবে
খুঁজছে সোমত্ত নৌকো তার ভেজা ঠোঁটে কিনারে
চুমো খাবে বলে। তারা শুধু পরস্পর
পিটপিটে চোখ টিপে দেখল কানের জানালায়
নির্ভার অস্তিত্ব এক বসেছে নিঃশব্দে। পৃথিবীর
সমস্ত স্তব্ধতা যেন শরীরে রেখেছে ঘিরে সেই আগন্তুক।
সবাই বলল তাকে, পাখিটাকে-শুয়োরের তাজা
টকটকে মাংসের পিণ্ডের মতো সন্ধ্যার সাক্ষাতে-
সবাই বলল তাকে সমবেত কণ্ঠের ক্রেঙ্কারে
‘গাও পাখি গান গাও, এ প্রহর গানের প্রহর।
নিষ্কম্প স্তব্ধতা দেখে তারা ফের দ্বিগুণ বিক্রমে
করল গানের ফরমাশ। নৈঃশব্দের দরবারে
তবুও হল না উন্মীলিত ফুলের পাপড়ির মতো কোমল গান্ধার।
চুরুট রঙের কোট ছুড়ে ফেলে, ফটোগ্রাফারের
কালো কাপড়ের মতো পর্দা টেনে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে
এক পশলা তারা সে-লোকটা (সবাই দেখল যাকে)
তাকাল পাখির ছোট দুটি সোনালি চোখের দিকে।
হাতের মুঠোয় তারা চকিতে উঠল বেজে রুপালি মুদ্রার
ঝনঝনে শব্দের মতো, পাখির চোখের দুটি তারা
ঝরাল আলোর দ্যুতি লোকটার কম্পিত মুঠোয়।
ছুঁচোর কেত্তন
যদি মুখ খুলি কী বলব? বলার কিছুই নেই?
বলব কি দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া রমনার শান্ত গাল
দিয়েছে রাঙিয়ে, বলব কি আর দশজন মরে মরুকগে,
আমার সকালে চাই রোজ দুটি আধাসেদ্ধ ডিম,
রুটি-মাখনের সঙ্গে-জ্যাম না-ই হোক, ক্ষতি নেই
অথবা মলির ছোট মেয়েটার (কী-যে তার নাম
ক’দিন হয়েছে হাম), যে-লেখক এবার পেলেন
আদমজী পুরস্কার তিনি প্রত্যহ মাজেন দাঁত
কলিনস্ দিয়ে, কী করে বিকোয় সবজি
বাজারে ইত্যাদি টুকিটাকি বলব কি
ছাদহীন ঘরে দিন কে চায় কাটাতে আজীবন,
সোনার খাঁচায় রইল না দিনগুলি।
আদিতে কিছুই নেই, অন্তে নেই কিছু;
মধ্যে শুধু এই থাকা না-থাকার জ্যোৎস্না চমকিত
ঊর্ণাজাল।
গ্রীষ্মের দুপুরে
রাস্তার বিবর্ণ কোণে ঘোড়ার খুরের শব্দ সত্য,
সত্য এই জানালার কাচে কালো বৃষ্টির আঁচড়,
পাতার কঙ্কাল আর ব্রিজের ওপর ঝকঝক
রাত্রির চলন্ত ট্রেন, দাড়ি না-কামানো
মুখের মতন দিন সত্য-সত্য সবি।
কিন্তু তবু কী সম্পর্ক পূর্ণিমা চাঁদের সঙ্গে এই
খেঁকি কুকুরের? অথবা রজনীগন্ধা আর দূর
চিমনির ধোঁয়া অবিশ্বাস্য কী গ্রন্থিতে আছে বাঁধা?
সম্বন্ধের কোন প্রসারিত পরিধিতে
মগ্ন পরস্পর হাতের চকিত মুদ্রা জনাকীর্ণ
এভেন্যুর ফোয়ারার বিচূর্ণিত জল!
একটি প্রখর পাখি ঠুক্রে ফেলে দেয় অবরিত
পোকা-খাওয়া মূল্যবোধ। আমরা যে-যার মতো পথ চলি,
দেখি বুড়ো লোকটা পার্কের বেঞ্চে ব’সে হাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে
অভিশাপ ছুড়ে দেয়, গাল পাড়ে ভিখিরিকে আর
উল্কি-পরা সরু গলি চমকায় নগ্ন ইশারায়,
বেকার যুবক দৃষ্টি দ্যায় সিনেমার প্ল্যাকার্ডের
রঙচঙে ঠোঁটে, মুখে বুকে আর মদির ঊরুতে।
পৃথিবীটা চলছে, চলবে যতদিন সূর্য তার
ছিটোবে সোনালি থুতু, কিন্তু যদি
ততই নিশ্চিত এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ তবে
কেন সে নব্বুই বছরের বুড়ো কনকনে হাওয়ায় ভাসিয়ে ধবধবে
সাদা চুল এক হাঁটু তুষারের মধ্যে দাঁড়িয়ে শোনায় কতো
শান্তি ললিত বাণী একই কেন্দ্রে ঘুরপাক-খাওয়া
অগণিত মানুষের হাটে!
যদি মুখ আদপেই খুলি বলব কি এপ্রিলের
উত্তপ্ত হাওয়ায় ঘেমে মেঘে রোজ হচ্ছি নাজেহাল,
ব্লাউজ পিস্টা চমৎকার…তোমাকে মানাবে ভালো
পরো যদি খয়েরি শাড়ির সঙ্গে অথবা হানিফ
করেছে সেঞ্চুরি ফের, দালাই লামার আত্মজীবনীতে কত
ঘটনার সমাহার; বলব কি চলো যাই কফি খাই
হাল ফ্যাশনের কিছু বই পড়া চাই
নইলে লাফাবে তুমি এঁদো ডোবা, কুয়োর ভেতরে।
বলব কি টাইয়ের নিখুঁত নট শিখলোনা বাঁধতে বেচারা
আজ অব্দি, বলব কি তিনটি সরলরেখা মিলেই ত্রিভুজ…
ঘরে বসে ছুঁচোর কেত্তনে আজ মেটাব কি সাধ,
বলব কি…
ডায়েরির একটি পাতা
সকালের রোদে এই সাতই আশ্বিনে
আরো একটি দিন এলো জানাতে সাদর
সম্ভাষণ। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চাদরে পা ঘষি,
অন্যমনে আঙুল চালিয়ে দিই চুলে
কোথাও উজ্জ্বল মোটরের হর্ন বেজে ওঠে (শুনি)
চেনা শব্দ হরেক রকম। টিক টিক ঘরি বাজে, ঠিক ঠিক
টিকটিকি সাড়া দেয় সহযোগী তন্ময় নিষ্ঠায়।
বাথরুমে গড়ায় কলের পানি, বারান্দায় দেখি
হাওয়ায় টবের ফুলে সে কী গলাগলি।
আলোলাগা ভালোলাগা বেলা
খেলা করে সত্তার প্রাঙ্গণে
-বেঁচে আছি।
আলনায় ঝোলানো আমার
ইজের কামিজ সাদা দেয়ালের ফুল,
টেবিলে পুরানো ছবি, শুকনো ফল, দাড়ি কামাবার
সরঞ্জাম, অসমাপ্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি, বই
সবকিছু ঝলমলিয়ে ওঠে
আশ্বিনের রোদ্দুরে এবং
মনে হয় থাকব এখানে চিরদিন।
যখন পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে
রুটি মাখনের ঘ্রাণ, সোনালি চায়ের
সুগন্ধ, চূড়ির শব্দ, দরজায় আড়ালে তোমার
কণ্ঠস্বর ছোঁয় প্রাণ, ভাবি কী সুন্দর
এই বেঁচে থাকা…
তিনটি বালক
রুটির দোকান ঘেঁষে তিনটি বালক সন্তর্পণে
দাঁড়ালো শীতের ভোরে, জড়োসড়ো। তিন জোড়া চোখ
বাদামি রুটির দীপ্তি নিল মেখে গোপন ঈর্ষায়।
রুটিকে মায়ের স্তন ভেবে তারা, তিনটি বালক
তৃষিত, আত্মাকে সঁপে সংযত লোভের দোলনায়,
অধিক ঘনিষ্ঠ হ’ল তন্দুরের তাপের আশায়।
কিন্তু তারা কর্মঠ থাবার তাড়া খেয়ে, তাড়াতাড়ি
ফিরে গেল হিমেল বাতাসে খুঁজে নিতে অন্য কোনো
বুভুক্ষার পরিমেল। যে বুড়ো লোকটা আধপোড়া সিগারেট
তন্ময় নিষ্ঠায় রাস্তা থেকে তুলে নেয়, তার কাছে
তিনটি বালক যেন নরক পালক, সহযাত্রী
দুঃখের ভ্রমর-ডিসেম্বরে ফুটপাতে
কুঁকড়ে থেকে এক কোণে হাড়ে হাড়ে টের পায় যারা
হিমেল হাওয়ার ধার শরীরের মাংস যেন খ’সে প’ড়ে যাবে
ইতস্তত পচা কমলালেবুর মতো নামমাত্র স্পর্শে, আর
ফুটোভরা কাঁথার তলায় শুয়ে তারাময় খোলা
আকাশের নিচে কোনো দিন
হয়তো অলক্ষ্যে হয় স্বর্গের শিকার।
মাঝে-মাঝে স্বপ্ন দেখে ম্লান কুয়াশায়
এক ঝাঁক ঘুঘু নামে পূর্বপুরুষের
সম্পন্ন ভিটায়।
দুঃখ
আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে
কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে
দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি
ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়
দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি
এবং বুলোয়
তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।
আমাদের একরত্তি উঠোনের কোণে
উড়ে-আসা চৈত্রের পাতায়
পাণ্ডুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায়
গ্রীষ্মের দুপুরে ঢক্ঢক্
জল-খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত-ঠকঠক
রাত্রির নরম লেপে দুঃখ তার বোনে
নাম
অবিরাম।
পিরিচ চামচ আর চায়ের বাটিতে
রোদ্দুরের উল্কি-আঁকা উঠোনের আপন মাটিতে
দুঃখ তার লেখে নাম।
চৌকি, পিঁড়ি শতরঞ্জি চাদর মশারি
পাঞ্জাবি তোয়ালে লাল কস্তাপেড়ে শাড়ি
প্রখর কম্বল আর কাঁথায় বালিশে
ঝাপসা তেলের শিশি টুথব্রাশ বাতের মালিশে
দুঃখ তার লেখে নাম।
খুকির পুতুলরানী এবং খোকার পোষমানা
পাখিটার ডানা
মুখ-বুজে-থাকা
সহধর্মিণীর সাদা শাড়ির আঁচলে দুঃখ তার
ওড়ায় পতাকা।
পায়ে-পায়ে-ঘোরা পুষি-বেড়ালের মসৃণ শরীরে
ছাগলের খুঁটি আর স্বপ্নের জোনাকিদের ভিড়ে
বৃষ্টি-ভেজা নিবন্ত উনুনে আর পুরানো বাড়ির
রাত্রিমাখা গন্ধে আর উপোসী হাঁড়ির
শূন্যতায় দুঃখ তার লেখে নাম।
হৃদয়ে-লতিয়ে-ওঠা একটি নিভৃততম গানে
সুখের নিদ্রায় কিবা জাগরণে, স্বপ্নের বাগানে,
অধরের অধীর চুম্বনে সান্নিধ্যের মধ্যদিনে
আমার নৈঃশব্দ আর মুখর আলাপে
স্বাস্থ্যের কৌলিন্যে ক্রূর যন্ত্রণার অসুস্থ প্রলাপে,
বিশ্বস্ত মাধুর্যে আর রুক্ষতার সুতীক্ষ্ম সঙ্গিনে
দুর্বিনীত ইচ্ছার ডানায়
আসক্তির কানায় কানায়
বৈরাগ্যের গৈরিক কৌপীনে
দুঃখ তার লেখে নাম।
রৌদ্রঝলকিত ভাঙা স্তিমিত আয়নায়
নববর্ষে খুকির বায়নায়
আমার রোদ্দুর আর আমার ছায়ায়
দুঃখ তার লেখে নাম।
অবেলায় পাতে-দেয়া ঠাণ্ডা ভাতে
বাল্যশিক্ষা ব্যাকরণ এবং আদর্শ ধারাপাতে
ফুলদানি, বিকৃত স্লেটের শান্ত মেঘলা ললাটে
আর আদিরসাত্মক বইয়ের মলাটে
চুলের বুরুশে চিরুনির নম্র দাঁতে
দুঃখ তার লেখে নাম।
কপালের টিপে,
শয্যার প্রবাল দ্বীপে,
জুতোর গুহায় আর দুধের বাটির সরোবরে
বাসনার মণিকণ্ঠ পাখিডাকা চরে
দুঃখ তার লেখে নাম।
বুকের পাঁজর ফুসফুস আমার পাকস্থলিতে
প্লীহায় যকৃতে আর অন্ত্রের গলিতে
দুঃখ তার লেখে নাম।
আমার হৃৎপিণ্ডে শুনি দ্রিমিকি দ্রিমিকি দ্রাক্ দ্রাক্
দুঃখ শুধু বাজায় নিপুণ তার ঢাক।
ঐ জীমরতিভরা পিতামহ ঘড়ির কাঁটায়
বার্ধক্য-ঠেকানো ছড়ি, পানের বাটায়
গোটানো আস্তিনে দুমড়ানো পাৎলুনে
কাগজের নৌকা আর রঙিন বেলুনে
দুঃখ তার লেখে নাম।
কখনো না-দেখা নীল দূর আকাশের
মিহি বাতাসের
সুন্দর পাখির মতো আমার আশায়
হৃদয়ের নিভৃত ভাষায়
দুঃখ তার লেখে নাম।
দুপুরে মাউথ অর্গান
উন্মত্ত বালক তার মাউথ অর্গানে দুপুরকে
চমকে দিয়ে সন্দেহপ্রবণ কিছু মানুষ ব্যতীত
দালান পুলিশ গাড়ি চকিত কুকুর অ্যাসফল্ট
রেস্তোরাঁকে বানাল দর্শক। ট্রাফিক সিগন্যালের
সবুজ বাতিটা ফের নতুন আশার মতো ঝল-
মল জ্বলে, কয়েকটি সম্ভ্রান্ত মোটর পাশাপাশি
হঠাৎ হরিণ হতে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে বুঝি
রোদচেরা সমুরের গমকে।
এভেন্যুর ফুটপাতে
উন্মত্ত বালক নেই, মাউথ অর্গান নাচে শুধু
দূরে-কাছে বাতাসের ঝঙ্কৃত সঙ্গতে। দুপুরের
রৌদ্রের বর্ষায় লোকগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠায়
প্রত্যেকটি মানুষকে মনে হল স্বপ্নে-ভেসে-ওঠা
দ্বীপের মতন, লুপ্ত স্মৃতির সন্ধানে চমকিত;
সুরের হীরকদ্যুতি ঝলসিত বুকের শ্লেষ্মায়
মগজের কোষে। ফুটাতে শুয়ে-শুয়ে সিংহ মুখো
কুষ্ঠরোগী আকাশে দু’চোখ রাখে, স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে
রঙিন পাখির কত নরম শরীর ভেসে যায়,
বাতাসে ছড়ায় রঙ। কখনো ভাবে না তারা কবে
ট্রেনের চাকার তলে কে রাখল দুঃস্বপ্ন-মথিত
মাথা তার, জানে শুধু অফুরন্ত ওড়ার আকাশ
বালকের অর্গানের সুরে ঝরে ত্রিতল দালানে,
রঙমাখা ক্লান্ত ঠোঁটে, নিঃশেষিত ফলের ঝুড়িতে
পথে বিট পুলিশের পোশাকের নিষ্প্রাণ শাদায়
মোটরের মসৃণ শরীর আর ব্যাংকের দেয়ালে
ফুটপাতে পরিত্যক্ত বাদামের উচ্ছিষ্ট খোসায়
পকেটমারের ক্ষিপ্র নিপুণ আঙুলে, তিনজন
গুণ্ডার টেড়িতে শুকনো-মুখ ফেরিঅলার গলায়।
কুষ্ঠরোগী দ্যাখে তারও ক্ষতের পিছল রসে ঝরে
মত্ত বালকের অর্গানের সুর ভাবে এই সুর
পারে না গড়তে তার গলিত শরীরে ভাঁজে ভাঁজে
আবার নতুন মাংস শিল্পের অলীক রসায়নে?
হতে কি পারে না তার বিনষ্ট শরীর ওই দূর
আকাশের পাখিদের মতো ফের সহজ সুন্দর?
নরমুণ্ডের নৃত্যে
স্ফটিক পাত্রে রুপালি পানীয়
কাঁপছে তরল জ্যোৎস্নার মতো,
অঞ্জলি ভরা ফুলের পরাগ
অঙ্গার হলো চোখ ফেরাতেই।
পিপাসায় জ্বলি এবং আমিও
চরম ক্ষতির বোঝা টেনে চলি।
জ্ঞানের গরিমা উঁচু মিনারের
চূড়ো না ছুঁতেই হারিয়েছে খেই;
সকালসন্ধে দর্শন খুঁড়ে
এনেছি চকিত চতুর মুষিক।
তুমি যা-ই বলো চরাচরে আজও
অলীক ঘটনা ঘটছে সদ্য।
জ্ঞানীণ্ডণীদের নাকের তলায়
অহরত কত খেল চমকায়
কে তার ভাষ্য দেবে নির্ভুল?
ত্রিলোকে তেমন মল্লিনাথের,
ঈশ্বর জানে, দেখা মেলা ভার।
কালো মহাদেশ অনিশ্চিতের
নাগরদোলায় ঘুরছে সদাই
এবং অযুত তারার মুলুকে
মহাশূন্যের সেনা দেয় হানা।
ভালুকের কড়া দাপটে ঈগল
ক্ষুব্ধ চিত্তে ঝাপটায় ডানা;
সমানে-সমানে কোলাকুলি তাই
বিমূঢ় সিংহ খাচ্ছে বিষম।
শীর্ষ মেলাটি বুদ্বুদ যেন
এক লহমার ফুৎকারে ফাটে;
থাকবে বজায় ঠাণ্ডা লড়াই।
সিংহমশাই ছয় মোড়লের
হাটে যেতে চান, কিন্তু সহসা
পথ আগলায় শক্রপক্ষ।
দিনকাল বড় বেয়াড়া এখন-
এমনকি তার শুকনো হাড়ের,
হায়রে কপাল, আশ্বাস নেই।
গাত্র বাঁচিয়ে পুণ্যবানেরা
পথ চলে বটে দৈনন্দিন,
কিন্তু তাঁদের শান্ত সকাল,
অলস দুপুর অমাবস্যার
কুটিল আঁধারে হচ্ছে বিলীন।
হাবেভাবে তাঁরা এত সমাহিত,
ঈশ্বর যেন বন-ভোজনের
ঠাণ্ডা আমেজে মগ্ন এখন।
নরমুণ্ডের ভয়াল নৃত্যে
চলছে যখন স্বপ্ন হনন,
দুঃস্বপ্নের ঊর্ণাজালেই
দার্শনিকের প্রবীণ কণ্ঠে
মানবতা আনে অযুত যুগের
সূর্যোদয়ের প্রেমঘন ভাষা।
পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ
পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ চেয়েছে চাঁদের কাছে বুঝি
একটি অদ্ভুত স্বপ্ন তাই রাত্রি তাকে
দিল উপহার
বিষাদের বিস্রস্ত তনিমা
যেন সে দুর্মর কাপালিক
চন্দ্রমার করোটিতে আকণ্ঠ করবে পান সুতীব্র মদিরা
পৃথিবীতে সম্পন্ন গাছের পাতা ঝরে
হরিণের কানের মতন পাতা ঝরে ধ্বনি ঝরে
উজ্জ্বল মাছের
রুপালি আঁশের মতো ধ্বনি ঝরে ঝরে ধ্বনি
ঝরে পৃথিবীতে
সে ধ্বনির আকাঙ্ক্ষায় জ্ব’লে ততদিন সে-ও
থাকবে পথের প্রান্তে প্রতীক্ষার ঘাটে
যতদিন সহজে ভাসানো চলে সোনার কলস
রৌদ্রের দস্যুতা জেনে বৃষ্টির আঁচড়ে
মুহ্যমান দুঃখের দর্পণে দেখে মুখ
বাসি রুটি
চিবোয় অভ্যাসবশে জ্যোৎস্নাজ্বলা দাঁতে
আর স্মৃতিগুলি একপাল কুকুরের মতো
খিঁচিয়ে ধারালো দাঁত মনের পিছনে করে তাড়া
ভাবে
একতাল শূন্যতায় ভাবে
বেহেস্তের ছবি যায় কশাই চামার
ছুতোর কামার আর
মুটে মজুরের ঘরে আর দরবেশের গুহায়
বাদশার হারেমে সুন্দরী বাঁদী যদি
বিলাসের কামনার খাদ্য হয় সোহাগ জোগায়
বিলোল অধরে
গড়ায় ক’ফোঁটা পানি ক্ষুধিত পাষাণে
অথবা নুলোর বউ কাঁদে ভাদ্রের দুপুরে
তবে যে লোকটা হেঁটে যায়
বিকেলের মোলায়েম রোদে
তার কীবা এসে যায়
অন্যের দুঃখের নদী বয়ে যেতে দেখে
আমরা সবাই কম বেশি
স্বস্তির হাওয়ায় ভাসি নিজের ফাঁড়ার কথা ভেবে
একচ্ছত্র ক্ষুধার সাম্রাজ্যে ঘুরে ঘুরে
ধুলো ঘেঁটে ছাই ছেনে হৈ হৈ ছেলেদের
দৌরাত্ম্যে অস্থির
ফিরে আসে পার্কে এই নিরানন্দ বাদামের খোসা
ভবঘুরে কাগজের অভ্যস্ত জগতে
যেখানে অনামি
বাউণ্ডুলে ময়লা ভিখিরি আর লম্পট জোচ্চোর
গণ্ডমূর্খ আর ভণ্ড ফকির অথবা
অর্ধনগ্ন ভস্মমাখা উন্মাদিনী বেহেড মাতাল
এসে জোটে সন্ধ্যার আড়ালে
যখন কোথাও
রজনীগন্ধার ডালে কাগজের মতো চাঁদ বোনে
স্বপ্নের রুপালি পাড়
অর্ধদগ্ধ বিড়িটাকে শুকনো ঠোঁটে চেপে
তাকায় রাস্তার ধারে চাঁদহীন মাঠে
অদ্ভুত বিকৃত মুখে যেন
পৃথিবীর কোনো সত্যে সৌন্দর্যে কল্যাণে
আস্থা নেই তার যেন একটি কর্কশ পাখি
আত্মাকে ঠুকরে বলে তোমার বাগান নেই বলে
রক্তিম গোলাপ আসবে না
বিকলাঙ্গ স্বপ্নের অলিন্দে কোনো দিন
জানে তার নেই ঠাঁই সুন্দরের কোলে
নুলোর বউটা তবে তাকে
থাক থাক
এসব কথার বুজরুকি
কখনো সাজে কি তার চালচুলো নেই যার এই
দুনিয়ার ঘরে
রোঁয়াওঠা কুকুরের সাহচর্য্যে গ্রীষ্মের গোধূলি
হয়তো লাগবে ভালো রাত্রি এলে চাঁদ
হয়তো অদ্ভুত স্বপ্ন দেবে তার সত্তার মাটিতে
বিষাদের ঘরে
কেউ জাগাবে না তাকে
পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জটাকে
পিতার প্রতিকৃতি
‘কখনো নদীর স্রোতে মৃত গাধা
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে। গোবিন্দলালের পিস্তলের
ধোঁয়ায় রোহিনী আর একটি যুগের অস্তরাগ
মিশে যেতে দেখেছি আমরা’-বলে
পিতা থামলেন কিছুক্ষণ।
তিনি ভোরে খাচ্ছিলেন রুটি আর স্মৃতির তিতির
পুরানো চেয়ারে ব’সে। রোদ্দুরের অরেঞ্জ স্কোয়াশে
ভিজিয়ে প্রবীণ কণ্ঠ বল্লেন জনক
“আমি তো বেঁচেছি ঢের খেয়ে-দেয়ে
ভালো থেকে অশেষ কৃপায়
তাঁর, কত বছরের রৌদ্রজলে ক্ষ’য়ে গেছে
অস্তিত্বের ধার
আর কে না জানে প্রকৃত দীর্ঘায়ু যিনি
অনেক বিচ্ছেদ মৃত্যু তার মনে প্রেতের ছায়ার
মতো ঝুলে থাকে আজীবন। শৈশবের
অশেষ সন্ধান তাকে টেনে আনে জনশূন্যতার
নেউল-ধূসর তীর্থে, যেখানে কুয়োর জলে
সত্যের নিটোল মুখ দেখার আশায়
যেতে হয়-যেখানে দরোজা বন্ধ, বারান্দায়
পাখির কংকাল,
গোলাপের ছাই প’ড়ে আছে
একটি বাতিল জুতো বিকেলের রোদের আদরে
হেসে উঠে বলের মতন নেচে নেচে নিরিবিলি
ফুলের জগতে চলে যায়
এবং একটি ঘোড়া চমকিত বালকের আকাঙ্ক্ষার ঘ্রাণে
মত্ত হয়ে ছুটে যায় দলছাড়া মেঘের তল্লাশে,
সহসা খিঁচিয়ে মুখ ছিঁড়ে নেয় অস্তগামী
সূর্যটির মাংস একতাল।
বেঁচে আছি বহুদিন তবু পৃথিবীকে
এখনও রহস্যময় মনে হয়… আর শোনো
ভাবতে পারি না
কোনো দিন থাকব না এখানে, চেয়ারে ব’সে
ঝিমাব না
ভোরের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে কোনো দিন।
‘তখন থাকবে তুমি আমার সন্তান
-দীর্ঘজীবী হও তুমি,
তোমার কর্মঠ আঙুলের উষ্ণ রক্তে ঘন ঘন
আমার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলি
এক ঝাঁক হাসের মতোই জানি
নিপুণ সাঁতার কেটে তোমাকে জোগাবে স্বপ্ন অনিদ্রার রাতে-‘
-বলে তিনি মুগ্ধ চোখে ফেরালেন মুখ
অতীতের দিকে,
তখন রাসেল রিলকে বুদ্ধ পিকাসোর
নাম জানেন না ভেবে
পারিনি করুণা করতে বয়েসী পিতাকে।
পুরাকালে
পুরাকালিএ কে এক বণিক তার সবচেয়ে দামি
মুক্তোটিকে বাগানের মাটির গভীরে
রেখেছিল লুকিয়ে যেখানে
সূর্যের তিমির-দীর্ণ আলো
পৌঁছেনি কখনো,
হৈমন্তী গাছের পাতা ঝরেনি যেখানে।
তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছা সেই
মুক্তোর মতোই জ্বলে আমার ভেতর রাত্রিদিন
আর আমি ভাবি এই সৌন্দর্যকে লালন করার
আশ্চর্য সাহস
কে দিল আমাকে?
মাথায় ভাবনা নিয়ে
মাথায় ভাবনা নিয়ে খুপরিতে আছি শুয়ে এই
নিজের আঁধারে লগ্ন, দেখি
ময়লা দেয়ালে আঁকা দুঃখের নিভৃত ফুল আর
মনকে প্রবোধ দিই রাত্রিদিন দুর্দশার ঢাক
বাজিয়ে কী লাভ?
প্রাণধারণের কত অমাবস্যা, কত না পূর্ণিমা,
বৈশাখের দীপ্ত দিন, শ্রাবণের সন্ধ্যা সুনিবিড়-
জীবনের এই রূপান্তর, আবর্তিত ইতিহাস,
ব্যক্তি-সমাজের চেতনায়
সোনার রোদ্দুর দিয়ে বোনে
প্রত্যহ স্বপ্নের পাড় বিমুগ্ধ খেলায়।
আত্মদান স্মৃতি আর সম্প্রীতির নিবিড় পূর্ণিমা
মানুষে মানুষে পড়ে আশ্চর্য সংলাপ
জীবনের মতো ব্যাপ্ত একটি সিম্ফনি
ঝরায় ঝরনার পানি
ফোটায় বাগানের ফুল স্বপ্নে জাগরণে।
দ্যাখো এই ঘরে জ্যোতির্ময় হতে পারে আজও,
আবার আমার আত্মা নতুন জন্মের প্রতিভায়
হতে পারে নিবিড় বাগান
তোমার দৃষ্টির তারাময় প্রস্রবণে।
যখন নিরুদ্ধ হতাশায় জীবনকে মনে হয়
একমুঠো বালি আর আকাশের চাঁদ
প্রতিভাত হয়
ভিক্ষুকের ভাঙা পাত্র বলে,
তোমার স্বপ্নের দীপ জ্ব’লে ওঠে নরকে আমার-
বুভুক্ষায় ঝরে
চকিতে স্বর্গের কান্তিবিগলিত দ্রাক্ষার মদিরা।
মায়ের চোখে
আমার খোকন গাঢ় দুপুরে ঘুমাত, ঘুমাবার
করত ভান আমার বালিশে, বুকে আর
‘গল্প বলো…কড়ির পাহাড়, শঙ্খমালা’, বলত গ্রীষ্মের দুপুরে
কাঁচা আম কত জলছবি হাতে, জাহাজের বাঁশি বাজাত নকল সুরে।
ওঁর চশমা চোখে টুপি পরে দেখা দিত মস্ত সং
আমার হেঁশেলে, লাল টুকটুকে কচি মুখে বুজরুকি ঢং
মাটিতে লুটাতে হেসে আর যারা দেখত পাঁচজন,
বলত, কী-যে কাণ্ড করে একরত্তি তোমার খোকন।
এখন সে স্থূলোদর, প্রশস্ত কপাল, পাতলা চুল
ঢাকে না মাথার টাক, স্লেট হাতে যায় না ইস্কুল।
আজ দেখি স্বাস্থ্যান্বেষী সে-ও ছড়ি হাতে
পার্কে কিংবা নদীতীরে (যদি কমে বাড়তি মেদ, বাড়ে
খুদেটুকু) ঘরে ফেলে সিঁড়ি হাতড়িয়ে অন্ধকারে।
বেড়েছে রক্তের চাপ, দাগ মেপে ঠিকঠাক ঘুমহীন রাতে
কেবলি ওষুধ খায়, ডেন্টিস্টের কাছে যায় যখন-তখন
আমার খোকন।
মূল্যের উপমা
(তাকে, আমাকে যে কবি ব’লে উপহাস করত)
লিখি না গোয়েন্দা গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী
কিংবা চিত্রতারকার বিচিত্র জীবনপঞ্জি লিখে
হয়নি প্রচুর অর্থাগম। অথচ যা-করি তা-ও
যায় না কখনো বলা অসংকোচে ভদ্রমণ্ডলীকে।
আমার উঠোনে সুখ নয় জানি মরালগামিনী
সকালের তাজা রোদে অপরাহ্নে অথবা উধাও
রাত্রির উপুড় করা অন্ধকারে। যখন প্রেমিক
প্রেমিকার উন্মোচিত স্তনে মুখ রেখে ভোলে শোক,
ঠোঁটের উত্তপ্ত তটে থরথর জীবনের দিক
ঝড়ে-পড়া সারেঙের মতো খোঁজে, গণিকার চোখ
যখন কাজলে দীপ্ত ক্লান্তির আড়ালে নগরের
অষ্টতম নাগরের আলিঙ্গনে, জেগে থেকে জ্বলি
স্বর্গবাসী স্বপ্নের চিন্তায় দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ টেবিলের
নিষ্কম্প আলোর দিকে দৃষ্টি মেলে। নিজেকে কেবলি
ছেড়ে দিই শুভ্রতম জীবনের বিস্তীর্ণ অতলে।
নিখাদ বিশ্বাস নিয়ে নির্বীজ মাটির রুক্ষতাকে
সাজাই সরেস ফুলে, আমার ঝর্ণার স্নিগ্ধ জলে
মরুভূমি আর্দ্র হয়, শুকনো মৃত কাঠ হয় বীণা
এবং কর্দমে জেগে ওঠে এমন প্রতিমা যাকে
ত্রিলোকে দ্যাখেনি কেউ। প্রত্যহ নগদ মূল্য বিনা
দেয়াল পাথর গাছ নদী বালি বাতাস আঁধার
বিড়ালের চোখ আর পাখির ডানার কাছে শুধু
কথা খুঁজি নিজেকে জীবনপণ যুদ্ধে করে ক্ষয়।
অথচ করে না কেউ ক্ষমা, তাই আমি জ্বলি ধু-ধু-
বিজ্ঞাপন, করতালি, বরমাল্য, জয়-পরাজয়
যা-ই হোক, জানি তবু একরত্তি মূল্য নেই তার।
মেষতন্ত্র
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ,
মনে চিন্তার নেইকো লেশ।
ডানে বললে ঘুরিস ডানে,
বামে বললে বামে।
হাবে ভাবে পৌঁছে যাবি
সোজা মোক্ষধামে।
চলায় ঢিমে তালের রেশ,
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ।
যাদের কথায় জগৎ আলো
বোবা আজকে তারা,
মুখে তুবড়ি ছোটে যাদের
আকাট মূর্খ যারা।
দিনদুপুরে ডাকাত পড়ে
পাড়ায় রাহাজানি,
দশের দশায় ধেড়ে কুমির
ফেলছে চোখের পানি।
পৃথিবীটা ঘুরছে ঘুরুক
মানুষ উড়ুক চাঁদে,
ফাটায় বোমা সাগর তলায়
পড়ছে পড়ুক ফাঁদে।
তোর তাতে কি? খড়বিচুলি
পেলেই পোয়াবারো।
জাবর কেটে দিন চলে যায়,
পশম বাড়ুক আরও।
জগৎ জোড়া দেখিস ঐ
সবুজ চিকন ঘাসের দেশ।
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ!
যখন রবীন্দ্রনাথ
যখন রবীন্দ্রনাথ কালো ঘোড়াটাকে সিন্ধুপারে
দেখলেন, সম্মুখ শান্তির পারাবার
অবগাহনের তৃষ্ণা নিয়ে চোখে দৃশ্য-মোছা-ঝড়ে
দিলেন প্রশান্ত দৃষ্টি মেলে চরাচরে,
মৃত্যুর অতীত সৃষ্টিলীলা, শান্তিলেপা কত ছবি
শব্দের ছন্দের জাদু, মায়াবনবিহারিণী হরিণী এবং
ছায়া সুনিবিড় গ্রাম, মাছের কানকা ভরা গলি, ঋতুরং-
যেদিন গেলেন তিনি, ভুললেন সবি।
হামেদ জালাল, সেই পৌঢ়, জ্যোৎস্না রাতে
যিনি গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায় ভেসে
আপেলের মতো ছাড়িয়ে সত্যের খোসা, স্মিত হেসে
বুদ্ধের মূর্তির নিচে, যিনি বাদামি চুলের বান্ধবীর সাথে
কাঁকড়ার ঝোল কিংবা অয়েস্টার চোখে,
মাতাডোর আর ষাঁড়ের লড়াই দেখে
মিটিয়ে চোখের তৃষ্ণা ঘাসের ঘাগরার নাচে, শেষে
একদিন সাফল্যের তরী বেয়ে সুদূরে আবেশে
স্বদেশের ঘাটে ভিড়লেন,
যিনি শালিকের দিকে চেয়ে ‘আগে এখানে নামিনি?
তিনিও ধুলোয় মিশে ভুললেন কাঞ্চন-কামিনী,
ত্বকের নিবিড় লেনদেন।
সুফিয়া খাতুন যার ঘন কেশদামে
ছিল দীপ্ত যৌবনের স্বর্ণভস্ম, যাকে নীল খামে
স্বামী ছাড়া আরো ক’জন উদ্ভ্রান্ত যুবা নানা ছলে
পাঠিয়েছে পত্র-লোকে বলে,
তিনিও কবরে শুয়ে ভোলেন নিপুণ কামকলা।
কর্মঘর্ম গাঁথা ব্যস্ত রাস্তায় গলিতে যারা গলাবাজি
করে, দাঁতে দাঁত ঘষে,
সহানুভূতির মতো সবুজ সবজির প্রয়োজনে দর কষে,
রুটির মতোই জীবনকে ধ্রুব জানে
জমায় বিভ্রান্ত ভিড় শুঁড়ির দোকানে,
সোনার ষাঁড়ের লেজ ধরার আশায় দিনরাত
ঘোরে দিগ্ধিদিক, বিকেলের মিহি রোদে
নেতার বক্তৃতা শুনে দেয় করতালি, অকস্মাৎ
মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে বেনামি দুর্জ্ঞেয় কোনো বোধে
তারা যাবে, ভুলবে বাজার দর আর
সোমবার কিবা রবিবার।
যদি ইচ্ছে হয়
যদি ইচ্ছে হয় যেতে পারি আদিম অরণ্যে
যেখানে অন্ধকারে মূল্যবান রত্নের মতো জ্বলে
পাশব চোখ, ভালুকের কশ বেয়ে
গড়িয়ে পড়ে টাটকা মধুর ধারা।
কিন্তু আমি যাইনে সেখানে, থাকি শহরে, আমার শহরে।
ঊর্ধ্বশ্বাস ট্রাফিকের ব্যস্ততায় বিজ্ঞাপনের মতো
ঝলমলিয়ে ওঠা হাসি
শিরায় আনে আশ্চর্য শিহরণ
মনে হয় যেন ঢক করে গিলে ফেলেছি
এক ঢোঁক ঝাঁঝালো মদ। আর প্রহরে প্রহরে
অজস্র ধাতব শব্দ বাজে আমার রক্তে,
যেন ভ্রমরের গুঞ্জন।
আমার ছোট খুপরিতে ভোর আসে
ব্যালেরিনার মতো নিপুণ বিন্যাসে, আমি
মৃত কবিদের প্রাণবন্ত অক্ষরে ডুবে থাকি-
বেলা গড়িয়ে অবেলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
রাতে খড়খড়িটা খুলে দেখি
বুড়ো রাজমিস্ত্রির চোখের মতো ছানি-পড়া আকাশে
জ্যামিতিক চাঁদ শোনে তারার কথকতা, সেই মুহূর্তে
রহমত ব্যাপারীর রক্ষিতা হয়তো তার ক্লান্ত যৌবনটাকে
কুঁচকে যাওয়া পোসাকের মতো
এলিয়ে দিয়েছে রাত্রির আলনায়।
কখনো দেখি, রাত্রির ফুটপাতের ধারে এসে জমে
সারি সারি উজ্জ্বল মসৃণ মোটর,
যেমন গাঢ়-সবুজ ডালে ভিড় করে
পাখির ঝাঁক সহজ অভ্যাসে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি
লোকে বলে বাংলাদেশে কবিতার আকাল এখন,
বিশেষত তোমার মৃত্যুর পরে কাব্যের প্রতিমা
ললিতল্যাবণ্যচ্ছটা হারিয়ে ফেলেছে-পরিবর্তে রুক্ষতার
কাঠিন্য লেগেছে শুধু, আর চারদিকে পোড়োজমি,
করোটিতে জ্যোৎস্না দেখে ক্ষুধার্ত ইঁদুর কী আশ্বাসে
চম্কে ওঠে কিছুতে বোঝে না ফণিমনসার ফুল।
সুধীন্দ্র জীবনানন্দ নেই, বুদ্ধদেব অনুবাদে
খোঁজেন নিভৃতি আর অতীতের মৃত পদধ্বনি
সমর-সুভাষ আজ। অন্যপক্ষে আর ক’টি নাম
ঝড়জল বাঁচিয়ে আসীন নিরাপদ সিংহাসনে,
এবং সম্প্রতি যারা ধরে হাল বহতা নদীতে
তাদের সাধের নৌকো অবেলায় হয় বানচাল
হঠাৎ চড়ায় ঠেকে। অথবা কুসুমপ্রিয় যারা
তারা পচা ফুলে ব’সে করে বসন্তের স্তব।
যেমন নতুন চারা পেতে চায় রোদবৃষ্টি তেমনি
আমাদেরও অমর্ত্যের ছিল প্রয়োজন আজীবন।
তোমার প্রশান্ত রূপ ঝরেছিল তাই সূর্যমুখী
চেতনার সৌরলোকে রাজনীতি প্রেমের সংলাপে।
যেন তুমি রাজসিক একাকিত্বে-মধ্যদিনে যবে
গান বন্ধ করে পাখি-কখনো ফেলোনি দীর্ঘশ্বাস,
যেন গ্রীষ্মে বোলপুরে হওনি কাতর কিংবা শুকনো
গলায় চাওনি জল-অথবা শমীর তিরোধানে
তোমার প্রোজ্জ্বল বুক হয়নিকো দীর্ণ কিংবা যেন
মোহন ছন্দের মায়ামৃগ করেনি ছলনা কোনো-
এমন মূর্তিতে ছিলে অধিষ্ঠিত সংখ্যাহীন প্রাণে।
গোলাপের তীক্ষ্ণ কাঁটা রিলকের সত্তার নীলিমাকে
ছিঁড়েছিল, তবু তাও ছিল স্নানাহার, চিরুণির
স্পর্শ ছিল চুলে, ছিল মহিলাকে নিবেদিতপ্রাণ।
আমার দিনকে তুমি দিয়েছ কাব্যের বর্ণচ্ছটা
রাত্রিকে রেখেছ ভরে গানের স্ফুলিঙ্গে, সপ্তরথী
কুৎসিতের ব্যূহ ভেদ করবার মন্ত্র আজীবন
পেয়েছি তোমার কাছে। ঘৃণার করাতে জর্জরিত
করেছি উন্মত্ত বর্বরের অট্রহাসি কী আশ্বাসে।
প্রতীকের মুক্ত পথে হেঁটে চলে গেছি আনন্দের
মাঠে আর ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বে তোমারই সাহসে।
অকপট নাস্তিকের সুরক্ষিত হৃদয় চকিতে
নিয়েছ ভাসিয়ে কত অমলিন গীতসুধারসে।
ব্যাঙডাকা ডোবা নয়, বিশাল সমুদ্র হতে চাই
এখনও তোমারই মতো উড়তে চেয়ে কাদায় লুটিয়ে
পড়ি বারবার, ভাবি অন্তত পাঁকের কোকিলের
ভূমিকায় সফলতা এলে কিছু সার্থক জনম।
রূপান্তর
চঞ্চলা নর্তকী নও, অথচ যখন হাঁটো কিংবা ছুটে যাও,
বর্ষার বৃষ্টির পরে রামধনু উঠলে আকাশে,
বারান্দায়, চলায় সহজে লাগে ছন্দের বিদ্যুৎ।
যখন আয়নার সামনে লিপস্টিক মাখো ঠোঁটে, হাই-হিল জুতো
পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামো, হাতে বই, বুকের উপর
কালো বেণী, চিবুকে ঘামের ফোঁটা, কী-যে ভালো লাগে।
যখন বাগান যাও, ফুল তোলো, ঝকঝকে দাঁতে
হঠাৎ কামড়ে ধরো সবুজ পেয়ারা, ময়নাকে
ছাতু দাও খেতে আর ভাঁড়ারের অন্ধকার কোণে
আঁতকে ওঠো আরশোলা দেখে, পানি চেয়ে
ভেঙে ফ্যালো গ্লাস, নখ খাও এবং চাবির রিং
ঘোরাও আঙুলে
অথবা সুরের তাল কেটে গেলে তন্ময় বিকেলে
খিলখিল ওঠো হেসে, ক্যারম খেলতে গিয়ে সারা
খেলাটাই করো মাটি
কী করে বোঝাই কতো ভালো লাগে তোমাকে তখন!
অবশ্য কখনো
কবিতা পড় না তুমি (ক্লাসের বরাদ্দ পদ্য ছাড়া)
তাতে কী? তবুও এ সুন্দর শরীরী সৌরভে মেতে
পৃথিবীতে আছ তাই মেটাই চোখের তৃষ্ণা
সারাক্ষণ।
হয়ত পারতে হতে সোনালি-নিবিড় বালুকণা
আমার মুঠোয় ঝলোমলো, ভাবি তুমি অর্গানের
ধ্বনির মতোই শ্রাবণের কালো ফোঁটা পাতাবাহারের বুকে,
বাগানের টসটসে ফলের সুরভি, মাংসে-বেঁধা
গোলাপের কাঁটা হয়তো পারতে হতে…
রৌদ্র করোটিতে
জীবনকে তুখোড় যদি সারাক্ষণ
মাতলামো করি আর শরীর গাঁজার গন্ধে ভরে
ছট করে চলে যাই সাঙাতের ফুর্তিবাজ রকে,
পাপকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলি হ্রদের আলোর
মতো যদি উৎপীড়িত অন্ধকারে, ঘেয়ো ভিখিরির
ছেঁড়া ন্যাকড়ার ভাঁজে নক্ষত্রের ছায়া দেখি যদি
অথবা স্বপ্নের ঠাণ্ডা হরিণকে কাঁধে নিয়ে, ওহে,
কোথাও অলক্ষ্যে স’রে পড়ি, কনে-দেখা আলো সাক্ষী
রেখে বড়বাবু পৃথিবীকে একটা সালাম ঠুকে
হো-হো হেসে উঠি অতর্কিতে বদরাগী উর্দি দেখে,
তবে কি বেল্লিক ভেবে সরাসরি দেবে নির্বাসন
চিরতরে অথবা লেখাবে দাসখৎ শোকাবহ
আত্মার সাক্ষাতে? যাই করো, চিরদিন আমি তবু
থাকব অনড় সাক্ষী তোমাদের কাপুরুষতার।
জানি যারা দেখতে চায় নিষ্কলুষ জ্যোৎস্নার সারস
ঘুমেভরা ডানা দুটি গুটিয়ে রয়েছে ব’সে ভাঙা
দেয়ালের মস্ত বড় হাঁয়ের ভেতর, দেখতে চায়
বয়স্কের তোবড়ানো গালের মতন অতীতের
ধসে কয়েকটি ক্লান্ত নর্তকী ঘুঙুর নিয়ে করে
নাড়াচাড়া, যারা দেখতে চায় ঝাড়লণ্ঠনের নিচে
মোহিনী সৌন্দর্য আবর্তিত কুৎসিতের আলিঙ্গনে
রাত্রির স্খলিত গালিচায়, ফেলেনি নোঙর তারা
কোনো দিন বণিকের জ্বলজ্বলে সম্পন্ন বন্দরে।
নির্বাসন দাও যদি জনহীন অসহ্য সৈকতে,
নিহত আত্মার শোকে করব না কখনো বিলাপ।
বরং নির্মেষ মনে হাত-পা ছড়িয়ে অবিচল
দুর্দশার প্রহার গ্রহণযোগ্য করে দেখব সে
ডানপিটে সূর্যটাও সহসা উধাও অন্ধকার
বনে; নিশাচর বেদে চাঁদের প্রসন্ন মুখে পাখা
ঝাপটায় ঢাউস বাদুড়, ছিঁড়ে ফেলে শুভ্রতাকে।
কখনো দেখব স্নপ্ন-কয়েকটি জলদস্যু যেন
অবলীলাক্রমে কাটা মুণ্ডুর চামড়া নিচ্ছে তুলে
অব্যর্থ ছোরার হিংস্রতায়, গড়ায় মদের পিপে
রক্তিম বালিতে আর বর্বর উল্লাসে চতুর্দিকে
কম্পিত পাতার মতো শব্দের ধমকে। কখনোবা
হঠাৎ দেখব জেগে শুয়ে আছি হাত-পা ছড়ানো
বিকেলের সাথে নামহীন কবরের হল্দে ঘাসে,
দেখব অঢেল রৌদ্রে ঝল্সে উঠে ঝরায় চুম্বন
ওষ্ঠহীন করোটিতে, জানব না সে করোটি কার,
সম্রাট অথবা ভাঁড় যার হোক আমি শুধু একা
দেখব রৌদ্রের খেলা একটি নির্মোহ করোটির
তমসায় দেখব কে ছুঁয়ে যায় কালের বুড়িকে।
লালনের গান
যখন তোমার বাহুর বাসরে
মগ্ন ছিলাম চন্দ্রিত চন্দ্রায়,
আলো-আঁধারির চকিত সীমায়,
লালনের গান দূর হতে এলো ভেসে।
সে গানের ধ্বনি স্তব্ধ সায়রে
ফোটায় নিবিড় অজস্র শতদল।
ধুলোয় উধাও সে গানের কলি
গ্রামছাড়া পথে মনের মানুষ খোঁজে।
শৈশব-গাঁথা জামতলা আর
কনক দুপুরে শ্রাবণ দিঘির ডুব,
ঘোরলাগা ভোর, অভিজ্ঞ সাঁঝ-
সবি আছে বুঝি স্মৃতির অভ্রে ডুবে।
কে আসে ঘাসের স্তব্ধ সবুজে
নীরবে নগ্ন শুভ্র চরণ ফেলে?
সে-যে সেই গান স্পন্দনে যার
আঁধারেও চির মনের মুকুল জ্বলে।
অবচেতনার গহন ধারায়
তারাময় মনে জাগে স্বপ্নের পলি।
একটি চাঁপার বিন্দুতে মেশে
সব দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিত অবসান।
সে গানের সুর জীবনে ঝরায়
জুঁই-চামেলির অরূপ সুরভি আজও
অস্তরাগের ধ্যানী বাসনায়
জ্বলে ওঠে ক্কীণ দীপ্ত চন্দ্রকলা।
কাল মন্থনে চেতনায় জাগে
অতীতের দ্বীপ, স্মৃতির প্রবালে লাল।
বর্তমানের মুক্ত আধারে
ভবিষ্যতের দীপাবলি ওঠে ভেসে।
সে-গানের ধ্বনি ফিরে ফিরে আসে
মর্ত্যজীবীর রঙিন ধুলোর পথে-
তারই মাধুর্যে ঋতুতে ঋতুতে
রৌদ্রছায়ায় শান্ত বাগানে বাঁচি।
সে-গান আমার বৈশাখী দিনে
যাত্রী-প্রাণের তৃষ্ণার সরোবর।
তারই টানে চলি বাকাচোরা পথে-
লালনের গান স্মৃতির দোসর সে-যে।
শনাক্ত পত্র
সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে তিনটি যুবক
প্রত্যহ একত্র হয়ে ধর্ণা দেয় সূর্যাস্তের কাছে।
‘সূর্যের চুল্লিতে আমি বহুদিন সেঁকেছি আত্মাকে
উল্টিয়ে পাল্টিয়ে, ওহে, তবু দেখি এখানে-সেখানে
থেকে যায় স্যাঁতেসেঁতে কিছু ভাব। অর্থাৎ এখনও
জীবন খোলেনি তার সবগুলি দ্বার সরাসরি,
বস্তুত হাতের পাঁচ অলক্ষ্যে দিয়েছে রেখে, তাই
পৃথিবীর রকে আজও হামাগুড়ি দিই, কেউ-কেউ
‘হাঁটি-হাঁটি পা-পা এইমতো কতো নাবালক ছাঁদে
ক্রমাগত চলেছি হোঁচট খেয়ে প্রতিটি প্রহর।
তালগোল কেবলি পাকিয়ে যায় এই পরজীবী
অস্তিত্বের বিমূর্ত চৌকাঠে। পথে দৌড়ে এসে দেখি
আমার আসার আগে যাত্রীর বান্ডিল নিয়ে ওই
ছেড়ে যায় বাস’- এই বলে সটান মাঠের মরা
ঘাসে শুয়ে দুই-মুখ-ফিরে-আসা সিগারেটে দিল
সুখটান প্রথম যুবক। চেয়ে দ্যাখে প্রায় নেভা
আকাশে সূর্যের স্টোভ সূর্যাস্তের রঙ দেখে তার
মনে পড়ে হঠাৎ মোটরে দেখা মহিলার ঠোঁট।
‘ইয়ার বলেছ তোফা। সেই কবে নড়বড়ে টোলে
জল পড়ে পাতা নড়ে মুখস্থ করেছিলুম জন
ত্রিশেক বালক মিলে ঐকতানে প্রশান্ত সকালে,
দুপুরের অন্ধ-করা রোদে আজ কে কোথায়, ওহে,
পড়েছে যে ছিটকে দূরে। ধড়িবাজ যে লোকটা
দেখাল ঘুঘুর ফাঁদ, একদিন সে-ই জানব না
ছিল চেনা সুবোধ বালক, শ্লেটে যার চকখড়ি
বুলাত আদর্শ জীবনের শর্তাবলি প্রথামতো।
‘ভুলেছি সবার নাম। তাদের মুখের রেখাটুকু
মুছে গেছে স্মৃতির অস্থির ক্যানভাস থেকে আজ।
সূর্যাস্তের রোগা আলো’-অবজ্ঞার ঢিল ছুড়ে দূরে
দ্বিতীয় কথক ভাবে- ‘রাশেদা ভাবীর ম্লান ঠোঁট।
‘নামে কী-বা আসে যায়, বলেছেন, কবি-নাট্যকার;
সত্যি, কী-বা আসে যায় নামে’, বলে তৃতীয় যুবক
ঝাড়ল হাতের ছাই, ‘ধরো এই তোমার নামের
যে-অর্থ দাঁড়ায় তার কতটুকু তুমি? কিন্তু যদি
বলি কেউ আমার নামের খামে মনের খেয়ালে
বসায় তোমার নাম, অথবা আমরা তিনজন
যদি ফের তুলে নিই যে-কোনো তিনটি নাম যার
যেটা ইচ্ছে, তাতে কিছু হবে কি বিশেষ হের-ফের?
‘নেমকহারাম নই, দেখেছি তো আরজি পেশ করে
এই জীবনের কাছে রাত্রিদিন, নেপোয় মেরেছে দইটুকু-
আমরা ক’জন শুধু শুকনো মুখে শূন্য হাতে শেষে
প্রত্যহ এসেছি ফিরে রকবাজ সন্তদের ভিড়ে’,
তৃতীয় যুবক ভাবে ‘মধ্যাহ্নের চিৎকারের পরে
এখনও রয়েছে লেগে আকাশের প্যালেটে যে-রঙ,
তাকি নয় উত্তপ্ত সন্ধ্যায় বন্ধ্যা গণিকার ঠোঁট?’
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, প্রথম যুবক বলে।
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, বাতাসে দ্বিতীয় স্বর
নকশা আঁকে হিজিবিজি।। চিন্তার কপাটে পড়ে খিল।
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, বলে তৃতীয় কথক।
সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে তারা তিনজন
সূর্যাস্তের কাছে চেয়েছে শিখতে কিছু জীবনের
রসায়ন। প্রথম যুবক দ্যাখে দ্বিতীয়ের চোখে
নেই তার নিজের চোখের মণি, তৃতীয়ের চোখ
সেখানে কাঁপছে মৃদু। দ্বিতীয় কথক দ্যাখে তার
নিজের থ্যাবড়া নাক নিয়েছে প্রথমজন কেড়ে।
হোক না কার্বন কপি পরস্পর, কী-বা আসে যায়
রকবাজ সন্তদের ভিড়ে, ওহে, কী-বা আসে যায়…
প্রাণপণ হেঁকে বলো শূন্যতায় কী-বা আসে যায়।
শিকি জ্যোৎস্নার আলো
নখ দিয়ে কুটি কুটি পারি না ছিঁড়তে আকাশের
ছড়ানো ত্রিপল কিংবা সাধ্য নেই পাহাড়ের চূড়া
নিমেষে গুঁড়িয়ে দিই, পোড়াই কোরিয়া হাসিমুখে,
ফোটাই সাধের ফুল ইচ্ছেমতো গোলাপ বাগানে
আর এক চুমুকে সমুদ্রের সব জল শুষে নিই
নিপুণ খেলার ছলে, পরাক্রান্ত সিমুমের ঝুঁটি
মুঠোর ভেতর ধরি, ঝরাই শ্রাবণ সাহারায়,
আম গাছে কালো জাম ফলাই চতুর কোনো শ্রমে,
সার্কাসের বিনীত পশুর মতো উঠবে বসবে
চন্দ্র-সূর্য তর্জনীর ইশারায় সাধ্যাতীত সবি।
অকুণ্ঠ কবুল করি শিখিনি এমন মন্ত্র যার বলে
আমার বাঁশির সুরে শহরের সমস্ত ইঁদুর,
রাঙা টুকটুকে সব ছেলেমেয়ে হবে অনুগামী,
কৃতকর্মে অনুতপ্ত পৌরসভা চাইবে মার্জনী।
যে রুটিতে বুভুক্ষার শুক্নো ছায়া পড়ে প্রতিদিন,
হতে পারি অংশীদার তার সন্ধ্যার নিঃসঙ্গ কোণে;
যে অঞ্জলি পেতে চায় তৃষ্ণার পানীয়, কয়েকটি
বিন্দু তারও শুষে নিতে পারি শিকি জ্যোৎস্নার আলোয়
আত্মার ঊষর জিভে…
অথবা যেমন খুশি পারি
আঁকতে স্বর্গের নকশা। বিশ্বভ্রাতৃত্বের বোল জানি
জীবনে বাজানো চলে, যেমন গভীর তানপুরা
গুণীর সহজ স্পর্শে মিড়ে মিড়ে অর্থময়, পারি
ঈশ্বরকে চমকে দিতে হৃদয়ের ধ্রুপদী আলাপে।
শীতরাত্রির সংলাপ
যে-রাত্রির পাস্টেরনাক দেখেছেন সাদা প্রান্তরের
বরফের স্তূপে, নেকড়ের ক্ষুধিত চিৎকারে ছেঁড়া
শূন্যতায়, সে-রাত্রি দেখিনি আমি এবং এখানে
আমাদের ফটকে জমে না।
অজস্র তুষার আর বরফ চিবানো আধ-পাগলা
মেয়ে বাগানের ভাঙা বেড়াটার ধারে
অথচ চৌকাঠে
মুচ্কি হেসে দাঁড়ায় না এসে সিল্কের রুমাল-বাঁধা
চুলে খোলা পায়।
একদার কুয়াশায় লীন কোনো পৌষের হিমেল
রাত আজও অস্তিত্বের গির্জের চূড়োয়
ঝরায় শিশির কণা মনে পড়ে সেই ছোট ঘরে
প্রথম প্রহরে তুমি পড়ছিলে ডাক্তার জিভাগো
একা, গায়ে পাৎলা কোট, নামহীন দূরত্বে আসীনা-
তখন তোমাকে সহজেই ভাবা যেত বিদেশিনী,
বলেও ছিলাম তাই। আর সেইক্ষণে অকস্মাৎ
নরম কাগজ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো পাস্টেরনাকের
সাদা রাত্রি, যেন
পড়ল ছড়িয়ে সবখানে, উদ্ভাসিত
আমাদের সত্তার জটিল গাছপালা।
বলেছিলে ‘শীতের প্রখর রাত্রি দিয়েছে নামিয়ে
আমাদের অন্ধখার হা-খোলা কবরে।
হয়তো চাঁদের প্রেত খানা-খন্দে উঁকি
দেবে ক্ষণকাল, ক্ষণকাল গোপনে রাত্রির কানে
দুল হয়ে থাকবে ঝুলে ক’টি চামচিকে
তৃতীয় প্রহরে। রাত্রিভর হিম হাওয়া বয়ে যায়
রক্তের ফেনিল হ্রদে আর বারবার কেঁপে ওঠে
অস্তিত্বের প্রচ্ছন্ন কংকাল।
আমি তার উত্তরে বলেছি এই দাঁতে-দাঁতে লাগা
নীল জীবনকে তাপ দেবে বসন্তের
উদার জ্বালানি। দ্যাখো চেয়ে সৌন্দর্যের গাঢ় স্তবে
মুখর রহস্যময় নিঃসঙ্গ মানুষ।
শুধু প্রশ্নে বিদ্ধ আমি
শুধু প্রশ্নে আমি, উড্ডীন যে-প্লেন কোনো দিন
পারে না নামতে নিচে এরোড্রমে, ঘোরে দিগ্ধিদিক,
গুঁড়ো হয় বিস্ফোরণে, অথবা নিখোঁজ তারই মতো
উত্তর দেয় না ধরা মননের মায়াবী গণ্ডিতে।
বরং ঘোরায় নিত্য কত ছলে, পড়ি খানা-খন্দে,
আবর্তে তলিয়ে যাই, মাথা ঠুকি পাথুরে গুহায়।
গাছ কি শিউরে ওঠে ঠাণ্ডা ভয়ে যখন শরীর
থেকে তার পাতাগুলি ঝরে যায় অথবা আনন্দে
উল্লসিত পাখির চোখে সোনালি শস্যের মাঠ কোনো
কখনো ওঠে কি জ্ব’লে স্বপ্নের মোহন আমন্ত্রণে?
মাছ কি বিতৃষ্ণ হয়ে মগ্ন হয় আত্মনিপীড়নে
কোনো ক্ষণে জলের বাগানে চায় পাখির কোরাস?
নিজেকে নিঃসঙ্গ ভেবে পথের কুকুর ফুটপাতে
রাত্রির নেশায় মত্ত খোঁজে কোন একান্ত সুহৃদ?
সন্দেহ ক্রমশ কেন হতাশায় হয়ে যায় লীন
বুদ্ধির জটিল চৌমাথায়? অনিদ্রার আক্রমণে
বেসিনে আরশোলা দেখে আঁতকে কেন উঠি মধ্যরাতে
মুখ ধুতে গিয়ে, কেন ভাবি কাফ্কার নায়কের
পরিণা, বিপন্ন অস্তিত্ব যার বুকে হেঁটে হেঁটে
শুনতে চেয়েছে জ্যোৎস্না-চমকিত বেহালার সুর,
চেয়েছে খুঁজতে সম্পর্কের অবলুপ্ত তন্তুজাল।
শুধু প্রশ্নে বিদ্ধ আমি আজীবন, উত্তরের প্লেন
নামে না ঘাঁটিতে কোনো, থামে না তর্কের কোলাহল।
সূর্যাবর্ত
বাঁচার আনন্দে আমি চেতনার তটে
প্রত্যহ ফোটাই ফুল, জ্বালি দীপাবলি
ধ্যানী অন্ধকারে। আর মৃত্যুকে অমোঘ
জেনেও স্বপ্নের পথে, জেনেও আমার
পৃথিবীতে খুঁজি
জীবনের দান গানে গানে, প্রাণলোকে
খুঁজি ফিরি উপসৃত সুন্দরের স্মৃতি।
অভ্যাসের বিবর্ণ দৃষ্টিতে নয়, সৃষ্টির আবেশে
সপ্রেম তাকাই চতুর্দিকে
এই চরাচরে উন্মীলিত
বৈশাখী রৌদ্রের উজ্জীবনে,
উধাও মাঠের প্রান্তে ধ্যানী ঐ গাছের ছায়ায়
আর বনে বনে মর্মরিত খোলা ঊর্মিল হাওয়ায়
নীলিমায় দিই মেলে মানসমরাল।
ব্যাপ্ত এই চরাচরে পতঙ্গ অথবা
নিবিড় গোলাপ-সবি মনে হয় অরূপ রতন।
এখনও সূর্যের আলো পৃথিবীরে আসে
যথারীতি, ঝরনার মতন ঝরে সম্পন্ন গৃহীর
নিকানো উঠোনে আর কবরের পুরানো ফাটলে।
প্রদীপ্ত সূর্যের রং লাগে যুবতীর
সলজ্জ রক্তিম গালে, আর
আলো ঝরে নিদ্রাহীন রোগীর শয্যায়।
পিচ্ছিল শবের ভোজে মত্ত কৃমি অথবা আজানে
উচ্চকিত সবচেয়ে উঁচু কোনো উজ্জ্বল মিনার-
সবাই অলক্ষ্যে পায় সূর্যের প্রসাদ
সমপরিমাণে;
এবং উদার সূর্য উপমা তোমার।
প্রকৃতির টোলে আমি কখনো নিইনি পাঠ, তবু
ঋতুতে ঋতুতে
আমার সত্তার স্বরগ্রাম
কেবলি ধ্বনিত হয়, অবিরাম প্রহরে প্রহরে
এখনও যে ক্লান্ত হলে নিসর্গের কাছে
আশ্চর্যের গ্লাস হাতে যাই,
অবসন্ন চেতনার গোধূলিতে শুনি
সান্ত্বনার ভাষা এখনও রবীন্দ্রনাথ,
সে তোমারি দান।
আমাকে দিয়েছ ভাষা, তার ধ্বনি, প্রতীকী হিল্লোল
অস্তিত্বের তটে আনে কত
ঐশ্বর্যের তরী-পাল-তোলা তরঙ্গের স্মৃতিস্রোত
দীপ্ত জলযান।
আমাকে দিয়েছ ভাষা, সে-ভাষা আমার
হৃদয়ের একান্ত স্পন্দনে
প্রাণের নিভৃত উচ্চারণে
শিখা হয়ে জেগে রয় জীবনের মুক্ত দীপাধারে।
এবং নিশ্চিত জানি তোমার বাণীর
দীপ থেকে অন্য এক ভাষার প্রদীপ
জ্বালাব অযুত প্রাণে, জ্বলবে তখন
কত না হীরক সম্ভাবনা সময়ের
বিমূর্ত সন্ধ্যায়।
তুমি নও সীমিত শুধুই কোনো পঁচিশে বৈশাখে।
তোমার নামের ঢেউ একটি দিনের
সংকীর্ণ পরিধি ছিঁড়ে পড়েছে ছড়িয়ে
রূপনারানের কূলে, বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘে
অনন্তের শুভ্রতায় তুমি নও সীমিত শুধুই
পঁচিশে বৈশাখে।
যেমন রৌদ্রের তাপ জ্যোৎস্নার মদির মায়ালোকে
হাওয়ার নির্ঝরে
অথবা শ্রাবণে
অক্লান্ত বর্ষণে বেঁচে থাকি মাঝে-মাঝে
নিজেরই অজ্ঞাতে,
তেমনি তোমার
কবিতায়, গানে প্রতিধ্বনি হয়ে জাগে
আমাদের সত্তার আকাশ।
জীবন যখন ক্রমে কেবলি শুকিয়ে যায়, ডোবে
পাঁকের আবর্তে আর বর্বরের বাচাল আক্রোশে
অবলুপ্ত জ্ঞানীর সুভাষ,
জেনেছি তখন
অলৌকিক পদ্মের মতন
তোমার স্বরণ
উন্মোচিত হয়,
হয় উদ্ভাসিত
অসংখ্য প্রাণের তীর্থে এবং তোমার
গানে গানে মৃত্যুর তুহিন শীতে ফোটে
ফোটে অবিরত
জীবনের পরাক্রান্ত ফুল।
স্বগত ভাষণ
আমার মাথার ক্ষত দ্যাখে লোকে ফুলের মতন
উন্মীলিত প্রতিদিন, আমি বিশ শতকের যিশু।
আমার চৌদিকে দেখি ক্রুশকাঠ নিয়ে যাচ্ছে বয়ে
মুখ বুজে কয়েকটি শীর্ণ শব, তারাই আবার
জ্বলজ্বলে রাত্রির দোকানে এসে কয় খিলি পান
কিনে দলছাড়া হয় অথবা প্রচণ্ড ক্ষোভে মেতে
নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ে তোলে তারার কবর
দেখতে চায় না চাঁদ ভেসে যাক অবারিত নীলে।
আমার মাথাটা যেন বহ্নিমান একটি শহর
যেখানে মানুষ, যান, বিজ্ঞাপন, রেডিওর গান,
ভিখিরির চ্যাঁচামেচি, বেশ্যার বেহায়া অনুরাগ,
কানাঘুষো, নামহীন মৃত শিশু আবর্তিত শুধু।
আমাকে শাসায় ভাগ্য সারাক্ষণ, বাগে পেয়ে যদি
টিট করে দেয় ঈর্ষাতুর দেবদূত দুঃস্বপ্নের
মুখোশ দেখিয়ে তবে কী মজা লুটবে অন্ধকারে
আমার দুর্দশা দেখে নোনাধরা চারটি দেয়াল!
ক্লান্ত হয়ে স্বপ্ন দেখি পেরিয়ে হুলুদ মরুভূমি
একটি বিকট সিংহ আত্মাটাকে নেড়ে-চেড়ে শেষে
ছুড়ে ফেলে দিয়ে জীর্ণ জঞ্জালে নিঃশব্দে চলে গেছে।
হয়তো রোচেনি মুখে, কিংবা যেটা যোগ্য কুকুরের
কী করে বসাবে ভাগ তাতে অরণ্যের অধীশ্বর?
নিজের ছায়াকে দেখি হেঁটে যায় দূরে, আমি তার
অনুগামী। কয়েকটি প্রবঞ্চক স্বর গান হয়ে
মিশে যায় কঙ্কালের মতন বৃক্ষের অন্তরালে
তিনটি ডাইনী বুড়ি দূরের আকাশ থেকে সাদা
চাঁদটাকে উপড়ে এনে, গুঁড়ো করে পাচনের সাথে
মিশিয়ে বিকৃত শব্দে টেনে নিয়ে তৃষিত জঠরে
বলে তারা কেন বৃথা করো তুমি নিজেরই মৃগায়?
মাথার ক্ষতের ঘ্রাণে জেগে দেখি ঘরের দেয়ালে
অলীক ফুলের নকশা, চতুর্দিকে যৌবনের রঙ
নিয়েছে জড়তা শুষে। শরীর চিৎকারে দীর্ণ হয়
আমি কি এখনও যুবা আলোকিত আয়ুর ভূগোলে?
হাতির শুঁড়
আদ্যিকালের বেবাক কিছুই অলৌকিক।
পক্ষীরাজের পক্ষছায়ায় দিগ্ধিদিক
নীল আকাশে উড়ত কত রাজকুমার।
আদ্যিকালের আজব কথার নেই শুমার!
ফলত সদা সোনার ডালে হীরের ফল,
জাগত জ্বেলে ঘিরের প্রদীপ লালকমল,
অসির খেলায় দৈত্যদানো করত বধ।
মরুভূমি, দূরের পাহাড়, মায়ার হ্রদ
উড়ন্ত সেই গালিচাটায় হচ্ছে পার।
সাত সফরে এই জীবনের সত্যসার
সিন্দাবাদের নখমুকুরে বিম্বিত।
সোনার কাঠি রুপোর কাঠি চিহ্নিত
ঘুমের খাটে শঙ্খমালা ঘুমন্ত;
কৌটো খোলা ভোমরা মরে জীবন্ত।
ঐরাবতের খেয়ালখুশির ধন্দায়
ভোরের ফকির মুকুট পরে সন্ধ্যায়।
প্রাক্তন সেই ভেল্কিবাজির মন্তরে
যাচ্ছে চেনা অনেক সাধু-সন্তরে।
সেই চালে ভাই মিত্র কিবা শত্তুর
চলছে সবই-মস্ত সহায় হাতির শুঁড়!