মধ্যদিন তুমি
তোমাকে দেখেছিলাম গতকাল। মধ্যদিনে তুমি
জল ছল ছল গোসলের পর মুছছিলে চুল
কমলা তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে, যেমন ছাদের
কার্নিশে অভিনিবেশ খোঁটে বিস্রস্ত পালক তার
বৃষ্টিভেজা পাখি; তারপর চিরুণী চালালে চুলে;
হয়তো পড়ছিলো মনে কবেকার স্তব্ধ পথরেখা,
আসমানে ডানা-অলা ঘোড়ার বিহার, টক ফল;
হয়তো কণ্ঠে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জানি নশ্বরতা
এ দৃশ্যের সহোদরা। এদৃশ্য আমার কাব্যে পাবে
অমর্ত্যলোকের আয়ু, এমন বড়াই কিছুতেই
সাজেনা আমাকে, কিন্তু আমি যতদিন নিঃশ্বাসের
অধিকারী, ততদিন তুমি আমার হৃদয়ময়
মধ্যদিনের তরুণীর ভঙ্গিতে গোসল সেরে একা
ঘষে ঘষে মুছবে দীঘল চুল, করবে চুলের বিন্যাস।
মধ্যরাতের পোস্টম্যান
এই মধ্যরাতে, এত জোরে জোরে কড়াই নাড়ছে কে?
আওয়াজ শুনেই
আমার বুকের ভেতর
একটা প্যাঁচা ডেকে উঠলো যেন।
অবিশ্যি আমি জেগেই ছিলাম, কিছুদিন ধ’রে
উচ্চাকঙক্ষী ব্লাডপ্রেসারটা ভোগাচ্ছে খুব।
টিপ টিপ-করা বুক নিয়ে
দরজা খুলে চমকে উঠলাম। একজন
ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়;
ওর ধকধকে কাল পাথরের মতো
চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে
কোলরিজের প্রাচীন নাবিক বলে মনে হলো আমার।
লোকটা যে নাবিক টাবিক নয়
তা’ বোঝা গেল একটু পরেই।
সে তার কাঁধে ঝোলানো মিশমিশে ব্যাগটা থেকে
একটা টেলিগ্রাম বের ক’রে
এগিয়ে দিলো আমার দিকে। শাদা
থান কাপড়ের মতো ধু-ধু
টেলিগ্রাম হাতে নিয়ে আমি বিমূঢ়।
নামহীন, ঠিকানাহীন, অক্ষরবিহীন
কাগজটি ওর কাছে ফেতর দিয়ে
বললাম, ‘কিছুই তো লেখা নেই।
অদ্ভুত হেসে সে বললো, ‘সরি, ভুল হয়ে গেছে,
পরের বার আর এমন ভুল হবে না।
তারপর তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে
লম্বা লম্বা পা ফেলে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
কিন্তু বেশি দূরে গেছে বলে মনে হলো না।
ওর কথাগুলো ধারণ করলো দেয়াল আর
আমার টেবিলে-রাখা গোলাপের শিরশিরে পাপড়ি।
কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে
আমার বুকের ভেতর যে প্যাঁচা ডেকে উঠেছিল,
গলা ও ঘাড়ের রোমসমুদয় ফুলিয়ে সে
তাকিয়ে রইল থমথমে রাস্তার দিকে।
যদি আমি হতাম হুডিনি
যদি আমি হতাম হুডিনি
তা’হলে আমার যাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়
যাবতীয় বন্দুকের নলগুলি এক লহমায়
হয়ে যেত পাখিদের চোখ,
সারি সারি ট্যাঙ্কের বদলে
বেবাক বার্থ-ডে কেক দিতাম সাজিয়ে,
যোজন যোজনব্যাপী কুচকাওয়াজকে
দিতাম বানিয়ে
তন্বী ব্যালেরিনাদের অপরূপ রাজহংসী নাচ,
আর জেনারেলদের মেডেলগুলিকে
মল্লিকা, টগর আর খোদ সমরনায়কদের
বাংলার বাউল!
যদি আমি হতাম হুডিনি,
তা’হলে আমার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়
চোখের পলকে পৃথিবীর সবগুলি
বোমার, বিমান হতো পারাবত আর
নিউট্রন বোমা
তাজমহলের জ্যোৎস্না-সপেদ গম্বুজ।
লজ্জানত
অন্তর্গত আলোড়নে বারংবার খুব উঁচু গ্রামে
বেজেছে আমার কণ্ঠস্বর।
কখনো নির্জনে আর কখনো সভায়
ফাটিয়েছি গলা; উচ্ছ্বসিত
শব্দদ্বীপ থেকে শব্দ দ্বীপান্তরে ভাসিয়েছি ভেলা
বদর বদর ব’লে ভাটি ও উজানে।
আমার নিজস্ব হুলস্থুল, চেঁচামেচি
গড়েছে জবার মতো সুকান্ত মোরগঝুঁটি আমার ভেতরে।
পড়ে না পা আমার মাটিতে। ভেসে বেড়াই হাওয়ায়।
নিচু স্বরে কথা বলে যারা
তাদের করেছি উপহাস, বলেছি, ‘তফাৎ যাও
ন্যাকার সাঙাৎ’
একদিন ঔদ্ধত্যের পতাকা উড়িয়ে
গেলাম বিকেলবেলা একজন প্রবীণের কাছে, যিনি বড়
নিশ্চুপ ছিলেন বসে একাকী মাদুরে।
কী বিপুল স্তব্ধতার
মন্দাকিনী করেছেন ধারণ সত্তায়,
অথচ এমন
নিবিড় বাঙময় আমি কাউকে দেখিনি কোনোকালে।
সব প্রগলভতা সদা-জাগা
ঔদাস্যের আড়ালে লুকিয়ে
চুপিসারে লজ্জানত ফিরে আসি একা।
লাগবে রক্তের ছোপ
একটি হরিণ খুব নিরিবিলি বনের কিনারে চিত্রবৎ,
যেন সে অনন্তকাল আছে একই স্থানে শিঙের স্থাপত্য নিয়ে
রৌদ্রে ঝিলিক-লাগা চিকন ঘাসের টানে। নানারঙা পাখি
উড়ে এসে বসে ডালে, ডাকে মাঝে-মাঝে পুনরায় যায় চলে।
পুরাণের শাপগ্রস্ত দেবীর মতন মাটিবন্দি গাছগুলি
সেই কবে থেকে; বাতাসের চুম্বন বাকল ভেদ করে যায়
মর্মমূলে, প্রজাপতি ছড়ায় আবীর তার এখানে সেখানে।
মনে হয়, পৃথিবীর ক্ষয় তাকে পারবে না ছুঁতে কোনোদিন।
পানির স্তব্ধতা বুঝি জলবিন্দুময় জলকন্যার মতন
চুপিসারে বনের কিনারে উঠে এসেছে এবং জংলা পিঁপড়ে
ঘাসের ডগায় কিছু উষ্ণতা বদল ক’রে ব্যবসায়ীদের
ধরনের প্রস্থান করে। নিসর্গের অ্যালকোহলে হরিণ বুঁদ।
হরিণের নিজের চিত্রল ঘ্রাণ, যা নিভৃত ভাসমান গান,
এখুনি আনবে ডেকে হয়তো স্তব্ধতা-ছেদনকারী ধকধকে
অঙ্গারের মতো উপস্থিতি, শান্তির ফ্যাসাদময় বনস্থলী
হবে দীর্ণ আর্তনাদে, লাগবে রক্তের ছোপ ছিন্ন ঝোপঝাড়ে।
শিরোনাম মনে পড়ে না
স্বপ্নে দেখলাম, মেহগনি কাঠের টেবিলে ঝুঁকে
লিখছি তন্ময় আমি বিশ শতকের সর্বশেষ কবিতা আমার
শিরোনামহীন। এ কবিতা ভিলানেল
নাকি সেসটিনা? এর ছন্দ
সংহত অমিত্রাক্ষর অথবা মরুভূমির বুকে
উটের যাত্রার মতো গদ্যের দুলুনিয়ম-কিছুই স্মরণে
নেই, শুধু মনে পড়ে
কী দ্রুত চলেছি লিখে একটানা, যেমন কর্মিষ্ঠ, অনলস
মাঝি গুণ টানে পাড়ভাঙা
নদীর কিনারের ধুনকের বাঁকানো ছিলার অবয়বে।
কলমের নিব সারসের, চষ্ণু, অবলীলাক্রমে
গেঁথে নেয় মাছ,
কখনো পালক খোঁটে উড্ডয়নপ্রিয়
স্বপ্নময়তায়, কখনো বা তাকায় চরের দিকে,
পানিতে নিজের ছায়াটিকে ভালোবাসে, কিছুক্ষণ।
স্বপ্নে দেখলাম, সর্বশেষে কবিতা আমার কুয়াশায় ঘেরা
স্টিমারের ডেক,; কতিপয় ছায়া করে আসা-যাওয়া,
রেলিঙে হেলান দিয়ে কেউ ঢেউয়ের মাস্তানি দ্যাখে,
কেউ ডেক চেয়ারের
আশ্রয়ে সায়ান্স ফিকশন হাতে ঝিমায়, কেউবা
পুরুটের ছাই ঝাড়ে, খালাসী তাতারি নাচে মাতে। অকস্মাৎ
হরিণের কাটা মুণ্ডু, পোড়া গন্ধময় মোমবাতি
এবং স্থলিত আংটি, ছুরি ডেকে গড়াগড়ি যায়।
বিশ শতক সর্বশেষ
কবিতা আমার ভূর্জপত্রে কালিদাসী হস্তাক্ষরে গড়ে ওঠে,
আবার লাইনো টাইপের ছাঁদে, কিছু রাবীন্দ্রিক
মায়া লেগে থাকে, পিছুটান মৃত বিহঙ্গের মতো
গলায় দোদুল্যমান। তুলোট কাগজে অক্ষরের পরে কত
অক্ষর সাজাই সুশৃঙ্খল, কিন্তু সব ওলট পালট হয়ে যায়,
পংক্তিমালা গায়েব এবং বালিয়াড়িময় পড়ে থাকে
উটের গলিত চোখ, খুলি বিধ্বস্ত বেহালা আর ছেঁড়া তসবিহদানা।
বিশ শতকের সর্বশেষ কবিতায়
সুচেতা দাঁড়ায় এসে খোলা চুলে, মেহগনি কাঠের টেবিলে
বসে পা দোলায় ঘন ঘন, পরনে গাউন তার, কথা বলে
অবোধ্য ভাষায় আর তার দিকে লক্ষ লক্ষ শীর্ণ হস্তধৃত
শূন্য থালা, সে বিহ্বলা, ব্যর্থ অন্নপূর্ণা লহমায়
উধাও এবং আমি ভীষণ পদদলিত, হাতে
ছোঁড়া পাণ্ডুলিপি; একটি বেড়াল, কালো, চুকচুক
চাটে শূন্যতাকে দুধ খাওয়ার ভঙ্গিতে।
স্বপ্নে দেখলাম, মেহগনি কাঠের টেবিলে বসে
কবিতা আমার আজরাইলের সঙ্গে পাশা খেলে, মাঝে-মাঝে
জেনে নিতে চায় কত ব্যাপ্ত জ্ঞানের বলয় আর
সুবিশাল ছত্রাকের মতো কী যেন ছড়িয়ে পড়ে দশদিকে।
সর্বশেষ কবিতা আমার তেজস্ক্রিয় আবর্জনা-স্তূপ থেকে
আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আর বিশ শতকের
শেষ সূর্য রশ্মির চুম্বন খেতে খেতে বেহুলার ভেলার মতন যায়
ভেসে যায় উথাল পাথাল গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ের ঢেউয়ের।