বন্যার পশুর মতো
কদ্দিন বাঁচবো আর? আর কদ্দিন জীবন নাম্নী রমণীর
সঙ্গে খুনসুটি করে যাবো?
ভোরবেলা বাঘবন্দি খেলি, দ্বিপ্রহরে
হাত ধ’রে তার
নিরাছুট্রা ঘুরে শহরের
আনাচে কানাচে,
বিকেলে লেহন করি ছায়া, রাত্রি কাটে
কখনো স্বপ্নের, কখনো বা দুঃস্বপ্নের ঊর্ণাজালে।
এরকম হয় মাঝে মাঝে-
যখন কাচের থালা আমার সম্মুখে
নিভৃতে সাজিয়ে রাখে কেউ, পাত্রে ঢালে প্রোজ্জ্বল পানীয়
তখন সে হঠাৎ আমার হাতে অজস্র স্লিপিং পিল ঝুর ঝুর ক’রে
নিঝুম ঝরিয়ে দেয়, বাজায় ট্রেনের হুইস্ল
বারবার; আমি সম্মোহিত
মানুষের মতো আচরণে
কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠি, এদিকে ওদিকে যাই,
খুব লুটোপুটি খাই ধুলোয় কাদায়।
আমার দর্পণ ফুঁড়ে কে আসে কে যায়
বোঝা দায়, অস্পষ্টতা এলেবেলে টিপ সই দিয়েছে এখানে;
দর্পণের ভেতরের কেউ
আমাকে আলাপচারিতায়
উদ্বুদ্ধ করতে চায়, কাচের ওপরে দীর্ঘশ্বাস
মেঘের মতন জমে থাকে। অন্ধকারে
চলেছি স্রোতের টানে বন্যায় পশুর মতো উদ্বেগ-নির্ভর,
চলেছিতো।
বেশি বাকী নেই
ভোরবেলা দাড়ি কেটে মসৃণ করেছি গাল; চুল
আঁচড়িয়ে আয়নায় কিছুটা মশগুল
থেকে বসি একান্ত নির্জনে
কাগজ কলম নিয়ে। অক্ষরের বনে পেয়ে যাই চকিতে হদিশ
পথের এবং বেজে ওঠে মগজে পাখির শিস,
দেখি শূন্যে হরিণের লাফ।
আলনায় রোদ্দুরের রমণীয় তাপ
পোহায় তাঁতের শাড়ি। গিয়েছিলাম কখনো লেকে,
মনে পড়ে পর্যটক মেঘমালা দেখে।
ইতোমধ্যে সকালবেলার ডাক এসে
গেছে; কার চিঠি এলো? যে আছে বিদেশে?
সকল সময় নয়, মাঝে-মাঝে কী-যে
হয়, চোখ ভিজে
ওঠে অকস্মাৎ, মনে নামে সফোক্লিসের কালের
সন্ধ্যার মতন সন্ধ্যেবেলা, পাখিদের
কংকাল ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, ভাবি-
কোথায় থাকবে প’ড়ে তৈজসের চটক, দরজা, গূঢ় চাবি।
যেতে তো হবেই
একদিন, আমার সময় আর বেশি বাকি নেই।
জীবনের যাবতীয় চলক, বিভূতি
চোখে আনে দ্যুতি
প্রায়শই, তাই আমি যখন কোথায়ও কালো ডানা
অকস্মাৎ হানা
দিতে দেখি, জানলার বাইরে তাকাই, সারাক্ষণ
ভয়ে ভয়ে থাকি আর ছায়ার মতন
চলা ফেরা করি ঘরে।
নাছোড় তাগিদময় পাওনাদারের মতো যদি এসে পড়ে
মৃত্যু, তবে কী ক’রে ফেরাবো তাকে? কোন্ ছলে? থাক্
সে ভাবনা, আপাতত জীবনের ঠোঁট ঠোঁট চেপে ধরা যাক।
বড় দীর্ঘ এ অসামাজিকতা
সেদিন সকালে তোমার তেতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে
আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম।
ভাবতেই পারিনি
তোমার কাছ থেকে অসৌজন্যের অমন
বেধড়ক ধাক্কা পাবো।
এই প্রথমবারের মতো, বুঝলে আফজাল, তুমি আমাকে
কোনো সাদর-সম্ভাষণ করোনি,
নিজ্ঞেস করোনি আমার কুশল সংবাদ।
সত্যি বলতে কী, তোমার সেই নিদারুণ অসৌজন্যে
আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি,
তোমার মধ্যে যে এমন সীমাহীন উদাসীনতা
বাসা বেঁধেছিল, জানা ছিল না আমার।
সেদিন সকালে তোমার ফ্ল্যাটের
দোরগোড়ায় পৌঁছে কলিং বেল বাজাতে হয়নি।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়েই
আমার মনে হয়েছিল, তোমার দরজা আজ খোলা থাকবে।
কলিংবেলের প্রসঙ্গ এখন
না ওঠালেও পারতাম। কিন্তু কী জানো আফজাল,
কখনো কখনো খুব তুচ্ছ ব্যাপারও
মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। যাকগে, চৌকাঠে পা রেখেই
দেখলাম, তুমি ঘুমাচ্ছ অঘোরে। এদিকে
আমি যে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোমার শয্যার পাশে,
বেলা যে খুব তেজী হয়ে উঠেছে,
বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই তোমার। সেই মুহূর্তে মনে হলো,
এখন রোদ যদি আরো বেশি তেতে ওঠে,
যদি টাইফুন বয়ে যায় তোমার ঘরের ভেতরে,
তবু তুমি এক চুলও নড়বে না
বিছানা থেকে, এতটুকু কাঁপবে না তোমার চোখের পাতা।
আফজাল, কী করে ভুলবো যে,
আমি এলে খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠতে তুমি,
হাত বাড়িয়ে দিতে হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে আর
খুব পীড়াপীড়ি করতে খেয়ে যাওয়ার জন্যে।
অথচ সেদিন কোনো অভিবাদন জানানো তো দুরের কথা,
তুমি একবার তাকালেও না আমার দিকে।
তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে
ঘন ঘন কান্নার রোল উঠেছিল তোমার ফ্ল্যাটে।
এর আগে তোমার পুত্র-কন্যা
এমন করে কেঁদে বুক ভাসায়নি কখনো।
তোমার স্ত্রীর অমন ডুকরে-ওঠা দেখে কংক্রিটের দেয়াল পর্যন্ত
গলে পানি হয়ে গিয়েছিল,
কিন্তু তোমার ঘুমে এতটুকু চিড় ধরেনি।
অথচ আগে সামান্য শব্দ হলে কিংবা তোমার গৃহিণী
আলতো ক’রে ধাক্কা দিলে গাঢ়তম ঘুম থেকেও তুমি
ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়তে।
আফজাল, এ বড় দীর্ঘ অসামাজিকতা তোমার।
কতকাল তুমি আসো না আমার বাসায়, স্মিত হেসে
বসো না বারান্দায়, বানাও না ধোঁয়ার রিং।
শুধু কখনো কখনো দেখি তুমি ছায়ার মতো
ঘুমিয়ে আছো মেঘের ভেলায়,
এয়ারপোর্ট রোডের কিনারে,
কচুরিপানার বেগুনী ফুলে, ক্রমাগত জাগতে-থাকা
আমার কবিতার খাতায়।
ভুল
তা’হলে কি গোড়াতেই হয়েছিল সুনসান ভুল?
সরল বিশ্বাসে তুমি যাকে
পথ ভেবে করেছিলে যাত্রা তা ছিল গোলকধাঁধা;
একদা যে-হাত ছুঁয়ে স্বর্গের প্রবালসিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে ব’লে
মনে হয়েছিল বারবার,
ছিল না ত’ হাত কোনোকালে, ছায়ার প্রসূন নিয়ে
ছিলে মেতে; ওষ্ঠ ভেবে যাতে
করেছো অর্পণ চুমো শতবার, সেসব চুম্বন
হাওয়ায় হারিয়ে গেছে, যেন
অশরীরী কেউ
চেপে ধরেছিল ঠোঁট তোমার সংরক্ত ওষ্ঠতটে।
ব্যর্থ বাসরের রঙ লেগে
থাকে কি আত্মায় চিরকাল? জন্মান্ধ নিঃশব্দ ঝড়
আঁচড় কাটতে থাকে সত্তার দেয়ালে,
স্বৈরিণীর হাসির মতন
আলোর ঝিলিক
আঁধারকে আরো বেশি অনাত্মীয় করে,
কী যেন নিমেষে ভেঙে যায় অকস্মাৎ
হৃদয়ের আবরণ ছিঁড়ে।
ভুল ভেঙে যাবার পরেই
একটু থমকে তুমি দাঁড়ালে যদিও তবু তুমি
নাওনি বিদায়,-
যেমণ মঞ্চের আলো নিভে যাবার পরেও নট
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য স্টেজে বিষণ্ন খেয়ালে!
পারোনি ফিরিয়ে নিতে চোখ
চেনা দৃশ্যাবলি থেকে। অন্ধকার সিঁড়ি
আর স্মৃতিখচিত দরোজা,
তক্তপোশ, কার্পেট, মাদুর,
এমনকি সে-ও
ছিল না তোমার তুমি নিজের ভিতর থেকে
একা বাইরে বেরিয়ে এসে পরাবাস্তবের
সৌহার্দে আপ্লুত হ’লে এবং রাখলে দুটি হাত
সংহারপ্রবণ সেই মরীচিকা শোভন হাতের ছায়াঘুমে!
প্রেমের কাঙাল তুমি, তাই আজো সবচেয়ে’ সুন্দর
পাঞ্জাবি চাপিয়ে গায়ে, পারফিউমের অন্তরালে
অতিশয় পোড়া
কাঠের মতন অস্তিত্বের গন্ধ চেপে
তার কাছে যাও আর অর্থহীন জেনেও নিবিড়
কথোপকথনে মেতে, কফি খেয়ে, এর ওর দিকে
তাকিয়ে গল্পের রেশ খোঁজো ঘুম-পাওয়া মুর্খ বালকের মতো।
প্রেমের কাঙাল তুমি, কখন তুমুল
স্বেচ্ছাচারিতায় উঠে গেছো ভুলে অপ্রেমের শীতল চিতায়।