দেয়াল কাহিনী
পাঁজরের হাড় বের হওয়া
দেয়ালটা ঝুঁকে পড়েছিল সামনের দিকে
বুড়ো মানুষের মতো
কিন্তু বড় তাজ্জবের ব্যাপার, এতদিনেও
মুখ থুবরে পড়ে যায়নি
নোনাধরা, শ্যাওলার জামা-পরা সেই দেয়াল।
তবে সত্যি বলতে কী,
এই এখন-পড়ি তখন-পড়ি দেয়ালটার দিকে
চোখ পড়লেই
আমার ভারি ভয় হতো।
কতদিন ভেবেছি কালবৈশাখী এক লহমায়
ওর ঘাড় মটকে দেবে, অথবা
লাগাতার বৃষ্টির ঝাপটায় হবে সে কুপোকাৎ।
কিন্তু ঝড়বাদল কখনো কখনো
খুব শক্ত সমর্থ
কোনো কোনো দেয়ালকে উপড়ে ফেললেও,
সেই কুঁজো দেয়ালটা
দিব্যি মাথা উঁচু ক’রে এতকাল দাঁড়িয়ে ছিল
গোয়ার গোবিন্দের ধরনে।
দেয়ালটার টিকে থাকার এই একরোখা
লড়াইয়ে এক ধরনের সৌন্দর্য
আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ওকে আমার মনে হতো
সেই যোদ্ধার মতো, যে প্রতিপক্ষের
দৃষ্টি-অন্ধ-করা গোলাবর্ষণের ভেতরেও
দাঁড়িয়ে থাকে অটল।
কিন্তু শেষ অব্দি জব্দ হতে হলো, ওকে, হঠাৎ
এক সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টির বর্শায়
ভীষণ জখম হয়ে সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল
সদর রাস্তায়।
দেয়ালের এই হালত দেখে
আমার মনের ভেতরে নেমে এল একটা নিঝুম ছায়া,
যেমন আসে আপনজনের বিয়োগে আর দেখলাম
রাত্রিবেলা দেওয়ালের পুঞ্জ পুঞ্জ শোকের মতো
ধ্বংসস্তূপের ওপর খিলখিলিয়ে
হাসছে ছমছমে জ্যোৎস্না।
পদ্মকোরকের মতো
অবসাদ হাত-পা খেলিয়ে স্মৃতিকে পাশে নিয়ে
শুয়ে আছে বিকেলবেলা।
অবসাদ এখন আমার ওপর শয্যা পেতেছে,
আমি পা দুলিয়ে হাত ঝুলিয়ে
মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে তুলছি
অনবরত সাবুদানার মতো যাবতীয় স্বপ্নকণা।
ইচ্ছে হলেই আমি এখন ছাদে যেতে পারি না,
সিঁড়ি নেই। আমার ঘর থেকে
দেখতে পারি এক মেঘের সঙ্গে অন্য মেঘের
সাবলীল মেলামেশা, আকাশজোড়া
পাখির সাঁতার, ঝাঁকামুটের
হনহনিয়ে ছুটে-যাওয়া।
হামেশা খুব রাত ক’রে ফিরতাম বলে আম্মা
টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে
বসে থাকতেন, ঘুমে চোখ বুঁজে আসতো, তাঁর,
মনে পড়ে। কখনো আমি মাতৃদৃষ্টি এড়িয়ে বেড়ালের মতো
চুপিসারে ঢুকে পড়তাম আমার ঘরে,
কখনোবা চুপচাপ বসে পড়তাম খাবার টেবিলে,
আম্মা কিছু না বলে
দেখতেন আমার আহার দৃশ্য।
একজন জোহরা আমার মশারি টাঙ্গিয়ে
ভাত নিয়ে মধ্যরাত অব্দি জেগে থাকে, প্রতীক্ষার আলপিন
ক্রমাগত ফুটতে থাকে ওর সত্তায়। যখন আমি
দরজার সামনে দাঁড়াই আলুথালু, এক ধরনের
অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা ভর করে ওর ওপর।
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
এক সময় ঘুমে ভিজে যায় চোখ।
ইদানীং মানুষের চেয়ে জীর্ণ পাঁচিলে আশ্রয় নিবিড়
ম্যাজেণ্টা রঙের পাখি,
আমার ঘরের দাগসমূহে মধ্য থেকে
জেগে-ওঠা নানা ছবি আর ঘরের ভেতর লুটিয়ে-পড়া
জ্যোৎস্নার সঙ্গেই বেশি কথা বলি,
পদ্মকোরকের মতো উম্মীলিত হয় সন্ধ্যাভাষা।
পোড়াতে জানে না
আজকাল পরাজয় যখন আমার
আত্মসম্মানে ঘাড় ধরে
হিড়হিড় ক’রে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিয়ত আঁধারে
তখন কেবলি মনে পড়ে তাঁর কথা।
খুব বেশি ক’রে
মনে পড়ে।
কার কথা? এমন একটা প্রশ্ন ওঠা
অমূলক কিছু নয়। যতটুকু জানি
আমি শুধু সেটুকুই
কোনো রঙ না চড়িয়ে বলে যাবো।
না, বাজারে তাঁর
কোনো আত্মজীবনী মেলে না।
জীবন চরিত্র লিখে যারা
যশস্বী এখন, তারা, বলা যায়, সযত্বে এড়িয়ে গেছে তাঁকে।
হয়তো তাঁর বিষয়ে তেমন মালমশলা গেঁজিয়ে
ওঠেনি এখনো।
হাজার হাজার বামনের ভিড়ে যখন আমরা
একজন দীর্ঘকায় মানুষকে দেখি,
বস্তুত তখন আমাদের
সবার চোখের তারা যেমন নিমেষে
স্থির হয়ে যায়,
অবিকল তেমনি হয়েছিল আমার সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে,
যখন প্রথম দেখি তাঁকে
সে মুহূর্তে আমার ভেতর
জ্বলে উঠেছিল লক্ষ প্রদীপের আলো।
যাদের শোণিতে খেলা করে সাপ, তারা
ছিটাতো ঘৃণার থুথু তাঁর প্রতি, কুৎসার জোয়ারে যেত ভেসে
আর যারা কাপুরুষ, তারা
সহজে নিত না তাঁর নাম,
যদিও অন্তরে তাঁকে
গভীর ভূতলবাসী রাজা বলে দিয়েছিল ঠাঁই।
আমি মধ্যবর্তী, তাই আমার স্বপ্নের
নায়কের পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছি বহুদিন,
অথচ ঝড়ের উড়ো ধূলি দেখে মাঝপথে হঠাৎ থমকে
দাঁড়িয়েছি নিজের প্রেতের মতো, আখেরে দিয়েছি পিঠ টান।
পরাস্ত মানুষ আমি নির্মাণের চেয়ে
দেখেছি ধ্বংসের নাচ বেশি মরুদ্যানের উদ্দেশে
যাত্রা করে গাফেল পথিক চলে গেছি
তপ্ত বালিয়াড়ির নিকটে।
অনেকেই ব্যাপক আলোর মতো শোভা হতে চায়,
কিন্তু কেউ সহজে কখনো
নায়কের ধরনে অমন
আতশবাজির মতো নিজের জীবনটাকে পোড়াতে জানে না।
ফিরিয়ে দেয় না
বিকেলবেলাটা ছিল সন্ন্যাসের মতোই উদাস,
হাওয়া বিষাদের শ্লোক। ওরা
বললো তাকে, থাকো তুমি আরও কিছুকাল।
কিন্তু থাকো বললেই কি
শেষ অব্দি থাকায় যায়, তাই
চোখের তারায় তার নেচে ওঠে সমস্ত জীবন।
গ্রন্থপাঠে অক্লান্ত সে। শহরের অলি গলি, নিজের গ্রামের অশত্থের আর
প্রাচীন দীঘির কাছে, ঝাঁক ঝাঁক টিয়ের নিকটে
স্বীকার করেছে ঋণ। জানে সে
পিছনে যা থেকে যায় তার প্রতি টান
কমে না কখনও বা চোরা টানে
গেছে ভেসে, বুঝিবা তলিয়ে, কোনোমতে মাথা জেগে ছিল জলে;
সত্যের খোঁজে সে কুয়াশায়
জড়িয়ে পড়েছে বারংবার।
কিছুকাল ধ’রে দেখতো সে প্রায়শই অস্পষ্ট মুখোশ-আঁটা
নিষাদের স্বপ্ন; ভয় পেয়ে মধ্যরাতে
ঘুম ভেঙে গেলে পারতো না ডুবে যেতে
ঘুমের গহনে আর। হিজিবিজি কথা
শত শত রক্তজবা হয়ে দিত ঘূর্ণা চারপাশে, অগণিত
কংকাল সন্তের বেশে শোনাতো প্রবোধবাক্য কুটকচালের।
বুক শূন্য-করা ডাকে গুঞ্জরণময় ঘর থেকে
যে উন্মুল ক’রে নিয়ে যায়, সে চকিতে
নিয়ে যায় স্তব্ধ অনুষ্ঠানে, কোনোদিন
ফিরিয়ে দেয় না।