তোমার সৃষ্টি ভিত্তি পাক
কেন তুমি আজ এভাবে তাকাও আমার দিকে?
তোমার দৃষ্টি মুক্তি পেলো কি ঝোড়ো আকাশে?
পাঁচ দশকের সত্তা আমার বাত্যাহত,
দু’জনের মাঝে প্রলয়াকাঙ্ক্ষী পিশাচ হাসে।
এ রকম জানি প্রায়শই ঘটে, সিঁড়ির ধাপ
বেয়ে উঠি আমি, তুমি নেমে যাও তরতরিয়ে।
সংলাপহীন কাটে কতকাল, আমরা যেন
দু’মেরুর প্রাণী। কারা বিষধোঁয়া দেয় ছড়িয়ে?
কেউ কারো মুখ দেখিনা আমরা অনেকদিন;
হঠাৎ কখনও দেখা হয়ে গেলে চমকে উঠি।
অপরিচয়ের ছায়া ঝুঁকে থাকে চোখের কাণে,
তোমার শিরায় স্পন্দিত হয় মোরগঝুঁটি।
তুমি অবিরত পাতালে নামছো; রাতদুপুরে
তোমাকে মাতায় সাইকেডেলিক চিত্রাবলি;
পারিনা ফেরাতে তোমাকে কখনও ভূতল থেকে;
তুমি ক্ষয়ে যাও আমি নিজস্ব নরকে জ্বলি।
যে কোন সময় তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে
হৃদয় আমার শ্মশানভস্মে যাচ্ছে ঢেকে।
তখন তোমাকে খুঁজবো কোথায় কোন নিবাসে?
কোন্ সে পাতালে বয়ে যাবে বেলা তোমাকে ডেকে?
বহু যুগ ধরে, আমার ভেতরে যে কাল্কূট
সঞ্চিত তার নির্যাস বুঝি তোমার শিরা
করেছে ধারণ। আমি অসহায় তাকিয়ে থাকি,
তোমাকে ক্রমশ করছে দখল করাল পীড়া।
চুম্বনে তুমি পাওয়া শান্তি নব্য যুবা।
যৌবনের ঘুণ ধরেছে আগেই, আশা উধাও,
বিপুল না-এর ক্রুর বীতংসে বন্দি হয়ে
মরীচিকাময় শূণ্যের প্রতি হাত বাড়াও।
নেতিবাদে হলে প্রতিবাদী সুর মঞ্জরিত
মৃতের মুখেও ফুটবে গোলাপ, বাজবে শাঁখ।
এই ডামাডোলে চাই আমি চাই তোমারই জয়,
আমার ধ্বংসে তোমার সৃষ্টি ভিত্তি পাক।
দাঁড়া আছে তারও
চোখে চোখ, হাতে হাত, আর
ঠোঁটের উপরে ঠোঁট রাখলেই বুঝি
ধরে নিতে হবে
ভালবাসা তার বাস্তুভিটা পেয়ে গেছে?
কখনো সখনো
ধ’রে নিয়ে নিজেকে আস্বস্ত করি বটে,
অথচ আমাকে অস্বস্তির পিঁপড়ে সুযোগ পেলেই
কামড়াতে থাকে
ধারণা এবং বাস্তবের
মধ্যে প্রকৃতই বিঘত ব্যবধান,
এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের তীরে ভেলা বেয়ে নিয়ে যাওয়া
তেমন সহজ নয়। তাই
যখন ডাগর চোখে গভীর তাকায় ভালোবাসা,
মনে মনে ‘কী সুন্দর’ ব’লে
অপলক চেয়ে থাকি, প্রকৃত প্রস্তাবে
বলি না কিছুই।
যখন মগজে কোকিলের গান আর
রক্তে জুঁই মল্লিকার ঘ্রাণ, সরোদের তান নিয়ে
দাঁড়াই সম্মুখে তার, তক্ষুণি ঝাঁঝালো
স্বরে বলে, ‘চলে যাও, শ্যামলিম অন্তরের দিকে।
ক্ষুধা ছিল, তৃষ্ণা ছিল আকণ্ঠ আমার।
দস্তুরমাফিক
মোহন দস্তরখান বিছিয়ে দিয়েও তুলে নিলো
এক ঝটকায় ভালোবাসা।
যা হলো ভালই হলো, নইলে
কে জানতো কাঁকড়াবিছের মতো দাঁড়া আছে তারও।
দুপুরে বেগমবাজারে
দুপুরের বেগমবাজারের রোগা গলির ভিতর
অত্যন্ত সান্নাটা গোরস্তানে
জংধরা টিনের কৌটার পানি চলকে পড়লো
আমার ঠোকরে, চতুর্দিকে উঁচু নিচু
কবরের ঢেউ। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
কার রৌদ্রপায়ী কবরের পাশে? যখন ছিলেন
নিঃশ্বাসের অধিকারী তিনি,
তখন কি লোকে তাকে
জানতো পুরুষ ব’লে? নাকি নারী তিনি? তন্বী কিংবা
বয়সিনী, কী-যে তার পরিচয়, কিছুই না জেনে
তারই কথা ভাবি,
যে-আছে মাটির নিচে তুখোড় মুনাফা-ঝলসিত
কুসদীজীবীর মতো অতিশয় কেজো
কীটের সংসারে স্মৃতিহীন, নাটক-রহিত, একা।
খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে এসেই
কেমন একলা পাখি কোথায় যে উড়ে চলে যায়।
ফুলকাটা পাঞ্জাবিটা ঘামে জবজবে, অজস্র সোনালি সূচ
চলেছে চিমটি কেটে, পায়ে
পুরানো ব্যথাটা
আবার মুখিয়ে ওঠে, আমার আত্মায় ক্রমে জ্বরোভাব ফোটে।
গোরখোদকেরা নির্বিকার
চালাচ্ছে কোদাল তালে তালে,
ঘাসের চাপড়া, তাল তাল মাটি জমে,
নতুন চাটাই, কিছু বাঁশ
অধীর অপেক্ষমান। ‘ঐ যে টগর চারার কাছে পিঠে বড়
ভাইজান আছেন ঘুমিয়ে-
তোমার কি মনে পড়ে, ‘বললেন, ধূসর মেজো ভাই।
আমি কি এখানে এর আগে
এসেছি কখন? না, আমার মনে পড়ে না কিছুই।
ভাইজান সত্যি কি নিদ্রিত
সেখানে গাছের কাছে, যেদিকে আমার মেজো ভাই
তুললেন তর্জনী তাঁর নিশানা নির্দেশকারী সন্তের মতন?
নাকি অন্য কারো কবরকে
করলেন শনাক্ত ঝাঁঝাঁ দুপুরে নিজের
ভাইয়ের কবর বলে? অদূরে নজরে পড়ে সদ্য
চুনকাম-করা কবরের জন্যে বিজলি বাতির কী বিশদ
আয়োজন, বুঝি ভদ্রলোক
অন্ধকার ঘরে শুতে ছিলেন অত্যন্ত অনিচ্ছুক,
খওফের নখ হয়তো তাকে আঁচড়াতো ঘন ঘন।
নকশা-কাটা সিল্কের মতন শরীরের পাখি
আমার অনেক কাছে এসে দুপুরকে চমকানো শিস দিয়ে
জীবনের সৌন্দর্য আবৃত্তি করে গেল।
কোদাল ঝিমায় রোদে, মাটির ডেউয়ের চারপাশে
ঊর্ধ্বারোহী প্রাথী হাত, ঘাড় উচ্চারিত নিরুদ্দেশে
সোপর্দের ভাষা-
নামুক কবরে তাঁর অবিরল রোশনির ঢল।
আবার আমরা নামি পথে; আস্তাবল,
যা বিলীয়মান দ্রুত, কেবলি উগরে দেয় ঝিমানো ঘোড়ার
বিষ্টা আর খড়-বিচালির গন্ধ, চা-খানার বেজায় ইচঁড়েপাকা চুনু,
কানে যার সিগারেট গোঁজা, টুল মোছে,
নয়া ফিল্মি গান গায়, ক্লান্ত চোখে দেখি
মোগল ঘোড়সওয়ার, নায়েবে নাজিম, চমকিলা
চামুটি, লাগাম হাতে জাফরানী রঙের ভেতরে
চলেছেন, বাতাস অলস
আতরের খোশবুতে আর দুলে ওঠে পরীবিবির তাঞ্জাম।
শুধু তাঁকে রেখে এসে, ঔদাস্যে সেলাই করা হুহু
শরীরে রৌদ্রের দাগ এবং আত্মায় জ্বরঠোস নিয়ে আমি
হঠাৎ চমকে উঠি-শ্রাবণের সিয়া আসমান
এসেছে জমিনে নেমে বেগমবাজারে,
অথচ আমার মধ্যে অপরূপ স্থাপত্যের মতো
আলোক বৃক্ষের জাগরণ।