একটি বাড়ির কথা ভাবি
রোজ আমি কান্তিমান একটি বাড়ির কথা ভাবি।
সে-বাড়িতে কারা কীরমভাবে আছে
ভাসাভাসা কানে আসে, কিছুবা কল্পনা
করে নিই, মনে মনে মনোনীত রঙের পোঁচড়া
সস্নেহে বুলিয়ে দিই বাড়িটার গায়ে। খুব কাছে
যাইনি কখনো শুধু দূর থেকে দেখি।
কোনো কোনো ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলে
মনে হয় সে-বাড়িতে শুয়ে আছি দক্ষিণের ঘরে
এবং পাশের ঘর পাঠাচ্ছে নৈবেদ্য ক্রমাগত
ক্লিফ রিচার্ডের গান। এলো
সৌন্দর্য সুঠাম তন্বী ছন্দে, হাতে ভোরের চায়ের সরঞ্জাম,
তারপর সুবাসিত আভিজাত্য ঝুঁকে থাকে আমার ওপর।
যখন বয়স্ক হয় রোদ, সে বাড়ির
আয়তন, রঙ কিংবা কী তার ধরন, আসবাব,
উপচার, বাসিন্দা কজন-
কিছুই পড়ে না মনে। স্মৃতিভ্রষ্ট আমি ভাবি শুধু
বাড়িটার কথা।
ছিল কি পুষ্পিত কোনো ডাল নুয়ে দক্ষিণের জানালায়?
আমি কি সদলবলে করবো ঘেরাও বাড়িটাকে
অবেলায়? নাকি
বেবাক গুঁড়িয়ে দেবো গ্রেনেডের প্রচণ্ড ধমকে?
আগুন লাগিয়ে দিই যদি,
তবে কি আমার গায়ে চিরদিন থাকবে নাছোড়
লেগে অন্যায়ের ছাই?
বাড়িটা যেমন আছে, তেমনি থাক তার অপরূপ
শোভা, শিল্প, পিছুটান নিয়ে।
কথোপকথন হোক সেখানে নিবিড়, কেউ লনে
দাঁড়াক বিকেলবেলা, যাক
মিশে পুষ্পবিকাশের সুরে। হয়তো আমি কোনোদিন
প্রকৃত সেখানে যাবো; আপাতত ভাবি শুধু বাড়িটার কথা।
এত বছর পরেও
কখন কোন্ ঘটনার অনুষঙ্গে কোন্ ছবি ভেসে ওঠে
অথবা কোন্ ছবি
ডেকে আনে কোন্ ঘটনাকে
তার কোনো নির্ধারিত নক্শা নেই।
তবে এখানো যখন আমি কোনো বালককে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে
পথ হাঁটতে দেখি, তখন অনিবার্যভাবে আমার ছেলেবেলার
ইশকুলের কথা মনে পড়ে যায়। আর
আমার হৃদয়ে
বাজতে থাকে একটি সোনালি ঘণ্টা।
এছাড়াও কখনো কখনো হঠাৎ
আমার ছেলেবেলোর ইশকুল ঝলসে ওটে স্মৃতিতে।
মাঝারি ধরনের একটা মাঠ
কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি,
নানা কলস্বরের মুখরিত ক্লাশরুম,
হাতে-টানা পাখা, বিবর্ণ ঝালর, সেই মধ্যবয়সী দারোয়ান,
দূর দ্বারভাঙায় ছিল যার নিবাস,
তার খয়েরি গলাবদ্ধ কোট আর খাটো ধুতি
আর জলখাবারের ঘর-এমনি টুকিটাকি অনেক কিছু
মনে পড়ে আমার।
তবে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে চিন্তাহরণ স্যারের কথা,
যিনি ক্লাশ নাইনে
আমাদের ইংরেজি পড়াতেন, যাঁর পড়ানোর ইন্দ্রাজালে
নেসফিল্ডের গ্রামার ইস্তক
হয়ে উঠতো চমৎকার অ্যাডভেঞ্চারময় ভ্রমণ কাহিনী।
এইতো দেখছি তিনি বসে আছেন নিশ্চুপ আলাদা
একটা কাঠের বাক্সের ওপর
তাঁর কাঁচাপাকা চুল আর ভাসাভাসা
দু’টি চোখ নিয়ে। ডুবে আছেন বইয়ের পাতায়।
এমন একটি দিনের কথাও মনে করতে পারি না
যেদিন চিন্তাহরণ স্যারের হাতে কোনো বই দেখিনি
তাঁর সম্পর্কে আমার কৌতুহল
ডানা ঝাপটাতো সকল সময়। তিনি যে ছুটির দিনে জলরঙ
ছবি আঁকতেন, এ খবর
আমি কুড়িয়ে নিয়েছিলাম আগে-ভাগে।
সৌভাগ্যবশত স্যারের একটা ছবি আমি দেখেছিলাম,
তাঁর পুত্রের সৌজন্যে।
ঊষাকিরণ ছিলো আমার সহপাঠী।
কোনো এক দুপুরে
টিফিনের বিরতিকালে
ঊষাকিরণ আমার সামনে মেলে ধরেছিল বাংলার বর্ষা
স্যারের তুলিতে রূপায়িত
রাধার বিরহের মতো পুঞ্জ-পুঞ্জ অন্ধকার আমাকে
অভিভূত করেছিল, মনে পড়ে।
আজ আমি বিলক্ষণ জানি,
আমার সকল সদিচ্ছা সত্ত্বেও সেই ছবির তুচ্ছতাকে
মুছে ফেলা যাবে না। সেই ছবির
মামুলিত্ব প্রমাণ করবার জন্যে কোনো হাবার্ট রিডকে
আমন্ত্রণ জানানোর দরকার নেই।
আমার স্যারের ছবিটা যত তুচ্ছই হোক,
এত বছর পরেও
সেই কাগজে বর্ষার ঘন অন্ধকার নামে
আমার মনের ভেতর আর
অনেকক্ষণ ধ’রে আমার মন কেমন করে।
কাঠবিষয়ক
কাঠের চেয়ারে তিনি বসে আছেন।
তার সামনে কাঠের টেবিল, কাঠের দেরাজ থেকে
এক তাড়া কাগজ বের ক’রে
কাঠপেন্সিল দিয়ে ঘস্ ঘস্ করে কী যেন লিখলেন।
কাঠঠোকরার ধরনের তিনি তাঁর অতীতকে
ঠোকরালেন অনেক্ষণ আর
কাঠের গুঁড়োর মতো কিছু স্মৃতিকণা
ঝরতে থাকলো কাঠের মেঝেতে।
কয়েক ঘণ্টা পর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে
তিনি সামলেন, সন্ধ্যালগ্নে প্রবেশ করলেন
তাঁর নিজস্ব কাঠের বাড়িতে। তাঁর
চোখ পড়লো কাঠের দেয়ালে, দেয়ালে ঝোলানো
ছবির কাঠের ফ্রেমে কাঠের আলমারিতে
কাঠের বুকশেল্ফে।
কাঠের ওয়ার্ডরোবে ট্রাউজার আর কোট্ টাই
গচ্ছিত রেখে কাঠের বাথরুমে
চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে হাই তুলে এসে
বসলেন কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে,
গৃহিনী কেঠো হাসি হেসে স্বামীর দিকে
বাড়িয়ে দিলেন কাঠবাদাম আর বিস্কুটময় কাঠের রেকাবি।
রাত্তিরে তিনি শুতে গেলেন কাঠের খাটে,
তারপর তাঁর স্বপ্নে এলো স্তুপ স্তুপ
কাঠভর্তি এক বিশাল কাঠের জাহাজ এবং তিনি নিজে
ঘুমিয়ে আছেন আলিশান কাঠপ্রসাদে কাঠের মূর্তির মতো!
কাদায় পড়েও
আমার গায়ে সদ্য কাদার গন্ধ পেয়ে
অলপ্পেয়ে
চামচিকের দল
ঝটিতি হয়ে উঠেছে চঞ্চল।
ওদের প্রত্যেকের মাথায় এখন
মুকুট আর গায়ে কেমন
চকরা বকরা পোশাক আশাকের বাহার;
গলায় গজমোতির হার
ঘন ঘন দুলছে এলাহি লম্ফ ঝম্পের তালে।
কেউ কেউ বাঘছালে
সেজেগুজে ছুঁড়ছে বেধড়ক লাথি।
চামচিকেদের খেয়োখেয়ি, মাতামাতি
দেখে পাড়া পড়শিরা বার-বার দিচ্ছে করতালি।
চেঁচামেচিতে ওদের কণ্ঠনালী
অবিরত
ফুলে উঠছে আহার-তৃপ্ত সাপের মতো।
সমস্ত গা থেকে কাদা ঝেড়ে আমি এখনো উঠে দাঁড়াতে
পারি, পারি তাড়াতে
বিচ্ছিরি চামচিকেদের কুংফু কায়দায়।
অথচ আমি থিকথিকে কাদায়
প’ড়েও চাইনা দিতে
প্রশ্রয় হিংস্রতাকে। আমি চাই আমার ধমনীতে
ফণিমনসা নয়,
সকল সময়
বয়ে যাক জুঁই মল্লিকার ঘ্রাণ। মড়াখেকো পাখি
যাক উড়ে দূরে, আমি কোকিলকেই ডাকি।