আনন্দিত কিশোরের মতো
সাজগোজের দিকে কোনাদিনই তেমন
মন ছিল না ওর। জামা-কাপড় খুব দ্রুত ময়লা
হয়ে যেতো সকল সময় চুল থাকতো
উসোক খুসকো। কিন্তু সেই রোববার ওরা ওকে
বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে
রওনা করে দিয়েছিল আর সে
দিব্যি আমতলা থেকে অনেক অনেক দূরে
চলে গেলে বিস্তর আতর গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে।
আমি ওর সেই সাজ দেখিনি, শুধু শুনেছি
লোক মুখে। যে ফুল দেখলেই কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলতো,
হাতে কোনো পুতুল এলেই
সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে এক বেনামী আক্রোশের প্ররোচনায়
ছুঁড়ে দিতো বাইরে, সেদিন সে অতিশয়
শান্তভাবে শরীরে ধারণ করেছিল কিছু ফুল
আর নিজেই হয়েছিল পুতুল। তড়িঘড়ি
আমি সেখানে যাইনি সেদিন কাক-ডাকা
ভীষণ খাঁখাঁ দুপুরে,
যেন ও কেউ ছিল না আমার।
পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত আমার মনে হয়
আমার হৃদয় বার বার ভরে যাচ্ছে আতর গোলাপের গন্ধে,
অথচ সে আর ফিরে আসেনি।
আমাকে বলেনি কেউ তবুও আমি বিশ্বস্ত থেকেছি
নিজস্ব প্রতীক্ষায় দিন দুপুরের, রাত্রির প্রতিটি প্রহরে।
কতবার দরজা খুলে রেখেছি মাঝরাতে,
এসো এসো বলে আমার ক্লান্ত স্বর ভাসিয়ে দিয়েছি
হাওয়ায়। আমার ভাষার ভুল ব্যবহারের জন্যেই কি
ওর ফিরে আসার আলোয়
আনন্দিত কিশোরের মতো হয়ে ওঠে না আমার ঘর?
আমার দুঃখ শুয়ে আছে উল্টো হাতে মাথা রেখে। ইদানীং
আমার মন থেকে ওর স্মৃতি খুব দ্রুত
চলে যাচ্ছে অধিরাজ অন্ধকারের অন্তঃপুরে,
যেন ও কেউ ছিল না আমার।
শুয়ে আছি, এইমাত্র বেডসাইড টেবিলে রেখেছি
অলৌকিক গল্প সংকলন,
এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে।
ঘরের ভেতর আমিষাশী উদ্ভিদের মতো বেড়ে উঠছে ভয়
ক্রমাগত জাপটে ধরছে আমাকে;
দম-বন্ধ-করা ঘরে আটকে-পড়া চুড়ুইয়ের মতো
ছটফট করছি আমি।
হননপ্রিয় উদ্ভিদ আমাকে গিলছে একটু একটু করে,
তবু আজ রাতেও আমি
আমন্ত্রণপ্রবণ ক’রে রাখবো আমার ঘর-দুয়ার।
আমার কবিতা আজ
আমার কবিতা আজ একরাশ পাতার মতন
উড়ে যায়, দূরে যায়, বস্তুত এ সন্ধ্যেবেলা যায়,
কোথায় যে যায়।
চাঁদের কপালে টিপ দিয়ে
পাহাড়ের কোলে দোল খায়,
নাকি জঙ্গলের ভেতরে মরণ
হবে হিংস্রতার সৌন্দর্যের তদারকি পেয়ে
ভেবে সেখানেই খোঁজে অন্তিম আশ্রয়।
কিছু পাতা থেকে যায় বারোয়ারী বিচার সাপেক্ষে
শহর ও গ্রামে; লোকালয়
তুলে নেয় হাত;
কখনো উৎসুক চোখে দ্যাখে, কখনোবা
মরা আরশোলা, বাজে কাগজের সঙ্গে এলেবেলে
ফেলে দেয়, তারপর জানালার বাইরের শোভা
উপভোগ করে।
প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি-এসব কিছুই নেই
কবিতার, আছে শুধু অক্ষরের মালা,
গা গলায় পরে নেচে বেড়ায় সে। একলা আঁধার ঘরে,
আমলকি বনের ভিতর অন্তর্জ্বালা
নিয়ে ওড়ে সারাক্ষণ দূর নীলিমায়,
প্রজাপতিদের সঙ্গে থাকে মধুপুরে;
কখনো হারিয়ে যায়, কে জানে কোথায়!
কখনো শোবার ঘর, কখনো বাবুর্চিখানা ঘুরে
বিস্ময়ের মতো নিরাছুট্রা হঠাৎ হাজির হয় পুনরায়।
ইকারুসের জন্ম
জানি বেশ কিছুকাল ধ’রে
কী একটা উৎসব মতো
চলছে তোমার ওখানে।
তুমি আমাকে ডাকোনি। অবিশ্যি সেজন্যে আমার হৃদয়
বিলাপ-কাতর নয় আদৌ।
উৎসব শব্দটি উচ্চারিত হলেই
আমি দেখতে পাই এক গুচ্ছ ডাগর গোলাপ,
স্রোতে ভাসমান দীপের মতো
কয়েকটি মুখ, শুনি সরোদের তান
মনে মনে আমি সাজিয়ে নিচ্ছি
কিছু ঝলমলে দৃশ্য-কেউ একজন এল, যার পরনে
সাফারি স্যুট, শীতলপাটির মতো
পরিপাটি চুল, কেউ চলে যাচ্ছে গলগলে ধোঁয়া উড়িয়ে।
এই মুহূর্তে আমি ভাবছি
পাপড়িহীন কিন্তু সৌরভময় কোনো গোলাপের কথা,
করুণ অথচ গীতনিষ্ঠ একটি পাখির কথা এবং
আমার মনে হলো, এখানেই শেষ হলে ছিল ভালো।
আমন্ত্রহীন তোমার ঘরে ঢুকেই দেখি তুমি সোফায়
বসে আছো আলস্যামদির ভঙ্গিতে।
তোমার চুল খোলা, হাতে
সায়ান্স ফিকশন। দেবব্রত ছড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যাকুলতা।
টেবিলে কয়েকটি গ্লাশ, ত্র্যাশট্রে উপচে-পড়া
আধপোড়া সিগারেট আর ছাই। এই গৃহে
এমন দাহ, আমার জানা ছিল না। সেই মুহূর্তে আমার চোখ
ইকারুসের চোখ, আমার বাহুমূলে ওর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ডানা।
এই পথ
এই পথ
বড় আঁকাবাঁকা,
অত্যন্ত ঘোরালো, সরু, বহুদূর চলে গেছে দিগন্তের দিকে।
পথসঙ্গী ছিল যারা তারা
একে
একে
একে
ঝরে যায়,
যেমন রূপোর টাকা ছোঁড়া জেব থেকে।
নারকেলকুঞ্জ মেচেতার মতো
পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়া
ফেলেছে পথের ধারে, সেখানে হরিণ
ব্যাঘ্র-লোভ থেকে দূরে ব্যগ্র
চলে আসে শান্তি বিহারের
আশায় একাকী।
মোটরের ধমকে নিমেষে
চমকিত, দেয় লাফ পার্শ্ববর্তী ঘন
বনের ভেতর
ফুলের পরাগগুলি
থ্যাঁৎলানো, কিছু পদচ্ছাপ
মিশে গেছে ঘাসে, নীড়ছুট
পাখি উড়ে যায় মাথার ওপর;
নিঃশব্দ কে আসে
আমার পেছনে?
আমার নিজেরই প্রেত? নাকি
অন্য কোন প্রাণী?
কী করে যে অনুসৃত হয়ে উঠি ঘোর অবেলায়?
এই আঁকা-বাঁকা
পাকদণ্ডী বেয়ে একা-একা
এরকম সম্বলবিহীন
কোথায় চলেছি কোন্ সূর্যাস্তের দিকে?
পাকদণ্ডী দেয়না আশ্বাস কোনো, শুধু ঘুরে ঘুরে
একই স্থানে ফিরে আসা। সুন্দরীর জিভের মতন
বের-হয়ে আসা
পুষ্প পরাগকে বলি, শান্ত গাছের উদ্দেশে বলি-
আমাকে দেখাও পথ ধ্যানী;
চোখ বন্ধ ক’রে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে
এখন কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো?