বেদে
একজন সুকান্ত বেদেকে প্রায় প্রতিরাতে স্বপ্নে দেখি, তার
ঠোঁট কাঁপে যেন কিছু বলবার আছে,
অথচ হয় না বলা কিছুতেই। এত দিনে তার মুখ বিশদ মুখস্থ
হয়ে গেছে আমার এবং
যখন কখনও জানালার বাইরে তাকাই, হাঁটি
বারান্দায়, অথবা লিখতে বসি, সধূম চায়ের পেয়ালায়
ওষ্ঠ রাখি, চোখের সমুখে সেই মুখ
ভেসে ওঠে, নিষ্পলক চেয়ে থাকে হতবাক আমার দিকেই।
কখনও কখনও সেই মুখ
সালভাদর দালির ঘড়ি হয়ে গলে যেতে থাকে
তারপর অকস্মাৎ একগুচ্ছ জলপাই হয়ে
শূন্যে ঝোলে, কখনও বা হরিণের প্রাচীন ভঙ্গুর
করোটিতে সহজে রূপান্তরিত। করোটিতে একটি গোলাপ
গুঁজে রেখে গেছে যেন কোনও নারী, যার
চৈতন্যে মধুর চন্দ্রোদয়। বেদে তাকে বহু যুগ
ধরে বুঝি ব্যাকুল বেড়ায় খুঁজে নদীতীরে, বিজন প্রান্তরে, লোকালয়ে।
কখনও যে সেই বেদে আমার ভেতরে কী কৌশলে
প্রবেশ করেছে, ঠিক বুঝতে পারিনি। বারবার পথ ডাকে,
জলপাইবন, দ্রাক্ষাকুঞ্জ ডাকে ইশারায় আর ঢ্যাঙা ডিঙি
দুলে দুলে জানায় মোহন আমন্ত্রণ, ধু ধু চর বাসর গড়বে ভেবে
বেদের সারিন্দা হাতে গান গাই অমাবস্যা আর
পূর্ণিমায়। কেউ কি আরশিতে মুখ দেখে পুলকিত
ফিকে অন্ধকারে। অন্ধকার কত গাঢ় হ’লে তাকে
রাত বলা যায়, এই প্রশ্ন বেদেকে উত্তাল নদী করে তোলে।
মনোজ অঞ্জলিতে
কবিতা লেখার আগে আমার ভেতরে যে কী তোলপাড়
শুরু হয়, লেগে যায় কিছু শব্দের কী তুমুল হুড়োহুড়ি।
ও ওকে ঠেলে এগোতে চায়, একে অন্যের পা মাড়িয়ে কনুইয়ের
গুঁতো দিয়ে দিব্যি নিজের জায়গা করে নিতে ব্যগ্র। কারও
কারও মাথা বেশ ঠাণ্ডা, দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ,
ধীর স্থির সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। অন্যেরা অবসন্ন হয়ে পড়লে
একটু একটু করে ফাঁকা পথে এগিয়ে যায় ওরা প্রায় কোনওরকম
ঘেমো চেষ্টা ছাড়াই প্রথম সারিতে জায়গা পেয়ে যায়।
ওদের চেহারায় থাকে না ক্লান্তির ছাপ, গায়ে তন্ন তন্ন করে
তালাশ করলেও পাবে না কোনও আঁচড়ের চিহ্ন।
কবিতার ওরা, মনে হতে পারে অবলীলাক্রমে মিশে
থাকে, যেমন গাছের পাতায় সজীব সবুজ, লাল গোলাপে
সোরভ, সঙ্গীতে সুরধারা। সেসব শব্দ কি অন্তরালের
ছায়ায় বসত যার, সেই সরস্বতী অশেষ কৃপায় তার
অধর থেকে ঝরিয়ে দেন আমার নিরন্তর প্রতীক্ষা-কাতর
অঞ্জলিতে? সেই অধর থেকে ঝরা প্রতিটি শব্দই অব্যর্থ, নতুন।
মুখের ওপর মাকড়সার জাল
দরজার সামনে গিয়ে হঠাৎ অপ্রস্তুত হলাম। আগে কখনও
এই দরাজ, সুকান্ত দরজার মুখে এমন কঠিন্য দেখিনি।
আমাকে দেখলেই সে উদ্ভাসিত হতো হাসিতে, ‘এসো, এসো’
ধ্বনি বেজে উঠত ওর কণ্ঠে বাঁশির সুরের মতো। প্রতিহত
আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থতা
আমার মুখ ম্লান করে দেয়। অন্দর মহলে খবর পাঠাবার
জো নেই। বিরূপ দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার পথ চলা।
বহুদূর হেঁটে হেঁটে এক বিরান জায়গায় চোখে পড়ে কার্ডফোনের
বুথ। আশান্বিত আমি ক্ষণকাল পরে বুঝতে পারি টেলিফোন
বিকল; পথে নামতেই মাথার ওপর এক বদমেজাজি পাখির পাখসাট।
আবার সেই দরজার উদ্দেশে যাত্রা। চেনা বাড়িতে ঢুকতে না
পারলে আমার স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি,
এবার দরজা খানিক খোলা। মনে চকিতে কিসের দোলা লাগে,
তাহলে দরজার কাঠিন্যের বরফ গলেছে। একটু চাপ দিতেই
খুলে যায় দোর। পা বাড়াই। ভেতর মহল বড়ো সুনসান। নিদ্রায়
নিঝুম কি সবাই? সিঁড়ি পাশে রেখে ড্রইং রুমে প্রবেশ
করতে যার, পথ আগলে প্রসারিত মাকড়সার জাল। এই জাল
এমন শক্ত হতে পারে জানা ছিল না। জাল ছিঁড়ে এগোই।
অন্ধকার সোফায় সেই মানবীকে দেখি, যার জন্যে এখানে
আমার আসা। আমার উৎসুক প্রশ্ন ‘কেমন আছো?’ নিরুত্তর
সে। খুব কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখি, যেন রক্তমাংসের কেউ নয়,
পাথরের মূর্তি। মূর্তির শীতলতায় আমার হিমপ্রবাহ। হঠাৎ
একটা শব্দে ঘরের নীরবতা আক্রান্ত। দেয়াল থেকে পড়ে যাওয়া
বস্তুটি কুড়িয়ে নিয়ে দেখি সেই মানবীর কৈশোরের কোমল
ছবি। ভালো করে দেখে, খানিক আদর বুলিয়ে ওর শৈশবকে
টেবিলে রেখে পাথরের মূর্তির দিকে তাকাই আবার।
শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমি ঘরে আলো জ্বালতে অক্ষম। হিংসুটে
অন্ধকার তার দাঁত বসিয়ে রেখেছে সারা ড্রইং রুমে। আমার
ঠোকর খেয়ে মেঝেরে কার্পেট কী যেন কাৎরে ওঠে। ঝুঁকে আবিষ্কার করি
আমারই লেখা কবিতার বই, আরশোলার মল আর কীটের কামড়ে
ভীষণ জব্দ, আহত। এই জখমি বইটিকে কোথায় রাখব ভেবে
পাই না। টেবিলে রাখব? নাকি মেঝেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে
থাকবে, যেমন দুর্ঘটনায় পথচারী? ভেবে পাই না। আমার
পা একটু টলে যায়। বইটি টেবিলে রাখলে মানবীর কৈশোরের
পাশে ওকে মানাবে না। আমার হাতেই রয়ে যায়। বইয়ের পাতাগুলো
থেকে উঠে আসা আর্তনাদ শুনে মনে হলো আমার অন্তর্গত
হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাড়ির আনাচে কানাচে। বিকেলে
ড্রইং রুমের পাথরের মূর্তির চোখে সন্ধ্যার শিশির।
মোহিনী জলাশয়ে
নিত্য কে আমাকে করছে চুরমার?
খেয়াল খুশিমতো গড়ছে পুনরায়।
কখনও ছন্দের দোলায় মাতায় সে,
ছন্দছুট রাখে কখনও দিনরাত।
সাঁতার জানা নেই, নেমেছি ক্ষ্যাপা জলে;
জলে ঝাপ্টায় আহত চোখ মুখ।
তবুও ভেসে থাকি ঘূর্ণি জলে আর
আখেরে প্রাণ নিয়ে ডাঙায় ফিরে আসি।
আমাকে যেতে হবে গহন বনে একা,
যেখানে শ্বাপদেরা রয়েছে ওত পেতে।
পেরিয়ে গেলে বন মিলবে সরোবর,
সেখানে ডুব দিলে পাবই অমরতা।
অথচ সারা পথে পাশব হুঙ্কার,
আমার চার পাশে কেবল পাতা ফাঁদ।
লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারি যাতে, তাই
হিংস্র পশুদের রয়েছে আনাগোনা।
আমার ছিল সাধ কঠোর সাধনায়
কাব্যে মুক্তির আনব রঙধনু।
কিন্তু বারবার সাধ্যে ধরে ঘুণ,
ভাবে ও আঙ্গিকে ঘটে বিপর্যয়।
তবুও সরোবরে প্রায়শ ডুব দিই,
মুক্তো খুঁজে নিতে গহনে হাতড়াই।
শূন্য হাতে ফিরে কৃষ্ণ সন্ধ্যায়
আবার চেয়ে থাকি মোহিনী জলাশয়ে।