- বইয়ের নামঃ যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার মননে
ফেরানো যাবে না; তুমি চলে যাবে আমাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে
সম্পর্কের ঝালরকে তীব্র তুড়ি মেরে।
আমার হৃদয়ে ছিলে, ছিলে
আমার চিন্তার তন্তুজালে, বোধের স্পন্দিত নীলে।
তুমি যার সঙ্গে যাবে, তার
পরনে সুনীল ডিস্কো শার্ট, জিনস্-এর ট্রাউজার,
চোখে গোল রঙিন চশমা, মুখে বুলি
হরেক রকম; একালের রলরোলে নাচে তার পেশীগুলি।
তোমার শরীরে তারা ফোটে ক্ষণে ক্ষণে
অন্তর্গত শিহরণে। আজ আমি যৌবনের অস্তগত প্রহরে মননে
পাই খুঁজে নক্ষত্রের রূপালি স্পন্দন।
মন আজো রয়ে গেছে মাছ-গাঁথা ছিপের মতোন।
যদি বলি, সব নৌকা নিমেষে পুড়িয়ে
এসেছি তোমার কাছে, আঁচল উড়িয়ে
দুরন্ত হাওয়ায় তুমি যেও না আমার যন্ত্রণার
লবণাক্ত সৈকতের থেকে দূরে, তাহলে তোমার অন্ধকার
উঠবে কি কেঁপে নবজাত নক্ষত্রের অকূল তৃষ্ণায়?
তুমি কি আমার অস্তিত্বের কিনারায়
থাকবে দাঁড়িয়ে অতীতের কোনো ভাস্কর্যের মতো?
দেবে কি উত্তর অসং কোচে? নাকি নেবে মৌনব্রত?
তোমার সম্ভ্রম আমি করবো না ক্ষুণ্ন কোনোদিন।
এতদিনে জেনে গেছি যুবক যুবতী হয় লীন
যুগ্মতায় আনন্দ তরঙ্গে বারবার; উৎফুল্ল নবীন ত্বক
প্রবীণ ত্বকের স্পর্শ চায় না সচরাচর। কখনো নিছক
কৌতূহলবশত নিকটে আসে, ফেরে সরে যায়,
যেমন তরুণী মাছ জলের উপরিভাগে এসে চমকায়
ক্ষণকাল, পুনরায় দেয় ডুব অত্যন্ত গহনে।
তোমার শরীরী আভা, হোক তা চঞ্চল, থাকে আমার মননে।
আসা যাওয়া
অসময়ে কোকিলের গানের মতোন
বেজে ওঠে টেলিফোন।
‘কাল যাচ্ছে, এসো তুমি সন্ধ্যেবেলা,’ বলে
জুড়ে দিলে আরো কিছু কথা অকৌশলে।
‘আসবো নিশ্চয়,’ বলি
মেলে দিয়ে তোমার সত্তায় দিকে স্বপ্নের অঞ্জলি-
‘কটায় তোমার ট্রেন?’
‘চিঠি দিও,’
বললে তুমি জ্যোৎস্না চমকিত রমণীয়
কণ্ঠস্বরে। কিছু পরে রিসিভারে ছড়িয়ে সন্ন্যাস
কেমন নিশ্চুপ হলে। ভাবছি, তোমার
এবং আমার এই অবিরত আসা-যাওয়া, তার
মধ্যে স্বপ্নাবেশে গাইছেন
কী প্রার্থনা অন্ধ সুরদাস!
এই আশ্বিনে
এই আশ্বিনে বারান্দাটায় পড়ছি বসে
হালফ্যাশনের দিলতড়পানো উপন্যাস।
হাওয়ার চুমোয় গাছের পাতারা যাচ্ছে খসে
হৃদয়ে আমার হঠাৎ ফোঁপায় হলদে ঘাস।
কখনো ঢুলুনি ব্যেপে আসে খুব, কখনো বই
বুকে রেখে ছুটি অতীতের ধুধু তেপান্তরে।
কখনো অমল কখনো কিশোর ডেভিড হই,
তন্দ্রা ফলায় বিষাদ আমার প্রৌঢ় স্বরে।
ট্রাফিকের খর কলরবে ফের চমকে উঠি,
পথিপার্শ্বের আদল কেমন অচেনা লাগে।
দু’চোখে ঘনায় অতীতের কিছু শ্বেত পিঁচুটি,
সত্তা আমার স্নাত অবেলায় অস্তরাগে।
জীবন এখন, বলা যেতে পারে, হতচেতন;
খবর কাগজে গল্পগুজবে সীমিত প্রায়।
নিউরসিসের পাকে আবদ্ধ ক্লান্ত মন
এবং নিয়ত আমাকে ভাবায় কন্যাদায়।
পেনসনহীন জীবন গোঙায় রাত্রিদিন;
ট্যাঁকে কুলোয় না, আশরাফি ঠাঁট আছে বজায়।
দরবারী বাজে মেদমজ্জায় বিরামহীন,
মানসম্ভ্রম আস্তে সুস্থে অস্ত যায়।
দৌহিত্রের লাল বল এসে গড়ায় পায়ে;
গৃহিণী কিচেনে, ছেলেটা ক্যাসেট প্লেয়ারে শোনে
ডোনা সামারের গান আর চলে ক্রমশ বাঁয়ে।
ওর উদ্যমে হৃদয় আমার স্বপ্ন বোনে।
এই আশ্বিনে মনে পড়ে যায় মজেছিলাম
আমিও একদা কারো চঞ্চল চোখের নীলে।
একদা জপেছি প্রহরে প্রহরে একটি নাম,
সাজিয়েছি তাকে আবেগ-ঋদ্ধ ছন্দে মিলে।
জানি সে দয়িতা আজকে আমাকে রাখেনি মনে;
অভিযোগহীন বসে আছি আশি ভীষণ একা।
চিরদিন কেউ করে না ভ্রমণ বৃন্দাবনে,
মেঘের ঘষায় মুছে বায় ক্রমে চন্দ্রলেখা।
তা বলে আমার উদ্বেগ নেই, এমন নয়;
তাইতো আজকে আমার হৃদয়ে গোধূলিবেলা
তার পদপাতে হয়েছে ব্যাপক হিরন্ময়,
অবচেতনের জলে ভাসে এক বিবাগী ভেলা।
স্বরচিত ঘোর কেটে যায় দেখি অকস্মাৎ
দূরবর্তী সে মিছিলের রোলে নাড়ির গতি
বাড়ে ক্রমাগত, হায়রে আমার পক্ষপাত
এখনো অটুট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি।
কবন্ধ এই সমাজ এখন শ্মশানবাসী,
আমিও এখানে দশের মতোই ওড়াই ছাই,
বাজলো কি আজ ইস্রাফিলের ভীষণ বাঁশি?
প্রস্পেরো তার কেতাব ডোবায়। কোথায় যাই?
একটি কফিন ছুয়ে
নিঝুম দুপুরবেলা একটি কফিন ছুঁয়ে আমি সরে যাই
অনেকের চোখের আড়ালে।
কব্জির ঘড়িতে দেখি আড়াইটা বাজে। শুকনো ডালে
গাঢ় নীল পাখি ডেকে ওঠে, যাকে চাই
সে নেই কোথাও কাছে, তবু মনে হয়
দুপুরের অগাধ রোদ্দুরে মিশে আছে,
মিশে আছে বুনো জ্যোৎস্নাপ্লুত মাঠে সকল সময়।
যেখানে কফিন স্তব্ধ বাগানের ক্ষয়া চারাগাছটির কাছে,
সেখানে অনেক মুখ কী যেন খুঁজছে সারা বেলা,
শূন্যতার নির্মোহ নিবাসে
কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য কাহিনীর বিস্তারিত খেলা
দেখে নিতে চায় ক্লান্ত দুপুরের তন্দ্রাশ্রিত স্বপ্নের আভাসে।
আড়াইটা বাজে, বেজে যায়। একটি কফিন ছুঁয়ে দূরে
কোথাও আড়ালে ছায়াপ্রায়
হয়ে যাই, দুপুরের রঙময় কুকুরটা বারান্দায় গভীর নিদ্রায়
কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। কেউ কেউ যায় অন্তপুরে,
কেউবা বিদায় নেয় আস্তেসুস্থে হাত ঝাঁকুনিতে।
একটি গোলাপি স্যুটকেশ পড়ে আছে এক কোণে, সবখানে
কান্নার ব্যাপক দাগ, প্লেট, চামচ, চায়ের কাপ কুলুঙ্গিতে
পোহায় বিশ্রাম, কোকিলের অন্তর্ধানে
অকালে উজাড় হলো যত্নের বাগান। দূর পথে
কে যেন বাজায় বাঁশি, সুরে অসমাপ্ত গল্প বাজে,
দোলে শূন্য খাঁচা দোলে জগৎ সংসার, কোনোমতে
সামনে সুমলে নিয়ে নিজেকে জড়াই তুচ্ছ কাজে!
একটি কফিন ছুয়ে নির্বোধের মতো মনে-মনে অনর্থক
আওড়াই কিছু কথা আর
খামকা ঘড়িটা দেখি ঝাপসা চোখে, চোখের পাতার
বিবাগী কম্পনে বেদনার তুহিন স্ফুলিঙ্গ ধ্বক
ধ্বক করে; বেলা আড়াইটা ঘরে, বাগানে, উঠোনে
বেদনার মতো স্তব্ধ, অদৃশ্য কাউকে বলি, ‘আসি
তাহলে আসি হে বন্ধু, আবার আসবো’। অন্ধকার গৃহকোণে
আরাম কেদারা গায় শূন্যতার বিশদ বেহাগ। অট্রহাসি
জেগে ওঠে বাড়িটার অন্তঃস্থল থেকে। সত্যি কি আসবো ফের?
গেট খুলে দাঁড়াবো এখানে ক্ষণকাল?
পাবো কি আবার খেই সেই অসমাপ্ত সংলাপের?
গেট খুলি; বাইরে বিস্তৃত পথ, প্রতারক ব্যস্ততার জাল।
কিছু সামাজিক কিছু বিদগ্ধ
কিছু সামাজিক কিছু বিদগ্ধ ভিড়ে
তোমাকে হঠাৎ দেখলাম, মনে হলো।
পরনে তোমায় ফিরোজা রঙের শাড়ি,
অমন মায়াবী চোখে কি স্বপ্ন ছিল?
সূর্য তখনো ছিল পশ্চিমে হেলে;
কারো হাতে প্লেট, কারো হাতে কোকাকোলা।
দ্রুত সরে যাওয়া তোমার দৃষ্টিপাত
হৃদয়ে আমার দিয়ে গেল কী যে দোলা।
স্নিগ্ধ সে লনে গুঞ্জনে ক্রমাগত
বেড়ে যায় আর কথার ফুলকি ওড়ে।
প্রৌঢ় সুবেশ কূটনীতিকের চোখে
ইতিহাস আর কত স্তনভার ঘোরে।
কেউ ঠোঁটে তার নাচায় নিপুণ ঢঙে
বিশ্বশান্তি, কেউ মানবাধিকার
বিষয়ে ব্যাকুল; কেউ বলে, ‘শুনেছেন,
ওয়ালেসা-জায়া নিলেন পুরস্কার’।
চীনে বয়ে যায় ঈষৎ নতুন হাওয়া,
জাপানকে আজ স্বর্ণমারীচ ডাকে।
কানায় কানায় ভরাট অস্ত্রাগার,
নানা প্রান্তরে হিটলারী-প্রেত হাঁকে!
ম্যানিলা ক্ষুব্ধ প্রমেথিউসের মতো,
দুঃস্বপ্নের চরে ঘোরে মার্কোস।
হায়, রেগানের যাত্রা নাস্তি আর
লেবাননে জ্বলে মেশিনগানের রোষ।
আমি নিশ্চুপ ঘুরি একা, বড় একা;
খুঁজি তোমাকেই, কিন্তু পণ্ডশ্রম।
কোথায় লুকালে? তুমি কি বাস্তবিকই
এসেছো এখানে? এ-ও কি দৃষ্টিভ্রম?
হয়তো দেখিনি তোমাকে মিশ্র ভিড়ে,
স্বরচিত এক মরীচিকা নিয়ে আছি।
পলকে পলকে পাল্টায় একই পট,
পিশাচীর চোখে চোখ রেখে আমি বাঁচি।
খাঁ খাঁ দীপাধার
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, তারই মধ্যে দলছাড়া এক
অচিন হংস বেড়ায় সাঁতার কেটে।
ঘরদুয়ারে নিবিয়ে বাতি, খাঁচার ভিতর জবা নিয়ে
ঈশান কোণে লালন গেলেন হেঁটে।
একতারাটি শূন্যে বাজে দীন দরদী সাইয়ের খোঁজে
অষ্টপ্রহর আরশি নগর জুড়ে।
আমি তাকে খুঁজি না আর বনবাদাড়ে, শীশমহলে;
থাকুন তিনি লক্ষ যোজন দূরে।
খরদুপুরে কোথায় আমি অন্ন পাবো? কোথায় পাবো
চৈত্রপোড়া আঁজলাভরা পানি?
সময় যে নেই, বিহান ত্বরায় গড়ায় নিশুত রাতের অমায়,
হাটবাজারে টানি নাছোড় ঘানি।
লালন শাহের হৃদয়জোড়া পদ্ম ছিল বিশ্বাসেরই
আভায় মোড়া, পড়শি ছিল তাঁর।
নিজস্ব সংকটে আমি সংশয়ী আর ভীষণ একা,
যেন শূন্য খাঁ খাঁ দীপাধার।
গ্রিক ট্যাজডির নায়কের মতো
তোমার সঙ্গে হয়েছিল দেখা ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে।
নদীতীরে নয়, বাগানেও নয়, পার্কে নয়,
হয়েছিল দেখা খোলা রাস্তায় দীপ্র ভিড়ে।
যদিও তোমাকে নিশ্চিত আমি দেখিনি আগে,
তবু মনে হয়, ছিল পরিচয় অনাদিকালে।
হয়তো আমরা ছিলাম গুহায় বাকলাবৃত।
এখন আবার জন্মান্তরে দাঁড়াই এসে
আমরা দু’জন পাশাপাশি এই শান-বাঁধানো
কোলাহলময় পথের প্রান্তে মিশ্র ভিড়ে।
শাড়ির আঁচল উড়ছে হাওয়ায়, শিথিল খোঁপা;
স্বেদকণা জমে নাকের ডগায়, কর্ণমূলে।
তোমার কণ্ঠে হয় বাঙ্ময় দিনদুপুর।
সেদিন দুপুরে তোমার দু’চোখে দেখেছিলাম
এলদেরাদোর ঈষৎ আভাস, অতুলনীয়।
শরীর তোমার নিমগ্ন এক গুণীর তান।
প্রথম দেখায় তোমাকে কি ভালো বেসেছিলাম?
হাজার কণ্ঠে মিশেছিল বটে তোমার গলা,
সে গলায় শুনি অলকানন্দা নদীর সুর।
তুমি মনোযোগী ছিলে না তখন আমার প্রতি,
অথচ ছিলাম সকল সময় তোমারই পাশে।
হৃদয়ে আমার ফুটেছিল শত স্বর্ণচাঁপা।
স্বর্ণচাঁপার আভা ছিল নাকি তোমার চোখে?
পথ চলি ভরা রোদ্দুরে আর ইতিহাসের
কাঁসর ঘণ্টা আমরা প্রবল নাড়িয়ে দিই।
হায় দুপুরেই কেমন কুটিল সন্ধ্যা নামে।
পাশা খেলা শেষ, শুরু হলো বুঝি বনপর্ব,
আড়ালে নিষাদ শানাচ্ছে খুব তীরের ফলা।
জোনাকির মতো স্বপ্ন আমার ব্যাপক, ক্রূর
ষড়যন্ত্রের আলখাল্লায় গিয়েছে ঢেকে-
আমরা দু’জন দু’দিকে ছিটকে পড়েছি আজ।
নিচ্ছে বিদায় চোখ কান আর কণ্ঠস্বর;
যায় সব যাক, অন্তত এই পোড়া জীবনে
গ্রিক ট্রাজেডির নায়কের মতো মহিমা থাক।
চকিতে সুন্দর জাগে
প্রস্তুতি ছিল না কিছু, অকস্মাৎ মগজের স্তরে
স্তরে মেঘমালা,
বিদ্যুতের স্পন্দমান শেকড় বাকড়-
অনন্তর সে এল, কবিতা,
আমাকে আচ্ছন্ন করে তার চুলে, অসিত শিখার মতো চুলে
আমাকে বদলে দিয়ে বৈপ্লবিক ভাবে।
মাঝে-মধ্যে ভাবি, আজো ভাবি
এ কেমন দাবি নিয়ে এল
অত্যন্ত রহস্যময়ী চঞ্চলা প্রতিমা?
এখনও তাকেই ভাবি যে আসে হঠাৎ
অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো মনের নিঃসীম বিরানায়, পুনরায়
চকিতে মিলিয়ে যায়।
কবিতাকে খুব কাছে পেতে চেয়ে কখনো কখনো
কবিতার কাছ থেকে দূরে চলে যাই।
কবিতাকে ভালোবাসি বলে পদ্মকেশরের
উৎসব হৃদয়ে উদ্ভাসিত। কবিতার
প্রতি ভালোবাসা ডেকে আনে ভালোবাসা
হতশ্রী জীবনে, খরাদগ্ধ অবেলায় ঢালে জল,
যেমন মৃন্ময়ী চণ্ডালিকা
আনন্দের আঁজলায়। কবিতাকে ভালোবাসি বলে
অন্তর্গত ভস্মরাশি থেকে
চকিতে সুন্দর জাগে অমর্ত্য কণ্ঠের পাখি, যাকে
আত্তার অথবা রুমি আত্মা বলতেন।
চতুর্থ ভাষা
আমরা দু’জন
বৌদ্ধ বিহারের কাছে হল্দে পাতাময় পথে দাঁড়িয়ে ছিলাম
কিছুক্ষণ।
হৃদয় আবৃত্তি করে বারবার ভিনদেশী নাম
তোমার এবং মৃদু কথোপথনে
আগ্রহী আমরা বলি কিছু ঝাপসা, গুঁড়ি গুঁড়ি কথা।
জানি না এখানে আজ এসেছি কিসের অন্বেষণে
নিজস্ব অস্তিত্বে নিয়ে গূঢ় ব্যাকুলতা।
যে-ভাষায় স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর গীতাঞ্জলি
যোগাযোগ, গোরা, নষ্ট নীড়
আমি সে-ভাষায় কথা বলি।
যে-ভাষা সহজে তোলে মীড়
আজন্ম তোমার প্রাণে, সে-ভাষায় ঋদ্ধ কাওয়াবাতা
তুষারে ফুটিয়েছেন ফুল। অথচ আমরা কেউ কারো
ভাষায় বলিনি কথা অজ্ঞতাবশত। ঝরা পাতা
গান হয় পায়ের তলায় আর তৃতীয় ভাষায় কিছু গাঢ়
কথা বলি পরস্পর, আধো-বাধো, মানে
ইয়েটস-এর ভাষা তোমার আমার ঠোঁটে
গুঞ্জরিত হয়, দু’টি প্রাণে
বাড়ে মূক ব্যাকুলতা, যেন মন্দিরের গায়ে বয় হাওয়া, ফোটে
সহসা চতুর্থ ভাষা যুগল সত্তায়,
সে-ভাষা চোখের আর স্পর্শাভিলীষী হাতের। তুমি
আর আমি স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাষাময় ভাষাহীনতায়
তন্ময় সাঁতার কাটি, খুঁজি যুগ্মতার জন্মভূমি।
চন্দ্রগ্রহণ
বহুদিন ধরে দূর থেকে দেখি আমি
একটি অত্যন্ত তেজী চিতাবাঘ। তাকে
দেখে অসম্ভব
বিমুগ্ধ না-হওয়া। সে নিজের সৌন্দর্যের
গর্বে বড় জ্বলজ্বলে
রাত্রিদিন। কী করে সে গ্রামে ও শহরে
বজায় রেখেছে আধিপত্য, তার কিছু
গল্প শোনা যায় ইতস্তত।
স্প্রিংয়ের মতোন তার পেশী,
ভয়ঙ্কর সুন্দর তাকানো,
বিপদবিহ্বল হরিণের
পেছনে দৌড়ানো,
ইত্যাদি দেখেছি আমি চোখ ভরে এবং শুনেছি
স্তব্ধতা-হননকারী ডাক।
একদিন শহর ভাসিয়ে জ্যোৎস্না ওঠে,
আকাশে সোমথ চাঁদ হাসে বাগদত্তার মতোন
অনাবিল আর দেখলাম
হঠাৎ কোত্থেকে এসে সেই ডাকাবুকো
চিতাবাঘ সে এক এলাহি লাফে ওঠে আসমানে,
তারপর বেমালুম গিলে ফেলে গোল চাঁদটাকে।
চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে এসে
পুনরায় পশু পাখিদের সৌন্দর্য এসেছি দেখে
চড়ুইভাতির ছলে। বেশ কিছুদিন এইমতো
কাছ থেকে ওদের হয়নি দেখা; শুধু ইতস্তত
একটি কি দু’টি পাখি অথবা বানর ব্যতিরেকে
দেখিনি তেমন কিছু, বলা যায়, আশেপাশে আজ
খাঁচার আড়ালে এক সিংহের উজ্জ্বল বিস্ফোরিত
কেশর এবং পার্শ্বস্থিত মাঠে কিছু সচকিত
হরিণের কেমন তাকানো, স্বাভাবিক কারুকাজ
ওদের মসৃণ শরীরের দেখে মুগ্ধ, বিশেষত গরিলা ও
শিম্পাঞ্জীর আচরণে মজা আমি পেয়েছি প্রচুর।
তাদের অমন মুখভঙ্গী দেখে এই শিল্পাতুর
মন, দ্বিধাহীন বলা যায়, যদি স্বীকারোক্তি চাও-
ভেবেছিল হঠাৎ রর্দার ভাবুকের মুখ আর
সে মুহূর্তে বিষণ্নতা করেছিল দখল আমাকে।
ফিরে এসে জামা ছাড়ি, ক্লান্ত মুখ ধুই, এক ফাঁকে
‘রুটস’-এর কিছু প্তা ওল্টাই, চা খাই, অন্ধকার
সাজায় অরণ্য চতুর্দিকে। নিমেষে কত কী ঘটে
আরণ্যক; খুন, রাহাজানি চলে প্রহরে প্রহরে-
পশুকে মানায় হার দ্বিপদী প্রাণীরা এ শহরে।
তবু স্বস্তি মুকুলিত-এখনও মানুষ আছি বটে।
চড়ুইভাতির পাখি
দপ্তরে বসে গুমোট দুপুরে হঠাৎ পড়ল মনে
একদা আমরা ক’জন নিভৃতে কাটিয়েছিলাম চড়ুইভাতির দিন
শালনার শালবনে।
শীত দুপুরের স্বচ্ছ রোদের আদর শরীরে মেখে
কাটিয়েছি বটে আহারে বিহারে; একটি কি দু’টি পাখি
চকিতে গিয়েছে ডেকে।
কেউ বলেছিল কবরী কেমন খোঁপা বাঁধে সিনেমায়,
কেউবা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাল ঊষা উত্থুপ, রুনা লায়লার গান,
কেউ পপ সুরে লেকের কিনারে চমকিলা নেচে যায়।
কেউ সচিত্র পত্রিকা খুলে অলস দৃষ্টি মেলে
দেখে নটীময় ফুরফুরে পাতা, পড়ে উড়ো কথা কিছু;
কেউ বুক থেকে তার জামদানী শাড়ির আঁচল হেসে
ফেলে দেয় অবহেলে।
নক্শি ছায়ায় কাঠবিড়ালিটা বিকেলের মায়া নিয়ে
তরতর করে গাছ বেয়ে ওঠে দেখি।
মাথার ওপর খেলিয়ে সবুজ ঢেউ যায় কত যে সতেজ টিয়ে।
আমি তার মুখ ভেবে আর কবিতার
বিন্যাস খুঁজে ছিলাম একাকী ঘাসে কান পেতে ফলের মতোন শুয়ে।
অলকানন্দা বয়ে যায় পাশে, হৃদয়ে আমার লায়ারের ঝংকার।
এখানে কোথায় হরিণের লাফ, বাঘের জোরালো ডাক?
নিসর্গ খুব শান্ত এখানে, কিন্তু হঠাৎ ভীষণ চমকে শুনি
গুলির শব্দ, দিশাহারা দেখি বনের পাখির ঝাঁক।
আমাদের কেউ টিপেছে ট্রিগার, একটি আহত পাখি
নিরীহ সবুজ ঘাস লাল করে অদূরে লুটিয়ে পড়ে।
ছটফট-করা পাখিটার দিকে সভয়ে তাকিয়ে থাকি।
পাখিটার কাছে ছুটে যায় শিশু, শিকারি দিলেন শিস।
শালবনে গাঢ় ছায়া নেমে আসে, এখন ফেরার পালা।
ছায়ার ভেতর বেজে ওঠে ধ্বনি-‘অ্যাডোনিস, অ্যাডোনিস’।
যাকে আমি খুঁজি সকল সময়, যে আমার ব্যাকুলতা,
তার উপেক্ষা যখন স্মরণে আসে,
তখন আমার মনে পড়ে যায় চড়ুইভাতির আহত পাখির কথা।
জন্মভূমিকেই
শহরে রোজ ট্রাফিক গর্জায়,
চতুর্দিকে চলছে কী হুজুগ;
কত চৈত্র, কত শ্রাবণ যায়,
তোমাকে আমি দেখি না কত যুগ।
অথচ দেখি নিমেষে আজকাল,
একলা ঘরে যখনই চোখ বুঝি।
খাটিয়ে রাঙা কল্পনার পাল
তোমার কাছে গিয়েছি সোজাসুজি।
তোমাকে দেখি তালদীঘির ঘাটে,
শারদ ভোরে দূর বেদাগ নীলে;
তোমাকে দেখি ফসলছাওয়া মাঠে,
চিলেকোঠায়, দূর চলনবিলে।
তোমার চোখ, তোমার কেশভার
ঝলসে ওঠে আমার চোখে শুধু।
কে আশাবরী শোনায় বারবার,
হৃদয়ে জ্বলে স্মৃতির মরু ধূ ধূ।
বৃথাই আমি তোমাকে কাছে চাই;
হিংস্র দিন, স্বৈরাচারী রাত
আমাকে রোজ পুড়িয়ে করে ছাই-
পাই না আর তোমার সাক্ষাৎ।
তোমার কাছে শিখেছিলাম বটে
বাঁচার মানে নতুন করে মেয়ে।
এখন শুনি নানান কথা রটে,
সত্য গেছে মিথ্যাতেই ছেয়ে।
রটনা জানি নেহাৎ একপেশে,
স্বপ্নেও যে তোমার দেখা নেই।
কিন্তু মেয়ে তোমাকে ভালোবেসে
হৃদয়ে চাই জন্মভূমিকেই।
জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা
জানি না তোমার নাম, তুমি রোজ সংবাদপত্রের
পাতায় বুলোতে কিনা চোখ কিম্বা ঝোপ
শার্ট পরে ছিপ হাতে যেতে কিনা পুরানো দিঘির
পাড়ে, আমার তা জানা নেই। সত্যি বলতে কী, ঠিক
তোমার বিষয়ে আমি কোনোদিন কারো কাছে কোনো
কাহিনী শুনিনি। শুধু যখন এদিকে আসি, দেখি
দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি আমাদের অনেক ওপরে-
ক্ষীণকায়, যেন রৌদ্রজলে একটু একটু করে
ক্ষয়ে গেছে ক্রমাগত সমুন্নত শরীর তোমার।
তোমার শপথঋদ্ধ হস্তধৃত বন্দুকের নল
কম্পাসের কাঁটার মতোন দিকচিহ্ন নির্দেশক।
একদা জীবিত ছিলে, বস্তুত এখন মৃত; তবু
কখনো কখনো মনে হয় তোমার পাথুরে বুক
ঘন ঘন স্পন্দিত নিশ্বাসে। হে অজ্ঞাত বীর, শোনো,
তোমার সংগ্রামী স্মৃতি মাছের কাঁটার মতো লেগে
আছে আমাদের বিবেকের শীর্ণ গলায় নিয়ত।
তুমি কি করেছো শুরু?
তুমি কি করেছো শুরু,প্রকৃত আরম্ভ যাকে বলে?
না, করোনি। অবশ্য ভেবেছো তুমি অনন্তের খুঁট
লক্ষ্য করে পেরিয়ে এসেছো চলে
প্রায় গন্তব্যের কাছে। সময়ের উট
তোমার অস্তিত্বে বালি ছড়াতে ছড়াতে
এবং কিছুটা নুলো বানিয়ে তোমাকে যাচ্ছে ছুটে
অবিরত, অদৃশ্য করাতে
তোমার সত্তায় তপ্ত ছেঁকার দাগের মতো ক্ষত নিয়ত উঠছে ফুটে।
তোমাকে দিই না দোষ। সাফল্যের দ্যুতি
মাঝে-মাঝে উঠলে ঝিকিয়ে চতুর্দিক
করতালিময় হয়, ললাটে বিভূতি
জেগে ওঠে, তখন এ ভাবনা স্বাভাবিক-
আখেরে পৌঁছুনো গেল সাধের মানস সরোবরে।
না, যায়নি। যদি যেত, তাহলে এখনো
কেন তুমি তোমার আপন কণ্ঠস্বরে
অমর্ত্য কিন্নর সুর লাগাতে হয়েছো ব্যর্থ? শোনো,
ফুলের আড়ালে অন্য ফুল
অথবা ফলের অন্তঃস্থলে ভিন্ন ফল
দেখার ক্ষমতা তুমি এখনো কি করেছো অর্জন? বাষ্পাকুল
চোখ কিংবা সুরাইয়ের সর্পিল ফাটল,
ধাবিত অশ্বের পাল, শুঁয়োপোকা, লাউডগাসহ
নিটোল শিশিরকণা অথবা পাখির ডাক, বৃদ্ধার তাকানো
পেরেছে কি করতে অর্থবহ
তোমার শব্দের পুঁতি? পারেনি যে তা’ তুমি নিজেই ভালো জানো।
তাহলে কীভাবে বলা যায়
অনেক আগেই তুমি করেছিলে শুরু? অন্ধকারে
সারাক্ষণ হাতড়ে বেড়াল পথ ভারি অসহায়,
প্রকৃত আরম্ভ তাকে বলা দায়। পথের কিনারে
বসে আছো দূরে চোখ মেলে কায়ক্লেশে
মুহ্যমান, পরিণামহীন;
এসেছো এ কোন্ দেশে রুক্ষ ছিন্ন বেশে
অবেশেষে, ভাবছো প্রমথাক্রান্ত মনে; যায় দিন।
অবশ্য ছাড়েনি হাল। মজ্জমান মানুষের হাত
যেমন মাটিকে ছুঁতে চায়,
তেমনি তুমি চাও পেতে ঘনিষ্ঠ সাক্ষাৎ
এখনো প্রকৃত আরম্ভের। মননের সাহারায়
কী করে ফোটাবে ফুল? মানুষ নিয়ত
সীমার শেকলে পিষ্ট, তবু তার স্বপ্নের মরাল
আকাশে আকাশে ওড়ে ধ্রুপদের মতো।
জেনেছো করাল
মূর্তির আড়ালে আছে ভবিষ্যত আর
গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছো সর্বদা। ক্ষণে ক্ষণে
তোমার ভেতর থেকে অন্তর্ভেদী পবিত্র চিৎকার
জেগে ওঠে-‘হারিয়ে ফেলেছি পথ শ্বাপদসংকুল এক বনে,
কোথায় প্রকৃত শুরু, কোথায় বা শেষ?
কখনো হঠাৎ প্রার্থনায় নতজানু
হও তুমি, সে-ও তো যন্ত্রণা সীমাহীন, নিরুদ্দেশ
ঠিকানার অন্বেষণে ক্রমাগত হতে থাকা স্থানু।
তৃতীয় চোখ
ইদানীং আমার একান্ত স্বাভাবিক দু’চোখের
মাঝখানে নতুন একটি চোখ জেগে থাকে ঢের
নাটকীয়তায়। আগে যা কিছু চোখের অন্তরালে
থেকে যেত, এখন সেসব এক দীপ্র রশ্মিজালে
ধরা পড়ে সহজেই। শুধু তাই নয়, বেলাবেলি
অদৃশ্য এমন কিছু দৃশ্য অকস্মাৎ দেখে ফেলি
যার কোনো যোগসূত্র নেই বাস্তবের সঙ্গে, মানে
যা যায় না দেখা চর্মচোখে কোনোকালে। স্বপ্ন আনে
যুক্তির সীমানা-ছেঁড়া স্বপ্ন, কখনো দুঃস্বপ্ন সেই
দৃশ্যাবলী। দেখি লক্ষ লক্ষ অন্ধ ‘কোনো আশা নেই’
বলে দ্রুত অতল খাদের ধারে হেঁটে যাচ্ছে আর
বিদ্যালয়ে, কলোনীতে সর্বগ্রাসী মরুর বিস্তার;
দিকে দিকে ভূমণ্ডলে নৃসিংহের বিকট উল্লাস,
প্রধান সড়কে দেখি কত দেশপ্রেমিকের লাশ।
যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য নয় এই দেখা কারো কাছে,
তাই আমি চোখ রাখি খরগোশ, নদী আর গাছে।
তোমার মেরুন কার্ডিগান
শীতার্ত সন্ধ্যায়
ছিলাম পুরানো ঘরে বসে একা উদাসীনতায়
গা ভাসিয়ে; অকস্মাৎ এলে তুমি বসন্তের উচ্ছ্বাসের মতো
স্পন্দিত শরীর নিয়ে; বসলে মোড়ায়, ইতস্তত
তাকালে এবং কী খেয়ালে
নিলে তুলে তরুণ কবির বই; সত্তার দেয়ালে
বেহেজাদ আর মাতিসের ছবি করে মেলা-মেশা।
খৃষ্ঠপূর্ব শতকের পুরুষের অনুরূপ শোণিতের নেশা
আমার শিরায় জাগে; এ ধূসর সাঁঝে
রেকর্ড প্লেয়ার বাজে,
শুনি আমি অবিশ্বাসী, রাবীন্দ্রিক বিশ্বাসের গান।
মনে পড়ে তোমার পরনে ছিল সেদিন মেরুন কার্ডিগান।
আমার প্রেমিকা তুমি নও; সহোদার,
অথবা আত্মাজা তা-ও নয়। তবে তুমি কি অধরা
সত্তা কোনো রঙিন কুয়াশাঘেরা? কোনো প্রহেলিকা
জ্বালিয়ে আমার মধ্যে সাপের জিভের মতো অগণন শিখা
চকিতে উধাও হয়ে যাও,
আবার কখনো দাও
প্রতীক্ষার অঞ্জলিতে হঠাৎ দেখার পুষ্পোচ্ছ্বাস? তুমি কোনো
মরীচিকা নও জানি। দৈবাৎ কখনো
আমার পুরানো ঘরে, হে নবীনা, তুমি এলে ভাবি
অমর্ত্যলোকের চাবি
এসে গেছে বামন মুঠোয়। কিন্তু পুনরায় না ফুরোতে প্রিয় তিথি
সন্ধি শূন্যে মিলায় তোমার উপস্থিতি।
সম্পর্কের সম্মোহন কিউপিড করেনি রচনা
তোমার আমার মধ্যে, তবু এককণা
নিভৃত কস্তুরী খুব কৌতূহলভরে
বিলায় সুবাস থ্যাঁৎলানো অস্তিত্বের স্তরে স্তরে।
এখনো তোমাকে ভালো লাগে, এইটুকু বলা যায়;
যখন তোমাকে ভাবি আমার নিদ্রালু, চেতনায়
কিছু স্বপ্ন, কিছু স্মৃতি, অস্পষ্ট গুঞ্জন
ভেসে ওঠে, জাগে আলোড়ন
অন্তর্গত প্রাণীর কংকালে আর দেখি, হে আমার হ্রস্বকেশী,
স্বপ্নিল বারান্দা এক, গৃহকোণে মোড়া, খাঁচা; সবচেয়ে বেশি
দেখি পুষ্পাগমে প্রীত বিনীত বাগান
এবং দোদুল্যমান কীটদষ্ট তোমার মেরুন কার্ডিগান।
দশ টাকার নোট এবং শৈশব
যা যায় তা আর ফিরে আসে না কখনো
ঠিক আগেকার মতো। পাখির ডানার
শব্দে সচকিত
সকালবেলার মতো আমার শৈশব
প্রত্যাবর্তনের দিকে ফেরাবে না মুখ
কস্মিনকালেও।
বাকদেওয়া মোরগের ধনুকের ছিলার মতোন
গ্রীবা, চৌবাচ্চায় একজোড়া সীমাবদ্ধ
হাঁসের সাঁতার, ভোরবেলাকার শিউলির ঘ্রাণ,
গ্রীষ্মের বিকেলে স্নিগ্ধ কুলপি বরফ,
মেরুন রঙের খাতাময় জলছবি,
সন্ধ্যার গলির মোড়ে কাঁধে মইবওয়া বাতিঅলা,
হার্নি সাহেবের হল্দে পুরোনো দালান,
খড়বিচালির গন্ধভরা মশা-গুঞ্জরিত
বিমর্ষ ঘোড়ার আস্তাবল, মেরাসীনদের গান
ধরে আছে সময়ের সুদূর তরঙ্গেমেশা আমার শৈশব।
মনে পড়ে, যখন ছিলাম ছোট, ঈদে
সদ্যকেনা জামাজুতো পরে
সালাম করার পর আমার প্রসন্ন হাত থেকে
স্বপ্নের ফলের মতো একটি আধুলি কিম্বা সিকি
ঝরে যেত ঝলমলে ঝনৎকারে আমার উন্মুখ
আনন্দিত হাতে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সেই পাট চুকে গেছে কবে।
এখন নিজেই আমি ছোটদের দিই ঈদী বর্ষীয়ান হাতে,
আয়নায় তাকিয়ে দেখি আপনকার কাঁচপাকা চুল,
ত্বকের কুঞ্চন।
এই ঈদে জননীকে করলাম সালাম যখন,
অনেক বছর পরে আম্মা কী খেয়ালে অকস্মাৎ
দিলেন আমার হাতে দশ টাকার একটি নোট,
স্বপ্নে দেখা পাখির পালক যেন, আর
তক্ষুণি এল সে ফিরে অমল শৈশব
আমার বিস্মিত চোখে কুয়াশা ছড়িয়ে।
দিগ্নির্দেশ
বৈকালী হাওয়া গুঞ্জন তোলে আমার কানে-
উত্তরে তুমি অবশ্য পাবে প্রিয়তমাকে’।
পথ চলি একা সেই ভরসায় নাছোড় টানে,
কিন্তু সেখানে শত বিভ্রমে পাই না তাকে।
সুকণ্ঠ এক পাখি গান খেয়ে জানায়, ‘তুমি
দক্ষিণে গেলে পেতে পারো তাকে ঝর্ণা তলে।
সারাদিন হেঁটে সন্ধ্যায় দেখি নিঝুম ভূমি,
ঝর্ণার ধারে শুধু এক ঝাঁক জোনাক জ্বলে।
যে নদীর সাথে ছিল শৈশবে সখ্য সেই
বেদেনীর মতো তরঙ্গময় নদীর ঢেউ
বললো, ‘পথিক, যদি যাও পূবে, পাবে তাকেই।
সেদিকে পৌঁছে দেখি সেখানেও নেই যে কেউ।
একটি বয়েসী বট করে গাঢ় উচ্চারণ,
‘পশ্চিম গেলে পাবে তার হাত তোমার হাতে’।
পশ্চিম দিকে বৃথা ঘুরে মরি, কী নির্জন
রাত্রি মুখর একাকিত্বের বন্দনাতে!
সবদিকে হেঁটে পাড়ি দিয়ে তের গহন নদী
মনোনীতা সেই নারীকে আমার হয়নি পাওয়া।
পাওয়া না-পাওয়া একই মুদ্রার দু’পিঠ যদি,
তাহলে খামকা কেন এই যাওয়া, কেবল যাওয়া?
বাঁশি
ভরদুপুরে, সন্ধ্যাবেলা, মধ্যযামে
বাঁশির সুরে চতুর্দিকে কেমন যেন
ছায়া নামে, মায়া নামে।
বাঁশির সুরে নীল যমুনা স্মৃতিকাতর,
অর্ফিয়ুসের সামনে আসে বনের পশু,
গুল্মলতা, নুড়িপাথর।
দায়ের ঘায়ে মুলী বাঁশের কান্না ঝরে।
বাঁশের মৃত্যু না হলে কি বাঁশির সুরে
পুষ্প জন্মে চরাচরে?
ভাবীকথকের প্রতি
তুমিতো এসেই গ্যাছো। তোমাকে দেখেছি শহরের
সবচেয়ে দীন চা-খানায়,
বাস টার্মিনালে, দগ্ধ ঘাসময় মাঠের কিনারে
একা লোকচক্ষুর আড়ালে,
প্রধান সড়কে আর গোধূলিতে পার্কের বেঞ্চিতে,
সন্ধ্যায় ওভারব্রিজে, কখনো চড়কে,
কখনো বা মহরমী শোকার্ত মিছিলে;
দেখেছি ঝিলের ধারে, জন্মান্ধ ডোবার আশেপাশে।
তোমার পরনে নেই জেল্লাদার পোশাক-আশাক,
যা দেখে ঝলসে যাবে চোখ; কত লোক
আসে যায় সর্বদা তোমার পাশ ঘেঁষে। মনে হয়,
করে না তোমাকে লক্ষ কেউ। বেলাশেষে ক্ষীণ আলোয় ফিরতি
মানুষের ঢেউ দোলে, উদাসীন তুমি
তাকাও নিস্পৃহ চোখে চাদ্দিকে এবং স্মিত ঠোঁটে
আওড়াও মনে মনে, কোথায় কে শিশু চোখ খোলে,
কোথায় নিমেষে কার চোখ বুজে যায়,
দিন যায়, দিন যায়;
নও তুমি দীর্ঘকায়, খর্বকায়ও নও। ভিড়ে মিশে গেলে তুমি
সহজে সনাক্ত করা দায়। অথচ কোথায় যেন
কী একটা আছে, বোঝা যায় চোখ পড়লেই,
তোমার ভেতরে।
তোমার দু’চোখ নয় যেমন তেমন। চক্ষুদ্বয়ে
করুণার জ্যোতি খুঁজি; যারা দিব্যোন্মাদ, বুঝি তারা
এমন চোখেরই অধিকারী।
কী বলবে তুমি এই হৈ হুল্লোড়ে? শুনছো নাকাড়া
নাকাড়া বাজছে অবিরাম দশদিকে?
নরনারী উচ্ছল সবাই,
যেন পানপাত্র থেকে ভরা মাইফেলে
উপচে পড়ছে ফেনা অবিরত। কিন্তু প্রত্যেকেই
অস্তিত্বে বেড়াচ্ছে বয়ে ঘুণপোকা; ভব্যতাসম্মত
আচরণে ওরা নড়ে চড়ে ক্ষণে ক্ষণে
পুতুলনাচের মতো। কখনো অভিন্ন ছাঁচে হাসে,
কাঁদে সিনেমার সীটে বসে, ভিটেমাটি আগলায়,
মেতে থাকে শত বছরের আয়োজনে,
গলায় তাবিজ তাগা পরে
কাটায় জীবন।
যখন বলবে তুমি গাঢ় কণ্ঠস্বরে
‘অকস্মাৎ দীর্ণ হবে নিথর মৃত্তিকা,
প্রবল ফুৎকারে ধসে যাবে লক্ষ লক্ষ অট্রালিকা,
কংকাল জীবিতদের কবরে শুইয়ে দেবে খুব
তাড়াহুড়ো করে,
যখন বলবে তুমি
অসংখ্য কবর থেকে মৃতদের উত্থানের কথা,
তেজস্ক্রিয় ভস্মে সমাহিত সব নগরীর কথা,
মানব জাতির দ্রুত পতনের কথা,
রক্ত-হিম-করা
সর্বশেষ সংঘর্ষের কথা,
বেজন্মা, বেনিয়া সভ্যতার নিশ্চিহ্ন হবার কথা,
তখন সে উচ্চারণ কেউ কেউ শুনবে দাঁড়িয়ে
রুটিমাখনের দোকানের ভিড়ে, কেউ
আনকোরা দামি শাড়ি পরখ করার কালে আর
কেউবা আইসক্রীম খেতে খেতে, কেউ সিনেমার
টিকিট কেনার কালে,
কেউবা গণিকালয়ে ঢোকার সময়।
তোমার কম্পিত উচ্চারণে
বস্তুত নগরবাসী দেবে না আমল।
আবছা মনস্কতায় শুনবে, যেমন
শোনে ক্যানভাসারের গৎ-বাঁধা কথা।
যদি দিতে চাও তুমি সত্যতার বিশুদ্ধ প্রমাণ,
তবে সুনিশ্চিত
তোমাকে যেতেই হবে দাউ দাউ
আগুনের মধ্য দিয়ে আর
অলৌকিক নগ্ন পায়ে হেঁটে সাবলীল
পাড়ি দিতে হবে খর নদী।
মাটির দিকেই
দৃশ্য থেকে দৃশ্যে তুমি কী খুঁজছো ইদানীং? নানা
দৃশ্যে চোখ রেখে গাঢ় অত্যন্ত গভীরে যেতে চাও,
গান তুলে নিতে চাও গাছের বাকল, পাথরের
বিষণ্ন স্তব্ধতা থেকে সাবলীল। খুঁজছো কি তুমি
পুরানো কংকাল হরিণের, রাখালের স্বপ্নময়
ছায়া-বিলাসের সাধ? দৃশ্যের ভিতরে পেতে চাও
সেই বাউলকে, যার পদচ্ছাপে পাঠ করা যায়
সহজিয়া ভাবাক্ষর সহজেই? নাকি তুমি আজ
সে পাখির খোঁজে কায়ক্লেশ করছো স্বীকার আর
সেরে নিচ্ছো রুখা সুখা আহার পথের ধারে, যার
চোখে সুদূরতা মায়া আনে, পাখা যার রৌদ্রলোকে,
মেঘের নানান স্তরে উল্লাসের মতো ঝলসিত।
অথচ সে পড়ে আছে মৃত্তিকায়, হতশ্রী, উদাস;
মাটির দিকেই বুঝি ছিল তার বড় বেশি টান।
মানুষ অধিককাল
মানুষ অধিককাল বরাদ্দ জায়গায়
থাকতে পারে না বসে নিত্য এক ঠায়
পিতলের মূর্তির মতোন।
পরিণামে গড়ানে পাথর হয়, জমে না সঞ্চয়
শ্যাওলার; মাঠ নদী বন উপবন
পেরিয়ে সর্বদা তার শুধু মনে হয়
কোথাও যায়নি যেন, কুচকাওয়াজের ভঙ্গিমায়
রয়ে গেছে একই বৃত্তে; দুঃখ তাকে নিজের দিকেই নিয়ে যায়।
কখনো দূরত্ব ডাকে বন্ধুর ভঙ্গিতে;
ব্যাকুলতা বয়
শিরায় শিরায়, গৃহত্যাগ অবিরাম
ফিস্ ফিস্ করে কানে, নিজেরই আলয়
মরুর দোসর হয়ে ওঠে, ফণিমনসার নাম
জপে আসবাবপত্র। কোন্ মরুদ্যান
দেয় হাতছানি, জাগে দূরে বিরল পাখির গান।
অস্থিরতা ব্যেপে এলে অসময়ে থাকে না কিছুই
করবার, স্বপ্নে ভাসে বিদেশ বিভুই
বারবার শিকড়ের টানে
চোখ ছলছল করলেও, মায়ের দুধের স্মৃতি সারাক্ষণ
অন্তর্গত জাতিস্মর শিশুর সত্তার বিয়াবানে
জাগলেও, দেহমন খিদে তেষ্টা ভুলে নির্বাসন
চর্চা করে ঘুমে জাগরণে। স্তব্ধতার
বাহুতে হেলান দিয়ে কেউ কেউ করে পান কালের আঁধার।
আমিও কেবলি জায়গা বদল করতে থাকি, বড়
কষ্ট পাই, দুঃখ জড়ো
হয় ক্রমাগত; একি মানুষের মুদ্রাদোষ, এই ঘরবাড়ি
বদলের গ্লেসিয়ার-স্পৃহা, নাকি
কবিরই স্বভাব এই? অনেক মিলন আর শত ছাড়াছাড়ি
কষ্টের আড়ালে রেখে ডাকি
ভুল করে মনোনীত কাউকএ; অস্থায়ী অন্তরায়
বেজে উঠে পায়ের ওপর দিয়ে নদী বয়ে যায়।
এখন একথা সোজাসুজি
বলে দেয়া ভালো, নিত্য এই খোঁজাখুজি,
ঘোরাঘুরি কখনো সরল পথে কখনো বিপথে, বাঁকা চোরা,
হয়েছে অনেক; একে ঠিক পর্যটন
বলবে কি কায়ক্লেশে কাতর পথিক? এই অন্তহীন ঘোরা
প্রকৃত ভ্রমণ নয়; ভ্রমণের মতো কিছু ভঙ্গী আমরণ
থেকে যাবে স্মৃতিতে আমার। ভাবি, নিয়ত দুঃখের দীর্ঘ খাল
সেচে যদি থিতু হয়ে বসে থাকা যেত কিছুকাল।
মিছিল থেকে খাঁচায়
তোমাকে দেখিনি আমি কোনোদিন উদ্দাম মিছিলে,
রাজপথে তোমার দু’চোখে কৃষ্ণচূড়ার মতোন
ঝকল দেখিনি,
দেখিনি তোমার উত্তোলিত হাত রৌদ্রস্নাত হাতের বাগানে,
শুনিনি দুপুর-চেরা শ্লোগান তোমার,
অথচ একদা ছিলে মিছিলের পুরোভাগে বহুদিন, হাতে
ছিল জ্বলজ্বল ভবিষ্যতের মতো স্পন্দিত পোস্টার।
সেই তুমি যখন বিকেলে ঘাসে বসে
নিঃশব্দে চা খেতে বান্ধবীর ভিড়ে বিনম্র ছায়ায়
অথবা হাসতে মৃদু সুভাষের কবিতার বইয়ের মলাটে
তোমার কুমারী হাত বুলাতে বুলাতে
কিংবা হেঁটে যেতে (স্বপ্ন-ঝলসিত শাড়ি, শরীর শ্যামের বাঁশি)
রমনার উদাস মাঠ ঘেঁষে,
কারো কথা ভেবে ভেবে (হঠাৎ পাখির গানে থমকে দাঁড়াতে)
তখন কেউ কি, আলো? তোমার দু’চোখ
আগুনের নগ্ন গান? তোমার দু’হাত
যৌবনের সাহসের উজ্জ্বল পতাকা?
তোমার স্লোগানে পথ হয়েছে সুকান্ত কতদিন,
আসমান রাজেন্দ্রানী, পথস্থিত গাছ ব্যালেরিনা,
পথচারীদের প্রাণ বিদ্রোহীন বীণা। ভাবি আজ
চেয়ারে হেলান দিয়ে-ফ্যানের হাওয়ায় ওড়ে শাদা-কালো চুল,
এদিকে নিভৃতে জুড়োয় চা, ওল্টাই বিদেশী পত্রিকার চারু
চকচকে পাতা, ভাবি তুমি ছিলে একদা মিছিলে।
আত্মরতিপরায়ণ গাঢ় গোধূলিতে
বীয়ারের ফেনার মতোন কলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত মধ্যবিত্ত কবি
মজি মেকি বুর্জোয়া বিলাসে, মাঝে-মাঝে কান পেতে
শুনি আতরাফী পদধ্বনি চতুর্দিকে। ভীষণ গাড্ডায় আমি
পড়ে গেছি ভেবে সান্ধ্য আড্ডায় নিয়ত পরিত্রাণ খুঁজি আর
বিপুল সাফল্য দেখি সেই সান্ত্রীদের যারা
মহাসমারোহে রোখে সূদ্রের বেয়াড়া অভিযান! কখনো বা
অ্যাকুরিয়ামের
রঙিন মাছের মতো আবদ্ধ পানিতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে
গাই গান, সর্বহারদের গান মাঝে-মধ্যে ভাবি
একদা তুমিও ছিলে মিছিলের পুরোভাগে এ ক্রুদ্ধ শহরে!
এখন তো রমনায় বিলুপ্ত কৃষ্ণচূড়া, তুমিও মিছিলে নেই আর;
পুষ্পিত খাঁচায় আছো, সুবাসিত তেলের মতোন
সম্প্রতি জীবনযাত্রা। কখনো সখনো
আকাশে মেঘের বঙ্গো, অকস্মাৎ কী এক জোয়ার
খাঁচাকে দুলিয়ে দেয় উথাল পাথাল, মহাকাল শিঙা ফোঁকে
নিরন্তর, খাঁচা-উপচানো হাত সম্মুখে বাড়ানো,
চোখে কাঁপে সদ্য কৃষ্ণচূড়ার ঝলক, মাংসে ফোটে
অসংখ্য নক্ষত্র আর কণ্ঠময় কী যেন ঝংকৃত হতে চায়
বারংবার প্রহরে পহরে,
পুরোনো গানের মতো হাহাকার খাঁচার ভেতরে।
তোমার চুলের গুচ্ছ থেকে ভেসে আসে সুদূরের শস্য
ভানার সঙ্গীত,
তোমার দু’চোখ থেকে ঝরে নিরন্তর
সুদূরের ঝরণাধারা,
তোমার আঙুল থেকে চকিতে বেরিয়ে আসে এক ঝাঁক
মরমিয়া টিয়া,
তোমার গ্রীবায় চরে নিরিবিলি বুটিদার একাকী হরিণ
মুখোশ
এখন আমাকে রাশি রাশি ফুল, ফুলের বাহারী তোড়া দিচ্ছো,
দাও, করবো না
বারণ। কারণ চলৎশক্তিহীন। প্রজাপতি
কিংবা একরত্তি মাছি এসে যদি বসে নাকের ডগায়, সত্যি
পারবো না তাড়াতে ওদের হাত নেড়ে।
লোবান অথবা
আগরবাতির ঘ্রাণ আমাকে করে না আমোদিত। পড়ে আছি
চিত হয়ে দৃষ্টিহীন দৃষ্টি নিয়ে। হু হু কান্না অথবা গোলাপজল
উভয়ের প্রতি উদাসীন। আমাকে করাবে স্নান
যে লোকটা চুলকাচ্ছে সে নধর পাছা তার। যে তম্বীর স্তন
হয়নি নমিত শোকে, তার
যৌবন আমাকে জপায় না আর জীবনের
আগড়ম বাগড়ম শ্লোক।
এখন আমাকে দিচ্ছো ফুল, দাও; দাও ঢেকে
আপাদমস্তক, উঠবে না নিষেধের
তর্জনী আমার। ট্রাকে চেপে কিছুক্ষণ
পরেই বেড়াতে যাবো বনানীতে। ফুরফুরে হাওয়া
লাগবে নিঃসাড় হাড়ে।
আমি ভাঙা বাবুই পাখির বাসা এক,
বড় একা পড়ে আছি স্বপ্নহীন দীর্ঘ বারান্দায়।
তোমরা কি আজ আমাকে পরাতে চাও নওশার সাজ?
পরাও, বারণ আমি করবো না এখন। যা খুশি
তোমরা করতে পারো, তবে সুর্মা কিংবা অন্য কোনো
মৃত্যুগন্ধী প্রসাধনে খুব বেশি বদলে দিও না
আমার নিজস্ব মুখ, যেমন চেহারা ঠিক তেমনটি থাক-
যেন ভিন্ন কারো মুখ আমার নিজের
মুখচ্ছদ ফুঁড়ে
বেরিয়ে না পড়ে, দ্যাখো এখন মুখোশহীন আমি;
পুরোনো মুখোশ, যার চাপে
আমৃত্যু ছিলাম আমি অস্বস্তির ক্লিষ্ট ক্রীড়নক,
খসে গ্যাছে এক লহমায়। দোহাই তোমরা আর
দিওনা আমার মুখে সেঁটে
অন্য কোনো দুর্বহ মুখোশ।
মৃত্যুর পরেও
মৃত্যু মৎস্যশিকারির মতো একদিন অতর্কিতে
ক্ষিপ্র গেঁথে নিয়ে যাবে আমাকে নিশ্চয়। এ নশ্বর
শরীর বেবাক স্মৃতি অনুস্মৃতিসহ হবে নিশ্চিহ্ন ধূলিতে,
থাকবে পিছনে পড়ে জীবন-ঊর্মিল প্রিয় ঘর।
রাত জেগে যে-কবিতা লিখেছি দু’চোখ রক্তজবা
করে তার ধ্বনিপুঞ্জ, প্রিয়তমা, তোমার সৌরভ
কিছুই হবে না অনুগামী। এই বিলুপ্তি অথবা
বিস্মরণ তিলমাত্র বাড়াবে না মৃত্যুর গৌরব।
যে-তুমি আমাকে ফেলে নৈরাশ্যের কংকালবাসরে
চলে গেছে চোখের আড়ালে, শোনো, সকল সময়
উৎসবে কি দুর্বিপাকে কামনার উন্মতাল ঝড়ে
তোমার আসার পথে আমার উন্মুখ চক্ষুদ্বয়
জ্বেলে রাখি। তোমার নিভৃত প্রতীক্ষায় কী অধীর
মৃত্যুর পরেও আমি রাখবো দু’চোখ খুলে স্থির।
মৌল বিষণ্নতা
কারণ ছাড়াই তুমি স্মরণীয় আমার নিকট।
এ আমার লেখার টেবিল, অনবদ্য ফাউন্টেন
পেন, জন্মদিনে পাওয়া, গদ্যপদ্য চৈত্রে কি শ্রাবণে
তোমাকেই মাঝে মাঝে রাখে মনে হৃদ্যতাবশত।
মাঝে-মাঝে; কেননা বস্তুত কেউ স্মৃতির আঘাত
পারে না সইতে জানি সকল সময়। পাখি দূর
নীলিমার দিকে খুব সতৃষ্ণ তাকালে কিম্বা কোনো
বাদ্যযন্ত্র বেজে বেজে থেমে গেলে স্মৃতি জন্ম নেয়।
এখানে গাছের নিচে বসেছিলে, পাতাগুলি খসে
পড়েছিল তোমার পায়ের কাছে, খোঁপায় আটকে
ছিল একটি কি দু’টি। অন্ধকার করেছিল গ্রাস
যুগল ভাস্কর্য, স্মরণীতায় লীন আজ
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, গোধূলির আঙটির ঝলক,
ফৈয়াজের দীর্ঘতান, দু’জনের ফুল্ল আলিঙ্গন।
আমার উপোসী ওষ্ঠে বুনো জ্যোৎস্না চুমোয় চুমোয়
বিষাদ ছড়িয়ে দেয়। একটি বেড়াল, অতিশয়
রাগী হিংস্র জিভে চেটে চেটে মুছে ফেলে খুব দ্রুত
আমার সকল পথ; প্রত্যেকটি সেতু, যা আমার
স্বপ্নজাত, আইসক্রিমের মতো গলে যায়, আমি
হৃতজ্যোতি চোখ হয়ে ঝুলে থাকি একা,অসহায়।
ঘরের চৌকাঠ আর শূন্য উঠোনের মাঝখানে,
সতত জাগর দৃষ্টি আর অন্ধকার মাঝখানি,
হাতের উন্মখ তালু, আর রেকাবির মাঝখানে,
স্তনের সোনালি বোঁটা আর তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠের মাঝে,
কাকতাড়ুয়ার আর হিরন্ময় ফসলের মাঝে
যে প্রকৃত ব্যবধান থাকে তার হাহাকার হয়
প্রতিধ্বনিময় সর্বক্ষণ আমার জীবনে; থাকি,
বেঁচে থাকি শিকারি-তাড়িত হরিণের ক্লেশ নিয়ে।
জ্ঞানত কখনো আমি করি না আক্ষেপ ঝরাপাতা,
গলন্ত মোমের কথা ভেবে, তবু আমার একান্ত
অভিমানী কবিতার খাতা কত অশ্রুপাত করে-
স্মৃতিতে রেঁনেসা থাকে, থাকে কিছু মৌল বিষণ্নতা।
যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে
যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে রাত্রিদিন আমার নিঝুম
বুকের কন্দরে একাকিনী,
তাকে চিনি বলে মনে হয়। অনিন্দ্য কুসুম ঝরে
তার চুলে মধ্যরাতে, সকল সময়
হাটুতে থুতনি রেখে বসে থাকে চুপচাপ, হাতে
গালের মসৃণ ত্বকে তার সুস্পষ্ট কান্নার ছাপ।
সে অন্ধ সুন্দরী
ব্যথিত বন্দিনী আজ। তার পায়ে কোনো
প্রাচীন নূপুর নয়, লোহার শেকল বাজে প্রহরে প্রহরে
প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে। কোনোদিন কোনো
দৃশ্য তার চোখে পড়বে না, এ সহজ সত্যটুকু
সে নিয়েছে মেনে। কারা তা খুব কাছে
পাকায় জটিল ঘোঁট, ফাঁদ পাতে আর
অকস্মাৎ খাপ থেকে খোলে তরবারি
নিঃশব্দে, এবং করে তাক
গোপন বন্দুক, সে দেখতে পাবে না কখনো কিছু।
অবশ্য হঠাৎ সে চমকে ওঠে কোনো কোনো শব্দ শুনে,
হাতড়ে বেড়ায়
নিজেরই বিষণ্ন ছায়া। কোথাও ইঁদুর আর ছুঁচো
পুরনো মাটির স্বাদে করে ছোটাছুটি,
হয়তো-বা বাদুড় ঝুলে থাকে ঘুণেখাওয়া কড়িকাঠে;
সে চমকে ওঠে
নিজের পায়ের শেকলের
ঈষৎ ঝংকারে বারে বারে।
কখনো কখনো এক বিদঘুটে প্রবীণ জল্লাদ
দর্পণ দেখাতে নিয়ে আসে সেই অন্ধ সুন্দরীকে।
দর্পণের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে
রূপসী বন্দিনী
শাদা মার্বেলের মতো চোখে মেলে ধূধূ চেয়ে থাকে
অপ্রস্তুত এবং বিব্রত। বিদঘুটে
প্রবীণ জল্লাদ হো হো হেসে ওঠে, যেন
প্রচণ্ড তামাশা দেখে ফেলেছে সে বন্ধ কুঠরিতে
অবেলায়। কখনো শানায় অস্ত্র, কখনো বা নিছক হেলায়
গলা টিপে হত্যা
করার খেলায় মানে অভিনয়ে মাতে
যাত্রার খুনীর মতো। তারপর বিকট হাসিতে
কাঁপিয়ে সকল দিক হেলে দুলে করে সে প্রস্থান।
যখন রাস্তায় আমি কোনো খাপছাড়া
তেজী তরুণকে দেখি হঠাৎ তখন
গাঁয়ে-কাঁটা দেওয়া অন্ধকারে
যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে আমার নিঝুম
বুকের কন্দরে তার পায়ের জটিল শেকলের
ঝংকার আমার মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়।
রেখেছো শব্দের রৌদ্রছায়া জালে
কথা ছিল হেঁটে যাবো আমরা দু’জন নদীবাঁকে
হয়তো পড়বে চোখে ঝলমলে বক, কখনো বা
হঠাৎ চমকে দেবে ফুটপাতে কোকিলের সুর।
দুপুরে কোথাও থেমে খেয়ে নেবো রুখা-সুখা, শোভা
দেখবো শহর ঘুরে, কথা ছিল; কথা ছিল নাকি?
তবে কেন অকস্মাৎ নিজেকে সরিয়ে নিতে চাও
আমার নিকট থেকে? আজ কোন্ অভিমানী পাখি
তোমাকে শোনালো গান বিদায়ের, দাও বলে দাও।
পাখি তার পাখিনীকে বলে আর্তস্বরে যাক আজ
পাখার চাঞ্চল্য থেমে, আকাশে দুর্যোগ ভয়ানক।
শাখা শূন্য করে গেলে নিমেষে চৌদিকে রুদ্র বাজ
ছড়াবে আগুন আর আমাকে ছিড়বে বৃষ্টি-নখ!
আমি সে পাখির ব্যাকুলতা জানি, জানি তার ভয়।
তুমি আছো ভেবে দীপ্র কিছুকাল ছিলাম পথিক
ক্লান্তিহীন দশদিকে এবং রাত্তিরে লোকালয়
থেকে দূরে চলে গিয়ে ছায়াচ্ছন্ন কোন্ সে গথিক
দালানের কাছে পৌঁছে চেয়েছি তৃষ্ণার জলধারা
তোমারই নির্জন ঘাটে। সেখানে আমরা কেউ কারো
মুখ আ দেখেই পরস্পর খুঁজি অবয়ব তারা
আর চাঁদহীন আকাশের নিচে। যদি যেতে পারে।
আমাকে আঁধারে ফেলে, চলে যেও। স্মৃতি পান করে
আমার সকালসন্ধ্যা কাটবে নিঃসঙ্গ; বারে বারে
ফিরে যাবো তুমিহীন তুমিময়তায়, একা ঘরে
তোমার প্রতিমা খুঁজে পাবো খড়মাটি অন্ধকারে।
রেখেছো শব্দের রৌদ্রছায়া জালে বন্দি করে তুমি
হে মধুর স্বরময়ী। তোমার অস্পষ্ট পদধ্বনি
বাজে সবখানে, স্নিগ্ধ প্রতিধ্বনিময় মনোভূমি
এখনই মিলনক্ষণ, পুনরায় বিচ্ছেদ এখনই।
শহীদ মিনারে কবিতাপাঠ
আমরা ক’জন
শহীদ মিনারের পাদপাঠে এসে দাঁড়ালাম
ফেব্রুয়ারীর শীতবিকেলে। একে একে
আস্তে সুস্থে সেখানে আসতে শুরু করলো অনেকে,
যেমন তীর্থ ভূমিতে অবিরাম
জড়ো হন ভক্তগণ।
সেখানে রোদের ঝলক ছিল না, আকাশ
তখন রাশভারি দার্শনিকের মুখের মতো,
আশেপাশে উজ্জ্বলতার কোনো আভাস
চোখে পড়েনি, তবু অবিরত
কিছু জ্যোতির্বলয়, মনেন হলো, খেলা
করছিল। আমরা ক’জন সেই বিকেলবেলা
চুপচাপ আরো ঘনিষ্ঠ হলাম পরস্পর।
একটু পরে আমাদের কণ্ঠস্বর
হলো মঞ্জরিত। আমাদের উচ্চারণের স্তবক
নিলো ঠাঁই শহীদ মিনারে সমর্পিত ফুলের পাশে।
সে সব শব্দগুচ্ছ ছিল না নিছক
শব্দ শব্দ খেলা, ছিল তারও বেশি, বিশ্বাসে
সঞ্জীবিত, নিশ্বাসে নিশ্বাসে অলৌকিক
ছন্দোময়। হঠাৎ পড়লো মনে সদ্য-প্রয়াত কবিবন্ধুর মুখ;
তার কথা ভেবে আমার চোখ করে চিক চিক
পানিতে যেন মরীচিকা। উন্মুখ
চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ, সরে বসে তড়িঘড়ি
আমার পাশে জায়গা করি,
যদি সে আবার আসে। তার বদলে দেবদূতের গান
ভেসে আসে দশদিক থেকে, থর থর
কাঁপি পাতার মতো; মহ্যমান
শহুরে গাছপালা, পথ, সিঁড়ি, প্রধান চত্বর।
আমাদের কবিতাপাঠের সময়
মনে হয়
তাঁরা এলেন শহীদ মিনারে, নিঃশব্দে কিছুক্ষণ
আসা-যাওয়া করে চত্বরে ক’জন
শহীদ দাঁড়ান পাদপাঠে। নিমেষে শস্যক্ষেত্র হয়ে যায়
শহীদ মিনার, তাঁরা কাহাতশাসিত দেশের শস্যের মতো
দুলতে থাকেন ক্রমাগত।
তারপর তাঁরা সব কিছু ছাপিয়ে ওঠেন, এমন দীর্ঘকায়।
শামসুর রাহমানের শার্ট অনুসন্ধান
আমি অনেকদিন থেকে এমন একটা শার্ট খুঁজছি,
যা আমাকে মানাবে।
নানা জামা-কাপড়ের দোকানে, শহরের
প্রতিটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে
ঢুঁ মেরে দেখেছি শাদা, কালো, হালকা নীল, গৈরিক,
সবুজ, বাদামি, মেরুন-রঙ বেরঙের শার্ট পরখ করে দেখেছি,
কিন্তু হা নসিব,
আমার মনের মতো শার্ট কোথাও নেই।
কোনো শার্টের রঙ হয়তো পছন্দ হয়, কিন্তু কলার
পছন্দ হয় না। কোনোটার কলার দারুণ লাগে,
অথচ হাতার খুঁত অত্যন্ত বেশি
নজরে পড়ে; আবার কোনো শার্টের
সকল কিছুই পছন্দমাফিক হলো,
কিন্তু সেটা গায়ে চাপাতে গিয়ে দেখি
বুকের কাছটায় এমন চেপে বসেছে যে,
দম বন্ধ হয়ে আসে।
তৈরি শার্টের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে
খুব দেখেশুনে কাপড় কিনে
নামজাদা দর্জির দোকানে গিয়েও
তেমন ফায়দা হলো না শেষ অব্দি।
শহরের অসামান্য দর্জি নেহাৎ মামুলি
একটা শার্ট বানালো আমার জন্যে।
ঝকঝকে প্যাকেট হাতে
ম্লান মুখে ফিরে আসি বাসায়।
ব্যয়বহুল শার্ট বাক্সবন্দি হয়ে
পড়ে রইলো।
আসলে আমি একটা অসাধারণ শার্ট খুঁজছি
অনেকদিন ধরে, তন্ন তন্ন করে।
এমন শার্ট আমি চাই যা লোকে
অন্য কারুর গায়ে দেখবে না কক্ষনো।
এতদিনে আমার এ বিশ্বাস
জন্মে গেছে যে, কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর
অথবা দর্জির দোকান
আমার মুশকিল আসান করতে পারবে না।
ফলত
আমি নিজেই আমার শার্ট বানানোর
সিদ্ধান্ত নিলাম এক শুভলগ্নে। দিনরাত
মাথা খাটিয়ে নকশা এঁকে
অনেক কাটছাঁট করা গেল।
আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির নিচে
ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো বাহারী শার্টের আদল।
নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেবার
একটা ইচ্ছা লক লক করে উঠলো
আমার ভেতর হাঁপানো কুকুরের জিভের মতো।
কিন্তু বড় বেশি খাপছাড়া আর বেমানান
হয়ে গেল না কি জামাটা?
না, ইহকালে
মনের মতো শার্ট আর পরা হবে না আমার।
শেষ অঙ্ক
এত সম্ভার কোথায় উধাও হলো?
কোথায় সে দিন অনুপম জ্বলজ্বলে?
যৌবন যায় ক্রমশ আস্তাচলে,
অনুশোচনার কৃষ্ণপক্ষ ভোলো।
তুমি কি শুধুই ঘুরবে ছদ্মবেশে?
প্রেতের সঙ্গে তোমার আলাপচারী
মনে হয় যেন কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি।
হয়ো না বন্ধু উন্মাদ অবশেষে।
তুমি আছো আজো স্বগত বিলাসে মজে
অথচ তোমার দয়িতা আত্মদানে
নগরে জটিল ছায়া-সংকট আনে।
তোমার দ্বন্দ্ব এখন কেই বা বোঝে?
মধ্যবয়সে অমাবস্যার ঘোরে
সত্তায় নিয়ে স্বপ্নের কিছু দাগ,
পিছুটান আর সমাহিত অনুরাগ
থাকতে কি চাও গৃহকোণে একা পড়ে?
চোখের চমক হয়নি অস্তমিত,
এখনো শিরায় জাগে হরিণের লাফ,
হৃদয়ে জাগর চিতার পদচ্ছাপ;
নিজের ছায়ায় ঝলকে হয়ো না ভীত।
ফিস ফিসে এই মঞ্চে তোমাকে দেখে
উদ্বেগে কাঁপে অনেক হৃদয় আজ।
তোমার শরীরে কেমন করুণ সাজ,
নেপথ্যে কত আততায়ী যায় হেঁকে।
অষ্ট প্রহর পাশে প্রিয় সহচর,
তার ওপরেই দিলে তুমি গুরুভার
ট্রাজিক কাহিনী বারে বারে বলবার;
অবচেতনায় ওঠে বৈশাখী ঝড়।
চেয়েছিলে তুমি দেশ হোক ভাস্বর,
আমজাম আর কাঁঠালের এই দেশে
মেধা ও মননে হৃদয়ের ধারা মেশে।
সবখানে বাজে তোমার কণ্ঠস্বর।
সব্যসাচী
কথা ছিল সে-ও যাবে একদিন দূর নীলিমায়,
অলকানন্দা নদীর বাঁকে,
কিন্তু পলকে ঘুণপোকা দিলো বিনাশের তাল,
রইলো সে পড়ে বিফল পাঁকে।
বুকের ভেতর তার ছিল এক অচিন বাগান,
অথচ ফোটেনি একটি ফুলও।
তার সত্তায় ছিল যুবরাজ উন্নত শির,
সে-যুবা হয়েছে অকালে নূলো।
তার কণ্ঠের প্রতি তন্ত্রীতে হতো ঝংকৃত
অর্ফিয়ুসের বীণার তার;
বোতলের ছিপি খুলে প্রত্যহ দিতো সে গড়িয়ে
ঝাঁঝালো, জাগর অন্ধকার।
ভেসে গেছে তার সত্তার ভিটা অকূল প্লাবনে,
ডুবেছে মুকুট, ডুবেছে মাথা।
তার কাছে কোনো উদ্যমী শাদা পায়রা আনেনি
ঠোঁটে বয়ে তাজা সবুজ পাতা।
সমুদ্রযাত্রা
সেই কোন্ যুগে আমি করেছি সমুদ্রযাত্রা। অথচ নিয়ত
সাগর সঙ্গমে কিংবা দ্বীপ-দ্বীপান্তরে
ঘুরেও এখনো আমি সামুদ্রিক জ্ঞান
আহরণে ব্যর্থ নিত্যদিন। কখনো ওড়াই পাল সারাবেলা,
রঙিন, অথচ শতচ্ছিন্ন, কখনো বা দাঁড় বাই,
জল সেঁচি কখনো-কখনো। মাঝে মাঝে
ঝড়ের থাপ্পড়ে কাঁপে ডিঙি, যেন ভয়ার্ত পায়রা
গোখরোর ফণার ছায়ায়। ছেঁড়ে দড়িদড়া আর
কোথায় যে যাই
ভেসে ডিঙিসুদ্ধ প্রতারক কুয়াশায়, মেলে না হদিস। শুধু
চেয়ে থাকি অসহায় বিপুল জলের দিকে, ব্যাপ্ত নীলিমায়।
অবেলায় ভীষণ ক্ষুধার্ত চোখে দেখি
কেমন বেগানা পাখি চক্রাকারে ঘোরে বারে বারে
মাথার উপর। হস্তধৃত দাঁড় দিয়ে
নিষ্ফল আঘাত ছুঁড়ি পাখির উদ্দেশে
বারংবার, নির্মোঘ চিৎকারে
নিঃসীম শূন্যতা ছিঁড়ে পাখি উড়ে যায়
নাগালের পরপারে।কখনো আবার
একটি দু’টি মাছ
লোভনীয় হয়ে ভেসে ওঠে
ডিঙির অনেক কাছে। আমি
আমার নিজের মধ্যে মৎস্যশিকারির
লীলা দেখে চমকিত। আমার জঠরে নরকাগ্নি আর
নিস্তব্ধ আকাশে
অন্ধ সুন্দরীর মতো চাঁদ
আসে, জ্যোৎস্না কুহক ছড়ায় চারপাশে। ভেসে চলি
ক্রমাগত দিকচিহ্নহীন;
অসফল জেলের মতোন পড়ে থাকি বড় একা
ডিঙির জঠরে, মতিচ্ছন্ন ধূ-ধূ ঘুমে
চোখ বুজে আসে।
বস্তুত উপরিতলে থেকে যাই সকল সময়, সমুদ্রের
গভীরে হয় না যাওয়া, মানে
রত্নান্বেষী ডুবুরীর মতো
এখনো নামিনী নিচে; আজ অব্দি পাইনি সন্ধান
অনিন্দ্য জলজ উদ্যানের। ডিঙি ডোবে তো ডুবুক,
ওপরের দৃশ্যাবলী থেকে
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বরং গভীরে যাও বলে
কে যেন অতলে দেয় ডুব। আমি মজ্জাগত ছায়াবিলাসের
গোপনীয়তায় চেয়ে থাকি। জল-স্থল,
এমনকি অন্তস্তল ঢেকে গেছে অপরূপ মৃগতৃষ্ণিকায়।