নির্বাসনের বিরুদ্ধে
কে আমাকে স্বর্ণচাঁপা এবং গোলাপ থেকে দূরে নির্বাসনে
এখনই পাঠাতে চায়? কার হাত আমাকে সরাতে
তৎপর দোয়েল, বুলবুল আর কোকিলের মহফিল থেকে?
না, আমি যাব না এ রকম নির্বাসনে। সৌন্দর্যের
স্তব রচনায় অনলস এই আমি
সুন্দরের মাঝে বসবাস করে যেতে চাই বিরতিবিহীন।
আমার চুম্বনে কত স্বর্ণচাঁপা, গোলাপ, চামেলি,
জুঁই, বেলী সুখে কেঁপে উঠেছে অজস্রবার আর
দোয়েল, পাপিয়া, বুলবুল, কোকিলের
সুরেলা আসর
আমার সান্নিধ্য চেয়ে হয়েছে ব্যাকুল বারবার। প্রতিদিন
আমিও রেখেছি পেতে কান প্রিয় পাখিদের গানের উদ্দেশে।
হে আমার মনোনীতা, আমি শুধু জানি
তুমি আছো ফুলের শোভায়, ঝর্ণাধ্বনি
এবং গায়ক পাখিদের কলতানে। যে-হাত আমাকে আজ
ফুল, পাখি, ঝর্ণা সরোবর থেকে দূরে
নির্বাসনে দিতে চায়, বস্তুত সে তোমার আমার
মধ্যে বিচ্ছেদের দীর্ঘ কালো রেখা টেনে দিতে প্রবল আগ্রহী।
তাহলে কী করি বলো এ যুগ-সঙ্কটে।
থাকি প্রতিবাদহীন, নিই মেনে এই নির্বাসন?
পাখি ও মানুষ
ব্যথিত পাখিটি তার কাছে এসে নিশ্চুপ দাঁড়ায়
সমর্পিত দৃষ্টি তার। কিছু শুশ্রূষার
প্রয়োজন ওর আছে ভেবে
লোকটা পাখিকে আরও ঘনিষ্ঠ বলয়ে ডেকে নেয়। হিংস্রতার
চিহ্ন বুকে বয়ে সেই আহত পাখিটি
উৎসুক লোকের ডাকে সাড়া দেয়, যদিও মানুষই
তাকে মরণের হিম স্পর্শ দিতে ব্যাকুল হয়েছে গোধূলিতে
পাখি ও মানুষ সখ্যে অন্তরঙ্গ হয়।
পারত যদি
পারত যদি সাজিয়ে দিত গোলাপ দিয়ে
তোমার ঘরের শূন্যতাকে।
তোমার সঙ্গে আস্তে সুস্থে বসত গিয়ে প্রবাল রঙের
চুপ সিঁড়িতে গোধূলিতে।
তোমার হাতের রাঙা পাতায় নিরিবিলি
আঁকত কিছু স্বপ্নরেখা।
পারত যদি তোমায় নিয়ে নীলাকাশে
কাটত সাঁতার মেঘের গাঙে।
দাঁড়িয়ে ছিলে স্পষ্ট রোদে
মেরুন শাড়ির লাজুক ভাঁজের শোভায় একা;
কিয়দ্দুরে তিনটি চড়ুই চঞ্চলতায় মেতেছিল।
ঘিরে রঙের উলে-বোনা কার্ডিগানে
রোদালো শীত বাধা পেয়ে তোমার গালে
চুমো আঁকে; দৃষ্টি তোমার কিসের খোঁজে শ্যামা পাখি?
পুরনো সেই বাড়ির কত ছায়া-ছায়া স্মৃতি এখন
মধ্যদিনে হৃদয় জুড়ে শঙ্খচিলের
মতোই কেঁদে বেড়ায় ধু ধু। কেমন একটা
বাঁশির ধ্বনি বিদায়বেলার দৃশ্য কিছু ডেকে আনে।
পারত যদি বাংলা ছাঁদের একটি বাড়ি
তৈরি করে লন বানাত,
তোমায় নিয়ে বসত দবিজ সবুজ ঘাসে,
খোঁপায় দিত গোলাপ গুঁজে।
হয়ত তোমার কানে কানে গুণগুণাত
নতুন যুগের পদ্য কিছু;
সেসব পদ্যে থাকত কী-যে জানত শুধু
বড়ই ব্যাকুল দু’টি হৃদয়।
পারত যদি মগ্ন কবি তোমার সকল
সাধ মেটাত কথায় কাজে।
তোমার জন্যে যিশুর মতোই
খুন-ঝরানো পায়ে হাঁটত এই শহরে,
পরত শিরে কাঁটার মুকুট সারা বেলা,
খুনী ডাকাত চোরের পাশে বিদ্ধ হতো কালো ক্রূশে।
পারত যদি ধ্যানী কবি অর্ধাহারে, অনাহারে
তোমার জন্যে অমর গাথা লিখত জানি।
বুকের রক্তে লেখা সেসব পঙ্ক্তিমালা
দেখে সুদূর দেবদূতেরা উঠত জ্বলে
সবুজচোখে ঈর্ষা নিয়ে, দস্যুবেশে
লুটে নিতে চাই কবির ভেতর-দৃষ্টি, মেধা মনন।
পুরস্কার
শূন্য থেকে কিছু কাব্যপঙ্ক্তি টেনে আনার সুবাদে
কয়েকটি ছোট পুরস্কার পেয়েছি আমিও
কখনও কখনও
স্বদেশে বিদেশে আর মালায় ভূষিত
হয়েছি প্রচুর আর জুটেছে গুণীর
সতর্ক প্রশংসাবাণী কিছু। ধন্য বোধ
করেছি নিজেকে খুব, অকুণ্ঠ স্বীকার করি। নিন্দার কাদাও
প্রচুর নিক্ষেপ করে কেউ কেউ সবেগে আমার বুকে পিঠে
সুখ্যাতির জ্যোৎস্নারাত এবং কুৎসার অমাবস্যা
করেছি যাপন যথারীতি।
এতকাল পর মনে হয়, যখন আমাকে দেখে
বুড়ো আর শিশুদের মুখে আনন্দের ঝরনা ঝরে,
তখন আমার কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে বড়
আর কোনও পুরস্কার নেই।
ফোটাও কালো হুল
নিজেকে ভোরবেলা কেমন ফাঁকা লাগে,
দুপুরে ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় করে ধু ধু,
বিকেলে ঝরা পাতা গুমরে ওঠে মনে,
অসিত রাতে বোবা আর্তনাদ শুধু।
তোমার বিরূপতা তীক্ষ্ণ শর হলে,
শক্র ঘেরা দিনে কীভাবে বলো বাঁচি?
আহত জন্তুর মতোই এক কোণে
আঁধার চোখে নিয়ে একলা পড়ে আছি।
ভাবিনি তুমি এত কঠোর হতে পারো,
তোমার কথা আজ এসিড অবিরত।
তোমার আচরণ তর্জমাতে হয়-
ইঁদুর মুখে নিয়ে বেড়াল ক্রীড়ারত।
আমাকে মোচড়ানো সহজ অতিশয়,
কেন না আমি দিগ্ভ্রান্ত পথচারী।
ভ্রষ্ট স্মৃতি নিয়ে চলাই হলো দায়,
অপরাধের বোঝা ক্রমশ খুব ভারী।
দুর্বিপাকে আজও তোমাকে শুধু চাই-
এটাই সারকথা, তা ছাড়া বাদবাকি
তুচ্ছ জানি আর আমার ব্যাকুলতা
ভেবো না প্রিয়তমা সিগারেটের ছাই!
যতই তুমি আজ ক্রোধের বশে এই
কবির অন্তরে ফোটাও কালো হুল,
সইব দংশন, আঁচড় মুখ বুজে,
বুঝবে একদিন তোমারই ছিল ভুল।
বন্ধু, ফিরে এসো
কোন্ সে কুহক এতো তাড়াতাড়ি জন্মন্ধ গুহায়
তোমাকে প্রবল টেনে নিয়ে গেল? তোমাকে এখন
ভোরের পাখির গান, আসমানে পায়রার ওড়া,
গোধূলির রঙ কিংবা সবুজ পাতার শিহরণ-
কিছুই টানে না আর আগেকার মতো। নির্বিকার
একা বসে থাকো ঘরে। খবরের কাগজ পড় না,
এমন কি কবিতার বইয়ের পাতায় বুলাও না
চোখ আজ ভুলেও ক্ষণেক। তাহলে কি বন্ধ ঘরে
এভাবেই দিনযাপনের পালা রাখবে তোমার?
অথচ একদা এই তুমিই আনন্দ-ভেলা বেয়ে
গ্যাছো কতো সামান্যের ঘাটে। অধরাকে ধরবার
আশায় রয়েছ জেগে দিনরাত। মনে পড়ে না কি
দ্বিপ্রহরে কোকিলের অকালের গান টেলিফোনে
শোনাতে আমাকে কোনও কোনও দিন উৎফুল্ল উৎসাহে?
বন্ধু, ফিরে এসো পারিপার্শ্বকের দৃশ্যের গন্ধে, রঙে