দুঃস্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে
হঠাৎ স্খলনে আমার নিজেরই দোষে
কুঁকড়ে রয়েছি সদা মানসিক চাপে।
বিব্রত খুব আমার আমিকে নিয়ে,
পুড়ছি এখন প্রখর মনস্তাপে।
ছিল দিনগুলি রঙধনুময় প্রেমে,
পথে যেতে-যেতে পা রেখেছি পাতা ফাঁদে;
চিদাকাশ হলো শূন্য ধূসর ভুমি,
হয়েছি বিদ্ধ ক্ষমাহীন অপরাধে।
প্রতারক এক সুরের ক্ষণিক মোহে
সর্বনাশের কুহক এনেছি ডেকে;
গৃধিনীর কালো পাখার ছায়ায় দেখি
আমার ভুবন নিমেষে গিয়েছে ঢেকে।
তার ভালোবাসা ছিল তো অতুলনীয়
তবু কেন হায় ভিন্ ছলনায় ভুলি?
অপরূপ প্রিয়্য বাগানের শোভা ছেড়ে
চোরাবালিতেই কেন যে কুড়াই ধূলি!
দুঃস্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে ভাবি-
তার বিশ্বাসে ধরিয়েছি আজ চিড়;
দিয়েছি বাড়িয়ে ক্ষতির সীমানা তার,
আমাদের ঘিরে থাকে পিশাচের ভিড়।
প্রেমের অতনু দেবতাকে বলি, শোনো,
শপথ তোমার, শুদ্ধ হতেই চাই।
পীড়িত, দগ্ধ আমার সত্তা থেকে
দিয়েছি ঝরিয়ে কুৎসিত সব ছাই।
দৌহিত্র প্রিয়-র জন্মদিনে
নতুন পথিক তুমি, সবে যাত্রা শুরু
দুর্গম জটিল পথে; গন্তব্য অজানা, তবু হেঁটে
যেতে হবে বহুদূর। দীর্ঘ এই পথে
নানা বাঁক আছে, ঝোপেঝাড়ে
আছে ওত পেতে হিংস্র জন্তু, হয়তো-বা
কোথাও কোথাও চোরাবালি
রয়েছে মোহন রূপে। কোথায় যে কুহকের জাল
থাকে পাতা, সহজে পায় না টের ক্লান্ত পথচারী।
এই যে আমাকে তুমি দেখছ এখন বসে আছি
একা ঘরে, ভগ্নস্বাস্থ্য, সমস্ত শরীরে নিয়ে বয়সের ক্রূর
আঁচড়, দু’চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি, শোনো প্রিয়।
একদা আমিও এই প্রফুল্ল তোমারই মতো উড়িয়েছি ঘুড়ি
আর কবুতর নীল আসমানে, কুড়িয়েছি ফুল
শিউলি তলায় কত সতেজ বিহানে। জেনেছিতো
আনন্দ বিহনে প্রাণে বিপুলের তরঙ্গ জাগে না,
অজানা সম্মুখে এগোবার প্রেরণার স্পন্দন নেই।
বুঝেছি আনন্দ আহরণের হাড়ভাঙা খাটুনি কি
সুবিপুল আয়োজন-কিছুরই হয় না প্রয়োজন। শুধু নিজ
অন্তর জাগিয়ে রেখে হাওয়ায় পাতার নড়া, পাখির উড়াল,
বৃষ্টিধারা কিংবা জ্যোৎস্না দেখা,
গাঙের পানির ধ্বনি আর রাঙামাটির পাহাড়ে
ডাগর চাঁদের নিচে গান শোনা অযাচিত অপরূপ উপহার, যার
স্পর্শে চিত্তশুদ্ধি হয় নিমেষে এবং
বাঁচবার তীব্র সাধ জাগে, যেন পুষ্পউন্মীলন।
বহু পথ হেঁটে বহু প্রান্তর পেরিয়ে
অনেক মরীচিকার স্মৃতি নিয়ে
জেনেছি জগতে শিল্প আর জ্ঞানময় প্রেম বিনা
নিরর্থক সব কিছু। শোনো,
ব্যাপক আন্ধারে হাতে নিয়ে একটি প্রদীপ আজও
পথ চলি, এই দীপশিখা তিমিরের প্রাণীকুল
এক ফুঁয়ে সর্বদা নিভিয়ে দিতে চায়। প্রিয়, তুমি
আমার এ দীপশিখা থেকে নেবে কি জ্বালিয়ে আরেকটি দীপ?
ধ্রুবপদ
বহুক্ষণ বসে আছি অন্ধকার ঘরে, ধারে কাছে কেউ নেই,
এরকম আন্ধারের কথা
জীবনানন্দের কবিতায়
অনেক পড়েছি আর সীমাহীন রহস্যময়তা
গূঢ় অনুভব করে নিজেরই ভেতর
হয়েছি অক্লান্ত পর্যটক। ত্র্যাশট্রেতে
পড়ে আছে চুরুটের বাসি ছাই। নাকি সুদূরের
নক্ষত্রের ছাই?
যখন এ-ঘরে ছিলাম না,
কেউ কি এখানে এসেছিল? নইলে কেন
এই বাসি ছাই, কেন আমার লেখার প্যাড এমন নির্লজ্জ
খোলা পড়ে আছে টেবিলের বুকে আর
একটি অচেনা পুঁথি আমাকে ইঙ্গতে কাছে ডাকে
বারবার? একটু পরেই একজন
দরজায় দাঁড়ালেন একতারা হাতে। আমাকে জিজ্ঞাসু দেখে
বলেন ঈষৎ হেসে তিনি, ‘আমি লালন ফকির। ও পড়শী
ধ্রুবপদ রচনায় কতদূর পারবে তুমি সিদ্ধির ভুবনে
হেঁটে যেতে, এসেছি পরখ করে নিতে।
নিঝুম কাফেতে
বহুদিন পর সেদিন হিমেল রাতে
ছিলাম দু’জন নিঝুম কাফেতে বসে।
কফির পেয়ালা ছিল সম্মুখে রাখা।,
মুহূর্তগুলো পড়ছিল মৃদু খসে।
কথোপকথনে আমরা উঠিনি মেতে,
হয়েছে কেবল দৃষ্টির বিনিময়।
তার হাত আর আমার হাতের মাঝে
ছিল কবোষ্ণ ঘনিষ্ঠ পরিচয়।
অনুরাগে তার দৃষ্টি যখন কাঁপে
হাওয়ায় মোমের নবীন আলোর মতো,
হৃদয়ে আমার জলতরঙ্গ বাজে,
করোটিতে ফোটে শত তারা অবিরত।
রাস্তার পিঠে হাওয়ার চাবুক পড়ে;
আমাদের মনে কত অনুক্ত কথা।
তার অন্তরে গুপ্ত কী আছে আজও,
আমি বই সব জানবার ব্যকুলতা।
বাধা সত্ত্বেও পেয়েছি মিলন-সুখ,
অমাবস্যায় জ্বলেছে তো পূর্ণিমা।
হিংসুটে সব মনের বিকার থেকে
রেখেছি মুক্ত স্বপ্ন-সাধের সীমা।
কিন্তু এখন ভূমিকম্পের পরে
মনে হানা দেয় বারবার কী যে ত্রাস!
প্রেমময় এই মধুর ক্ষণেও ভাবি-
ভয়াবহ কিছু করবে কি সব গ্রাস?
আমাদের মুখে যুগের করাল ছায়া,
স্মৃতিতে পুরাণ-প্রাণীদের হিংস্রতা।
শিকরি কুকুর নিত্য করেছে তাড়া,
বারবার থাবা মেলেছে বর্বরতা।
নিঝুম কাফেতে আছি তার মুখোমুখি,
তবুও নিজেকে লাগে অসহায়, একা।
ব্যাপক আঁধারে এইটুকু দীপশিখা-
যুগসঙ্কটে তার সাথে হলো দেখা।
নির্বাসনের পরে
এখন আমি অসুস্থ কুকুর যেন, নিস্তেজ, ঝিমোনা,
অথচ ঘুম নেই। মশা, মাছি, পিঁপড়ে, গুবরে পোকা
সারাক্ষণ বিরক্ত করছে, সহ্য করি ওদের উৎপীড়ন মুখ বুজে,
ওগুলোকে তাড়াবার ইচ্ছে পর্যন্ত হয় না,
এমনই নিরুদ্যম আমি। কখনও
তন্দ্রাচ্ছন্নতায় দেখি, এক ঝাঁক দাঁড়কাক আমার
শরীরকে ভীষণ ঠুকরে ঠুকরে
শতচ্ছিন্ন ন্যাকড়া বানাচ্ছে, ছোরাসদৃশ
চঞ্চু দিয়ে উপড়ে ফেলছে হৃৎপিণ্ড। খুব কাছে থেকে
এই দৃশ্যে মজা লুটছে
ক’জন জাঁহাবাজ মাস্তান আর জুতোর ডগায়
নাচাচ্ছে কয়েকটি করোটি, মুখে ক্রূর হাসি।
হায়, কী সেই সময়! কোকিলের গান ছাড়াই
গুণীর বাদ্যযন্ত্রের মতো ঝংকৃত হতো
মুহূর্তগুলো; কোথাও কোনও ফুল নেই, অথচ
আমার চুতুর্দিক সুরভিত সারাক্ষণ। না ডাকলেও কোত্থেকে
চলে আসত কয়েকটি রাজহাঁস। তখন
তোমার কথার পাপড়ি আর হাসির ঝর্ণাতলায়
নিত্য নিয়েছি বিশ্রাম। তোমাকে
একটু দাঁড়াতে কিংবা বসে থাকতে দেখলে মনে হতো
বসন্ত আমার সত্তায় ছড়িয়ে দিয়েছে সজীবতা হঠাৎ
হাভাতে জ্যোৎস্নাখেকো মেঘ গিলে ফেলে পূর্ণিমাকে।
তারপর থেকে এই নির্বাসিত আমি-র স্বস্তি নেই, শান্তি নেই;
কাটে নির্ঘুম রাত। অনুশোচনার ক্রুশকাঠে বিদ্ধ
আমি যন্ত্রণার অন্তহীন সেতু পেরোতে গিয়ে
হোঁচট খাই বারবার। চোখের পাতা বুজে আসে,
কিন্তু আমি কি ঘুমাতে পারি
তোমার অপ্রসন্নতার কণ্টকময় তিমিরে?
আবার অলৌকিক তরঙ্গ স্পর্শ করে আমাকে;
নির্বাসনের পরে তোমার উদার প্রসন্নতা তারার ঝর্ণা হয়ে
ঝরে আমার ওপর এবং
মনোজ আনন্দ নিকেতনে কবির বসবাস।