তবুও মনে প্রানে
আছেন এ শহরে অনেক সুন্দরী,
তবুও মনে প্রাণে চাই যে তোমাকেই।
বলি না তুমি নও দেখতে মনোরমা,
তোমার আছে জানি অতুলনীয় মন।
তোমার জন্যেই আমার কত রাত
কেটেছে নির্ঘুম; যখনই লিখি কিছু,
তোমারই মুখ ফোটে পাতার বুক জুড়ে,
দাঁড়াও এসে তুমি স্বপ্নময় মোড়ে।
কখনও তুমি হাস্যে ঝর্ণাধারা হয়ে,
কখনও কথা বলো ঝরিয়ে মাধুর্য,
তোমার স্বর হয় জ্যোৎস্না অনুপমঃ
কখনও অন্তরে ফোটাও শুধু হুল।
তোমাকে ভেবে ভেবে কাটাই দিনরাত,
অথচ ভাবো তুমি আমার অবহেলা
তোমাকে কোনও ঠাঁই দেয় না ভাবনায়!
আমার অন্তরে তুমিই আছ জেগে।
তোমার অতৃপ্তি তোমাকে বারবার
গোপনে কুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে আমাকেও;
আমার স্বপ্নেরা ভস্মে পড়ে চাপা।
তাতে কী
একদিন প্রিয় মুখ, গাছপালা, ফুল
রোদ, জ্যোৎস্না, বৃষ্টিধারা, বইপত্র হঠাৎ দু’চোখ
থেকে মুছে যাবে; শুনব না কারও কথা,
পদধ্বনি, কোকিলের কুহু তান, দোয়েলের শিস,
রবীন্দ্রসঙ্গীত। শুধু কারও কারও ঠোঁটে
কখনও হয়তো মৃদু নেচে উঠবে আমার নাম, জানব না।
লেখাপত্র ধূসরিমা নিয়ে
থাকবে ফাইলবন্দি দেরাজের নিবিড় আঁধারে,
বইগুলো ধুলোম্লান থাকবে এবং
কলম গোপনে অশ্রুপাত
করে করে গুমরে মরবে স্তব্ধতায়। কেউ কি কখনও ভুলে
তুলে নেবে সেই শীর্ণ নিভৃত কলম?
থাকব না এই ঘরে, টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে লিখব না আর,
আসবে না ঘন ঘন চায়ের পেয়ালা
অথবা সংবাদপত্র পোহাবে না রোদ বিছানায়।
তাব না, তাতে কী? ভোরের আবর্জনাময় পথে
একটি গোলাপ দিব্যি হাসিমুখে থাকবে এবং
ছেলেমেয়েদের দল ছুটে যাবে শিউলি কুড়াতে
এবং শ্রাবণ পূর্ণিমায়
যুবক শোনাবে যুবতীকে প্রেমকথা নিরিবিলি।
তোমার আসা, না-আসার উদ্দেশে
দূরগামী পাখিদের বুক থেকে ভরসন্ধ্যা নেমে পড়তেই
বুকশেলফ্ থেকে
প্লেটোর রিপাবলিক লরেল পাতার মালা নিয়ে,
রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা যূথির স্তবক নিয়ে
গালিবের দিওয়ান গোলাপ,
ইয়েটস্ লাইলাক, ড্যাফোডিল নিয়ে
এবং লালনগীতি চন্দনের ফোঁটা নিয়ে আর
নিঃসঙ্গ অধম আমি সারা পথে প্রতীক্ষার ফুল
বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্যেই আর
এই হৃদয়ের স্পন্দন ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে শুধু।
এই তো এসেছ তুমি। নইলে কেন আমার এ-ঘর
‘এসো, এসো’ সম্ভাষণে গুঞ্জরিত? কেন প্রজ্বলিত
দীপ? কেন বেজে ওঠে সারেঙ্গি, দোতারা, এস্রাজ, সরোদ?
গহন সৌন্দর্য নিয়ে বসলে অদূরে নিরিবিলি
মধ্যবিত্ত আসনে, তাকালে জানালার বাইরে খানিক, যেন
আকাশের নক্ষত্র এবং বৃক্ষশোভা
ঘরের ভেতর ডেকে আনবে এখনই। ইচ্ছে হলো
তোমার একান্ত কাছে গিয়ে বসি, হাতে হাত রাখি।
আমার চোখের পাখি তোমার চোখের নিরালায়
গভীর প্রবেশ করে বলে-
‘তোমাকেই ভালোবাসি খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে থেকে। অনন্তর
তোমার ওষ্ঠের প্রজাপতি নিবিড় আবৃত্তি করে,-
‘আমার হৃদয় আমি তোমাকেই করেছি অর্পণ
বুদ্ধের জন্মেরও আগে থেকে। ঊর্ণাজালে কম্পমান মহাকাল।
অকস্মাৎ দেখি তুমি নেই এখানে কোথাও, বড়
একা বসে আছি অন্ধকার ঘরে। হায়, তবে কেন
তোমার উপস্থিতির মরীচিকা ও সৌরভ মগ্ন চেতনায়
ভেসে উঠেছিল? তুমি প্রকৃত আসোনি, এই সত্য মেনে নিয়ে
প্লেটোর রিপাবলি, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা,
এবং লালনগীতি আমাকে প্রবোধ দিয়ে যে জায়গায়
চলে যায়। তবে কি অবোধ আমি তোমার নিভৃত আসা-গুলো
মনের খেয়ালে সৃষ্টি করে চলি কবিতার মতো?
ভাদ্রের ক্ষ্যাপাটে তাপে সারাদিন মাছভাজা হয়ে সন্ধ্যারাতে
ঘরে ফিরে চমকে তাকাই-কী আশ্চর্য, এক কোণে
প্রেমের কবিতা হয়ে মানবীরই বেশে। জ্বলজ্বলে
হাতটা বাড়িয়ে দিলে ঋদ্ধ ঐতিহাসিক ভঙ্গিতে,
অথচ নিশ্চিত নম্র সুরে বাঁধা আধুনিকা তুমি। গলিপথে
বেবিট্যাক্সি হাঁপানি রোগীর মতো ধুঁকতে ধুঁকতে
চলে যায়; আমরা দু’জন বসে থাকি পূর্ণিমার প্রত্যাশায়।
তোমার একটি স্বপ্ন
সেদিন তোমার দুপুরের একটি স্বপ্নের কথা
বললে আমাকে। ঘুমের বড়ি খেয়ে অনিদ্রার টকটকে চোখে
ধুলো দেওয়ার জন্যে তুমি গা ঢেলেছিলে বিছানায়। কয়েক
মিনিট না কাটতেই দেখতে পেলে
তোমার মাথার ভেতর গজিয়ে উঠেছে একটি গাছ
আর চারপাশে ঝোপঝাড় আর তোমার
করতলে একটা কদম ফুল ফুটে উঠল এবং
পর মুহূর্তেই কদম ফুল রূপান্তরিত ক্যামেলিয়ায়।
মেঘে ঢাকা আকাশ যেমন বিদ্যুচ্চমকে
খরায় ন্যাড়া মাটির মতো চৌচির হয়ে যায়,
তেমনি তোমার মগজ যেন হয়ে গেল
কোনও চিত্রকরের রাগী তুলির আঁচড়।
আবার দেখলে তুমি কখনও আরশোলা,
কখনও টিকটিকি রূপে ঘরের ধূসর দেয়ালে
হামাগুড়ি দিচ্ছি। তুমি ঘুমিয়েছিলে নাকি আধো ঘুমে
আধো জাগরণে তোমার সময় করাতের দাঁতে
ঘষটে যাচ্ছিল, কে বলবে? মনে হয়,
তোমার স্বপ্নটি মাকড়সার জালে আটকে পড়া পোকা।
আর হ্যাঁ, মনে পড়ল অনেক আগে তুমি বিজ্ঞানীর
কল্প-কাহিনী পড়েছিলেন, যিনি মাকড়সা বিষয়ে গবেষণা
করতে-করতে পেয়ে গেলেন সেই অষ্টপদী
কীটের অবয়ব, কিন্তু মাথাটা তার নিজেরই রয়ে গেল।
এরপর থেকে কোনও বড়সড় মাকড়সা দেখলেই তুমি
ভয়ার্ত চোখে ওর মুখে আবিষ্কার করতে মানুষের মুখ।
অথচ আমি নিশ্চিত জানি, তুমি কখনও
কাফকার কোনও গল্পই পড়নি।
তোরঙ্গ
আমাকে একটি রঙিন তোরঙ্গে পুরে তালা লাগিয়ে
দিলে তুমি। অপরিসর তোরঙ্গে কোনওমতে
হাত-পা মুড়ে পড়ে ছিলাম। শ্বাস রোধ হয়ে
আসছিল আমার। সে কী যন্ত্রণা, বোঝানো যাবে না।
কেন যে তুমি আমাকে এভাবে আটকে রেখেছিলে, সেই
গূঢ় কথা আর কেউ না জানুক, আমার অজানা নয়।
মাঝে-মাঝে তোরঙ্গ খুলে আমাকে দেখতে, নিবিড়তম
চুম্বনে মাতাল করে তুলে প্রিয়তম বন্দিটিকে। আমার
শ্বাসকষ্ট অস্তমিত হতো কিছুক্ষণের জন্যে। আবার
বন্ধ নয়ে যেত রঙিন তোরঙ্গের ডালা।
রুদ্ধ তোরঙ্গে আমার ডাক আসতো মাঠের থৈ থৈ
সবুজ, আকাশময় নক্ষত্র-চুমকি, বর্ষারাতের প্রথম
কদম ফুল, আমার লেখা না-হাওয়া কবিতা আর
সবচেয়ে বেশি, তুমি বিশ্বাস করো আর না-ই করো,
তোমার বুদ্ধি ঝলসিত, লাবণ্যময় মুখের। তোরঙ্গ থেকে
আমার আহ্বান তোমার হৃদয়ে ঢেউ জাগাত কিনা
জানি না। তোমার স্বপ্নের ভেতর তুমি যে কখনও কখহও
অনিন্দ্য পুলকে ঈষৎ কেঁপে উঠতে, সে-তো আমারই নিঃশ্বাসে।
ঘুমভাঙা রাতে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলেই
দেখতে পেতে আমার নিঃশ্বাসের দাগ।
একদিন অতর্কিতে হারিয়ে ফেললে তোরঙ্গের চাবি।
চাবি হারিয়ে তুমি প্রায় উন্মাদিনী হয়ে গেলে আমার
পরিণামের কথা ভেবে। আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার
আশঙ্কায় তোমারই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল খুব।
দিশেহারা তুমি হাতুড়ির কড়া আঘাতে চুরমার
করে ফেললে তালা আর আমি বেরিয়ে এলাম, যেন
মৃত্যুপুরী থেকে অর্ফিয়ুস। উচ্ছ্বসিত ঝরণার মতো তুমি
জানলে, তপোবনপ্রতিম উদ্যান, খোলা হাওয়া, আকাশের
নীলিমা, লাল পদ্মময় দিঘির ঘাট, আর নদীতীরে যখন
থাকি, থকনই আমি তোমার হৃদয়ের অন্তরঙ্গতম বাশিন্দা।