ক্ষমার মুদ্রায়
মনে হচ্ছে, কিয়দ্দূর থেকে তুমি ডাকছ আমাকে,
গান যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে সুরের নানা রঙে।
আমার শরীরে কাদা লেপ্টে আছে কিছুকাল থেকে,
কখনও লাগলে হাত গালে অথবা গলায়, কেঁপে
উঠি, আধভেজা ক্লেদ আমাকে পীড়িত করে খুব।
তোমার নির্ভৃত সত্তা থেকে উঠে-আসা সুরধারা
আমার গায়ের কাদা ধুয়ে দেয়। যারা অন্তরাল
থেকে জাল আঁধারে বিছিয়েছিল আমাকে ভাগাড়ে
ফেলে রাখবার হিংস্র বাসনায়, সবিস্ময়ে দেখে
ওরা, তুমি পবিত্র অনলে কী বিনম্র দগ্ধ করে জাল
এই ক্লিন্ন আমাকেই আশ্চর্য সুরভিময় শত
পরাগের স্পর্শে শুদ্ধতায় নিয়ে যাও। বজ্রপাতে
যে-তুমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলে অকালে সন্ধ্যায়,
সে-তুমি আবার এলে খুব কাছে ক্ষমার মুদ্রায়।
গন্তব্যের গান
কী জমাট অন্ধকার চারদিকে, যেন দাঁত আছে
এই আন্ধারের আজ দাঁতগুলো খুব
সহজেই বসে যেতে পারে আমার বাহুতে, বুকে, চোখে মুখে
অথবা পাঁজরে। মোদ্দা কথা,
এই ভয়ঙ্কর, হিংস্র অন্ধকার খুবলে খুবলে
খেতে পারে আমাকে এবং
এই ঘোর তিমিরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তা’ ছাড়া আমার
গত্যন্তর নেই।
অভীষ্ঠ গন্তব্যে যদি আমাকে পৌঁছতে হয় তা’ হলে এ-পথ
ছেড়ে অন্য পথ
ধরার জো নেই। জানি, পথের দু’ধার
থেকে যত পাথরই গড়িয়ে
পড়ুক, মেলুক ফণা অগণিত সাপ, ধূলিঝড়ে
দু’চোখ আচ্ছন্ন হোক বারবার, আমাকে এগোতে
হবে সুনিশ্চিত কাঁটাময়
বিভ্রম-ছড়ানো পথে, যদিও ঝরছে দু’পা থেকে
তাজা রক্ত; ওপরে তাকিয়ে দেখি চাঁদে
শুয়ে আছে একজন নারী ধ্রুব সৌন্দর্য ছড়িয়ে
একা, বুকে তার অপরূপ
বাসনা যুগল নীড় বেঁধে আছে, বইছে চুলের স্মিত ঝর্ণাধারা।
হঠাৎ হোঁচট খাই পুরনো পাথরে, বৃশ্চিকের
সুতীব্র দংশনে চোখে পানি এসে পড়ে। আমার ভেতরে আছে
যে অক্লান্ত একরোখা সাধকের নিঝুম স্পন্দন,
তার একতারা
উন্মতাল আমাকে বাজায় নানা সুরে আর জীবনের
মেঘ রৌদ্র পথপ্রান্তে পৌঁছে দিতে অনাবিল রসদ জোগায়।
গেলাম একটি বাগানে
সেদিন শীতবিকেলে আমরা দু’জন
গেলাম একটি বাগানে। তুমি
আমার হাতে হাত রাখোনি, তোমার ঠোঁটে ছিল না
মদির হাসির ঝলক। বাগানে
নানা রঙের ফুল ছিল, অথচ কুসুমপ্রিয় তুমি
আবেগ ভরে করোনি কোনও উচ্চারণ।
বিষণ্ন কোনও গ্রিক দেবীর মতো হেঁটে গেলে
বাগানের এক কোণে; সেখান থেকে
এক মুঠো ছাই কুড়িয়ে তুমি আমার দিকে
ভস্মময় মুঠো বাড়িয়ে দিলে। অনেকক্ষণ পর
অস্বস্তিকর নীরবতাকে ছিঁড়ে
ধ্বনিত হলো তোমার কণ্ঠস্বর, ‘একটি নিরুপম
পাখি তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম
এখানে এই বাগানে,
সেই অপরূপ সুন্দর পাখিটিকে পুড়িয়ে
খাক করেছ তুমি।
ময়লা ধুলোর মূর্তির মতো নত মাথায়
দাঁড়িয়ে ছিলাম নির্বাক, নিঃসাড়। হাওয়ার এক ঝটকায়
ঝুরঝুর ঝরে যেতে পারতাম, অথচ অন্তর্গত ঝড়ের
তাণ্ডব সত্ত্বেও রইলাম স্থির। মনে পড়ল,
পাখিটির সারা শরীরে কতই না আদর বুলিয়ে দিয়েছি,
কতবারই না চুম্বন করেছি ওকে
ঝড়ো আবেগে ঋতুতে ঋতুতে। পাখি ছিল
আমার সকল অভিনিবেশের আলোয় সদা স্নাত।
হঠাৎ এক নিশিগ্রস্ত প্রহরে মাথার ভেতর
ভীষণ তোলপাড়, নিষ্ঠার নীলপদ্ম বাজের
চঞ্চু-নখরে ছিন্ন; নিজ হাতে নিমেষে জীবন্ত পোড়াই পাখিকে,
ভস্মরাশি বাগানকে বানায়
শ্মশানভূমি। ভস্মীভূত পাখির দুঃসহ স্মৃতিসহ
আমাকে তুমি নিয়ে এলে এখানে।
যেন কিছুই হয়নি, এইমতো মনোভঙ্গিতে
তোমাকে আলিঙ্গনে বাঁধি, চুম্বন করি তোমার অনিচ্ছুক
ঠোঁটে; আমার মুখ
শিশিরভেজা ভস্মে ভরে যায়। পা দু’টো
কাদায় ডোবে, প্রেতের শীতল আঙুলগুলোর চাপে
আমার চোখের মণি দ্রুত গলতে থাকে এবং
তোমার মুখ প্রজাপতিপুঞ্জ হয়ে
ক্ষমার অগাধ জ্যোৎস্নায় ক্ষণে ক্ষণে স্পন্দমান। এই তো
আমার হাত আহত মাছের মতো
সাঁতার কেটে ভেসে উঠতে চাইছে তোমার স্নিগ্ধ তটে।
গোলাপ, তোমাকে
গোলাপ তুমি কি লুলিয়েছ মুখ ভবঘুরে কোনও
মেঘের আড়ালে? আমার দগ্ধ বক্ষে তোমার
অশ্রুকণারা যে কবে শুকিয়ে গিয়েছে, জানি না।
কত যে ভস্ম হাওয়ায় উড়েছে, তুমিও তো তার
হিসেব রাখোনি। শুধু মনে পড়ে, ফুটেছিলে তুমি
হৃদয়ে আমার খুব নির্জনে। অন্ধ পাখির
ক্রুদ্ধ নখর করেছে ছিন্ন তোমার পরাগ,
বেদনায় কালো হয়েছে হৃদয় হু হু সন্ধ্যায়।
গোলাপ তোমার বোবা কান্নায় ছিল মিশ্রিত
কত অকথিত গাথার বিলাপ বিষাদে গীত।
গোলাপ তোমার উদ্দেশে হাত বাড়ালেই আমি
ইদানিং হায় ছুঁয়ে ফেলি শুধু তুমিহীনতাকে।
মগজে কুয়াশা, দু’চোখে কুয়াশা, কুয়াশা হৃদয়ে;
কাঁটাতারে চোখ ছিঁড়ে যেতে চায়, ফণিমনসার
গোঁয়ার কাঁটার আঘাতে ওষ্ঠ হয় চৌচির,
গোলাপ তোমার সন্ধানে আমি বাউলা হয়েছি!
মেঘদল আর হিলহিলে সব শস্যের মাঠ,
দিঘির পদ্ম, তারাগুলো বলে, পাবো না তোমাকে,
কখনও পাবো না। অথচ নিত্য তোমাকেই খুঁজি,
তোমাকেই দেখি ভোরবেলাকার প্রথম রোদের
ঝর্ণাতলায়, কখনও মেঘের পালকিতে আর
গারো পাহাড়ের গোধূলি রঙিন গাঢ় প্রচ্ছদে,
কখনও নিঝুম জ্যোৎস্নাপ্লাবিত পাকদণ্ডিতে
কখনও রূপালি মহানন্দার প্রখর ধারায়।
ঘরে-বাইরে
আয়নায় নিজের শুকনো মুখ দেখে কেমন অচেনা মনে হয়;
বেশ কিছুদিন থেকে কোথাও যাই না, শুয়ে-বসে
আর পায়চারি করে নিজের ঘরেই আছি। হঠাৎ কী হয়,
একদিন ফুটপাত কাউকে কিছু না বলে ঠিক
ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কিছুদিন ঘর ছেড়ে
বাইরে বাইরে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছি বহু মানুষের
জটলায়, কোলাহলে। তারপর দেখি একদিন কী খেয়ালে
আমার আপন ঘর এসে খোলা রাস্তায় দাঁড়ায়।
কবিতার মুহূর্ত এখনই-ঘরে বসে ভেবে নিয়ে
তাড়াতাড়ি একটি কলম হাতে তুলে নিই। মগজের নানা
স্তরে ফোঁটা ফোঁটা মধু ঝরে,দোয়েলের গান জাগে
দোলে নীল পদ্ম, পূর্ণিমার বান ডাকে, রাঙা প্রজাপতি ওড়ে
আনন্দের ঢেউ হয়ে। অথচ খাতার পাতা শূন্য থাকে, লাফিয়ে ওঠে না
রঙিন মাছের মতো কোনও পঙ্ক্তি। এমনও তো হয়, পথে একা
হেঁটে যাই, মগজের কোনও স্তরে মেঘ নেই, বিদ্যুল্লতা,
অথচ চঞ্চল হয় অলস আঙুল, নিমেষেই
মনোলোকে খাতার বিরান মরুভূমি ইন্দ্রজালে
যেন চোখ জুড়ানো নবীন মরুদ্যান হয়ে যায়।
কিছুদিন আমার নিজের ঘরে চাতক, ধনেশ হরিয়াল,
পাপিয়া, কোকিল, শ্যামা আসর জমায়,
তারপর একদিন উড়ে উড়ে চলে যায় দূরে। পাখিদের স্বরলিপি
শুনতে পাই না বলে মনে
বেদনা আঁচড় কাটে ক্ষণে ক্ষণে। কী-যে হয়, হঠাৎ কখন
ঘর ছেড়ে ঘুরি বনবাদাড়ে পাখির সঙ্গ পেতে। পক্ষীকুল
আমাকে চিনতে পেরে কণ্ঠে অর্কেস্ট্রার
সুর তুলে স্বাগত জানায়।