লক্ষ্মীবাজারের রৌদ্রময় অন্ধকারে
আমার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অনেক পোড়া, আধপোড়া,
ছেঁড়াখোড়া, ছাই-হয়ে-যাওয়া বইপত্তর, খাতা, কলম,
ছিন্নভিন্ন জামাকাপড়, বিছানা, কয়েকটি স্পঞ্জের স্যান্ডেল
এক পাটি উল্টে-থাকা মেয়েলি জুতো। এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে
দাঁড়িয়ে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কোন্ শতাব্দী
এখন লালন করছে আমাকে! কোন্ শতাব্দীর আসুরিক ক্রূর
অন্ধকার এখানকার আলোকপ্রার্থী, প্রশান্ত, সুশীল বিদ্যানিকেতনে,
উপাসনা-স্নিগ্ধ গির্জায় জুড়েছিল প্রলয়-নাচ?
বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদে দাঁড়িয়ে দেখছি ধুলোয় লুণ্ঠিত হাত-পা
আর মস্তকবিহীন যীশু, বিচূর্ণ ক্রূশ; ভেতরে দগ্ধ, ধ্বস্ত ঘরে
ভীষণ আহত মাতা মেরী, আধপোড়া বাইবেল, তছনছ-করা, ক’টি
মুক বাদ্যযন্ত্র। যেন কোনও দম-আটকানো ঘোর দুঃস্বপ্নের ভেতর
আমার কানে এসে বারবার আছড়ে পড়ছিল শাহানা, পারভিন,
লতিফা, ক্রিস্টিনা, ললিতা, রাশেদা, ডেইজি গোমেজ, মল্লিকা,
আইরিন, সিলভিয়া ডি কস্টা, সুরাইয়া, রেহানা এবং আরও অনেক
শিক্ষার্থিনীর আর্ত চিৎকার।
না, মানুষ নয়, ধর্মান্ধতাপুষ্ট আয়েশলালিত অবিবেকী এক
চক্রচালিত কয়েক হাজার হিংস্র রোবটের তাণ্ডবে সৃষ্ট এই
ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি লজ্জায় নতমস্তক, বেদনাবিহ্বল।
চোখ তুলে দেখি অদূরে দাঁড়ানো ধূসর জোব্বা-পরা সক্রেটিস, প্লেটো,
অ্যারিস্টটল, চার্বাক, দান্তে, জালালুদ্দিন রুমি, ইবনে রুশদ, বার্ট্রাণ্ড
রাসেল, আইনস্টাইন, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন, ডিরোজিও
মাইকেল মধুসুদন, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, লালন ফকির, কাজী নজরুল
ইসলাম। প্রখর দুপুরে তাঁদের প্রত্যেকের মুখমণ্ডলে শ্রাবণের মেঘ,
চোখে তিরস্কার এবং ধিক্কারের স্তব্ধ বাণী। নিজেকে কেমন অসহায়, আক্রান্ত,
ক্ষতবিক্ষত মূর্তি বলে মনে হ’ল
সেইন্ট জেভিয়ার্স বিদ্যালয়ের রৌদ্রময় অন্ধকারে।
সন্ধ্যারাত যখন দাতা
দীর্ঘ দীর্ঘকাল পর এমন একটি সন্ধ্যারাত কী নরম
পা রাখে আমার ঘরে। আয়োজন ছিল না কিছুই,
তবু জন্ম হলো অগোচরে
নামহীন এক উৎসবের। আলগোছে তুমি এলে,
নতুন কবিতা যেন সৃজনের খরাশেষে। এই সন্ধ্যারাত
বস্তুত তোমারই সৃষ্টি সহজ সৌন্দর্যে অনাবিল, সুগভীর।
তোমার স্পর্শের প্রজ্বলনে, প্রদীপের শিখা হওয়া
সে মুহূর্তে ছিল না সম্ভব,
যদিও হৃদয়ে ছিল অপরূপ নিভৃত দেয়ালি। দু’টি চোখ
কুড়িয়ে নিচ্ছিল খুব সঙ্গোপনে ঘরে
ঘনিষ্ঠ ছড়িয়ে থাকা তোমার মুহূর্তগুলি তুমি
আমার দৃষ্টিতে করছিলে পাঠ চূর্ণ ইতিহাস
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আর অন্তরালে চেতনাপ্রবাহে
ছিল ডুবসাঁতার তোমার।
তোমার কিসের তাড়া ছিল? সন্ধ্যারাত
সন্ধ্যার সতেজ ঘ্রাণ সম্পূর্ণ মুছে না ফেলতেই চলে গেলে,
বর্তমান হলো স্মৃতি। ঘরে একা বসে থাকি এবং তোমার
ফেলে-যাওয়া শূন্যতাকে ব্যাকুল চুম্বন করি বারবার, দেখি
হাহাকার সহস্র বুদ্বুদ হয়ে আঁধারে মিলায়
ক্ষণে ক্ষণে, নিজেকে বিবিক্ত উদ্বাস্তুর ছায়া বলে মনে হয়।
এই সন্ধ্যারাত দীর্ঘকাল পর তার রূপে ফের
আমাকে করেছে দগ্ধ; কিছুতে নয়, শুধু
করেছে কোমল শুদ্ধ, হৃদয় নিয়েছে জন্ম চন্দ্রিল সঙ্গীত
পুনরায়, বন্ধ্যা সময়ের হলো অবসান। এই
তোমার বিদ্যুৎ-তুল্য আসা-যাওয়া তোমাকে আমার
আরও বেশি কাছে এনে দিয়েছে, শুনছি
কান পেতে-বলে সন্ধ্যারাতে হাওয়া আর
ঘাসের সবুজ ঢেউ, জোনাকির কাছে।
সাধ
আজীবন শহরের বাশিন্দা সে। ধুলোবালি, ইট
পাথর, হুল্লোড় তার ভালোই লেগেছে এতকাল,
নালিশে হয়নি মন ধূমায়িত। অথচ এখন
কিছুদিন থেকে
তাকে টানে পাড়াগাঁ, যেখানে পিতামহ, মাতামহ
এবং প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা ছিলেন একদা
ধূসর অতীতে। হায় সেই
অজ্ঞাত বুজুর্গদের পরিচয় খুঁজবে কোন্ সে
বিলুপ্ত কেতাবে? আপাতত
কালো ধোঁয়া-ত্রাস আর বহুরূপী শব্দের প্রহার
বড় বিচলিত করে লোকটিকে। এক তীব্র সাধ
সারসের মতো গলা বাড়ায় নিয়ত আজকাল-
যদি সে দিঘির কিনারায়
কিংবা জ্যোৎস্না রাতে পুরু সবুজ ঘাসের বিছানায়
মাথা রেখে শ্রাবণ পূর্ণিমা
সত্তায় ধারণ করে অশেষ রহস্যময়তায় খুব মগ্ন হতে পারে।
স্বপ্নপুরাণ
এখন আমি ষাটের কোঠার হাটহদ্দ ছুঁয়ে আছি
ঝড় ঝাপ্টা সয়েছি খুব, খানাখন্দে পড়েছি মুখ থুবড়ে কত।
হরেক রকম বিরূপতা চলার পথে ছদ্মবেশে দাঁড়ায় এসে,
বাদুড়মুখো কিছু মানুষ হেসে হেসে হিংস্র হয়ে কামড়ে ধরে।
কখনও কেউ অমানিশায় পথ ভুলিয়ে খন্দে ফেলে,
কখনও কেউ ওষ্ঠ আমার চুমোর ছলে গরল ঢালে,
কখনও কেউ বন্ধু সেজে চোরাবালির দিকে ঠ্যালে,
তবু আমি প্রেত-প্রহরে শুভকালের স্বপ্ন দেখি।
স্বপ্নে দেখি সূর্য বুকের দরজা খুলে ডাকে আমায়,
অসংকোচে প্রবেশ করি, অপরূপের জগৎ দেখি
উদ্ভাসিত দৃষ্টিপথে-অচেনা গাছ পুষ্পে ছাওয়া,
আমার প্রবীণ মৃত পিতা শাগালের নিজ গাঁয়ের ছবি
বুকে নিয়ে আছেন শুয়ে হ্রদের ধারে; আমার মৃতা মা রূপালি
চাঁদের নায়ে বসে একা কোন্ সুদূরে যাত্রা করেন;
স্বপ্নে দেখি প্রিয়তমা গৌরী মাঠে জ্যোৎস্না কুড়ায়
পুরাকালের পাণ্ডুলিপি পাখির ডানায় ভেসে বেড়ায়।
যাচ্ছি কোথায়? ডানে ঘাতক অস্ত্র নামায়, বামে নামে
ঘোর কুয়াশা। হোঁচট খেয়ে চলছি তবু আলোর আশায়,
স্বপ্ন জুড়ে অন্তবিহীন সেতু জাগে কবন্ধদের মিছিল নিয়ে;
কাঁটাতারের বেড়ায় দেখি পরীর ডানা আট্কে আছে।
পিকাসো তাঁর গোয়ের্নিকা ছুঁড়ে মারেন তালেবানি
কসাইখানায়; লোর্কার লাশে প্রজাপতির অবাধ মেলা।
ভগ্ন সেতুর কংকালে কার বাসর সাজে অন্ধকারে।
বাউলা হাসন ঢোল বাজিয়ে তারা ছিটোন চতুর্দিকে।
বাইরে আমি ছড়িয়ে পড়ি মাঝে মাঝে কিসের টানে?
আবার আমার ভেতরে যাই অনেক দূরে গহনপুরে।
ধ্যানের ছোঁয়ায় একতারাটা হাতে নিয়ে নিজের ভেতর
ঘুরে বেড়াই গেয়ে বেড়াই ধুধু মাঠে, নদীর ঘাটে।
আমায় আমি রৌদ্রে সেঁকে, ছায়ার মেখে ক্রমান্বয়ে
গড়ে তুলি, সবার মধ্যে থেকেও আছি বড়ই একা।
কেউ বোঝে না আমার গোপন রক্তক্ষরণ, ক্ষতের পীড়ন;
দ্যাখে না কেউ আমায় পোড়ায় ক্ষণে ক্ষণে কেমন আগুন।
ফাঁদ-পাতা এই জটিল পথে চলতে হবে সকল সময়,
শ্বাপদঘেরা হুমকিভরা চরাচরে থাকব আমি
কেমন ক’রে? আমার ভাঁড়ার নিচ্ছে লুটে তাতার দস্যু,
যায় যদি যাক পুঁজিপাটা, অন্তত থাক স্বপ্নপুরাণ।