যখন বৃষ্টি পড়ে
দিনটি শুরুই হয়েছে ঘন মেঘময়তা আর ঘোর
বর্ষণ নিয়ে। শ্রাবণ তার সারা গায়ে গায়ে কাজল শাড়ি জড়িয়ে
এসেছে আমার আপন শহরে। আমি একজন
উজ্জ্বল নারীকে জানি, যে আষাঢ় আর শ্রাবণের
কৃষ্ণবরণ মেঘ এবং রাধার মতো আকাশেচেরা বিদ্যুল্লতা
দেখে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়ে।
যখন বৃষ্টি পড়ে রিমঝিম কিংবা ঝমঝমিয়ে, তখন
তার হৃদয়ে সেতারের ঝালা, রক্তে রবীন্দ্রনাথের গানের
তন্ময়তা, বহু যুগের ওপারে বাঙ্ময় স্তব্ধতা।
সে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়
সবুজ লনে, ফুলগাছের পাতায় বৃষ্টি ধারা দেখে
ওর মনে পড়ে যায় কবেকার কোন-শূন্য মন্দিরের কথা,
মনে পড়ে সদ্য যৌবনের প্রথম শাড়ি পরে
কেমন নেচে উঠেছিল বৃষ্টিময় দুপুরে খোলা ছাদে,
নিজের অজান্তে ওর কণ্ঠে পল্লবিত হয়েছিল
বর্ষার মেঘমন্দ্রিত গান।
বর্ষা-আন্দোলিত সেই নারী তার শূন্য মন্দিরে
বসিয়েছে যে-কবিকে, বৃষ্টিধারায়, ভেজাপাতার ঘ্রাণে
সে-ও মোহিত, কিন্তু দীর্ঘকাল পুরোনো শহরে
বসবাস হেতু বর্ষার উদগ্র মাতলামি তার অসহ্য ঠেকে।
শহর-ভাসানো কলুষিত জল উজিয়ে হেঁটে আসা-যাওয়ার
পথের স্মৃতি তার মুখ আর মন ম্লান করে দেয় আজও।
২
আকাশ মেঘে-ঢাকা, তুমুল জলধারা দিচ্ছে ধুয়ে আজ শহরটিকে,
ভেজা দুপুরে দেখি পথিকহীন পথ, কাকেরা আশ্রয় খুঁজছে।
গহন বর্ষার ছায়ামেদুর গান গুঞ্জরিত মনে, শূন্য মন্দির এবং
কেমন হাহাকার বুকের প্রান্তরে বইতে থাকে হু হু রাত্রে।
যক্ষ নই কোনও, তবুও আষাঢ়ের কিংবা শ্রাবণের মেঘের ঘটা
হৃদয়ে ব্যাকুলতা সৃষ্টি করে আজও হঠাৎ চুপিসারে একলা ঘরে।
বাইরে চেয়ে থাকি, আকাশ জুড়ে তার মুখের ছায়া দেখি, অথচ
আমার এ বয়সে নেহাৎ বেমানান এমন ব্যাকুলতা, সত্যি।
কিন্তু বর্ষার এমনই মোহময় প্রভাব হায় ছোটো পড়ার গৃহকোণে দেখছি
আমার এই একাকীত্ব আর আমি বসেছি মুখোমুখি নিশ্চুপ।
শ্রাবণধারা মনে জাগায় তাকে কাছে পাওয়ার সাধ এই নিমেষে;
আমার বাসনা কি ছিন্নপত্রের মতোই ভেসে যাবে জলধারায়?
রবীন্দ্রনাথের কাছে
আজকাল বাস্তবের ঝাঁ ঝাঁ রোদ থেকে সহজেই
স্বপ্নের ছায়ায় চলে যাই। সেদিন দুপুর বেলা
‘গীতবিতানে’র পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কখন যে
নির্জন সমুদ্রতীরে পা রেখেছি, বলা ভার। তটে সমুদ্রের
ওগরানো শঙ্খ থেকে ভেসে আসে কিন্নরের গান। হেঁটে যায়,
কখনও বাউল আমি কখনও বা ঐবাদুর; দেখি
সম্মুখে রূপালি সরোবর, তীরে বীণা আর হাঁস
আছে পাশাপাশি, দূরে শিমুল গাছের ছায়া পোহায় হরিণ।
পরের মুহূর্তে উদ্ভাসিত অপরূপ গুলবাগ,
যেখানে গৌরবে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস,
শ্রী মধুসূদন দত্ত, লালন ফকির, নজরুল ইসলাম
এবং জীবনানন্দসহ তিরিশের কবিকুল
আর ছায়াপ্রায় কেউ কেউ উপবিষ্ট ক’টি রূপালি আসনে,
স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ স্বর্ণাসনে সমাসীন, তাঁর
মাথায় মুকুট। কবিদের সমাবেশ ঘিরে নক্ষত্রের নাচ
চলে, ঝরে শত পারিজাত।
সমাবেশ লক্ষ্য করে এগোতেই একজন দীর্ঘকায় লোক,
মুখ তার কাঠিন্যখচিত, বলে দৃঢ় স্বরে, ‘যাও,
চলে যাও, এখানে আসন নেই আর। বাধা পেয়ে খানিকটা
দমে যাই, ক্ষণকাল পরে নিজেকে সামলে নিয়ে, কণ্ঠে ঢেলে
অনুনয় বলি ‘আমি চাই না আসন কোনও, শুধু
এতটুকু ঠাঁই পেতে চাই তাঁর, রবীন্দ্রনাথের
উদার পায়ের কাছে, যদি তিনি অনুমতি দেন। অনুমতি
পেলাম কি পেলাম না, বুঝতে পারিনি শেষাবধি।
মেঘ এসে ঢেকে দেয় মুখ আর আমি
নিজের নিকট থেকে দূরে বহুদূরে চলে যাই। ভাসমান
দেহমনে কবেকার জলরোষ, ভগ্নতরী, শামুকের, জলজগুল্মের
ঘ্রাণ পাই। একটি গৈরিক আলখাল্লা কম্পমান
দিগন্তরেখায় ক্ষ্যাপা বৈশাখী হাওয়ায়, আত্মমগ্ন বংশীধ্বনি
আমাকে জাগিয়ে তোলে বলে মনে হয়।
রূপালি মুকুট
এইমাত্র লোকটা নিঃশব্দে ঢোকে তার খুপরিতে। এককোণে
মেঝেতে বিছানা পাতা; মলিন চাঁদর,
বালিশ ওয়াড়ছুট, আহত পশুর মতো যেন
গোঙাচ্ছে, ঘরের তাকে কয়েকটি বই। একমাত্র
টুল ছাড়া আসবার বলতে কিছুই
নেই, জানলার নিচে আধপোড়া মোমবাতি টিনের কৌটোয়
করুণ দাঁড়ানো। সে কাপড় না ছেড়েই টুলে
কিছুক্ষণ বসে জুতো জোড়া ছুঁড়ে ফেলে গা রাখে শয্যায়।
লোকটাকে ঘিরে এই বিশীর্ণ গলিতে
রটেছে নানান কথা। কেউ বলে সে ঘোর অমাবস্যায়। জ্যোৎস্না,
বর্ষার রোদ্দুর পুরে রাখে তার বুকের পকেটে। মধ্যরাতে
ডাঙায় চালিয়ে নৌকো মেঘলোকে যায়, ফিরে এলে
জামায় মেঘের দাগ, নক্ষত্রের রেণু লেগে থাকে,
লোকে দ্যাখে; তারপর ঈষৎ গা ঝাড়া দিয়ে ঢোকে
খুপরিতে নিরিবিলি। সহজে ঘেষে না কেউ লোকটার কাছে,
কেবল বালক বালিকারা তার সঙ্গে মেতে ওঠে
কানামাছি খেলায় বিকেলবেলা অবরে-সবরে। স্বেচ্ছায় সে
বাজায় বাঁশের বাঁশি প্রতিদিন, যেন চৌরাসিয়া, সুরধারা
গলি ছেড়ে দূরে যেতে-যেতে নীলিমাকে ছোঁয়। ওরা
শোনে ভরা মুগ্ধতায়, দ্যাখে লোকটার
সমস্ত শরীর রঙধনু, মাথা আগুনের বল।
এক সন্ধ্যেবেলা, যখন যে ফিরছিল খুপরিতে,
পাড়ার রটনাকারীগণ প্রায় তেড়েমেড়ে আসে
লোকটার দিকে আর তাকে ঐন্দ্রজালিক ঠাউরে নিয়ে তার
শার্ট, ট্রাউজারের পকেট
তক্ষুণি উজাড় করে রোদ্দুর, চাঁদিনী, ঝকঝকে
অসংখ্য নোটের তাড়া, হীরে জহরত, সোনা দানা
দিতে বলে। লোকটা অসুস্থ, হৃদরোগী, ভিড়ভাট্রা দেখে আর
অতিশয় কর্কশ আওয়াজ
শুনে বেশ কিছুটা ভড়কে যায়। টানা-হেঁচড়ায়
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, বুকের স্পন্দিত একা ঘড়ি থেমে যায়।
একটু পরেই খুব চুপচাপ বালক বালিকা সব আসে
একে একে, অশ্রুময় চোখে লোকটার
চারপাশে দাঁড়ায় এবং দ্যাখে স্তব্ধ সেই বংশীবাদকের
শিয়রে রোদ্দুর আর পায়ের তলায় জ্যোৎস্না। আজ
উন্নত মাথায় তার আগুনের বল নেই কোনও,
আছে শুধু নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে রূপালি মুকুট।