- বইয়ের নামঃ রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যা রাতে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনুপম সৌধ
ক’বছর আগেকার কথা, সময়টা আমার খারাপই ছিল,
বলা যায়। আমার চৌদিকে কিছু ভাঙা ইট, নুড়ি, চুন বালি
বস্তুত ছড়ানো ছিল ইতস্তত। ধূসরিত হাহাকার আর
মাথায় শূন্যতা নিয়ে ছিলাম নিষ্ক্রিয়। আকাশের নীল রঙ,
কিয়দ্দূর থেকে ভেসে-আসা পাখির কোমল ডাক, বাতাসের
ছোঁয়ায় গাছের পাতাদের নেচে-ওঠা-সব কিছু ব্যর্থ ছিল
তখন আমার কাছে। অন্ধকারে হঠাৎ আলোর মতো তুমি
এসে বলেছিলে , ‘এসো এই ভাঙাচোরা বস্তুগুলো বহুদূরে
সরিয়ে দু’জনের এক অনুপম সৌধ নির্মাণের পরে এর
নাম রাখি প্রেমালয়। অনন্তর তুমি আর আমি শ্রমহীন
শ্রমে পড়ে তুলি সৌধ যুগলবন্দির অলৌকিক সুরে।
কী-যে হয়, সাফল্যের শেষ ধাপে তুমি চকিতে গুটিয়ে নাও
হাত, মুখ ফিরিয়ে ভাঙার প্ররোচনায় তিমিরে যাত্রা করো।
জানো না কি তোমার প্রস্থানে প্রেমালয় নিমেষেই ধসে যাবে
স্খলিত দাঁতের মতো? চৌদিকে পেঁচার ডাক; আকাশ বমন
করে রক্তপুঁজ, অসমাপ্ত সৌধ শেষে পোড়ো বাড়ি হয়ে যাবে।
পোড়ো বাড়ি প্রদীপে সাজাই যদি, ব্যর্থ হবে সব আয়োজন;
চামচিকা, বাদুড়ের ক্রোধে অমাবস্যা নিমেষে আসবে ব্যেপে!
অন্তহীন ঘন কুয়াশায়
মোহাম্মদ নোমান স্বরণে
দিনরাতে নিভৃতির নিবিড় মেদুর ছায়া ঘিরে
রেখেছিল আপনাকে। তাই দেখাশোনা
হয়নি তেমন, তবু মনে
কিছু স্মৃতিরেখা জেগে আছে। আপনি কি
রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে
কখনও গেছেন চলে বহুদূরে ঘন কুয়াশায়?
কখনও কি সন্ধ্যেবেলা ঘাসে শুয়ে জোনাকির খেলা
দেখেছেন স্বপ্নাতুর চোখে? আজ এই
পড়ন্ত বেলায় মনে পড়ে,
যখন তারুণ্য ছিল দেহমনে কিটস্-এর ওড
আপনাকে বড় বেশি করেছে উন্মন,
মৎস্যকন্যা ডেকে নিয়ে গেছে নীল সমুদ্রের দিকে!
এই দর কষাকষি, ক্রূর ঘষাঘষিময় জগত সংসারে
ছিলেন নিছক বেমানান, বুঝি তাই
ফ্যাসাদ, বচসা, খেয়োখেয়ি
থেকে রেখেছেন
নিজেকে আড়ালে আর একদিন বড়ই নিঃসঙ্গ
হঠাৎ গেছেন মিশে অন্তহীন ঘন কুয়াশায়।
অযৌক্তিক
একজন ভদ্রলোক, ধারালো ছুরির মতো যার চোখ, ঘোর
যুক্তিবাদী, আমাকে খানিক
আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নিরাসক্ত কণ্ঠস্বরে
বললেন, এই যে আপনি কবিতায়
কখনও কখনও ডানা-অলা ঘোড়া, মৎস্যকন্যা, পরী
আর দেবদূতদের কথা লেখেন, সেগুলো বড়
অবাস্তব, অযৌক্তিক। এ যুগে এসব
একবারে অচল, বাতিল।
নিরুত্তর আমি দেখি আমার সমুখে বীণা হাতে
সুস্মিত দাঁড়ালো অর্ফিয়ুস, আফ্রোদিতি
সারা গায় সমুদ্রের ফেনা নিয়ে ভাসমান পদ্ম থেকে নেমে
এলেন বিজন ঘাটে। যুক্তিবাদী ভদ্রলোক, তাড়া ছিল তার,
বেরিয়ে গেলেন দ্রুত আমার পড়ার ঘর থেকে
আর আমি খাতার পাতায় কবিতার নিজস্ব যুক্তির কিছু
রূপকল্প খুঁজে পাই। কবিতার খাতা
যেন বীণাপাণির হাঁসের মতো ধ্যানে মগ্ন হয়।
আদিবাসী মেয়েটি
আদিবাসী মেয়েটি পাহাড়, নদী, জ্যোৎস্না আর
পেলব আঁধার ছেড়ে এসেছিল এই
ঝলমলে রাজধানী শহরে নিশ্চিত কোনও চাকচিক্য,
অথবা বেয়াড়া বিলাসিতা কিংবা আহ্লাদের
হেতু নয়, এসেছিল শুধু
নিয়মিত দু’মুঠো তণ্ডুল আর একটি কি দু’টি
শাদামাঠা বস্ত্রের তাগিদে। আদিবাসী
মেয়েটির ছিল না মোটেও পরিচয়
হায়, বস্ত্রহরণ অথবা
ধর্ষণ শব্দের সঙ্গে। কয়েকটি শাহরিক নেকড়ে
তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে
কর্কশ আঁধার চিরে পাশব উল্লাসে মেতে ওঠে।
যখন সে, আদিবাসী তরুণীটি, আত্মহননের
অন্ধকারে মুক্তি সন্ধানের
অভিলাষে নিঃসঙ্গ দাঁড়ায়, রাজধানী শহরের
মাথা হেঁট হলো না কি চকিতে নিমেষে? অন্তহীন
অন্ধকার করেনি গ্রহণ ওকে, জীবনের প্রবল সংকেত
আড়মোড়া ভাঙে, শুভ আলোয় মেয়েটি স্নানার্থিনী।
আপন ভুবনে
কী-যে হয়, এই
আমার মতোন ঘরকুনো লোকটাও একদিন
বলা-কওয়া সেই ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুড়ে
হঠাৎ পালিয়ে এল এই এলাকায়,
যেখানে কোথাও জনমানবের সাড়া নেই। গলা
ফাটিয়ে ডাকাও নিরর্থক। চতুদিকে গাছপালা
রয়েছে গৌরবে মাথা তুলে আর কাছে একটি সরোবরে
প্রফুল্ল সাঁতার কাটে ক’টি রাজহাঁস।
বেলা বাড়ে, ফলমূল, খেয়ে
মেটাই সুতীক্ষ্ম ক্ষুধা; ডালপাতা দিয়ে আস্তে সুস্থে
বানাই বিনীত ডেরা মাথা গোঁজার এবং শ্রমে
অবসন্ন ভুলে থাকি; আশেপাশে আছে
কি নেই নেকড়ে বাঘ, সাপ খোপ। শুধু মনে পড়ে,
বিরক্তির হুলে জর্জরিত আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।
গোড়ায় ভালোই লেগেছিল এ বাড়িতে বসবাস,
ভেবেছি নিজেকে সুখী, অথচ ক্রমেই
পূর্ণিমাকে করে গ্রাস অমাবস্যা। মাস না ফুরাতে
ভাড়ারে নাছোড় টান, ধারদেনা শুরু,
ঘিনঘিনে কাদা যেন নিত্য নৈমিত্তিক খিটিমিটি,
উপরন্তু অবিরাম সভাসমিতির
ঠেলাঠেলি, চ্যাঁচামেচি। ফলে সংসারের মুখে থুথু
ছিটিয়ে পালিয়ে আসি নিঃসর্গের শান্তিনিকেতনে।
এখানে হরিণ আসে ভোরবেলা কিংবা জ্যোস্নারাতে
কাঠবিড়ালিরা খেলা করে ডালে ডালে
এবং পাখির গানে গানে বিমোহিত
দিকগুলি। নিশীথের আরণ্যক নিদ্রায় স্বপ্নের
ভেতরে আমার ঘরবাড়ি
চকিতে পাতাল থেকে জেগে ওঠে ফের
মানবিক কণ্ঠস্বর নিয়ে। আমার চায়ের বাটি
দেখছি প্রবালে তৈরি, জ্বলজ্বলে হীরে দিয়ে গড়া
লেখার টেবিল, সংসারের খিটিমিটি
শ্রী চৌরাসিয়ার বংশীধ্বনি, টেলিফোনে ভেসে আসে
ভেনাসের কণ্ঠসুর; জেগে উঠে স্বপ্নকে আদর করি খুব।
ভোরবেলা জনহীন নিসর্গের রূপে কিছুক্ষণ
মগ্ন থেকে অনন্তর পথ চলি, থেমে
তাকাই পিছন ফিরে, ফের হেঁটে যাই, বেলাবেলি
পুনরায় বাজাব কলিংবেল আপন ভুবনে।