শেষ অঙ্ক
এত সম্ভার কোথায় উধাও হলো?
কোথায় সে দিন অনুপম জ্বলজ্বলে?
যৌবন যায় ক্রমশ আস্তাচলে,
অনুশোচনার কৃষ্ণপক্ষ ভোলো।
তুমি কি শুধুই ঘুরবে ছদ্মবেশে?
প্রেতের সঙ্গে তোমার আলাপচারী
মনে হয় যেন কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি।
হয়ো না বন্ধু উন্মাদ অবশেষে।
তুমি আছো আজো স্বগত বিলাসে মজে
অথচ তোমার দয়িতা আত্মদানে
নগরে জটিল ছায়া-সংকট আনে।
তোমার দ্বন্দ্ব এখন কেই বা বোঝে?
মধ্যবয়সে অমাবস্যার ঘোরে
সত্তায় নিয়ে স্বপ্নের কিছু দাগ,
পিছুটান আর সমাহিত অনুরাগ
থাকতে কি চাও গৃহকোণে একা পড়ে?
চোখের চমক হয়নি অস্তমিত,
এখনো শিরায় জাগে হরিণের লাফ,
হৃদয়ে জাগর চিতার পদচ্ছাপ;
নিজের ছায়ায় ঝলকে হয়ো না ভীত।
ফিস ফিসে এই মঞ্চে তোমাকে দেখে
উদ্বেগে কাঁপে অনেক হৃদয় আজ।
তোমার শরীরে কেমন করুণ সাজ,
নেপথ্যে কত আততায়ী যায় হেঁকে।
অষ্ট প্রহর পাশে প্রিয় সহচর,
তার ওপরেই দিলে তুমি গুরুভার
ট্রাজিক কাহিনী বারে বারে বলবার;
অবচেতনায় ওঠে বৈশাখী ঝড়।
চেয়েছিলে তুমি দেশ হোক ভাস্বর,
আমজাম আর কাঁঠালের এই দেশে
মেধা ও মননে হৃদয়ের ধারা মেশে।
সবখানে বাজে তোমার কণ্ঠস্বর।
সব্যসাচী
কথা ছিল সে-ও যাবে একদিন দূর নীলিমায়,
অলকানন্দা নদীর বাঁকে,
কিন্তু পলকে ঘুণপোকা দিলো বিনাশের তাল,
রইলো সে পড়ে বিফল পাঁকে।
বুকের ভেতর তার ছিল এক অচিন বাগান,
অথচ ফোটেনি একটি ফুলও।
তার সত্তায় ছিল যুবরাজ উন্নত শির,
সে-যুবা হয়েছে অকালে নূলো।
তার কণ্ঠের প্রতি তন্ত্রীতে হতো ঝংকৃত
অর্ফিয়ুসের বীণার তার;
বোতলের ছিপি খুলে প্রত্যহ দিতো সে গড়িয়ে
ঝাঁঝালো, জাগর অন্ধকার।
ভেসে গেছে তার সত্তার ভিটা অকূল প্লাবনে,
ডুবেছে মুকুট, ডুবেছে মাথা।
তার কাছে কোনো উদ্যমী শাদা পায়রা আনেনি
ঠোঁটে বয়ে তাজা সবুজ পাতা।
সমুদ্রযাত্রা
সেই কোন্ যুগে আমি করেছি সমুদ্রযাত্রা। অথচ নিয়ত
সাগর সঙ্গমে কিংবা দ্বীপ-দ্বীপান্তরে
ঘুরেও এখনো আমি সামুদ্রিক জ্ঞান
আহরণে ব্যর্থ নিত্যদিন। কখনো ওড়াই পাল সারাবেলা,
রঙিন, অথচ শতচ্ছিন্ন, কখনো বা দাঁড় বাই,
জল সেঁচি কখনো-কখনো। মাঝে মাঝে
ঝড়ের থাপ্পড়ে কাঁপে ডিঙি, যেন ভয়ার্ত পায়রা
গোখরোর ফণার ছায়ায়। ছেঁড়ে দড়িদড়া আর
কোথায় যে যাই
ভেসে ডিঙিসুদ্ধ প্রতারক কুয়াশায়, মেলে না হদিস। শুধু
চেয়ে থাকি অসহায় বিপুল জলের দিকে, ব্যাপ্ত নীলিমায়।
অবেলায় ভীষণ ক্ষুধার্ত চোখে দেখি
কেমন বেগানা পাখি চক্রাকারে ঘোরে বারে বারে
মাথার উপর। হস্তধৃত দাঁড় দিয়ে
নিষ্ফল আঘাত ছুঁড়ি পাখির উদ্দেশে
বারংবার, নির্মোঘ চিৎকারে
নিঃসীম শূন্যতা ছিঁড়ে পাখি উড়ে যায়
নাগালের পরপারে।কখনো আবার
একটি দু’টি মাছ
লোভনীয় হয়ে ভেসে ওঠে
ডিঙির অনেক কাছে। আমি
আমার নিজের মধ্যে মৎস্যশিকারির
লীলা দেখে চমকিত। আমার জঠরে নরকাগ্নি আর
নিস্তব্ধ আকাশে
অন্ধ সুন্দরীর মতো চাঁদ
আসে, জ্যোৎস্না কুহক ছড়ায় চারপাশে। ভেসে চলি
ক্রমাগত দিকচিহ্নহীন;
অসফল জেলের মতোন পড়ে থাকি বড় একা
ডিঙির জঠরে, মতিচ্ছন্ন ধূ-ধূ ঘুমে
চোখ বুজে আসে।
বস্তুত উপরিতলে থেকে যাই সকল সময়, সমুদ্রের
গভীরে হয় না যাওয়া, মানে
রত্নান্বেষী ডুবুরীর মতো
এখনো নামিনী নিচে; আজ অব্দি পাইনি সন্ধান
অনিন্দ্য জলজ উদ্যানের। ডিঙি ডোবে তো ডুবুক,
ওপরের দৃশ্যাবলী থেকে
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বরং গভীরে যাও বলে
কে যেন অতলে দেয় ডুব। আমি মজ্জাগত ছায়াবিলাসের
গোপনীয়তায় চেয়ে থাকি। জল-স্থল,
এমনকি অন্তস্তল ঢেকে গেছে অপরূপ মৃগতৃষ্ণিকায়।