যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে
যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে রাত্রিদিন আমার নিঝুম
বুকের কন্দরে একাকিনী,
তাকে চিনি বলে মনে হয়। অনিন্দ্য কুসুম ঝরে
তার চুলে মধ্যরাতে, সকল সময়
হাটুতে থুতনি রেখে বসে থাকে চুপচাপ, হাতে
গালের মসৃণ ত্বকে তার সুস্পষ্ট কান্নার ছাপ।
সে অন্ধ সুন্দরী
ব্যথিত বন্দিনী আজ। তার পায়ে কোনো
প্রাচীন নূপুর নয়, লোহার শেকল বাজে প্রহরে প্রহরে
প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে। কোনোদিন কোনো
দৃশ্য তার চোখে পড়বে না, এ সহজ সত্যটুকু
সে নিয়েছে মেনে। কারা তা খুব কাছে
পাকায় জটিল ঘোঁট, ফাঁদ পাতে আর
অকস্মাৎ খাপ থেকে খোলে তরবারি
নিঃশব্দে, এবং করে তাক
গোপন বন্দুক, সে দেখতে পাবে না কখনো কিছু।
অবশ্য হঠাৎ সে চমকে ওঠে কোনো কোনো শব্দ শুনে,
হাতড়ে বেড়ায়
নিজেরই বিষণ্ন ছায়া। কোথাও ইঁদুর আর ছুঁচো
পুরনো মাটির স্বাদে করে ছোটাছুটি,
হয়তো-বা বাদুড় ঝুলে থাকে ঘুণেখাওয়া কড়িকাঠে;
সে চমকে ওঠে
নিজের পায়ের শেকলের
ঈষৎ ঝংকারে বারে বারে।
কখনো কখনো এক বিদঘুটে প্রবীণ জল্লাদ
দর্পণ দেখাতে নিয়ে আসে সেই অন্ধ সুন্দরীকে।
দর্পণের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে
রূপসী বন্দিনী
শাদা মার্বেলের মতো চোখে মেলে ধূধূ চেয়ে থাকে
অপ্রস্তুত এবং বিব্রত। বিদঘুটে
প্রবীণ জল্লাদ হো হো হেসে ওঠে, যেন
প্রচণ্ড তামাশা দেখে ফেলেছে সে বন্ধ কুঠরিতে
অবেলায়। কখনো শানায় অস্ত্র, কখনো বা নিছক হেলায়
গলা টিপে হত্যা
করার খেলায় মানে অভিনয়ে মাতে
যাত্রার খুনীর মতো। তারপর বিকট হাসিতে
কাঁপিয়ে সকল দিক হেলে দুলে করে সে প্রস্থান।
যখন রাস্তায় আমি কোনো খাপছাড়া
তেজী তরুণকে দেখি হঠাৎ তখন
গাঁয়ে-কাঁটা দেওয়া অন্ধকারে
যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে আমার নিঝুম
বুকের কন্দরে তার পায়ের জটিল শেকলের
ঝংকার আমার মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়।
রেখেছো শব্দের রৌদ্রছায়া জালে
কথা ছিল হেঁটে যাবো আমরা দু’জন নদীবাঁকে
হয়তো পড়বে চোখে ঝলমলে বক, কখনো বা
হঠাৎ চমকে দেবে ফুটপাতে কোকিলের সুর।
দুপুরে কোথাও থেমে খেয়ে নেবো রুখা-সুখা, শোভা
দেখবো শহর ঘুরে, কথা ছিল; কথা ছিল নাকি?
তবে কেন অকস্মাৎ নিজেকে সরিয়ে নিতে চাও
আমার নিকট থেকে? আজ কোন্ অভিমানী পাখি
তোমাকে শোনালো গান বিদায়ের, দাও বলে দাও।
পাখি তার পাখিনীকে বলে আর্তস্বরে যাক আজ
পাখার চাঞ্চল্য থেমে, আকাশে দুর্যোগ ভয়ানক।
শাখা শূন্য করে গেলে নিমেষে চৌদিকে রুদ্র বাজ
ছড়াবে আগুন আর আমাকে ছিড়বে বৃষ্টি-নখ!
আমি সে পাখির ব্যাকুলতা জানি, জানি তার ভয়।
তুমি আছো ভেবে দীপ্র কিছুকাল ছিলাম পথিক
ক্লান্তিহীন দশদিকে এবং রাত্তিরে লোকালয়
থেকে দূরে চলে গিয়ে ছায়াচ্ছন্ন কোন্ সে গথিক
দালানের কাছে পৌঁছে চেয়েছি তৃষ্ণার জলধারা
তোমারই নির্জন ঘাটে। সেখানে আমরা কেউ কারো
মুখ আ দেখেই পরস্পর খুঁজি অবয়ব তারা
আর চাঁদহীন আকাশের নিচে। যদি যেতে পারে।
আমাকে আঁধারে ফেলে, চলে যেও। স্মৃতি পান করে
আমার সকালসন্ধ্যা কাটবে নিঃসঙ্গ; বারে বারে
ফিরে যাবো তুমিহীন তুমিময়তায়, একা ঘরে
তোমার প্রতিমা খুঁজে পাবো খড়মাটি অন্ধকারে।
রেখেছো শব্দের রৌদ্রছায়া জালে বন্দি করে তুমি
হে মধুর স্বরময়ী। তোমার অস্পষ্ট পদধ্বনি
বাজে সবখানে, স্নিগ্ধ প্রতিধ্বনিময় মনোভূমি
এখনই মিলনক্ষণ, পুনরায় বিচ্ছেদ এখনই।
শহীদ মিনারে কবিতাপাঠ
আমরা ক’জন
শহীদ মিনারের পাদপাঠে এসে দাঁড়ালাম
ফেব্রুয়ারীর শীতবিকেলে। একে একে
আস্তে সুস্থে সেখানে আসতে শুরু করলো অনেকে,
যেমন তীর্থ ভূমিতে অবিরাম
জড়ো হন ভক্তগণ।
সেখানে রোদের ঝলক ছিল না, আকাশ
তখন রাশভারি দার্শনিকের মুখের মতো,
আশেপাশে উজ্জ্বলতার কোনো আভাস
চোখে পড়েনি, তবু অবিরত
কিছু জ্যোতির্বলয়, মনেন হলো, খেলা
করছিল। আমরা ক’জন সেই বিকেলবেলা
চুপচাপ আরো ঘনিষ্ঠ হলাম পরস্পর।
একটু পরে আমাদের কণ্ঠস্বর
হলো মঞ্জরিত। আমাদের উচ্চারণের স্তবক
নিলো ঠাঁই শহীদ মিনারে সমর্পিত ফুলের পাশে।
সে সব শব্দগুচ্ছ ছিল না নিছক
শব্দ শব্দ খেলা, ছিল তারও বেশি, বিশ্বাসে
সঞ্জীবিত, নিশ্বাসে নিশ্বাসে অলৌকিক
ছন্দোময়। হঠাৎ পড়লো মনে সদ্য-প্রয়াত কবিবন্ধুর মুখ;
তার কথা ভেবে আমার চোখ করে চিক চিক
পানিতে যেন মরীচিকা। উন্মুখ
চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ, সরে বসে তড়িঘড়ি
আমার পাশে জায়গা করি,
যদি সে আবার আসে। তার বদলে দেবদূতের গান
ভেসে আসে দশদিক থেকে, থর থর
কাঁপি পাতার মতো; মহ্যমান
শহুরে গাছপালা, পথ, সিঁড়ি, প্রধান চত্বর।
আমাদের কবিতাপাঠের সময়
মনে হয়
তাঁরা এলেন শহীদ মিনারে, নিঃশব্দে কিছুক্ষণ
আসা-যাওয়া করে চত্বরে ক’জন
শহীদ দাঁড়ান পাদপাঠে। নিমেষে শস্যক্ষেত্র হয়ে যায়
শহীদ মিনার, তাঁরা কাহাতশাসিত দেশের শস্যের মতো
দুলতে থাকেন ক্রমাগত।
তারপর তাঁরা সব কিছু ছাপিয়ে ওঠেন, এমন দীর্ঘকায়।
শামসুর রাহমানের শার্ট অনুসন্ধান
আমি অনেকদিন থেকে এমন একটা শার্ট খুঁজছি,
যা আমাকে মানাবে।
নানা জামা-কাপড়ের দোকানে, শহরের
প্রতিটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে
ঢুঁ মেরে দেখেছি শাদা, কালো, হালকা নীল, গৈরিক,
সবুজ, বাদামি, মেরুন-রঙ বেরঙের শার্ট পরখ করে দেখেছি,
কিন্তু হা নসিব,
আমার মনের মতো শার্ট কোথাও নেই।
কোনো শার্টের রঙ হয়তো পছন্দ হয়, কিন্তু কলার
পছন্দ হয় না। কোনোটার কলার দারুণ লাগে,
অথচ হাতার খুঁত অত্যন্ত বেশি
নজরে পড়ে; আবার কোনো শার্টের
সকল কিছুই পছন্দমাফিক হলো,
কিন্তু সেটা গায়ে চাপাতে গিয়ে দেখি
বুকের কাছটায় এমন চেপে বসেছে যে,
দম বন্ধ হয়ে আসে।
তৈরি শার্টের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে
খুব দেখেশুনে কাপড় কিনে
নামজাদা দর্জির দোকানে গিয়েও
তেমন ফায়দা হলো না শেষ অব্দি।
শহরের অসামান্য দর্জি নেহাৎ মামুলি
একটা শার্ট বানালো আমার জন্যে।
ঝকঝকে প্যাকেট হাতে
ম্লান মুখে ফিরে আসি বাসায়।
ব্যয়বহুল শার্ট বাক্সবন্দি হয়ে
পড়ে রইলো।
আসলে আমি একটা অসাধারণ শার্ট খুঁজছি
অনেকদিন ধরে, তন্ন তন্ন করে।
এমন শার্ট আমি চাই যা লোকে
অন্য কারুর গায়ে দেখবে না কক্ষনো।
এতদিনে আমার এ বিশ্বাস
জন্মে গেছে যে, কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর
অথবা দর্জির দোকান
আমার মুশকিল আসান করতে পারবে না।
ফলত
আমি নিজেই আমার শার্ট বানানোর
সিদ্ধান্ত নিলাম এক শুভলগ্নে। দিনরাত
মাথা খাটিয়ে নকশা এঁকে
অনেক কাটছাঁট করা গেল।
আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির নিচে
ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো বাহারী শার্টের আদল।
নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেবার
একটা ইচ্ছা লক লক করে উঠলো
আমার ভেতর হাঁপানো কুকুরের জিভের মতো।
কিন্তু বড় বেশি খাপছাড়া আর বেমানান
হয়ে গেল না কি জামাটা?
না, ইহকালে
মনের মতো শার্ট আর পরা হবে না আমার।