দিগ্নির্দেশ
বৈকালী হাওয়া গুঞ্জন তোলে আমার কানে-
উত্তরে তুমি অবশ্য পাবে প্রিয়তমাকে’।
পথ চলি একা সেই ভরসায় নাছোড় টানে,
কিন্তু সেখানে শত বিভ্রমে পাই না তাকে।
সুকণ্ঠ এক পাখি গান খেয়ে জানায়, ‘তুমি
দক্ষিণে গেলে পেতে পারো তাকে ঝর্ণা তলে।
সারাদিন হেঁটে সন্ধ্যায় দেখি নিঝুম ভূমি,
ঝর্ণার ধারে শুধু এক ঝাঁক জোনাক জ্বলে।
যে নদীর সাথে ছিল শৈশবে সখ্য সেই
বেদেনীর মতো তরঙ্গময় নদীর ঢেউ
বললো, ‘পথিক, যদি যাও পূবে, পাবে তাকেই।
সেদিকে পৌঁছে দেখি সেখানেও নেই যে কেউ।
একটি বয়েসী বট করে গাঢ় উচ্চারণ,
‘পশ্চিম গেলে পাবে তার হাত তোমার হাতে’।
পশ্চিম দিকে বৃথা ঘুরে মরি, কী নির্জন
রাত্রি মুখর একাকিত্বের বন্দনাতে!
সবদিকে হেঁটে পাড়ি দিয়ে তের গহন নদী
মনোনীতা সেই নারীকে আমার হয়নি পাওয়া।
পাওয়া না-পাওয়া একই মুদ্রার দু’পিঠ যদি,
তাহলে খামকা কেন এই যাওয়া, কেবল যাওয়া?
বাঁশি
ভরদুপুরে, সন্ধ্যাবেলা, মধ্যযামে
বাঁশির সুরে চতুর্দিকে কেমন যেন
ছায়া নামে, মায়া নামে।
বাঁশির সুরে নীল যমুনা স্মৃতিকাতর,
অর্ফিয়ুসের সামনে আসে বনের পশু,
গুল্মলতা, নুড়িপাথর।
দায়ের ঘায়ে মুলী বাঁশের কান্না ঝরে।
বাঁশের মৃত্যু না হলে কি বাঁশির সুরে
পুষ্প জন্মে চরাচরে?
ভাবীকথকের প্রতি
তুমিতো এসেই গ্যাছো। তোমাকে দেখেছি শহরের
সবচেয়ে দীন চা-খানায়,
বাস টার্মিনালে, দগ্ধ ঘাসময় মাঠের কিনারে
একা লোকচক্ষুর আড়ালে,
প্রধান সড়কে আর গোধূলিতে পার্কের বেঞ্চিতে,
সন্ধ্যায় ওভারব্রিজে, কখনো চড়কে,
কখনো বা মহরমী শোকার্ত মিছিলে;
দেখেছি ঝিলের ধারে, জন্মান্ধ ডোবার আশেপাশে।
তোমার পরনে নেই জেল্লাদার পোশাক-আশাক,
যা দেখে ঝলসে যাবে চোখ; কত লোক
আসে যায় সর্বদা তোমার পাশ ঘেঁষে। মনে হয়,
করে না তোমাকে লক্ষ কেউ। বেলাশেষে ক্ষীণ আলোয় ফিরতি
মানুষের ঢেউ দোলে, উদাসীন তুমি
তাকাও নিস্পৃহ চোখে চাদ্দিকে এবং স্মিত ঠোঁটে
আওড়াও মনে মনে, কোথায় কে শিশু চোখ খোলে,
কোথায় নিমেষে কার চোখ বুজে যায়,
দিন যায়, দিন যায়;
নও তুমি দীর্ঘকায়, খর্বকায়ও নও। ভিড়ে মিশে গেলে তুমি
সহজে সনাক্ত করা দায়। অথচ কোথায় যেন
কী একটা আছে, বোঝা যায় চোখ পড়লেই,
তোমার ভেতরে।
তোমার দু’চোখ নয় যেমন তেমন। চক্ষুদ্বয়ে
করুণার জ্যোতি খুঁজি; যারা দিব্যোন্মাদ, বুঝি তারা
এমন চোখেরই অধিকারী।
কী বলবে তুমি এই হৈ হুল্লোড়ে? শুনছো নাকাড়া
নাকাড়া বাজছে অবিরাম দশদিকে?
নরনারী উচ্ছল সবাই,
যেন পানপাত্র থেকে ভরা মাইফেলে
উপচে পড়ছে ফেনা অবিরত। কিন্তু প্রত্যেকেই
অস্তিত্বে বেড়াচ্ছে বয়ে ঘুণপোকা; ভব্যতাসম্মত
আচরণে ওরা নড়ে চড়ে ক্ষণে ক্ষণে
পুতুলনাচের মতো। কখনো অভিন্ন ছাঁচে হাসে,
কাঁদে সিনেমার সীটে বসে, ভিটেমাটি আগলায়,
মেতে থাকে শত বছরের আয়োজনে,
গলায় তাবিজ তাগা পরে
কাটায় জীবন।
যখন বলবে তুমি গাঢ় কণ্ঠস্বরে
‘অকস্মাৎ দীর্ণ হবে নিথর মৃত্তিকা,
প্রবল ফুৎকারে ধসে যাবে লক্ষ লক্ষ অট্রালিকা,
কংকাল জীবিতদের কবরে শুইয়ে দেবে খুব
তাড়াহুড়ো করে,
যখন বলবে তুমি
অসংখ্য কবর থেকে মৃতদের উত্থানের কথা,
তেজস্ক্রিয় ভস্মে সমাহিত সব নগরীর কথা,
মানব জাতির দ্রুত পতনের কথা,
রক্ত-হিম-করা
সর্বশেষ সংঘর্ষের কথা,
বেজন্মা, বেনিয়া সভ্যতার নিশ্চিহ্ন হবার কথা,
তখন সে উচ্চারণ কেউ কেউ শুনবে দাঁড়িয়ে
রুটিমাখনের দোকানের ভিড়ে, কেউ
আনকোরা দামি শাড়ি পরখ করার কালে আর
কেউবা আইসক্রীম খেতে খেতে, কেউ সিনেমার
টিকিট কেনার কালে,
কেউবা গণিকালয়ে ঢোকার সময়।
তোমার কম্পিত উচ্চারণে
বস্তুত নগরবাসী দেবে না আমল।
আবছা মনস্কতায় শুনবে, যেমন
শোনে ক্যানভাসারের গৎ-বাঁধা কথা।
যদি দিতে চাও তুমি সত্যতার বিশুদ্ধ প্রমাণ,
তবে সুনিশ্চিত
তোমাকে যেতেই হবে দাউ দাউ
আগুনের মধ্য দিয়ে আর
অলৌকিক নগ্ন পায়ে হেঁটে সাবলীল
পাড়ি দিতে হবে খর নদী।
মাটির দিকেই
দৃশ্য থেকে দৃশ্যে তুমি কী খুঁজছো ইদানীং? নানা
দৃশ্যে চোখ রেখে গাঢ় অত্যন্ত গভীরে যেতে চাও,
গান তুলে নিতে চাও গাছের বাকল, পাথরের
বিষণ্ন স্তব্ধতা থেকে সাবলীল। খুঁজছো কি তুমি
পুরানো কংকাল হরিণের, রাখালের স্বপ্নময়
ছায়া-বিলাসের সাধ? দৃশ্যের ভিতরে পেতে চাও
সেই বাউলকে, যার পদচ্ছাপে পাঠ করা যায়
সহজিয়া ভাবাক্ষর সহজেই? নাকি তুমি আজ
সে পাখির খোঁজে কায়ক্লেশ করছো স্বীকার আর
সেরে নিচ্ছো রুখা সুখা আহার পথের ধারে, যার
চোখে সুদূরতা মায়া আনে, পাখা যার রৌদ্রলোকে,
মেঘের নানান স্তরে উল্লাসের মতো ঝলসিত।
অথচ সে পড়ে আছে মৃত্তিকায়, হতশ্রী, উদাস;
মাটির দিকেই বুঝি ছিল তার বড় বেশি টান।
মানুষ অধিককাল
মানুষ অধিককাল বরাদ্দ জায়গায়
থাকতে পারে না বসে নিত্য এক ঠায়
পিতলের মূর্তির মতোন।
পরিণামে গড়ানে পাথর হয়, জমে না সঞ্চয়
শ্যাওলার; মাঠ নদী বন উপবন
পেরিয়ে সর্বদা তার শুধু মনে হয়
কোথাও যায়নি যেন, কুচকাওয়াজের ভঙ্গিমায়
রয়ে গেছে একই বৃত্তে; দুঃখ তাকে নিজের দিকেই নিয়ে যায়।
কখনো দূরত্ব ডাকে বন্ধুর ভঙ্গিতে;
ব্যাকুলতা বয়
শিরায় শিরায়, গৃহত্যাগ অবিরাম
ফিস্ ফিস্ করে কানে, নিজেরই আলয়
মরুর দোসর হয়ে ওঠে, ফণিমনসার নাম
জপে আসবাবপত্র। কোন্ মরুদ্যান
দেয় হাতছানি, জাগে দূরে বিরল পাখির গান।
অস্থিরতা ব্যেপে এলে অসময়ে থাকে না কিছুই
করবার, স্বপ্নে ভাসে বিদেশ বিভুই
বারবার শিকড়ের টানে
চোখ ছলছল করলেও, মায়ের দুধের স্মৃতি সারাক্ষণ
অন্তর্গত জাতিস্মর শিশুর সত্তার বিয়াবানে
জাগলেও, দেহমন খিদে তেষ্টা ভুলে নির্বাসন
চর্চা করে ঘুমে জাগরণে। স্তব্ধতার
বাহুতে হেলান দিয়ে কেউ কেউ করে পান কালের আঁধার।
আমিও কেবলি জায়গা বদল করতে থাকি, বড়
কষ্ট পাই, দুঃখ জড়ো
হয় ক্রমাগত; একি মানুষের মুদ্রাদোষ, এই ঘরবাড়ি
বদলের গ্লেসিয়ার-স্পৃহা, নাকি
কবিরই স্বভাব এই? অনেক মিলন আর শত ছাড়াছাড়ি
কষ্টের আড়ালে রেখে ডাকি
ভুল করে মনোনীত কাউকএ; অস্থায়ী অন্তরায়
বেজে উঠে পায়ের ওপর দিয়ে নদী বয়ে যায়।
এখন একথা সোজাসুজি
বলে দেয়া ভালো, নিত্য এই খোঁজাখুজি,
ঘোরাঘুরি কখনো সরল পথে কখনো বিপথে, বাঁকা চোরা,
হয়েছে অনেক; একে ঠিক পর্যটন
বলবে কি কায়ক্লেশে কাতর পথিক? এই অন্তহীন ঘোরা
প্রকৃত ভ্রমণ নয়; ভ্রমণের মতো কিছু ভঙ্গী আমরণ
থেকে যাবে স্মৃতিতে আমার। ভাবি, নিয়ত দুঃখের দীর্ঘ খাল
সেচে যদি থিতু হয়ে বসে থাকা যেত কিছুকাল।