চন্দ্রগ্রহণ
বহুদিন ধরে দূর থেকে দেখি আমি
একটি অত্যন্ত তেজী চিতাবাঘ। তাকে
দেখে অসম্ভব
বিমুগ্ধ না-হওয়া। সে নিজের সৌন্দর্যের
গর্বে বড় জ্বলজ্বলে
রাত্রিদিন। কী করে সে গ্রামে ও শহরে
বজায় রেখেছে আধিপত্য, তার কিছু
গল্প শোনা যায় ইতস্তত।
স্প্রিংয়ের মতোন তার পেশী,
ভয়ঙ্কর সুন্দর তাকানো,
বিপদবিহ্বল হরিণের
পেছনে দৌড়ানো,
ইত্যাদি দেখেছি আমি চোখ ভরে এবং শুনেছি
স্তব্ধতা-হননকারী ডাক।
একদিন শহর ভাসিয়ে জ্যোৎস্না ওঠে,
আকাশে সোমথ চাঁদ হাসে বাগদত্তার মতোন
অনাবিল আর দেখলাম
হঠাৎ কোত্থেকে এসে সেই ডাকাবুকো
চিতাবাঘ সে এক এলাহি লাফে ওঠে আসমানে,
তারপর বেমালুম গিলে ফেলে গোল চাঁদটাকে।
চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে এসে
পুনরায় পশু পাখিদের সৌন্দর্য এসেছি দেখে
চড়ুইভাতির ছলে। বেশ কিছুদিন এইমতো
কাছ থেকে ওদের হয়নি দেখা; শুধু ইতস্তত
একটি কি দু’টি পাখি অথবা বানর ব্যতিরেকে
দেখিনি তেমন কিছু, বলা যায়, আশেপাশে আজ
খাঁচার আড়ালে এক সিংহের উজ্জ্বল বিস্ফোরিত
কেশর এবং পার্শ্বস্থিত মাঠে কিছু সচকিত
হরিণের কেমন তাকানো, স্বাভাবিক কারুকাজ
ওদের মসৃণ শরীরের দেখে মুগ্ধ, বিশেষত গরিলা ও
শিম্পাঞ্জীর আচরণে মজা আমি পেয়েছি প্রচুর।
তাদের অমন মুখভঙ্গী দেখে এই শিল্পাতুর
মন, দ্বিধাহীন বলা যায়, যদি স্বীকারোক্তি চাও-
ভেবেছিল হঠাৎ রর্দার ভাবুকের মুখ আর
সে মুহূর্তে বিষণ্নতা করেছিল দখল আমাকে।
ফিরে এসে জামা ছাড়ি, ক্লান্ত মুখ ধুই, এক ফাঁকে
‘রুটস’-এর কিছু প্তা ওল্টাই, চা খাই, অন্ধকার
সাজায় অরণ্য চতুর্দিকে। নিমেষে কত কী ঘটে
আরণ্যক; খুন, রাহাজানি চলে প্রহরে প্রহরে-
পশুকে মানায় হার দ্বিপদী প্রাণীরা এ শহরে।
তবু স্বস্তি মুকুলিত-এখনও মানুষ আছি বটে।
চড়ুইভাতির পাখি
দপ্তরে বসে গুমোট দুপুরে হঠাৎ পড়ল মনে
একদা আমরা ক’জন নিভৃতে কাটিয়েছিলাম চড়ুইভাতির দিন
শালনার শালবনে।
শীত দুপুরের স্বচ্ছ রোদের আদর শরীরে মেখে
কাটিয়েছি বটে আহারে বিহারে; একটি কি দু’টি পাখি
চকিতে গিয়েছে ডেকে।
কেউ বলেছিল কবরী কেমন খোঁপা বাঁধে সিনেমায়,
কেউবা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাল ঊষা উত্থুপ, রুনা লায়লার গান,
কেউ পপ সুরে লেকের কিনারে চমকিলা নেচে যায়।
কেউ সচিত্র পত্রিকা খুলে অলস দৃষ্টি মেলে
দেখে নটীময় ফুরফুরে পাতা, পড়ে উড়ো কথা কিছু;
কেউ বুক থেকে তার জামদানী শাড়ির আঁচল হেসে
ফেলে দেয় অবহেলে।
নক্শি ছায়ায় কাঠবিড়ালিটা বিকেলের মায়া নিয়ে
তরতর করে গাছ বেয়ে ওঠে দেখি।
মাথার ওপর খেলিয়ে সবুজ ঢেউ যায় কত যে সতেজ টিয়ে।
আমি তার মুখ ভেবে আর কবিতার
বিন্যাস খুঁজে ছিলাম একাকী ঘাসে কান পেতে ফলের মতোন শুয়ে।
অলকানন্দা বয়ে যায় পাশে, হৃদয়ে আমার লায়ারের ঝংকার।
এখানে কোথায় হরিণের লাফ, বাঘের জোরালো ডাক?
নিসর্গ খুব শান্ত এখানে, কিন্তু হঠাৎ ভীষণ চমকে শুনি
গুলির শব্দ, দিশাহারা দেখি বনের পাখির ঝাঁক।
আমাদের কেউ টিপেছে ট্রিগার, একটি আহত পাখি
নিরীহ সবুজ ঘাস লাল করে অদূরে লুটিয়ে পড়ে।
ছটফট-করা পাখিটার দিকে সভয়ে তাকিয়ে থাকি।
পাখিটার কাছে ছুটে যায় শিশু, শিকারি দিলেন শিস।
শালবনে গাঢ় ছায়া নেমে আসে, এখন ফেরার পালা।
ছায়ার ভেতর বেজে ওঠে ধ্বনি-‘অ্যাডোনিস, অ্যাডোনিস’।
যাকে আমি খুঁজি সকল সময়, যে আমার ব্যাকুলতা,
তার উপেক্ষা যখন স্মরণে আসে,
তখন আমার মনে পড়ে যায় চড়ুইভাতির আহত পাখির কথা।
জন্মভূমিকেই
শহরে রোজ ট্রাফিক গর্জায়,
চতুর্দিকে চলছে কী হুজুগ;
কত চৈত্র, কত শ্রাবণ যায়,
তোমাকে আমি দেখি না কত যুগ।
অথচ দেখি নিমেষে আজকাল,
একলা ঘরে যখনই চোখ বুঝি।
খাটিয়ে রাঙা কল্পনার পাল
তোমার কাছে গিয়েছি সোজাসুজি।
তোমাকে দেখি তালদীঘির ঘাটে,
শারদ ভোরে দূর বেদাগ নীলে;
তোমাকে দেখি ফসলছাওয়া মাঠে,
চিলেকোঠায়, দূর চলনবিলে।
তোমার চোখ, তোমার কেশভার
ঝলসে ওঠে আমার চোখে শুধু।
কে আশাবরী শোনায় বারবার,
হৃদয়ে জ্বলে স্মৃতির মরু ধূ ধূ।
বৃথাই আমি তোমাকে কাছে চাই;
হিংস্র দিন, স্বৈরাচারী রাত
আমাকে রোজ পুড়িয়ে করে ছাই-
পাই না আর তোমার সাক্ষাৎ।
তোমার কাছে শিখেছিলাম বটে
বাঁচার মানে নতুন করে মেয়ে।
এখন শুনি নানান কথা রটে,
সত্য গেছে মিথ্যাতেই ছেয়ে।
রটনা জানি নেহাৎ একপেশে,
স্বপ্নেও যে তোমার দেখা নেই।
কিন্তু মেয়ে তোমাকে ভালোবেসে
হৃদয়ে চাই জন্মভূমিকেই।
জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা
জানি না তোমার নাম, তুমি রোজ সংবাদপত্রের
পাতায় বুলোতে কিনা চোখ কিম্বা ঝোপ
শার্ট পরে ছিপ হাতে যেতে কিনা পুরানো দিঘির
পাড়ে, আমার তা জানা নেই। সত্যি বলতে কী, ঠিক
তোমার বিষয়ে আমি কোনোদিন কারো কাছে কোনো
কাহিনী শুনিনি। শুধু যখন এদিকে আসি, দেখি
দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি আমাদের অনেক ওপরে-
ক্ষীণকায়, যেন রৌদ্রজলে একটু একটু করে
ক্ষয়ে গেছে ক্রমাগত সমুন্নত শরীর তোমার।
তোমার শপথঋদ্ধ হস্তধৃত বন্দুকের নল
কম্পাসের কাঁটার মতোন দিকচিহ্ন নির্দেশক।
একদা জীবিত ছিলে, বস্তুত এখন মৃত; তবু
কখনো কখনো মনে হয় তোমার পাথুরে বুক
ঘন ঘন স্পন্দিত নিশ্বাসে। হে অজ্ঞাত বীর, শোনো,
তোমার সংগ্রামী স্মৃতি মাছের কাঁটার মতো লেগে
আছে আমাদের বিবেকের শীর্ণ গলায় নিয়ত।