কিছু সামাজিক কিছু বিদগ্ধ
কিছু সামাজিক কিছু বিদগ্ধ ভিড়ে
তোমাকে হঠাৎ দেখলাম, মনে হলো।
পরনে তোমায় ফিরোজা রঙের শাড়ি,
অমন মায়াবী চোখে কি স্বপ্ন ছিল?
সূর্য তখনো ছিল পশ্চিমে হেলে;
কারো হাতে প্লেট, কারো হাতে কোকাকোলা।
দ্রুত সরে যাওয়া তোমার দৃষ্টিপাত
হৃদয়ে আমার দিয়ে গেল কী যে দোলা।
স্নিগ্ধ সে লনে গুঞ্জনে ক্রমাগত
বেড়ে যায় আর কথার ফুলকি ওড়ে।
প্রৌঢ় সুবেশ কূটনীতিকের চোখে
ইতিহাস আর কত স্তনভার ঘোরে।
কেউ ঠোঁটে তার নাচায় নিপুণ ঢঙে
বিশ্বশান্তি, কেউ মানবাধিকার
বিষয়ে ব্যাকুল; কেউ বলে, ‘শুনেছেন,
ওয়ালেসা-জায়া নিলেন পুরস্কার’।
চীনে বয়ে যায় ঈষৎ নতুন হাওয়া,
জাপানকে আজ স্বর্ণমারীচ ডাকে।
কানায় কানায় ভরাট অস্ত্রাগার,
নানা প্রান্তরে হিটলারী-প্রেত হাঁকে!
ম্যানিলা ক্ষুব্ধ প্রমেথিউসের মতো,
দুঃস্বপ্নের চরে ঘোরে মার্কোস।
হায়, রেগানের যাত্রা নাস্তি আর
লেবাননে জ্বলে মেশিনগানের রোষ।
আমি নিশ্চুপ ঘুরি একা, বড় একা;
খুঁজি তোমাকেই, কিন্তু পণ্ডশ্রম।
কোথায় লুকালে? তুমি কি বাস্তবিকই
এসেছো এখানে? এ-ও কি দৃষ্টিভ্রম?
হয়তো দেখিনি তোমাকে মিশ্র ভিড়ে,
স্বরচিত এক মরীচিকা নিয়ে আছি।
পলকে পলকে পাল্টায় একই পট,
পিশাচীর চোখে চোখ রেখে আমি বাঁচি।
খাঁ খাঁ দীপাধার
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, তারই মধ্যে দলছাড়া এক
অচিন হংস বেড়ায় সাঁতার কেটে।
ঘরদুয়ারে নিবিয়ে বাতি, খাঁচার ভিতর জবা নিয়ে
ঈশান কোণে লালন গেলেন হেঁটে।
একতারাটি শূন্যে বাজে দীন দরদী সাইয়ের খোঁজে
অষ্টপ্রহর আরশি নগর জুড়ে।
আমি তাকে খুঁজি না আর বনবাদাড়ে, শীশমহলে;
থাকুন তিনি লক্ষ যোজন দূরে।
খরদুপুরে কোথায় আমি অন্ন পাবো? কোথায় পাবো
চৈত্রপোড়া আঁজলাভরা পানি?
সময় যে নেই, বিহান ত্বরায় গড়ায় নিশুত রাতের অমায়,
হাটবাজারে টানি নাছোড় ঘানি।
লালন শাহের হৃদয়জোড়া পদ্ম ছিল বিশ্বাসেরই
আভায় মোড়া, পড়শি ছিল তাঁর।
নিজস্ব সংকটে আমি সংশয়ী আর ভীষণ একা,
যেন শূন্য খাঁ খাঁ দীপাধার।
গ্রিক ট্যাজডির নায়কের মতো
তোমার সঙ্গে হয়েছিল দেখা ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে।
নদীতীরে নয়, বাগানেও নয়, পার্কে নয়,
হয়েছিল দেখা খোলা রাস্তায় দীপ্র ভিড়ে।
যদিও তোমাকে নিশ্চিত আমি দেখিনি আগে,
তবু মনে হয়, ছিল পরিচয় অনাদিকালে।
হয়তো আমরা ছিলাম গুহায় বাকলাবৃত।
এখন আবার জন্মান্তরে দাঁড়াই এসে
আমরা দু’জন পাশাপাশি এই শান-বাঁধানো
কোলাহলময় পথের প্রান্তে মিশ্র ভিড়ে।
শাড়ির আঁচল উড়ছে হাওয়ায়, শিথিল খোঁপা;
স্বেদকণা জমে নাকের ডগায়, কর্ণমূলে।
তোমার কণ্ঠে হয় বাঙ্ময় দিনদুপুর।
সেদিন দুপুরে তোমার দু’চোখে দেখেছিলাম
এলদেরাদোর ঈষৎ আভাস, অতুলনীয়।
শরীর তোমার নিমগ্ন এক গুণীর তান।
প্রথম দেখায় তোমাকে কি ভালো বেসেছিলাম?
হাজার কণ্ঠে মিশেছিল বটে তোমার গলা,
সে গলায় শুনি অলকানন্দা নদীর সুর।
তুমি মনোযোগী ছিলে না তখন আমার প্রতি,
অথচ ছিলাম সকল সময় তোমারই পাশে।
হৃদয়ে আমার ফুটেছিল শত স্বর্ণচাঁপা।
স্বর্ণচাঁপার আভা ছিল নাকি তোমার চোখে?
পথ চলি ভরা রোদ্দুরে আর ইতিহাসের
কাঁসর ঘণ্টা আমরা প্রবল নাড়িয়ে দিই।
হায় দুপুরেই কেমন কুটিল সন্ধ্যা নামে।
পাশা খেলা শেষ, শুরু হলো বুঝি বনপর্ব,
আড়ালে নিষাদ শানাচ্ছে খুব তীরের ফলা।
জোনাকির মতো স্বপ্ন আমার ব্যাপক, ক্রূর
ষড়যন্ত্রের আলখাল্লায় গিয়েছে ঢেকে-
আমরা দু’জন দু’দিকে ছিটকে পড়েছি আজ।
নিচ্ছে বিদায় চোখ কান আর কণ্ঠস্বর;
যায় সব যাক, অন্তত এই পোড়া জীবনে
গ্রিক ট্রাজেডির নায়কের মতো মহিমা থাক।
চকিতে সুন্দর জাগে
প্রস্তুতি ছিল না কিছু, অকস্মাৎ মগজের স্তরে
স্তরে মেঘমালা,
বিদ্যুতের স্পন্দমান শেকড় বাকড়-
অনন্তর সে এল, কবিতা,
আমাকে আচ্ছন্ন করে তার চুলে, অসিত শিখার মতো চুলে
আমাকে বদলে দিয়ে বৈপ্লবিক ভাবে।
মাঝে-মধ্যে ভাবি, আজো ভাবি
এ কেমন দাবি নিয়ে এল
অত্যন্ত রহস্যময়ী চঞ্চলা প্রতিমা?
এখনও তাকেই ভাবি যে আসে হঠাৎ
অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো মনের নিঃসীম বিরানায়, পুনরায়
চকিতে মিলিয়ে যায়।
কবিতাকে খুব কাছে পেতে চেয়ে কখনো কখনো
কবিতার কাছ থেকে দূরে চলে যাই।
কবিতাকে ভালোবাসি বলে পদ্মকেশরের
উৎসব হৃদয়ে উদ্ভাসিত। কবিতার
প্রতি ভালোবাসা ডেকে আনে ভালোবাসা
হতশ্রী জীবনে, খরাদগ্ধ অবেলায় ঢালে জল,
যেমন মৃন্ময়ী চণ্ডালিকা
আনন্দের আঁজলায়। কবিতাকে ভালোবাসি বলে
অন্তর্গত ভস্মরাশি থেকে
চকিতে সুন্দর জাগে অমর্ত্য কণ্ঠের পাখি, যাকে
আত্তার অথবা রুমি আত্মা বলতেন।
চতুর্থ ভাষা
আমরা দু’জন
বৌদ্ধ বিহারের কাছে হল্দে পাতাময় পথে দাঁড়িয়ে ছিলাম
কিছুক্ষণ।
হৃদয় আবৃত্তি করে বারবার ভিনদেশী নাম
তোমার এবং মৃদু কথোপথনে
আগ্রহী আমরা বলি কিছু ঝাপসা, গুঁড়ি গুঁড়ি কথা।
জানি না এখানে আজ এসেছি কিসের অন্বেষণে
নিজস্ব অস্তিত্বে নিয়ে গূঢ় ব্যাকুলতা।
যে-ভাষায় স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর গীতাঞ্জলি
যোগাযোগ, গোরা, নষ্ট নীড়
আমি সে-ভাষায় কথা বলি।
যে-ভাষা সহজে তোলে মীড়
আজন্ম তোমার প্রাণে, সে-ভাষায় ঋদ্ধ কাওয়াবাতা
তুষারে ফুটিয়েছেন ফুল। অথচ আমরা কেউ কারো
ভাষায় বলিনি কথা অজ্ঞতাবশত। ঝরা পাতা
গান হয় পায়ের তলায় আর তৃতীয় ভাষায় কিছু গাঢ়
কথা বলি পরস্পর, আধো-বাধো, মানে
ইয়েটস-এর ভাষা তোমার আমার ঠোঁটে
গুঞ্জরিত হয়, দু’টি প্রাণে
বাড়ে মূক ব্যাকুলতা, যেন মন্দিরের গায়ে বয় হাওয়া, ফোটে
সহসা চতুর্থ ভাষা যুগল সত্তায়,
সে-ভাষা চোখের আর স্পর্শাভিলীষী হাতের। তুমি
আর আমি স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাষাময় ভাষাহীনতায়
তন্ময় সাঁতার কাটি, খুঁজি যুগ্মতার জন্মভূমি।