- বইয়ের নামঃ যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার মননে
ফেরানো যাবে না; তুমি চলে যাবে আমাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে
সম্পর্কের ঝালরকে তীব্র তুড়ি মেরে।
আমার হৃদয়ে ছিলে, ছিলে
আমার চিন্তার তন্তুজালে, বোধের স্পন্দিত নীলে।
তুমি যার সঙ্গে যাবে, তার
পরনে সুনীল ডিস্কো শার্ট, জিনস্-এর ট্রাউজার,
চোখে গোল রঙিন চশমা, মুখে বুলি
হরেক রকম; একালের রলরোলে নাচে তার পেশীগুলি।
তোমার শরীরে তারা ফোটে ক্ষণে ক্ষণে
অন্তর্গত শিহরণে। আজ আমি যৌবনের অস্তগত প্রহরে মননে
পাই খুঁজে নক্ষত্রের রূপালি স্পন্দন।
মন আজো রয়ে গেছে মাছ-গাঁথা ছিপের মতোন।
যদি বলি, সব নৌকা নিমেষে পুড়িয়ে
এসেছি তোমার কাছে, আঁচল উড়িয়ে
দুরন্ত হাওয়ায় তুমি যেও না আমার যন্ত্রণার
লবণাক্ত সৈকতের থেকে দূরে, তাহলে তোমার অন্ধকার
উঠবে কি কেঁপে নবজাত নক্ষত্রের অকূল তৃষ্ণায়?
তুমি কি আমার অস্তিত্বের কিনারায়
থাকবে দাঁড়িয়ে অতীতের কোনো ভাস্কর্যের মতো?
দেবে কি উত্তর অসং কোচে? নাকি নেবে মৌনব্রত?
তোমার সম্ভ্রম আমি করবো না ক্ষুণ্ন কোনোদিন।
এতদিনে জেনে গেছি যুবক যুবতী হয় লীন
যুগ্মতায় আনন্দ তরঙ্গে বারবার; উৎফুল্ল নবীন ত্বক
প্রবীণ ত্বকের স্পর্শ চায় না সচরাচর। কখনো নিছক
কৌতূহলবশত নিকটে আসে, ফেরে সরে যায়,
যেমন তরুণী মাছ জলের উপরিভাগে এসে চমকায়
ক্ষণকাল, পুনরায় দেয় ডুব অত্যন্ত গহনে।
তোমার শরীরী আভা, হোক তা চঞ্চল, থাকে আমার মননে।
আসা যাওয়া
অসময়ে কোকিলের গানের মতোন
বেজে ওঠে টেলিফোন।
‘কাল যাচ্ছে, এসো তুমি সন্ধ্যেবেলা,’ বলে
জুড়ে দিলে আরো কিছু কথা অকৌশলে।
‘আসবো নিশ্চয়,’ বলি
মেলে দিয়ে তোমার সত্তায় দিকে স্বপ্নের অঞ্জলি-
‘কটায় তোমার ট্রেন?’
‘চিঠি দিও,’
বললে তুমি জ্যোৎস্না চমকিত রমণীয়
কণ্ঠস্বরে। কিছু পরে রিসিভারে ছড়িয়ে সন্ন্যাস
কেমন নিশ্চুপ হলে। ভাবছি, তোমার
এবং আমার এই অবিরত আসা-যাওয়া, তার
মধ্যে স্বপ্নাবেশে গাইছেন
কী প্রার্থনা অন্ধ সুরদাস!
এই আশ্বিনে
এই আশ্বিনে বারান্দাটায় পড়ছি বসে
হালফ্যাশনের দিলতড়পানো উপন্যাস।
হাওয়ার চুমোয় গাছের পাতারা যাচ্ছে খসে
হৃদয়ে আমার হঠাৎ ফোঁপায় হলদে ঘাস।
কখনো ঢুলুনি ব্যেপে আসে খুব, কখনো বই
বুকে রেখে ছুটি অতীতের ধুধু তেপান্তরে।
কখনো অমল কখনো কিশোর ডেভিড হই,
তন্দ্রা ফলায় বিষাদ আমার প্রৌঢ় স্বরে।
ট্রাফিকের খর কলরবে ফের চমকে উঠি,
পথিপার্শ্বের আদল কেমন অচেনা লাগে।
দু’চোখে ঘনায় অতীতের কিছু শ্বেত পিঁচুটি,
সত্তা আমার স্নাত অবেলায় অস্তরাগে।
জীবন এখন, বলা যেতে পারে, হতচেতন;
খবর কাগজে গল্পগুজবে সীমিত প্রায়।
নিউরসিসের পাকে আবদ্ধ ক্লান্ত মন
এবং নিয়ত আমাকে ভাবায় কন্যাদায়।
পেনসনহীন জীবন গোঙায় রাত্রিদিন;
ট্যাঁকে কুলোয় না, আশরাফি ঠাঁট আছে বজায়।
দরবারী বাজে মেদমজ্জায় বিরামহীন,
মানসম্ভ্রম আস্তে সুস্থে অস্ত যায়।
দৌহিত্রের লাল বল এসে গড়ায় পায়ে;
গৃহিণী কিচেনে, ছেলেটা ক্যাসেট প্লেয়ারে শোনে
ডোনা সামারের গান আর চলে ক্রমশ বাঁয়ে।
ওর উদ্যমে হৃদয় আমার স্বপ্ন বোনে।
এই আশ্বিনে মনে পড়ে যায় মজেছিলাম
আমিও একদা কারো চঞ্চল চোখের নীলে।
একদা জপেছি প্রহরে প্রহরে একটি নাম,
সাজিয়েছি তাকে আবেগ-ঋদ্ধ ছন্দে মিলে।
জানি সে দয়িতা আজকে আমাকে রাখেনি মনে;
অভিযোগহীন বসে আছি আশি ভীষণ একা।
চিরদিন কেউ করে না ভ্রমণ বৃন্দাবনে,
মেঘের ঘষায় মুছে বায় ক্রমে চন্দ্রলেখা।
তা বলে আমার উদ্বেগ নেই, এমন নয়;
তাইতো আজকে আমার হৃদয়ে গোধূলিবেলা
তার পদপাতে হয়েছে ব্যাপক হিরন্ময়,
অবচেতনের জলে ভাসে এক বিবাগী ভেলা।
স্বরচিত ঘোর কেটে যায় দেখি অকস্মাৎ
দূরবর্তী সে মিছিলের রোলে নাড়ির গতি
বাড়ে ক্রমাগত, হায়রে আমার পক্ষপাত
এখনো অটুট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি।
কবন্ধ এই সমাজ এখন শ্মশানবাসী,
আমিও এখানে দশের মতোই ওড়াই ছাই,
বাজলো কি আজ ইস্রাফিলের ভীষণ বাঁশি?
প্রস্পেরো তার কেতাব ডোবায়। কোথায় যাই?
একটি কফিন ছুয়ে
নিঝুম দুপুরবেলা একটি কফিন ছুঁয়ে আমি সরে যাই
অনেকের চোখের আড়ালে।
কব্জির ঘড়িতে দেখি আড়াইটা বাজে। শুকনো ডালে
গাঢ় নীল পাখি ডেকে ওঠে, যাকে চাই
সে নেই কোথাও কাছে, তবু মনে হয়
দুপুরের অগাধ রোদ্দুরে মিশে আছে,
মিশে আছে বুনো জ্যোৎস্নাপ্লুত মাঠে সকল সময়।
যেখানে কফিন স্তব্ধ বাগানের ক্ষয়া চারাগাছটির কাছে,
সেখানে অনেক মুখ কী যেন খুঁজছে সারা বেলা,
শূন্যতার নির্মোহ নিবাসে
কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য কাহিনীর বিস্তারিত খেলা
দেখে নিতে চায় ক্লান্ত দুপুরের তন্দ্রাশ্রিত স্বপ্নের আভাসে।
আড়াইটা বাজে, বেজে যায়। একটি কফিন ছুঁয়ে দূরে
কোথাও আড়ালে ছায়াপ্রায়
হয়ে যাই, দুপুরের রঙময় কুকুরটা বারান্দায় গভীর নিদ্রায়
কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। কেউ কেউ যায় অন্তপুরে,
কেউবা বিদায় নেয় আস্তেসুস্থে হাত ঝাঁকুনিতে।
একটি গোলাপি স্যুটকেশ পড়ে আছে এক কোণে, সবখানে
কান্নার ব্যাপক দাগ, প্লেট, চামচ, চায়ের কাপ কুলুঙ্গিতে
পোহায় বিশ্রাম, কোকিলের অন্তর্ধানে
অকালে উজাড় হলো যত্নের বাগান। দূর পথে
কে যেন বাজায় বাঁশি, সুরে অসমাপ্ত গল্প বাজে,
দোলে শূন্য খাঁচা দোলে জগৎ সংসার, কোনোমতে
সামনে সুমলে নিয়ে নিজেকে জড়াই তুচ্ছ কাজে!
একটি কফিন ছুয়ে নির্বোধের মতো মনে-মনে অনর্থক
আওড়াই কিছু কথা আর
খামকা ঘড়িটা দেখি ঝাপসা চোখে, চোখের পাতার
বিবাগী কম্পনে বেদনার তুহিন স্ফুলিঙ্গ ধ্বক
ধ্বক করে; বেলা আড়াইটা ঘরে, বাগানে, উঠোনে
বেদনার মতো স্তব্ধ, অদৃশ্য কাউকে বলি, ‘আসি
তাহলে আসি হে বন্ধু, আবার আসবো’। অন্ধকার গৃহকোণে
আরাম কেদারা গায় শূন্যতার বিশদ বেহাগ। অট্রহাসি
জেগে ওঠে বাড়িটার অন্তঃস্থল থেকে। সত্যি কি আসবো ফের?
গেট খুলে দাঁড়াবো এখানে ক্ষণকাল?
পাবো কি আবার খেই সেই অসমাপ্ত সংলাপের?
গেট খুলি; বাইরে বিস্তৃত পথ, প্রতারক ব্যস্ততার জাল।