Site icon BnBoi.Com

মেঘলোকে মনোজ নিবাস – শামসুর রাহমান

মেঘলোকে মনোজ নিবাস - শামসুর রাহমান

অলৌকিক আসর

এই যে আমি পথ হাঁটছি দিনের পর দিন, শহরের ধুলোবালি
মাখছি শরীরে হামেশা, বুকে টেনে নিচ্ছি বিষের ধোঁয়া,
দাবদাহের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি-এর পরিণতি কী শেষ তক?
কখনও কখনও ক্লান্তির প্রহরে এই প্রশ্ন আমাকে কামড়ে ধরে।
কামড়ের জ্বালা ভুলে থাকার জন্যে চোখ মেলে দিই ঘরের
জানলার বাইরে। এই সামান্য ছোট ঘর, লেখার টেবিল, চেয়ার,
খাট আর বেশ কিছু বই নিয়ে আমার এক নিজস্ব জগৎ। নাছোড়
প্রয়োজন কিংবা মোহন কোনও সাধ ছাড়া এখান থেকে অন্য কোথাও
পা বাড়াই না সহজে। চার দেয়ালের ভেতর নিজের মনের সঙ্গে
বিরতিহীন এক খেলায় আমি মশগুল। এই খেলার রৌদ্র জ্যোৎস্নাময়
পথেই নিত্য তোমার আসা যাওয়া। বুঝি তাই আমার হৃদয়ে আজও
বসন্ত ঝরায় পুষ্পবৃষ্টি। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমের গুহায়
নিশ্চেতন, এ ঘরে বসে যায় প্রজাপতি, ফড়িং, জোনাকি, গাঙচিল,
ডাহুক, দোয়েল, পাপিয়া আর লাল নীল পদ্মের আসর। ছেঁউড়িয়ার
একতারা আর শান্তিনিকেতনের এস্রাজ হয় সঙ্গীতময়। রবীন্দ্রনাথ সেই
আসরে গ্যেয়টেকে হাত ধরে নিয়ে আসেন, নজরুল ইসলাম মনোহর
বাবরি দুলিয়ে নাচ জুড়ে দেন শ্যামা সঙ্গীতের তালে তালে পাবলো
নেরুদা আর মায়াকোভস্কির সঙ্গে। রুক্ষ, রোদেপোড়া ভ্যানগগ এক উন্মাতাল ঘোরে
ক্যানভাসে তোলেন তুলি এবং রঙের ঝড়। আমার সৌভাগ্যে ঝলমলে
আমি দেখি চোখ ভরে, শুনি অলৌকিক কলতান। তুমি দাঁড়িয়ে
আছো এক কোণে আমার হাতে ঘনিষ্ঠ, মদির, দ্যুতিময় হাত রেখে।
১১.৭.৯৭

 অ্যাকোরিয়াম, কয়েকটি মুখ

সকালটা ছিল যে-কোনও সকালেরই মতো। টাটকা মাখন রঙের রোদ,
ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের গাঢ় সবুজ পাতার স্পন্দন, উঠোনে একটি কি দু’টি
ছোট পাখির ওড়াউড়ি, আমার ঘরকে চড়ুইয়ের নিজস্ব আকাশ বলে ঠাউরে
নেওয়া, দোতলার রেলিঙে শাড়ি, বাকরখানির ঘ্রাণ, রেডিওর গান, চা-খানার
গুঞ্জন, রিকশার টাং টাং শব্দ। আমার বেডসাইড টেবিলে ধূমায়িত চায়ের বাটি,
কাচের চুড়ির আনন্দ-ভৈরবী। কী যেন মনে পড়ছিল আমার, বহুদিন আগে যে
জায়গায় গিয়েছিলাম সেই জায়গার কিছু দৃশ্য, কোনও কোনও মুখ।
জায়গাটার নাম মনে পড়ছে না; কবে গিয়েছিলাম, তা-ও ঠিক মনে নেই।
বারবার মনে পড়ছে একটা বাগানের কথা, রঙ বেরঙের ফুলে সাজানো
মধ্যবিত্ত বাগান। বাগানে কি কেউ ছিল?

ওরা চলেছে আল বেয়ে, ক্লান্তি পায়ে; ছায়ার মতো এগোচ্ছে ওরা শ্লথ গতিতে?
ওরা কারা? ওদের কি আমি চিনি? একজন বসে বসে ধুঁকছে, আঁকড়ে ধরেছে
আলের ভেজা মাটি। নোংরা নোখের ভেতর উঠে এসেছে কিছু মাটি, ওর চোখ
ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে চোখে ভবিষ্যতের কোনও ছবি ছিল না, বাগানের
রঙিন স্তব্ধতা ছিল না, ছিল না ঝর্ণার পানির স্বচ্ছতা। সবার আগে যে হাঁটছিল,
সে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ওর দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে সকাল বেলার রোদ,
পাখির ডানায় ঝলসানি, ময়ূরের আনন্দিত পেখম। ওর ভবিষ্যতের ভাবনায়
রোদ ছিল না, মেঘের আনাগোনা ছিল। যে মেয়েটি ছেলে কাঁখে হাঁটছিল, ওর
একটা চুড়ি ভেঙে গেল হঠাৎ, টুকরোগুলো পড়ে রইল আলের এক পাশে।
মেয়েটির মনের ভেতর ওর ছেলের কান্নার দাগের মতো একটা দাগ খুব গাঢ়
হয়ে রয়েছে। ভাঙা বাবুই পাখির বাসার মতো তার সংসার অনেক দূরে
সমাহিত। উনুনের মুখ গহ্বর থেকে আর ধোঁয়া ওঠে না পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে,
‘গেরস্থের খোকা হোল’ বলে যে পাখি মাঝে-মধ্যে ডেকে যায়, সে হয়তো
বিধ্বস্ত ভিটের লাগোয়া গাছের ডালে এসে বসবে, কিন্তু দেখবে ত্রিসীমানায়
গেরস্থ নেই।

সকালটা ছিল যে-কোনও সকালেরই মতো। টাটকা মাখন রঙের রোদ,
ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের গাঢ় সবুজ পাতা স্পন্দন উঠোনে একটি কি দু’টি
পাখির ওড়াউড়ি। সকাল বেলা মধ্যরাতে রূপান্তরিত হয়ে এক লহমায়।
টেলিফোনে কার কণ্ঠস্বর? নিদ্রা-প্রভাবিত, স্বপ্ন-নির্ভর কণ্ঠস্বর। কিছুতেই
শনাক্ত করা যাচ্ছে না। আমি কি দরবারী কানাড়া শুনছি? সেই কণ্ঠস্বরে
নিঃসঙ্গতা, উদ্বেগ আর বিষণ্নতার অর্কেস্ট্রা। সেই কণ্ঠস্বর আমাকে পর্যটক
বানায়; আমি পাকদণ্ডী বেয়ে পাহাড়ে উঠি, জাহাজে চড়ে সাত সমুদ্র তের নদী
পাড়ি দিই, প্লেনে যাত্রা করি পূর্ব গোলার্ধ থেকে পশ্চিম গোলার্ধে, মরুভূমির
বালিয়াড়িতে সূর্যের চুম্বনে আমার ত্বক ঝলসে যায়, উত্তর মেরুর তুষার-
কামড়ে আমি জ্বরাক্রান্ত রোগীর মতো প্রলাপ বকি। সেই কণ্ঠস্বর বন্দি করে
আমাকে, আমার হাতে পরিয়ে দেয় ক্রীতদাসের কড়া। আমি কি প্রকৃত চিনি
তাকে?

তাকে চিনি, একাল বেলার আকাশকে যেমন চিনি, কিংবা যেমন চিনি সন্ধ্যার
মেঘমালাকে-একথা বলার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারি না কিছুতেই। যদি
আমার ভুল হয়ে যায়! ভুল করবার অধিকার আমার আছে জেনেও আমি
নিজেকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখি। একটা পরাক্রান্ত হেঁয়ালিকে আমি
একনায়কত্ব ফলাতে দিই স্বেচ্ছায়। হেঁয়ালি মাকড়সার মতো জাল বুনতে
থাকে আমার চারপাশে, আমি জালবন্দি হই। মাঝে-মধ্যে চকচকে ছুরির মতো
ঝলসে ওঠে একটা ইচ্ছা-হেঁয়ালির অস্পষ্ট ঝালর সমাচ্ছন্ন টুঁটি আমি চেপে
ধরবে একদিন, যেমন ওথেলোর প্রবল কালো দু’টি হাত চেপে ধরেছিল
ডেসডেমোনার স্বপ্ন-শুভ্র গলা।

আমি কি ভুল উপমার ফাঁদে পা দিলাম? আলোয় স্নান করতে গিয়ে কি অন্ধকার
মেখে নিলাম সমগ্র সত্তায়? আমার ভ্রূতে এখন স্বপ্নভুক, ক্রুদ্ধ একটা পাখি
ডানা ঝাপটাচ্ছে ক্রমাগত, আমার আঙুল থেকে উৎসারিত ফোয়ারা উদ্‌গীরণ
করছে আগুনের হলকা। আস্তে সুস্থে মৃতের বাগানে প্রবেশ করছি আমি; জানি
সেখানে কাউকে দেখতে পাব না, শুধু কারও কারও অনুপস্থিত উপস্থিতি নিস্তব্ধ
রাগিণীর মতো বেজে উঠবে হাওয়ায়, আমার শিরায়। পা ভারী হয়ে আসবে,
বিস্ফারিত হবে চোখ। কথা আমি কম বলি, যেটুকু বলি গলার পর্দা নিচু
রেখেই বলি। কিছু ছায়াকে দোসর ভেবে ওদের সঙ্গে কথা বললাম। মনে
হলো, অন্ধকার রাত্রির ফসফরাসময় তরঙ্গের মতো বয়ে গেল বহু যুগ।

এইতো আমি এসে পড়েছি বিরাট এক অ্যাকোরিয়ামের কাছে। অনেক রঙিন
মাছ কেলিপরায়ণ সেখানে। কেউ সাঁতার কাটছে উদ্ভিদ ঘেঁষে, কেউবা ক্ষুধে
পিছল বল্লমের মতো ছুটে চলেছে নুড়ির দিকে। অ্যাকোরিয়ামের ভেতর মাছ
কি কুমারী থাকতে পারে কখনও? মাছগুলো আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে চায়
ওদের মৎস্যবৃত্তান্ত। ওদের অন্তর্জীবন পরতে পরতে যাতে যাতে মেলে ধরতে
পারি, সেজন্যে ওদের শরীর থেকে ওরা বিচ্ছুরিত হতে দিচ্ছে রহস্যময় সুর।
ওদের সন্ধ্যাভাষার দীক্ষিত করতে চাইছে আমাকে।
আমি লিখতে পারি, আমার কলমে অলৌকিকের ঈষৎ ঝলক আছে-একথা
ওদের বলে দিল কে? মাছগুলোর চোখ আমার দিকে? বিব্রত বোধ করলাম
আমি। আমি কি সেই কুহকিনীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে চলেছি, যার চোখ
ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল আর চুল সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো সবুজ? আমি কি
লিখতে পারব নতুন এক মৎস্য পুরাণ? ইতোমধ্যে একটি সোনালি মাছকে
আমি স্বৈরিতায় বলে শনাক্ত করেছি। না কি অ্যাকোরিয়ামের প্রতিটি স্ত্রী মাছই
স্বৈরিতায় নিপুণা আর প্রত্যেকটি পুরুষ মাছ অজাচারে পারঙ্গম? মাছগুলোর
জলকেলি দু’ চোখ ভরে দেখি, ওরা আমার ভেতর প্রবেশ করে সূর্যরশ্মির মতো,
আমি অ্যাকোরিয়ামের পাতালে চলে যাই, মাছ হই।

এখানেই শেষ হতে পারত এই কথাগুচ্ছ, নামতে পারত এক বিবাগী নীরবতা।
অথচ বাবুই পাখির ভাঙা বাসার মতো একটি সংসার, ধুঁকতে-থাকা একজন
বৃদ্ধ, হারিয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে প্রায়-উন্মাদিনী মা আমার ভাবনাকে
ভবঘুরে করে। একটা আচাভুয়া পাখি ডাকতে থাকে আমার বুকের সান্নাটায়।
সেই ডাক আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণের জন্যে। আমার ঘুম আর
জাগরণের মধ্যে আছে যে বিরানা প্রান্তর, তার সুদূরতা আমাকে বলে ‘বাঁচো,
তুমি বাঁচো।

আমাদের ভালোবাসায় সন্তান

ক’দিন একটানা আঁধিঝড়ের পর, পাখির নীড়-পোড়ানো
দহনে হৃদয় ঝলসে যাওয়ার পর আষাঢ়ের ঘন মেঘ নামে
আমার অন্তর ছেয়ে। তোমার হৃদয়-কূলের উদ্দেশে জোয়ারে
ভাসিয়েছিলাম যে-তরী তার চোখে কি তুমি আমার অথই
ব্যাকুলতা পাঠ করতে পেরেছিলে? সে-চোখের ভাষা
অস্পষ্ট দেখলে তুমি তোমার অন্তরের পুশিদা পাখিটিকে
জিগ্যেশ করে নিলেই পারতে। আমি তো রবীন্দ্রনাথের গান,
বিটোভেনের সিস্ফনি, স্বর্ণচূড়ার রঙ, ভ্যান-গগের ছবি,
সন্ধ্যার পাখির উড়ে-যাওয়া, মায় ঘাসের শিশিরে কী সহজে
তোমার বার্তা পেয়ে যাই। যা-কিছু সুন্দর তাতেই দেখতে
পাই তোমাকে। আহ্‌, কী চোখ-জুড়ানো রূপ।

আষাঢ়ের প্রায় সন্ধ্যাপ্রতিম মন-কেমন-করা দুপুর।
বিছানায় শুয়ে পড়ছিলাম হাল আমলের কবিতার
বই; আমাকে খানিক চমকে দিয়ে টেলিফোনে বেজে
উঠল। ‘ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম নাকি’, তোমার কণ্ঠস্বর।
‘মোটেই না, আমি তো জেগেই আছি। ‘তবু অসময়ে
টেলিফোন করে ফেললাম বলে দুঃখিত। কেমন অস্থির
লাগছিল, তাই…,’ তুমি বললে কণ্ঠে ঝর্ণাধারা বইয়ে
দিয়ে। কী-যে বলছ তুমি, আমার সকল সময় তোমাকেই
অর্পণ করেছি। তোমার জন্যে আমার কোনও বেলাই
নয়, অবেলা, আমার স্মিত উত্তর। তুমি বললে, ‘তোমাকে
আমার মতো করে চাইছিলাম এই লগ্নে, তোমার কথা
আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিল নিমেষে। আমার অস্থিরতা
মিলিয়ে গেছে আষাঢ়ী মেঘে। এখন তুমি বিশ্রাম করো
কবি; ইচ্ছে হলে বই পড়ো কিংবা কবিতা লেখো; পরে
কথা হবে।
আমি চাই তুমি আমাকে জাগিয়ে তোলো সবসময়। পথ চলতে
যখন জড়িয়ে আসে আমার চোখের পাতা তখন তোমার কণ্ঠস্বর ক্লান্তিপ্রসৃত
জড়তা-কুয়াশা ছিঁড়ে ফেলুক। তোমার ডাক আমাকে ফিরিয়ে
আনুক ভুলভ্রান্তির চোরাটান থেকে, আমি চাই। চাই তোমার
কথার সেই মোহন স্পর্শ, যা গাইবে জাগরণী গান। একদিন তো
এমন আসবে, যখন আমার সত্তা জুড়ে নামবে রক্ত-জমানো
বরফের পানিভেজা হিমশীতল কালো চাদরের মতো এক দুর্ভেদ্য
নিদ্রা। হায়, সেই ঘুমপাথর তোমার অমন মধুর কণ্ঠস্বরের
আলোড়নেও নড়বে না কিছুতেই।

আপাতত যাক সেদিনের কথা; এখন সে-কথার বিষপিঁপড়ে
তোমার অন্তরে ছড়িয়ে বিরূপতার কর্কশকাচে মুখ ঘষে রক্তাক্ত
হতে চাই না। আমাদের ভালোবাসার সন্তান এক ফুটফুটে স্বপ্ন, যে
কখনও রোদে, কখনও জ্যোৎস্নায় খেলছে, এখন এটাই হোক প্রিয় ভাবনা।
২৭.৬.৯৭

আমার অসমাপ্ত কবিতা

আকাশের কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ পাড়ার নার্সারির কচি ঘাস
চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের চোখে তৃপ্তির কুয়াশা আর গোলাপগুলি
ঈষৎ লাজনম্র আর ভয়কাতর। এখানে তোমার দৃষ্টি পড়েনি ক’দিন।
আকাশ থেকে এক অতিকায় পাখি এসে নামলে, তুমি তার জঠর থেকে
বেরিয়ে আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে। মনের চোখে দেখব তোমাকে।
তুমি কি এলে বহু যুগের স্মৃতি জড়িয়ে তোমার সত্তায়? তোমার চোখে যেন
সুদূরতার ছায়ানিঝুম আত্মপ্রকাশ। জানলার শার্সি ধরে সেই কবে থেকে
দাঁড়িয়ে আছি। ঘণ্টা দেড়েক আগে বৃষ্টি এক পশলা চুমো ঝরিয়ে
গেছে আশেপাশে দরদালানে, গলিতে, নার্সারিতে। কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ,
যেগুলি চরছিল নার্সারিতে, চিবোচ্ছিল কচি ঘাস, এখন উধাও। তুমি তোমার
ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছ মধ্যরাত্রির শয্যায়। আমার বাসনাগুলি পুরুষ
মৌমাছি হয়ে উঠছে তোমার ক্লান্ত যৌবনের মৌচাক ঘিরে, তুমি না
জেনেই ঘুমিয়ে পড়বে।

এখন আমার অসমাপ্ত কবিতা তোমাকে ভাবছে কয়েকটি সড়ক, বইয়ের
দোকান, ট্রাফিক-লাইট, মসজিদ, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান
আর সিনেমা হলের ওপার থেকে। আমার অসমাপ্ত কবিতার রঙিন মাছগুলি
ডুবসাঁতার দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তোমার মেহগলি কাঠের খাটের কিনারে
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোমল নিদ্রায় তোমার শরীর অন্যায়বিহীন আর
কী নির্মল। অন্য কোনও পুরুষের স্পর্শের কালো কখনও তোমার শরীরে
ছড়িয়েছে কি না, এ নিয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা এখন তেমন ভাবিত নয়।
সে এখন গাঢ় অনুরাগে এই নিঝুম প্রহরে তোমার অধরে, গালে, স্তনযুগলে
আর নাভিমূলে মন্দিরে পুরোহিতের মতো প্রসাদ-রেণু ছিটিয়ে দিচ্ছে অবিরল।
রাত্রির টাইম-পিসে এই মুহূর্তে কটা বাজে, খেয়াল নেই। তোমার ঘুম, একটি
রাতজাগা পাখি, হাওয়ো-মাতাল গাছ, জনহীন গলি, এতিমখানার অন্ধ নীরবতা
আমার মধ্যে কী এক অস্থিরতা ডেকে আনে। অন্ধকারের আড়ালে ঢাকা-পড়া
নক্ষত্র আর ভাসমান মেঘের গলা জড়িয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা গন্তব্যের
প্রায় সীমান্তে পৌঁছে যায়। দ্রুত হতে থাকে বুকের স্পন্দন। এই যাত্রা কে জানে
কোথায় থামবে? কোনও পুরানো কবরস্তানে নাকি নতুন কোনও পুষ্পল উদ্যানে?
৫.৯.৯৭

 ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে ডাকছি

দাঁড়িয়ে এক মহান উৎসবের মুখোমুখি। ভিড়, কোলাহল, আনন্দোচ্ছ্বাস,
আলোকসজ্জা ইত্যাদির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে। এই
আনন্দ, এই হাস্যরোল কি স্পর্শ করছে না আমাকে? উদ্‌যাপিত হচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী। আমাদের গৌরবের বিপুল সূর্যোদয় সারা দেশের
নরনারী এবং শিশুকে চুম্বন করছে। আমি সেই চুম্বনের স্বাদ পাচ্ছি আমার সমগ্র
সত্তায়। এখন আমি গোলাপ, বুলবুল, ভ্রমর এবং স্বর্ণলতাকে ডেকে আনতে
পারি এখানে। আমার ঈষৎ সঙ্কেতে ওরা কথা বলে উঠতে পারে, গাইতে পারে
অনিন্দ্য গান। ওদের ঐকতানে আজকের এই উৎসব পাবে স্বতন্ত্র মাত্রা। এই
তো ওরা উপস্থিত হয়েছে বরণীয় অতিথির মতো। ওরা আমার ইশারার জন্য
অপেক্ষমাণ। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না ওদের। আমার ইঙ্গিত এখনি,
এই মুহূর্তেই, পৌঁছে যাবে ওদের কাছে। বেজে উঠবে বিউগল, ওস্তাদের
সেতার, রাখালের বাঁশি। আমার চোখ, আমার ওষ্ঠ, কাঁধ, বুক, দু’টি হাত
উৎসবের আলোয় উদ্‌ভাসিত, আমি রূপান্তরিত হচ্ছি একটু-একটু করে। আমি
কি এখন মিকেলেঞ্জোলোর গড়া কোনও ভাস্কর্য যা অপরূপ সৃজনশীলতায়
দেদীপ্যমান, জীবনের ছন্দে স্পন্দিত? আমি নিজেই এক অনন্য উৎসব, যেমন
গুণী সুরের ঝরনা বইয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে যান কোনও তান?
মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী উৎসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, আমি
কি কথা বলাতে পারবো গত সিকি শতাব্দীকে? পঁচিশটি বছর কি ফোয়ারা হয়ে
উঠবে অপ্রতিরোধ্য উচ্ছ্বাসে? পঁচিশটি বছর কণ্ঠ থেকে কোনও কথা ঝরানোর
আগেই ঈশান কোণ থেকে এক খণ্ড মেঘ আমার ওপর ঝুঁকে বললো, “যে
মানুষটি একজন উৎকৃষ্ট মৃৎশিল্পীর মতো স্বদেশকে প্রতিমা করে তুলতে
চেয়েছিলেন, চার বছর অস্তমিত না হতেই তাঁকে গ্রাস করল তাঁরই সৃষ্টি!” আজ
উৎসবের আনন্দমুখর প্রহরে এই সত্য ভুলে থাকা অপরাধ, গ্রীবা বাড়িয়ে
বললো সরোবরের শ্বেতশুভ্র রাজহাঁস। বাঁশবনের আড়াল থেকে গহিন গাঙের
ঢেউয়ে শব্দের মতো কণ্ঠস্বরে কে যেন বললেন, ‘দুর্ভাগা দেশে এরকমই হয়।
আমাদের কি মনে নেই তাঁর কথা, যিনি মানবগণের অন্তরে ভিন্ন এক রাজ্য
প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন? তাঁরই মাথায় কাঁটার মুকুট পরিয়ে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ
করা হয়েছিল গলগোথায় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে। স্বর্নরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের
এই তো পুরস্কার।
সোনার বাংলা ছেয়ে গেছে গুণ্ডায়-নিখাদ গুণ্ডা, রাজনৈতিক গুণ্ডা, ধর্মীয় গুণ্ডা,
সাহিত্যিক গুণ্ডা আর সাংস্কৃতিক গুণ্ডার তাণ্ডবে উৎকৃষ্টগণ গা ঢাকা দিয়েছেন
অন্তরালে। তাঁদের কথামালা, পরামর্শ গড়াগড়ি যায় আবর্জনার স্তূপে, পশুর
মলে। প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন যেসব
লেখক তাঁদের কলম ছিনিয়ে নেওয়া ষড়যন্ত্র চলছে। রাজনীতি-বিদ্বেষী
বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক কেউ কেউ বস্তাপচা ধোঁয়াটে থিওরি কপচিয়ে কেউ
কেউ ধর্মীয় আখড়ায় ফতোয়া বিতরণ করে চমৎকার মশগুল। অনেকে আবার
‘ফুলচন্দন পড়ুক তাদের মুখে’ বলে ঢোলক বাজাচ্ছে ঋতুতে ঋতুতে।
যে-দেশে রজব আলী চাষির সানকিতে আজ কী শাদা কী লাল কোনও ভাতই
ফুটে থাকে না ফুলের মতো, রজব আলীর বউ রাহেলা ছেঁড়া শাড়ি পড়ে হি
হি কাঁপে শীতে যে-দেশে, যে-দেশে নাছোড় অপুষ্টিতে দৃষ্টি হারায় অগণিত
শিশু, যে-দেশে ফতোয়াবাজদের মধ্যযুগীয় উৎপীড়নে, পাথর ও দোররার
আঘাতে সিলেটের নূরজাহান এবং তারই মতো আরও কোনও কোনও বঙ্গ-
দুহিতার মৃত্যুকালীন আর্তনাদ রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, বেনো জলে
ভাসে, যে-দেশে ইয়াসমিনের মতো কোমল মেয়ে পুলিশের পৈশাচিক হি-হি
হা-হা ধর্ষণের পরে খুন হয়, সে-দেশে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা
নিয়ে বুধবৃন্দ ও কবিকুলের বাহাস এক তুমুল তামাশা ছাড়া আর কিছুই মনে
হয় না। যে-দেশে নকল নায়কের স্তবে অনেকে মাতোয়ারা, ভুল নেতা নিয়ে
হৈ-হুল্লোড়, নাচানাচি যে-দেশে লক্ষণীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্রমাগত নীরব
নিষ্ক্রমণ, যে-দেশে শহীদ জননীর ভাবমূর্তিতে বিষ্ঠা ছুঁড়ে দেয় দালালের দল,
সে-দেশে কোনও উৎসব উদ্‌যাপন কেমন খাপছাড়া মনে হয়।
তবু মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত মহান উৎসবের
বড়ো প্রয়োজন আমাদের। এই শহর, যাকে আমি আবাল্য ভালোবাসি, এই
স্বাধীন, প্রিয় শহর আমাকে ঠেলে দিচ্ছে বিপন্নতায়, বুঝিবা পাঠাতে চায়
নির্বাসনে, যেমন মহাকবি দান্তেকে পাঠিয়েছিল তাঁর নিজের শহর। চৌদিক
থেকে নিরাপত্তাহীনতার আঁকশি ঘিরে ধরছে আমাকে, তবু আমি আজও অসীম
সাহসে টিকে আছি আপন বসতিতে। এই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি এই
আলো-ঝলসিত শহরে পঁচিশ বছরকে কথা বলানোর আশায়। আমার চৌদিকে
প্রবল জনস্রোত। সুপ্রিয়া গৌরী, তুমি এসে দেখে যাও এই অতুলনীয়
দৃশ্যাবলি। আমি আজ ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে ডাকছি। আমাদের
এগিয়ে যেতে হবে সকল বাধা ডিঙিয়ে, পশ্চাৎপদতার কুহকের হাতছানি
এড়িয়ে নতুন সভ্যতার দিকে। বিজয়োৎসব আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে
অনির্বাণ মশাল।

এভাবে কতক্ষণ বসে থাকব

এভাবে কতক্ষণ বসে থাকব চোখ দুটোকে প্রতীক্ষা-কাতর
করে? তুমি কি চাও আমার শরীর হয়ে উঠুক বল্মীকময়?
আমার নিজস্ব ধ্যানে কেবল তোমাকেই ধ্রুবতারা মেনে ঠায়
বসে থাকব মাসের পর মাস উপবাসে শীর্ণ? নিদ্রাহীনতায়
রুক্ষ, জীর্ণ? যদি জানতে পারতাম তোমার প্রকৃত ইচ্ছা, আমি
নিজেকে প্রস্তুত করে নিতাম সেই অনুসারে। এখন আমি সারাক্ষণ
গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছি; তোমার মন জুগিয়ে চলার পথ
খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। কখনও প্রজাপতি এসে আমাকে জিগ্যেশ
করে আমি কেন এমন দিশেহারা? কখনও দোয়েল আমার কাঁধে
এসে বসে, উদ্বিগ্ন সুরে জানতে চায় আমার মনের খবর আর কখনও
জানলার পাশের গাছের ডালটি গ্রীবা বাড়িয়ে আমাকে সবুজ
সমবেদনা জানায়। কী বলে ওদের উদ্বেগের ছায়া মুছে দেব, ভেবে
পাই না। ওদের কাছ থেকে কিছু শব্দ সংগ্রহ করে নিজের
নিঃসঙ্গতাকে তোমার পৌনঃপুনিক বিরূপতার কাঁটাগুলোকে
সহনীয় করে তোলার জন্যে কয়েকটি পঙ্‌ক্তি রচনায় উদ্যোগী হই
আষাঢ়ের এই গোধূলি বেলায়। বাল্মীকি হওয়া আমার সাধ্যাতীত।
আমার হাতে তাঁর বীণা নেই। আমি একতারা বাজিয়ে বাজিয়ে
সময় কাটাই। এই সুরে মুগ্ধ হবে গৌড়জন, এই অসম্ভব দাবি কি
আমাকে সাজে? আমার এই একতারার সুর যদি তোমার শরীরে
শস্য ক্ষেতের ঘ্রাণ বুনে দিতে পারে, যদি তোমার বিরূপতার
অমাবস্যায় আনতে পারে জ্যোৎস্নার ঝলক, ঠোঁটের রুক্ষতায়
ফোটাতে পারে গোলাপ, তবেই এই শূন্য ঘরে আমার বাউল-নাচ।
একবার তুমি তোমার অভিমানের ধূলিঝড় থামিয়ে এই আমাকে
একটিবার এসে দেখে যাও।
২৫.৬.৯৭

কবি

যাদের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয় তারা কেউই আর
ফিরে আসে না আমার কাছে। আমার বাবা, কোনও
কোনও ভাই, বোন, এক ছেলে-যারাই আমাকে ছেড়ে
গ্যাছে তারা কেউই ফিরে আসেনি। এই তো ক’মাস হলো
আম্মা গেলেন, তিনি প্রত্যাবর্তন করে মমতামগ্ন হাত
রাখেন নি আমার শাদা চুলময় মাথায়। আমি দেয়ালে
মাথা খুঁড়ে মরলেও তিনি আসবেন না আর। আমার কোনও
কোনও বন্ধু নিজেদেরই অপরাধে আমার কাছ থেকে দূরে
সরে গেছেন। তাদের সঙ্গে মামুলি কুশল বিনিময় তো দূরের
কথা, সুখদর্শনও নাস্তি। ওরা কেউ কেউ দুয়ো দেয়, কেউ
কেউ সাধে শক্রতা।

অথচ আমার বারান্দায় ভোরবেলা টাটকা মাখন-রোদ
গায়ে নিয়ে খেলতে আসে তিন-চারটি আদরণীয় অতিথি
চড়ুই। আমার ঘরে কখনও কখনও দুপুর কিংবা বিকেলে
ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। দোয়েল আমার হাঁটুর ওপর বসে,
কাঁধে ঠাঁই নেয় চঞ্চল প্রজাপতি। পায়ের কাছে পায়ের কাছে পায়রা-যুগল
সাবলীল প্রেম করে। বিরলদৃষ্ট যে কোকিল সে-ও সামনে
হাজির হয়ে প্রায়শ আমাকে অন্তরঙ্গ গান শুনিয়ে যায়। আর
আমার এই ছোট ঘরে মাঝে মাঝে দেখা দেয় এক মানবী
সত্তায় অনুপম বসন্তের বর্ণচ্ছটা নিয়ে। কথা এবং আচরণের
রোদ-জ্যোৎস্নাধারায় আমার খরাগ্রস্ত জীবনকে স্নিগ্ধ স্নান
করায়। আমরা দুজন গড়েছি এক প্রণম্য মনোজ বসতি। যদি
সে কোনও দিন আমাকে ছেড়ে ঠাঁই-নাড়া হয়, তাহলে দুনিয়া
আমার অ্যান্ধার, যেমন কবিতা আমাকে ত্যাগ করলে।


কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে জলবালিতে নয়, ইটখোলার ইটের
টুকরোটাকরা অথবা আমাদের এই গলির ধুলোকাঁকরেও
নয়, মাঝে মাঝে সকাল-দুপুর, গোধূলি-সন্ধ্যা কিংবা মধ্যরাতে
ঘরের মেঝে আর বিছানায় কোথাকার পাথরের নুড়ির ওপর
গড়াগড়ি দিই। আজকাল রাতে ঘুম প্রায়শই লাপাত্তা। জানি,
চিকিৎসাশাস্ত্রের বরাত দিয়ে লোকে ইনসমনিয়া বলে এই উপসর্গকে।
নির্ঘুম রাতে আমার কণ্ঠনালী দিয়ে জঠরে ঢুকে যায় বালিকণা,
বেবি ট্যাক্সি, ট্রাক-বাসের কালো ধোঁয়া, ইটের ভগ্নাংশ, মরা পাতা,
বাতিল বিয়ার ক্যানের খণ্ড, পুরনো টুথব্রাশ, কাঁকর, ছেঁড়া
চিঠি, বাৎস্যায়ন ঋষির ‘কামসূত্রে’র একটি মলিন পাতা, আর
পাথরের অনেকগুলো নুড়ি। কখনও কখনও কয়েক দিন পর,
আবার হয়ত সে-রাতেই আমার ভীষণ বিবমিষা হয় আর
আমি বমন করি পূর্বাষাঢ়া, রেবতী, বিশাখা, স্বাতী,
শতভিষা, জোহরা সিতারা, সপ্তর্ষি মণ্ডল আর কিছু অচেনা
মণিমুক্তো। সংবিং ফিরে এল আমি বিস্মিত-থরথর হাতে
সেগুলো কুড়াতে থাকি।
১৯.৮.৯৭

কী করে করবো বসবাস

সকাল থেকেই আমার হৃদয় জুড়ে প্রখর তৃষ্ণা। বুক পুড়ে যাচ্ছে অনবরত।
ভাদ্রের জলধারা মুছতে ব্যর্থ হবে এই দাউ দাউ তেষ্টা জুড়োতে।
বনপোড়া শিঙঅলা হরিণের মতো অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই এদিক
ওদিক। যেন চলেছি বেঢপ চালে এক মরু পথে। নেকড়ের
মতো খেঁকিয়ে ওঠা রোদ আমাকে ভাজছে কাবাব রূপে।
দু’চোখে ক্ষুধার্ত পশুর জঠরজ্বালা। পথে পড়ে থাকা ঘোড়ার
কংকাল, রুক্ষ গাছের ডালে ঝুলন্ত বিষধর সাপ, বালিতে
লুণ্ঠিত পুরানো রক্ত চিহ্নময় পোশাক, আর অতিকায় মরু কাঁকড়া
আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। হোঁচট খেয়ে বারবার বালিতে মুখ
থুবড়ে পড়ি। আমার চোখের তৃষ্ণা আর বুকের তেষ্টা এক যোগে
আর্তনাদ করে মরু নদীর মতো।

আজ তোমাকে দেখার সঙ্গেই হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে
জেগে ওঠে তৃষ্ণানিবারণী জলময়তা। আমাদের
দুজনের দু’টি হাত পরস্পর চুম্বন ধারায় ভাসতে থাকে
কিছুক্ষণ। আমার মুখাবয়বে আন্দোচ্ছাসের ঝাপটা দেখে
তুমি মুগ্ধ হলে। কয়েক মিনিট পরেই আমার মুখের বিষণ্নতার
উকিঝুঁকি দেখে তোমাকে স্পর্শ করে মন খারাপের নীলাভ
আঙুল। তুমি আমার বিষণ্নতার উৎস জানতে চাইলে আমি
নিজের অসুস্থতার কপট উচ্চারণ করি। অথচ তোমাকে ক’দিন
এখানে দেখতে পাব না ভেবেই আমার হৃদয় ধুলোয়
লুটিয়ে পড়েছে আহত দোয়েলের মতো।

তোমাকে আবার দেখার জন্যে নিরুপায় হয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও
সাতদিন। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার নিষ্করুণ ঘরে কী করে করবো বসবাস?

কী কী করতে হয় আমাকে

যদি আমার একটা নোটবুক থাকত তাহলে আমার নিজস্ব
ভাবনাগুলোকে টুকে রাখতে পারতাম আর এখন কী সহজেই না
সেরে ফেলা যেত কাজটা। খুব অল্প সময়ে পদ্মার ধু ধু চরের মতো
একটা পাতা সেজে উঠত কতিপয় পঙ্‌ক্তিতে। কঁকিয়ে-ওঠা সিঁড়িতে পা রাখতেই
মনে হলো কে যেন আমার পাশাপাশি হাঁটছে। হাড়-কাঁপানো শীতল নিঃশ্বাস আমাকে
স্পর্শ করে। কবিতা লেখার জন্যে কী কী আমাকে করতে হয়, এ-কথা যদি
কেউ বুঝতে পারত। জ্যোৎস্নারাতে ঝরাপাতার ওপর হরিণের পায়ের শব্দ
শোনার জন্যে আমি কান পেতে রাখি কত প্রহর, গুলিবিদ্ধ পক্ষিণীর আর্তনাদে
অনুভব করার জন্যে কতবার চিৎকার করে উঠি, রাত-বিরেতে, ঝর্ণাজলে
আদিবাসী যুবা নিজের মুখের যে বিষণ্ন ছায়া দেখে তার প্রতিচ্ছবি
আমার মধ্যে দেখতে গিয়ে যে বেদনা প্রত্যক্ষ করি একটি কবিতা
লেখার জন্যে, কে তার খোঁজ রাখে? একটি কবিতা লেখার জন্যে
আমি অভিধান শুঁকি, যেমন সানুরাগ শুঁকি প্রিয়তমার শরীর।
একটি কবিতা লেখার জন্যে আমাকে লাশকাটা ঘরে শুতে হয়
লাশের চেয়ে অধিক লাশ হয়ে। কতিপয় পঙ্‌ক্তি লেখার জন্যে
মৃণালিনী ঘোষালের শব হয়ে আমাকে ভাসতে হয় করুণ জ্যোৎস্নায়।
একটি কবিতা লেখার জন্যে আমি রঁদার ভাবুক হই, হই রিলকের বাঘ,
ভ্যান গগের আত্মপ্রতিকৃতি। একটি কবিতা লেখার জন্যে জীবনানন্দের
সঙ্গে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।
২০.৯.৯৭

কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ

কখনও সখনও যে চা-খানায় চা খেতে যাই কিংবা কিছু সময় কাটাতে,
সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলা-কওয়া নেই লোকটা গ্যাঁট হয়ে
বসল আমার মুখোমুখি। কোনও কোনও মানুষ আছে যাদের দেখলেই মনে
পড়ে পাখির কথা। লোকটা সে ধরনের একজন মানুষ। কেন জানি না, তাকে
মনে হলো একটা দাঁড়কাকের মতো, যদিও এই বিশেষ প্রাণীটির সঙ্গে তার
কোনও মিল আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। পক্ষান্তরে লক্ষ করলাম, ওর
ভুরুতে বনস্থলির শ্যামলিমা, হাতের নোংরা নোখ থেকে বেরিয়ে এসেছে গুচ্ছ
গুচ্ছ রক্তকরবীর লালিমা, ঠোঁটে সমুদ্রতটের নুন, চোখে কবরের ভেতরকার
রহস্য। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়ছিল, সে এসেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত
থেকে।
আমার চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে লোকটা তাকাল রাস্তার দিকে, তারপর
বলতে শুরু করল একটি কাহিনী; আমি শুনতে চাই কিনা সে-কথা জানতেও
চাইল না। কথার বড়শি দিয়ে সে গেঁথে ফেললো আমাকে। কার সাধ্য সেই
বড়শি থেকে ছাড়া পায়? তার কথা বলার ধরন থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে
উঠল আমার কাছে যে, সে এক প্রাচীন ভ্রমণকারী। নানা ঘাটের পানি খেয়েছে
লোকটা। ওর গলায় বহু অতিজ্ঞতার মিশ্র স্বর, এক চিত্ত-আলোড়নকারী
ঐকতান। আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঢেউয়ের পর ঢেউ। বিচিত্র মশলার
ঘ্রাণে ভরে উঠল সেই চা-খানা, আমি অনুভব করলাম পাখির বুকের উত্তাপ,
সুদূরতম দ্বীপের ওপর বয়ে যাওয়া হাওয়ার ঝলক, ঝরনার স্বচ্ছ জলের
শীতলতা। সে তার কাহিনী শুরু করল এভাবে-
এক ঝাঁক দাঁড়কাক এসে বসল উঁচু দেয়ালে, যেন পুঞ্জ পুঞ্জ হিংসা। ওদের
পাখায় লেখা আছে একটা শব্দ, প্রতিশোধ। দাঁড়কাকগুলো দশদিক চমকে
দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল, আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল কুচকুচে কালো
রঙ। দাঁড়াকাকদের গলা সেই রঙের উৎস। একে একে ওরা উড়ে গেল
প্রাসাদটির প্রতি, ফিরে এল একটু পরে; ফের হানা দিল সবাই এক সঙ্গে।
চঞ্চুর আঘাতে আঘাতে ওরা ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে চাইল ফটকটিকে। সেই
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে ওরা ভেতরকার রহস্য জেনে নিতে চায়, জেনে নিতে
চায় এমন কী আছে প্রাসাদের ভেতরে যা রাখতে হবে সবার চোখের আড়ালে?
মোদ্দা কথা, ওরা প্রাসাদটিকে দখল করতে চায়। কিন্তু আপাদমস্তক দামি
ধাতুতে মোড়া প্রহরীদের বন্দুকের ধমকে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল, কালো
কালো ছেঁড়া পালকে ছেয়ে গেল চারদিক, দাঁড়াকাকগুলো রাশি রাশি মণ্ডের
মতো পড়ে রইল। ফটক ছিদ্র করবার মতো শক্তিমান ছিল না ওদের চঞ্চু।
আর ওরা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রহরীদের বর্মের ঝলসানিতে। প্রহরীরা বীরদর্পে
দাঁড়কাকের শবের ওপর কুচকাওয়াজ করল কিছুক্ষণ; কুচকাওয়াজ,
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
দাঁড়কাকদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়। সময়ের ঠোকরে চিড় ধরে
না প্রাসাদের প্রাচীরে। খোলে না ফটক। খুললেও কারও প্রবেশাধিকার নেই
সেখানে, শুধুমাত্র নির্বাচিতরাই যেতে পারে ভেতরে। যারা যায় তারা আর
ফিরে আসে না। প্রাসাদের প্রাচীরে কিংবা গম্বুজে কাকপক্ষীও বসতে পারে না।
দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা অষ্টপ্রহর প্রস্তুত। একটা পিঁপড়ে ওদের চোখ
এড়িয়ে যাবে, এমন ফাঁকফোকর ওরা রাখেনি কোথাও। প্রাসাদ আছে
প্রাসাদের হালে, কখনও কখনও ভেতর থেকে ভেসে আসে নানা বাদ্যরব,
নর্তকীদের মঞ্জীর-ধ্বনি। ফটকের বাইরে সকাল সন্ধ্যা প্রহরীরা করে
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
হঠাৎ একদল শিম্পাঞ্জী সেই প্রাসাদের ওপর চড়াও হলো একদিন। কিন্তু ওদের
উৎপাত স্তব্ধ হয়ে গেল এক পশলা বুলেটে একটা আঁচড়ও লাগল না
প্রাসাদের গায়ে। পরাভূত শিম্পাঞ্জীদের অনেকেই বেঘোরে প্রাণ হারাল, যারা
বেঁচে রইল তাদের বেঁচে না থাকাই ছিল ভালো। কেউ হারাল হাত, কেউ পা,
কেউ কেউ হাত-পা দুটোই। প্রহরীদের বর্মে সূর্যের আলোর ঠিকরে পড়ে,
ঝলসিত হয় চতুর্দিক। শিম্পাঞ্জীদের শবের ওপর প্রহরীরা বীরদর্পে
কুচকাওয়াজ করল কিছুক্ষণ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়। পূব দিকে সূর্য ওঠে, পশ্চিমে
অস্ত যায়। গাছে পাতা গজায়, পাতা ঝরে যায়। প্রাসাদ থাকে প্রাসাদের হালে;
ঝকঝক করে সূর্যের আলোয়, অন্ধকারকে শাসন করে নিজস্ব আলোর ছটায়।
শোনা যায় প্রাসাদের ভেতরে বারো মাস তেরো পার্বণ কাটে প্রায় একইভাবে,
একই তালে লয়ে। মাঝে-মাঝে গুঞ্জন রটে বাইরে। গুজব গুজবই। তাই ওসব
নিয়ে মাথা ঘামানোর লোকের সংখ্যা কম। প্রহরীরা টহল দিয়ে বেড়ায়
প্রাসাদের চারদিকে। দিনভর, রাতভর। কোনও কিছু নড়তে চড়তে দেখলেই
বলে, হল্ট। সহজে কেউ ঘেঁষে না ফটকের কাছে, দূর থেকে তাকায় আড়
চোখে। লোকে বলে, কোনও কোনও মধ্যরাতে প্রাসাদের প্রাচীরগুলি ডুকরে
ওঠে ট্রয় নগরীর রমণীদের বিলাপের মতো।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের বহু বছর পরে শত শত লোক ছুটে এল প্রাসাদের
দিকে লাঠিসোটা আর দা-কুড়াল নিয়ে। মনে হলো জনবন্যায় দেশলাইয়ের
বাক্সের মতো ভেসে যাবে প্রাসাদ। কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক বুলেট আর কামানের
গোলায় বন্যার গতি হলো রুদ্ধ, মৃত্যু এলোপাতাড়ি উপড়ে নিল বহু প্রাণশস্য।
যারা এসেছিল প্রাসাদের প্রাচীর চুরমার করার জন্যে, ফটকটিকে কাগজের
মতো দুমড়ে ফেলার জন্যে, ব্যর্থ হলো তারা। ওরা এসেছিল একটা সূর্যোদয়ের
জন্যে, ফিরে গেল অস্তিত্বময় অমাবস্যা নিয়ে। তখন আমি জ্বলজ্বলে যুবক,
সবেমাত্র কুড়ি পেরিয়েছি। আমার হাতের মুঠোয় স্বপ্নের চারাগাছ, চোখে
সামুদ্রিক ঢেউয়ের ঝাপটা, আমার সত্তায় ভবিষ্যতের লাবণ্য।
যাকগে, মানুষের সেই পরাজয় আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এত লাশ আমি এর
আগে দেখিনি। চোখে জ্বালা ধরে যায়। মৃতদেহ এত আগুন, কে জানত? চোখ
পড়ে যায়। কেউ কেউ বাঁচল পালিয়ে, কিন্তু সেই বাঁচার চেয়ে মরাই ছিল
ভালো। আসল পা ছেড়ে কাঠের পা নিয়ে কে বাঁচতে চায়? কে চায় হুইল
চেয়ারে বসে ঝিমোতে? চোখের জ্যাতি হারিয়ে দিন যাপনের গ্লানি সইতে কে
চায়? প্রিয় সঙ্গীর মুণ্ডুহীন ধড় দেখার পর কেউ সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে
হাত মেলাতে পারে না। আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা মানুষের
লাশের ওপর কুচকাওয়াজ করল কিছুক্ষণ; কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ,
কুচকাওয়াজ।
সেই পরাস্ত লোকগুলোর মধ্যে ছিল একজন জিপসি। বেখাপ্পা তার
জীবনযাত্রা, অদ্ভুত তার আচরণ। ওরা পালিয়ে এসে ডেরা বাঁধল বহুদূরে, নদী
তীরে। লোকগুলো বসেছিল গোল হয়ে ফ্রেস্কোর মণ্ডলের মতো। কারও মাথায়
ব্যাণ্ডেজ, কারও উড়ে-যাওয়া পায়ের অবশেষে ব্যাণ্ডজ, কারও চোখে
ব্যাণ্ডেজ। জিপসিটা বলল, মনমরা হয়ে থেকো না তোমরা। যারা একদিন
বীরের মতো প্রবেশ করবে সেই প্রাসাদে আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া
প্রহরীদের পরাস্ত করে তারা বাড়ছে গোকুলে। ওরা কারা? জানতে চাইল
সবাই। জানি না; তবে ওরা আসবে, দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে উত্তর দিল
সেই জিপসি। কবে আসবে সেদিন? একটা গুঞ্জন উঠল আহত লোকগুলোর
মধ্যে। সেই বিজয়ের দিন কবে আসবে? এই প্রশ্ন তীরের মতো ছুটে গেল
জিপসির দিকে। জিপসির চোখে কী একটা ছায়া দুলে ওঠে যেন, আকাশে
ঝুলে আছে যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া চোখের মতো চাঁদ। জিপসি স্বপ্নঝলসিত কণ্ঠ
বলে, বিজয়ের নির্ধারিত কোনও তারিখ নেই।
এটুকু বলে থামল আমার মুখোমুখি বসে-থাকা লোকটা। জিপসির সেই বাণী,
বিজয়ের নির্ধারিত কোনও তারিখ নেই, গুঞ্জরিত হতে থাকল চা-খানায়, যেন
শুনতে পেলাম আমি। হঠাৎ দাঁড়কাকের মতো লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাঁড়াল, রওনা হলে রাস্তার দিকে। আমি তাকে ডাকলাম, কিন্তু সে ফিরে
তাকাল না পর্যন্ত। যেন আমি কোনও ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। লোকটার হাঁটার
ভঙ্গিতে কোনও স্বাভাবিকতা ছিল না। খট খট করে একটা শব্দ হচ্ছিল। তখুনি
আমি প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করলাম, লোকটার একটা পা কাঠের। আর
সেই কাঠের পা থেকেই বিজয়ের কোনও নির্ধারিত তারিখ নেই শব্দগুচ্ছ
মুঞ্জুরিত হয়ে চা-খানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল চরাচরে।

ক্ষণকাল

ঘুমভাঙা চোখে দেখি, হাতঘড়িতে ভোর ছ’টী। আকাশ-ঝারি
শহরময় অবিরল জল ছিটোচ্ছে রাতের শেষ প্রহর থেকেই। শ্রাবণ-
ধারায় আমি হয়ে উঠি গুণীর সেতারের আলাপ। আমার মনের
গহনে চকিতে কদম ফুল ফোটে। এই ফুল ফোটালে তুমি, অথচ
নিজেই জানলে না। জানি, এখন তুমি ঘুমের গহীন গাঙে স্বপ্নময়
ডুবসাঁতারে নিমগ্ন, ছুঁয়েছ জলজ গুল্ম আর কয়েকটি রঙিন শঙ্খ
গাঙের তলদেশ। তোমার ঘুমন্ত ঠোঁটে হাসির কুঁড়ি চোখ মেলছে
তোমার অজ্ঞাতে। তোমার নিত্যদিনের সুপ্রভাত আর শুভ রাত্রিগুলো
আনন্দমেলা হয়ে আমাকে ঘিরে দুলছে এক স্বপ্নিল
ঘোর-লাগা নাগরদোলায়। কৃতজ্ঞতায় ছলছলে আমার চোখ। মনে
পড়ে, কাল রাতে হঠাৎ তোমার ক্ষণিকের আবির্ভাবে অনন্তের কয়েকটি
বুদ্বুদ দেখেছিলাম। অনৈতিহাসিক অথচ ব্যক্তিগত তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তের
মুকুল আমার অসুস্থতার কালোয় আলো ছড়িয়েছিল অকপট অকার্পণ্যে।
সেই ঝলক তোমারই দান জেনে জ্যোৎস্নারাতের সোনালি মাছ হয়ে
তুমি ঝলসে উঠছিলে ক্ষণে ক্ষণে। আজকের ভোরবেলা গত রাতের
কয়েকটি মিনিট লাল চেলী গায়ে আমার বুকে মাথা রাখে। উন্মাতাল
আমি দু’বাহুর নীড়ে টেনে নিই বিগত ক্ষণকালকে।
২৭.৭.৯৭

 ছায়ার ত্রিভুজ

এখন আমি আগেকার মতো নেই আর। ক’দিন থেকে আমার
বুকের ভেতর একটা ছায়ার ত্রিভুজ জেগে উঠেছে। সেই ত্রিভুজের
শীর্ষবিন্দুতে কালো ঝুঁটি-অলা আজনবি এক বিষণ্ন পাখির
বসবাস। ওর দু’ফোটা কালো চোখ ঘিরে সিঁদুর রঙের
বাহার। পাখিটাকে কথা বলাবার জন্যে, নিদেনপক্ষে একটি
কি দু’টি শিস যাতে শোনায় আমাকে, কত যে সাধ্য-সাধনা করেছি
সে জন্যে। অথচ সে নিস্তব্ধতার কঠিন মোড়ক ছিঁড়তে প্রবল
অনাগ্রহী। মধ্যে-মধ্যে শুধু কালো ঝুটি নাচায় আর কেমন আড়চোখে
তাকায় আমার দিকে। যখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি, যখন
আমার কণ্ঠ থেকে আবেগবিহ্বল মুহূর্তে রৌদ্র জ্যোৎস্নাময় এবং
ঘনঘোর মেঘবিদ্যুৎ ভরা পদাবলীপ্রতিম কিছু বাণী নিঃসৃত
হয়, তখন পাখিটি সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে কখনও আমার ফুসফুস,
কখনও ওর নিজের বুক ঠোকরাতে থাকে জন্মান্ধ আক্রোশে।
আমি তার বিরুদ্ধে কোনও নালিশ রুজু করছি না কারও কাছে।
ভেব না, ওর লাগাতার জুলুমের কেচ্ছা রটিয়ে ফিরিস্তি
সাজিয়ে আমি তোমার সহানুভূতি কিংবা করুণার কোমল
ছায়ায় দাঁড়াতে চাই। হঠাৎ কোনও কোনওদিন দুপুরে
অথবা সন্ধ্যায় তোমাকে দেখলে আমার ভেতরকার ছায়ার
ত্রভুজবাসী কালো ঝুঁটি-অলা পাখিটির অস্তিত্ব ভুলে থাকি।

ডাকহরকরা বিলি করলেও


ডাক-হরকরা বিলি করলেও রাজা রামমোহন রায়ের পত্র ঘরে ঘরে
পৌঁছেনি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখে জবাব না পেয়ে আখেরে নিজেকে
আবৃত করেছিলেন নিঃসঙ্গতায়, অশ্রদ্ধা তাঁর মুখাবয়বে বসিয়ে দিয়েছিল
কাঠিন্যের রেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পত্রাবলী রচনায় অনলস, এমনকি শেষ
বয়সের গোধূলিতে কম্পিত হস্তে রচনা করেছেন বিস্তর চিঠি। টেলিগ্রাম
পাঠিয়েছেন বারবার। মনে হয় না, সেসব চিঠি কেউ পড়েছে। পড়লেও
মর্মোদ্ধারে ব্যর্থ অনেকে, কেউ কেউ বুঝলেও তেমন আমল দেয়নি, অনেকে
খাম পর্যন্ত খোলেনি। অবশ্যি অধিকাংশ লোকের কাছে ক-অক্ষর হারাম বলে
তারা শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়েছে। সেসব চিঠি মানবচিত্তে মনুষ্য ধর্মকে
পদ্মের মতো প্রস্ফূটিত করতে চেয়েছিল। এখন সেই প্রাতঃস্মরণীয় ত্রয়ীর
সুসমাচার ফাঁপা পথচারীদের কাছে ইলেকট্রিকের তারে আটকে থাকা কাটা
ঘুড়ির ছিন্নাংশ কিংবা নর্দমার পানিতে ভাসমান ছেঁড়াখোঁড়া কাগজের নৌকা,
যা বস্তির ছেলেমানুষদের তৈরি।


যখন বয়স ছিল কম, তখন ক্ষীণায়ু কীটস্‌ এবং তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো
মৃত্যুবন্দনায় ছিলাম উচ্ছ্বসিত। ভাবতাম জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কোনও চৈতীরাতে
আবেগাতুর কবিতা পাঠকালীন আমার ওপর মৃত্যু যদি নেমে আসত, সুশীল
পাখির মতো কি ভালোই না লাগত আমার। মৃত্যুকে দয়িতা ভেবে মরণের
প্রেমে পড়েছিলাম তারুণ্যে। অথচ আজ ষাটের ধূসরতায় বিবর্ণ হয়েও বেঁচে
থাকার সাধ তীব্র সুরার মতো উদ্দীপিত করে আমাকে। কেননা, এই তো
সেদিন দেখলাম তোমাকে-তন্বী এবং সুন্দর।


ভেবেছিলাম নাছোড় অভিমান এক আমাকে রাখবে লোকালয় থেকে
বহুদূরে নুড়িময় ঝর্ণাতলায় সুখে বুঁদ। বুনো ছাগ-যূথে, গাছগাছালির ভিড়ে,
পাখাপাখালির রাজ্যে জীবনযাপন মাধুর্যে মোড়া চিরদিন, ছিল আশা। পাথর
আর জলধারার ভাষা শেখা হবে। সুখের সংজ্ঞা কখনও কখনও ভাবায়।
গাছতলায় শুয়ে পাখির গান শোনা, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রঙধনুর পেখম দেখা,
সূর্যের আলোয় নেয়ে ওঠা, চৈতালি জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়ানো, সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে দাঁড়ানো-এসবই তো সুখকর; তবু কেন মানুষের মুখ দেখার
ব্যাকুলতা? লোকালয়ের উত্তাপ ফিরে না পেলে টইটম্বুর হবে না আমার সুখের
কলস।


কখনো সেজেগুজে, পরিপাটি দাড়ি কামিয়ে সুগন্ধি মেখে, কখনও বা
উশ্‌কো খুশ্‌কো ৩ দিনের না কামানো দাড়ি নিয়ে তার নিবাসে গিয়ে কড়া
নাড়ি। ব্যাকুলতা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ। যতক্ষণ না ওর ড্রইং
রুমের সোফায় বসি, কথা বলি এলোমেলো, তাকাই বারান্দায় লুটিয়ে পড়া
রৌদ্রের দিকে, ততক্ষণ আমার স্বস্তি নদারৎ। আলবৎ ওকে ভালোবাসি,
এরকম ভালোবাসিনি কোনও নারীকে। আমাকে সে ভালোবাসে কিনা, সঠিক
জানি না। যেমন জন্মান্ধের অজ্ঞাত চৈত্ররাত্রির জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য। সন্দেহের
কাল বেড়াল ফিরোজা চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে, ভীত আমি
উদাসীনতায় ডুবে থাকার ভান করি। কোনও কোনওদিন আমার ঠোঁট থেকে
লতার মতো দুলতে থাকে একটা প্রশ্ন, ‘তুমি কি সত্যি ভালোবাস আমাকে?’
কখনও নিরুত্তর সে নোখ দিয়ে খুঁটতে থাকে সোফার হাতল কিংবা বলে,
‘চাই, চা করে আনি। কখন কি খেয়াল হয়, আমার দিকে না তাকিয়েই
ফ্লাওয়ার ভাস সাজাতে উচ্চারণ করে, ‘ভালোবাসি’। সেই মুহূর্তে
তার কণ্ঠস্বরে যেশাসের জন্মের আগেকার সুদূরতা। প্রাচীনতম লেখনের
পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় ক্লান্ত আমি বর্তমানকে মুছে ফেলি নিজেরই অজান্তে। এর
পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকে আমার অনুভুতিগুলো, জড়ো করার উৎসাহ সবুজ
শিখার মতো জ্বলে ওঠে না। আমার ভেতরকার দুরন্ত যুবার অবয়বে বৃদ্ধের
মুখচ্ছন্দ দোদুল্যমান।


তার কাছে পৌঁছেই বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আমি। সে নিমেষে ফ্রিজের বোতল
থেকে এক গ্লাস পানি হাজির করে আমার সামনে। ঢক ঢক খেয়ে ফেলি
সবটুকু পানি। একটু পরে বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আজ। আবার এক গ্লাস পানি,
আর ধোঁয়াওঠা চায়ের পেয়ালা। পানির গ্লাস এবং চায়ের বাটি উজাড় করেও
আমার তৃষ্ণা মেটে না। উসখুস করি, যেন পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। জালালউদ্দীন
রুমির মতো নিজের শরীরের উদ্দেশে বলি, ‘হে দেহ, এই তো তুমি বিটকেল
যুবরাজ। অধৈর্য আমি শেষটায় বলি, ‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
ঘরের ভেতর তখন এক হাজার একরাত্রির রহস্যময়তা আর পারস্য গালিচার
সৌকর্য; অথচ সে দিনানু-দৈনিক কাজে মশগুল, হঠাৎ ব্যেপে আসা
অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের প্রতি উদাসীন। আখেরে আরও এক গ্লাস পানি গলায়
ঢেলে আমি পথচারী, একা, স্পর্শহারা, চুম্বনবিহীন। বুকজোড়া দাউ দাউ তৃষ্ণা
আর হাহাকার, যা আমার একাকিত্বকে আরও দুঃসহ করায় ব্রতী। কি করে
তৃষিত পায়রার ঘাড় মটাকে হয় বারবার, সে ভালো করেই জানে।


এখনও আছো, পরে থাকবে না। ভালোই, তখন আমি এই পৃথিবীর কেউ
নই। দর্পণে বিম্বিত নিজেকে উপভোগ করা চমৎকার খেলা তোমার। একদিন
ফুরাবে খেলা, তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে আদমসুরত। আবার বন্দনায় যে
সৌন্দর্য অক্ষরের পরতে পরতে ধৃত, সংরক্ষিত, তা হারানোর বুকজোড়া
হাহাকার কে আর শুনবে তুমি ছাড়া? কাকের ডাকে চমকে উঠে তুমি নিরর্থক
তরুণী পরিচারিকাকে করবে ভর্ৎসনা। হয়ত মনে পড়বে তাকে, যে তোমার
খুব কাছে আসতে চেয়ে ফিরে গেছে বারবার ব্যর্থ, অসহায়। কোনও কোনও
মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নে কুরূপার বীভৎসতা, করোটিতে সাপের ফণা দেখে জেগে
উঠবে। তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল। ভূতুড়ে জ্যোৎস্নায় স্তব্ধতা
চিরে ডেকে উঠবে যুগপৎ কাক ও কোকিল।


বৃষ্টি নেই, রোদও নয় চড়চড়ে। তবু যাই না। আজকাল ইচ্ছে করেই
তোমার নিবাসে আমি অনুপস্থিত। তোমার কাছ থেকে দূরে থাকার সাধনায়
গলায় অন্যমনস্কতার রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে ঔদাস্যের তস্‌বি। তবুও
কোনও কোনওদিন তোমাকে দেখতে যাব বলে গলির মোড়ে উঠে পড়ি
রিক্‌শায়। রিক্‌শাচালক ঠিকানা জানতে চাইলে বলি, ‘নীলিমায় উড়ে যেতে
পার? আরোহীকে উন্মাদ ঠাউরে শীর্ণকায় লোকটা প্যাডেলে অসাবধানতা
ছড়ায় দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্দেশে বলি,
‘হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চলো।
কেন সেখানে যেতে হবে, নিজেই জানি না। শুনেছি তুমি বেশ ভালোই আছ,
তৃপ্তিতে টইটম্বর। আগের চেয়ে ফরসা, স্বাস্থ্যে স্বর্ণলতার সজীবতা। আর
যেখানেই হোক তুমি এ শহরের কোনও হাসপাতালে, ক্লিনিকে নেই। তোমার
কাছ থেকে বহুদূরে টেনে টুনে রেখেছি নিজেকে এবং তোমাকে তিল তিল করে
গড়ে তুলছি পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তিতে। সেই হরফের মূর্তি তোমার মতোই অথচ
তুমি নও। তোমার চেয়েও নমনীয়, দয়াময়ী। তার হাত দৈনন্দিনতায় নয়,
নক্ষত্রপুঞ্জে মিশেছে। কখনও সে আমাকে পাতালে টেনে নেয়, কখনও বা
তুমুল মন্দিরা বাজিয়ে নিয়ে যায় প্রাণবন্ত জীবজগতে।


নিস্তব্ধ বাড়ি ধ্যানী দরবেশের মতো জেগে আছেন, তার মাথা আকাশকে
স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে, হাত লাগে দেয়ালে,
যেখানে রক্তের দাগ। বিছানায় বেনামী ভয় লেপ্টে থাকে, নিজেকে মনে হয়
ছন্নছাড়া আগন্তুক; আর ক’দিনই বা আছি এই ডেরায়? আজ আমি যে জায়গায়
খাট পেতেছি, সাজিয়েছি টেবিল, বুকশেলফ-এসব কি এরকমই থাকবে
অবিকল বহুবছর পর? এ জায়গায় ভিন্ন কোনও খাটে, কবোষ্ণ শয্যায় হয়ত
ঘুমোবে আমার কোনও ষাটপেরুনো বংশধর। তার নিদ্রিত হাত কি জেগে
উঠবে দেয়ালের স্পর্শে? তাকেও কি ডালকুত্তার মতো কামড়ে ধরবে এমনি
কোনও চিন্তা যা আমাকে এই মুহূর্তে গ্রাস করেছে? সে কি আমার মতোই
ভুগবে অর্থকষ্টে নাকি দু’হাতে ওড়াবে টাকা? সে কি কোনও অধ্যাপকের পদ
অলংকৃত করবে, অথবা হবে আমৃত্যু দুঃখের জোয়াল বয়ে বেড়ানো কোনও
কবি?

ডাহুক

ডাহুক তার গলার ভেতর রাত্রিকে খানিক খেলিয়ে, খানিক
বাজাতে বাজাতে নিজের ভেতর স্থির হয়। ডাহুক গহনতায়
ডুব দিতে থাকে ক্রমাগত; ডাহুকের পালকগুলো রাত্রি
হয়ে ওঠে। রাত্রিময়তা রাত্রিকে স্পর্শ করে ডাহুককণ্ঠে।
ডাহুক আমাকে দেয় রাত্রি, যেমন সাকী ভরে তোলে সুরাপায়ীর পাত্র।
রাত্রি এমন এক প্রহরে প্রবেশ করে, যখন রাত্রি, ডাহুক আর এই আমার
মধ্যে কোনও ভেদচিহ্ন থাকে না। ডাহুক ফোঁটা ফোঁটা আঙুরের রস হয়ে
ঝরে, হয়ে যায় বিন্দু বিন্দু সুর।

ডাহুকের সুর আমাকে বহুদূর নিয়ে যায় ভিন্ন এক দৃশ্যের ভিতরে।
কে সেখানে দাঁড়িয়ে? তিন মাথা-অলা ভয়ঙ্কর এক প্রাণী দাঁড়ানো
আমার সামনে। গায়ক পাখিদের চিরশক্র এই প্রাণীর চারপাশে
ছড়ানো অনেক রক্তাক্ত পালক, বহু পাখির ছিন্ন মুণ্ডু, অর্ধভুক্ত যকৃৎ,
প্লীহা। আর কী অবাক কাণ্ড, সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীর আমিষাশী
দন্ত-নখরের নাছোড় হিংস্রতাকে ফাঁকি দিয়ে এক দ্যুতিময়
পাখির কী তন্ময় উড়াল, সপ্ত সিন্ধু দিগন্তে অন্তহীন
প্রকৃতি-মাতানো কী গান!
১৯.৯.৯৭

তোমার নালিশের পরে

আজকাল মাঝে মাঝে সকালে কি সাঁঝে আমাকে ঘিরে
বেহাগের করুণ সুরের মতো বাজে তোমার নালিশ। আমার
কথা না কি এখন আগেকার মতো তোমার হৃদয়ে সরোবর
তৈরি করতে পারে না, পারে না লাল নীল পদ্ম ফোটাতে
হাওয়ায় ঈষৎ দুলে-ওঠা মানস সরোবরে আমার কথার
মুখ এখন তোমাকে লতাগুল্ম, ফুল, ফলমূল, আর
রঙ বেরঙের পাখির গানে গুঞ্জরিত দ্বীপে পৌঁছে দিতে না
পারার ব্যর্থতার কালি মেখে নিশ্চুপ থাকে প্রায়শ,
এইটুকু তুমি স্পষ্টতই উচ্চারণ করেছ। কস্মিনকালেও বাকপটু
নই আমি, প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারিনি কোনও চারুবাকের।
এই দড় কথা গুছিয়ে বলার খেলায়। তুমি যথার্থই বলেছি আমি
লোকটা ঘোর স্বার্থপর। স্বীকার করি, অনেক কথাই সযত্নে
সঞ্চিত রাখি কবিতার জন্যে। কথোপকথনের মুহূর্তে কথা পাখির
কোন্‌ পালক কখন ছোঁব, বুঝতেই পারি না। পরিণামে কিছু
অনাবশ্যক, বেসুরো কথা অথবা দীর্ঘ নীরবতা।

থাক এসব বকুনি। এই যে আমি আমার ভালোবাসার
মঞ্জরী সাজিয়ে রাখি তোমাকে বুকে, তোমার কালো
চুলের ঢালে, তোমার আসা-যাওয়ার পথে, সেগুলো
তুমি কুড়িয়ে নাও না কেন?
১০.৮.৯৭

দিব্যোন্মদ

মানি অর্ডার ফর্মে একটি প্রেমের কবিতার খসড়া। দু’তিনটি
পঙ্‌ক্তির পর কিছু কাটাকুটি, তারপর কয়েকটি পঙূক্তি। শেষের
দিকের বাক্যটি অসমাপ্ত। নিজের হস্তাক্ষর সে নিজেই
বুঝতে ব্যর্থ। হঠাৎ এক সময় ওর মনে হয়, সে তো একজন নয়,
নানা জন। এই মুহূর্তে প্রত্যেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সে নিজেকে ওদের ভেতর থেকে বের করে এনে বসে চেয়ারে।
কিসের আকর্ষণে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। সে জাঁহাবাজ দুপুরে
নিজের উপস্থিতি টের পায় হলদে শস্য ক্ষেতের ধারে। শস্য
ক্ষেতের ওপর এক ঝাঁক উড়ন্ত কালো কাক। তার ভেতর কবেকার এক
চিত্রকর ভর করে যেন, তার হাত ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে রঙ আর তুলির
জন্যে, ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা, এক ধরনের উন্মাদনা তাকে
কী সহজে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।

বাজখাঁই সূর্যের তাপ স্তিমিত হলে সে ফিরে আসে নিজের
ঘরে। ঘরে ঢুকতেই ওর চোখে পড়ে মানি অর্ডার ফর্মে লেখা
প্রেমের কবিতার খসড়াটি টেবিল থেকে উঠে দেয়ালে সেঁটে
গেছে সমুদ্র থেকে উঠে আসা ভেনাস হয়ে। ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে
একটা কাটা কান আর মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ব্যান্ডেজ
গাঙচিল-রূপে উড়ে যায় দূরে। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে
প্রশ্ন করে, “আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি?” প্রত্যুত্তরে ঘরের
কিন্নরকণ্ঠ চারদেয়াল উচ্চারণ করে, তুমি দিব্যোন্মাদ।
২০.১০.৯৭

দীর্ঘ পথ হাঁটার পর

দীর্ঘ পথ হেঁটেছে সে, তবু তার ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই
এতটুকু। আরও কিছু পথ বাকি আছে ভেবে তার সত্তা
সরোদের মতো বেজে ওঠে। পথ চলতে কতবার পুরু সবুজ।
ঘাসে গড়াগড়ি খেয়েছে, দেখেছে ঝোপের কান ঘেঁষে
খরগোশের দৌড়, কাঠবিড়ালির ত্রস্ত তাকানো, বাদাম মুখে
নিয়ে গাছের কোটরে লুকানো। কতবার সে গোধূলিতে নদীতীরে
দাঁড়িয়েছি, কতদিন ছুটেছে এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতির
পেছনে, কত রাত ফুলের সুগন্ধ আর গোল চাঁদ তাকে জাগিয়ে
রেখেছে। কবেকার জাহাজডুবি, নাবিকদের হাহাকার আর
মধ্যসমুদ্রে চকিতে ভেসে-ওঠা মৎস্যকন্যাদের গানের কথা ভেবে স্বপ্নে
সে ডুবে গেছে। অনেকটা পথ হেঁটেছে সে, আরও কিছু পথ আছে
বাকি, এ-কথা ভাবলেই মনের ভেতর তার করতালি।

এই দীর্ঘ পথ হাঁটতে গিয়ে সে গল্প জুড়ে দিয়েছে কাছের হরেক
রকম গাছগাছালি আর দূরের আকাশের তারাদের সঙ্গে, ঘনিষ্ঠ
বসে গেছে দোয়েল, কোকিল, বুলবুলি, ঘুঘু আর ডাহুকের মেলায়।
পথ চলতে ওর সখ্য হয়েছে কত মানুষের সঙ্গে, তারা অনেকে সাধারণ,
কেউ কেউ অসাধারণ। এবং এই চলার পথেই সে অন্ধকারে আতশবাজির
মতো জ্বলে উঠে হাত রেখেছে গৌরীর হাতে, ওর কালো চোখের অতল
নির্জনে ডুবে মনে হয়েছে মনে এই মানবীকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের হাজার
বছর আগে থেকে ভালোবেসেছে। গৌরীর কথা কখনও আলিঙ্গন, কখনও
চুম্বন হয়ে স্পর্শ করে তাকে। অনেকটা পথ হাঁটার পর সামনের দিকে
দৃষ্টি ছড়িয়ে ওর মনে হয়, এ পথের শেষ কোথায়, কখন-জানা নেই।
সে জানে, তার এতটুকু ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই একরক্তি। সে চায়, পথ
যেন ফুরিয়ে না যায় চলার পথে যেন থাকে চঞ্চল প্রজাপতির দল,
গাছের পাতার মৃদু কম্পন, দোয়েলের শিস, মৎস্যকন্যার ঝলসানি, গৌরীর
বাড়িয়ে-দেওয়া সোনালি হাত। পথ চলাতেই যে তার ছন্দোময়
শিহরণ। আচমকা ছন্দপতন তার কাম্য নয় কিছুতেই।
১২.১০.৯৭

দুই যাত্রী

আমরা দু’জন ছিলাম দু’দিকের যাত্রী, অথচ তড়িঘড়ি উঠে পড়ি
বেঠিক ট্রেনের এক্‌ ভুল কম্পার্টমেন্টে। যখন ভুল বুঝতে পারলাম,
তখন ট্রেন বেশ জোরে চলতে শুরু করেছে। আমরা পরস্পরের দিকে
ঘনঘন তাকাচ্ছিলাম, যেন দূরের দু’টি গ্রহ। ট্রেন যখনই একটি
ইস্টিশানকে ছোঁয় গাঢ় অন্তরঙ্গতায়, ভাবি এখানে নেমে পড়ব।
অথচ নামা হয় না। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনও বাক্য, পুরো
কিংবা টুকরো, নিবিময়ে সম্ভাবনাই জাগে না। বাক্য উচ্চারণ
ছাড়াও কথা বলার জন্যে অন্য ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার জীব সমাজে প্রচলিত।
আমরা দুজন আপাতত চোখের সহযোগিতা গ্রহণ করি। অন্য যাত্রীরা
আমাদের লক্ষ করছে কি করছে না-বিষয়টিকে তেমন আমল
দিচ্ছি না। আমার ব্যাকুলতা সারসের মতো গ্রীবা বাড়ায় আমার
সিটের উল্টো দিকে, যেখানে সে বসে আছে প্রার্থনার মতো। সারসের
চঞ্চু প্রার্থনার প্রবাহে ডোবে, ভিজে ওঠে স্নিগ্ধতায়।

হঠাৎ প্রার্থনা কেমন ছড়িয়ে পড়ে শ্রাবণের ভেজা রোদের
ধরনে। রোদের মুকুলগুলো কুড়িয়ে নিই। হ্যান্ডব্যাগ হাতে
নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসা ইস্টিশানে নেমে পড়ার উদ্যোগ
নিই মনে-মনে। আর দেরি করা ঠিক হবে না, ভাবি। ট্রেন
প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে কিছুক্ষণের জন্যে জিরোয় তৃষ্ণার্ত ঘোড়ার মতো।
এদিক ওদিক তাকাই, হ্যান্ডব্যাগ অলস কেরানির মতো আগের
জায়গাতেই ঝিম ধরে বসে থাকে। সে-ও শাড়ির আঁচল ঈষৎ
গুছিয়ে নিয়ে নিজের সিটে অনড়।

আখেরে ট্রেন এসে থামে সব শেষের ইস্টিশানে। এই
অন্ধকার, ছন্নছাড়া জায়গাটির পর আর কোনও গন্তব্যের
হদিশ ট্রেনের ড্রাইভার, গার্ড কিংবা ইস্টিশান মাস্টার
কারুরই জানা নেই। ট্রেনের কামরায় তখন শুধু আমরা দু’জন
মুখোমুখি বসে আছি নিশ্চুপ নিষ্পৃহ। কয়েক মুহূর্ত পর
আমরা ধূসর, নির্জন প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ি। দু’জন হাঁটতে
থাকি ছায়া-পোহানো কোনও প্রাণীর পিঠের মতো
প্ল্যাটফর্মের দুদিকে।

কিন্তু এ কী, চোখ ফেরাতেই দেখি, আমরা দু’জন
পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি। হাওয়ায় নড়ছে ওর কানের
দুল আর কালো চুলের ঢালে জোনাকির জ্বলা আর
নেভা, নেভা আর জ্বলা। একটি শক্ত আর একটি নরম
অন্য রকম সঙ্গীত পিপাসু হাতে বেজে ওঠে যুগলবন্দি।
১৬.৮.৯৭

দুপুর, তুমি এবং পাখি

দুপুরটার যেন গায়ে হলুদ আজ। আমি জানি, একটু পরেই তুমি
নরম পায়ে তোমাদের দোলনায় ছায়াটে বারান্দায় এসে বসবে।
দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবে সামনের দিকে, চোখে পড়বে একটি কি দু’টি
ছুটন্ত মোটারকার, রিক্‌শা। কোনও কোনও পথচারীও হবেন দৃশ্যমান।
এরই মধ্যে হয়তো আমার কথা ভাববে তুমি দূরের গাছটির প্রতি
মনোযোগী হয়ে। হয়তো তোমার কোনও বান্ধবীকে আজ টেলিফোন
না করার লজ্জা তোমাকে খানিক বিব্রত করবে, একটু পরে চোখ
ফেরাতেই তুমি হঠাৎ আবিষ্কার করবে তোমার খুব কাছে একটি পাখিকে।
তোমাকে আমার একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে পাখিকে জানিয়েছিলাম।
বিনীত অনুরোধ। ওকে বলেছি, ‘তোমাদের কথা এত লিখেছি, তার
বিনিময়ে তুমি কি আমার দয়িতার কাছে বয়ে নিয়ে যাবে না একটি
বার্তা?’ আমার কণ্ঠস্বরে আকুলতা পাঠ করে পাখি তার পাখা ছড়িয়ে
দেয় আমার সামনে। আমি প্রসারিত পাখায় লিখলাম, ‘আজ সন্ধ্যায়
এসো, প্রতীক্ষায় থাকব। তুমি এখন নিশ্চয় পড়ে উঠতে পেরেছ বিহঙ্গবাহিত
লিপি। মনে-মনে বলছ, ‘কবির আদিখ্যেতা দেখে বাঁচিনে; টেলিফোন না
করে পাখির পালকে খবর পাঠিয়েছেন। এক সময় বার্তাবাহক পক্ষীটিকে
তুমি আদর বুলোতে থাকবে। সেই স্পর্শ আমাকেই প্রজ্বলিত করবে আর
আমি লেখার টেবিলে বসে একটি প্রেমের কবিতা লেখার জন্যে শব্দের
ঝর্ণাধারাকে ডেকে আনব খাতায় পাতায়, ভাসব আনন্দ-প্লাবনে।
৯.৭.৯৭

 ধুলোমাখা জলরঙ


নব্বই-এর গণআন্দোলন, তার বিজয়, রূপান্তরিত করেছে আমাদের।
তোমাকে দেখলাম ‘জনতার জয়’ মঞ্চে কিছুক্ষণের জন্যে। ভিন্ন এক তুমি
এরই মধ্যে এক ফাঁকে কানে কানে বললে, ‘এই উৎসবে তোমাকে কিছু
উপহার দিতে মন চাইছে। ‘কী? আমার এই প্রশ্ন রৌদে ঝলসে ওঠে
শঙ্খচিলের ডানার মতো। তুমি কোনও উত্তর না দিয়ে ঠোঁটে হাসি খেলিয়ে
কোথায় উধাও। দিন যায়, রাত যায়; উৎসবের আনন্দ এখন ধুলোমাখা
জলরঙ। বর্বরদের পুনরুত্থানের কাল অনেকের আত্মত্যাগকে উপহাস করে
এসে গেল বলে। দিন যায়, দিন যায়। তোমার উপহাস আজও পাইনি।
প্রতিশ্রুতি আর কথা না রাখার মাঝখানে ভাসমান ক’জন শহীদের মুখ।
আমার না পাওয়ার তুচ্ছতায় লজ্জাবনত আমি ক্ষমা প্রার্থী তাঁদের কাছে, যাঁরা
রক্তের কালজয়ী আল্পনা এঁকে দিয়েছেন আমাদের আগামীর করোটি চিহ্নিত
বন্ধুর পথে।


কত রাত ভালো ঘুম হয় না। চেয়ে চিন্তে আনা মুশকিল, চোখের পাতা
জোড়া লাগে না। বিছানায় শুয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনও কখনও বিক্ষুব্ধ
মনে ক্যাপ্টেন আহারের মতো বহুক্ষণ পায়চারি জারি রাখি। দু’চোখে কেউ
যেন শুকনো মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়। পানির ছিটা নয় নিদান। সমুদ্র উথাল
পাথাল করে ভেসে উঠলো অতিকায়, সাদা মবি ডিক? অনেকগুলো প্রেতমূর্তি
নাচতে থাকে ঘরময়। শব্দহীন , উদ্ভট সেই নাচ দেখি শুধু আমি। আরো কত
কিছু ঘটে নির্ঘুম ঘরে; কাউকে বললে, তুমি মেরে উড়িয়ে দেবে, যেন গাঁজাখুরি
গল্প। ভাবি, কবে রাত হবে কাবার? ভাবার আর কিছু থাকে না অনিদ্রার
ক্রুশকাঠে বিদ্ধাবস্থায়। কখনও তুমি আমাকে ঘুমোতে দাও না, কখনও না-
লেখা কবিতা আমার চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে সরায় ঘুমের পাতলা কুয়াশা।
অথচ তোমাদের দু’জনের কাউকেই কাছে পাই না সেসব অত্যাচারী মুহূর্তে।
কবিতা তবুও দয়াপরবশ হয়ে মাঝে-মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয়, তুমি একেবারে ধরা
ছোঁয়ার বাইরে। কতকাল এভাবে না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে এই বয়েসী কবিকে?


চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পেতো জঙ্গলের প্রান্তসীমার ঝিল, তৃষ্ণার্ত
হরিণের পাল। ওর হাত প্রসারিত হলেই হাতে চক্ষু ঘষতো রঙ বেরঙের
পাখি। এই মুহূর্তে তার দুটো চোখ রুদ্ধ জানালার মতো, হাতে প্রসারিত হবার
ক্ষমতা গায়েব, এমন নিস্পন্দ। এখন সে মৃত্যুর উপত্যকায়। মাটির নিচে
পোকামাকড় তাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায়। টেবিলে কিছু বইপত্তর ,
চায়ের শূন্য পেয়ালা, যার গায়ে কিটস্‌-এর বাড়ি, আর একটি উজাড় শিশি।
কবিতার খাতায় সারিবন্দি হরফ নয়, কাটাকুটির বিক্ষোভ মিছিল। ডাক্তার
ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন আত্মহত্যাকে মুছে ফেলে, ঝুট ঝামেলার
ফাঁকফোকর বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। মর্গে পাঠানো হবে না একে একে অনেকে
এসে জড়ো হয়েছে প্রান্তিক বাড়িতে কবিকে শেষবারের মতো এক ঝলক
দেখার জন্যে। কারও কারও বুক ডুকরানো; হু হু বিলাপের সঙ্গে লোবানের
ঘ্রাণ জড়ানো কোরানের আয়াতের ধ্বনি ঊর্ধগামী। রহস্যময়ী একজন কবির
বাড়ির দোরগোড়া থেকেই চলে গেল সকলের অগোচরে। গাছের একরাশ
পাতার প্রশ্ন, ‘কে তুমি নিষ্ঠুরতমা এভাবে ফিরে যাচ্ছো কবিকে এক নজর না
দেখেই?’ ‘একালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা আমি, যার জন্যে কবি মাথা কুটে মরেছে
রাতভর। আমার আগমনের আগেই তার অন্তর্ধান; সে প্রকৃত প্রতীক্ষা
শেখেনি,’ নির্বিকার কণ্ঠস্বর স্পর্শ করে রক্তজবার একগুচ্ছ সজীবপাতাকে, ঝুল
বারান্দাকে।


আজকাল চেনা রাস্তাগুলো বড় অচেনা মনে হয়। যে গলিতে ছিল আমার
নিত্যদিনের আসা-যাওয়া তার ভেতরে ঢুকলে একটা লম্বা সাপের সন্ধান পাই,
যাকে দেখিনি কোনওদিন। গলির মোড়ে বসতো যে দোকানদার সে
গরহাজির, ওর জায়গায় অন্য কেউ হিসেবনিকেশে ব্যস্ত, যার চুল তেল
চুকচুকে এবং ঢেউ খেলানো। বহুবার-পড়া কবিতার বইয়ের পঙ্‌ক্তিমালা
আমার পরিচয়ের গণ্ডি ছড়িয়ে ঝুঁকে থাকে অপরিচয়ের ভরসন্ধ্যায়। বস্তুত এই
ডামাডোলে দুঃসাধ্য কাউকে সঠিক শনাক্ত করা। একজনের মুখ অন্যজনের
মুখে মিশে যাচ্ছে অতি দ্রুত। অচেনা ঘরদোর, ভিডিও ক্লাব, ছাত্রাবাস,
সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সবচেয়ে বেশি অচেনা লাগে নিজেকে, এই অচেনা
আমি-কে নিয়ে কী করি?


মধ্যরাতে এক নেকড়ে ধর্ষণ করে স্তব্ধতাকে; চমকে ওঠে শহর, জেগে
থাকা কবির কলম থেমে যায়, ছিনতাইকারীদের আস্তানায় ঝাঁকুনি। চাঁদ
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেঘের আঁচলে মুখ ঢাকে তাড়াতাড়ি; বিষণ্ন নারীর শাড়ি
থেকে খসে পড়ে লম্পটের রোমশ হাত। নিঃশব্দতার মাঝখানে নেকড়ের পথ
চলা টহলদার পুলিশের নাকের ডগার নিচে। নিমেষে সে পৌঁছে যায় শহরের
শেষপ্রান্তে। ছিনতাইবাজদের আখড়ায় পুনরায় মাতলামি, ইতরামি, লম্পটের
হাত ক্রিয়াশীল। বিনিদ্র কবি জানলা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনোযোগী কবিতার
খাতায়, গড়ে উপমা, চিত্রকল্প। নিঃসঙ্গ বেগানা এক নেকড়ে প্রগাঢ় ছায়া রেখে
যায় নিশাকালীন রচনায়।


শরীরে ফাল্গুনের উজ্জ্বলতা নিয়ে তুমি ভোরবেলা জানালে, ‘আজ বসন্তের
প্রথম দিন। ইচ্ছে হয়, তোমাকে এক গাদা গাঁদা ফুল উপহার দিই। কেন তুমি
এই বিশেষ ফুলের নাম উচ্চারণ করলে? গাঁদা বললে আমার হরিদ্রাভ
পেলবতার কথা মনে পড়ে না, এমনই স্বভাব আমার, গাধা শব্দটি জিভের
ডগায় নাচতে শুরু করে, হয়ত মিলের প্ররোচনা। এ কথা তোমাকে
জানানোর সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে হাসি ছড়িয়ে দিলে, বসন্ত দিনের রঙের
ফোয়ারা। সেই মুহূর্তে তোমার পরনে কি ছিল গাদা ফুল রঙের শাড়ি? ‘এমন
দিনে তোমাকে অন্য কিছু উপহার দেয়ার সাধ জাগে’; আমার উচ্চারিত
শব্দগুচ্ছের জবাবে তোমার ওষ্ঠ থেকে ঝরে, ‘বুঝেছি, আর কিছু বলার দরকার
নেই। কোনও কিছুই আমাদের দূরত্বের সীমা মুছে ফেলতে পারে না। আমরা
দু’জন দাঁড়িয়ে আছি দুই মেরুতে-তুমি উচ্ছ্বসিত বসন্তের রঙিন প্রান্তরে, আমি
প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের মাঝখানে, চতুর্দিকে নেকড়ের বরফ ফাটানো চিৎকার।
তোমাদের বাসায় অতিথির ভিড়। টেলিফোনী সংলাপে পড়ে ছেদ। ঘরের
মেঝেতে গাঁদা ফুলের স্তূপ। কোথাকার এক গর্দভ দার্শনিক ভঙ্গিতে এসে
তড়িঘড়ি চুমো খেতে শুরু করে ফুলগুলোকে, অনন্ত তার চিবিয়ে খাবার পালা।
গাধার আচরণ আমাকে বিস্ময়ের ওপারে দাঁড় করিয়ে রাখে, বলা যাবে না।


তোমাকেই উত্তমর্ণ বলে জানি। তোমার টুকরো টুকরো কথা আমার
কবিতার খাতাকে মুখর করে তোলে। যখন তুমি সামান্য কোনও কথা বলো
আমাকে-এই ধরো, ‘আজ ভোরবেলার মুহূর্তগুলো চমৎকার’ কিংবা ‘কাল তুমি
কোথায় ছিলে সন্ধ্যাবেলা’, তখন কবিতার পঙ্‌ক্তি জ্বলে ওঠে অবসাদের
অন্ধকারে। বারান্দায় তোমার দাঁড়িয়ে থাকা সৃজনশীলতার খরায় আনে প্রবল
বর্ষণ। তোমার চকিত স্পর্শ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এমন কোনো কবিতা,
যা আমার মৃত্যুর পরেও যুবক-যুবতীরা পড়বে মুগ্ধাবেশে। জানতেও পারো না
আমি কীভাবে ক্রমাগত ঋণী চলেছি তোমার কাছে।


যখন গোলাপ মাটিতে শুকনো পাপড়ির জটলা, তখন কি আমার নিজের
মৃত্যুর কথা মনে পড়ে? আমার বয়স দ্রুতগামী খরগোশ, অনিবার্য মৃত্যুর দিকে
এগিয়ে যাওয়া। তবু এখন, এই মুহূর্তে বেঁচে আছি, পড়ছি মনের মতো বই,
ভাবতে পারছি তার কথা, যে আমাকে হাত ধরে নিয়ে যায় স্বর্গপথে; ভাবতে
পারছি ফেরেশতাগণ জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কণ্ঠে আবৃত্তি করেন আমার কবিতা,
বেঁচে আছি বলেই কান পেতে শুনি সমাজ বদলের দূরাগত ঘণ্টাধ্বনি; আমার
অপন হৃদয় বারবার দুলে ওঠে প্রিয়তমার চোখের চাওয়ায়, দিনরাত্রি হয়ে যায়
গুণীর তান। আমার সদ্যমৃত অনুজ কোনও কোনও মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে জেমস
ডিনের ধরনে দরজায় হাত রেখে, যখন লিখি টেবিলে ঝুঁকে, সে পেছন থেকে
চোখ বুলায় আমার পঙ্‌ক্তিমালায়। আমি তাকে কিছুতেই বলতে পারি না, ‘বস
এখানে আমার পাশে’, অথবা ‘চলে যা’, এই নিষ্ঠুরতাও উচ্চারিত হয় না
মধ্যরাতে। দৃষ্টিভ্রম আমাকে পীড়িত করে। কে যেন দরজা ঠেলে ঘন ঘন ঘরে
ঢোকার জন্যে। মৃত্যু? হ্যাঁ, মৃত্যু প্রত্যহ তার ঠাণ্ডা, বিশীর্ণ, পাথুরে আঙ্গুল দিয়ে
ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। তার কোনও ভব্যতা, সমাজ সচেতনতা কিংবা
বিবেচনাবোধ নেই।

পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে


কোনও কোনও কবিতা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে; রুখু লালচে চুল, নীল চোখ,
গালে আপেলের রক্তিমাভা; ক্ষুৎ-পিপাসা, বুলেট এবং বোমা থেকে পালিয়ে
বেড়ানো উদ্বাস্তু ইরাকী বালিকা। হাত নেড়ে ডাকি, রুটি, কোকাকোলা আর
লজেন্সের প্রতিশ্রুতি দিই, তবু সে অনড়। যেন আমার চারপাশে অদৃশ্য
কাঁটাতারের বেড়া, টপকিয়ে আসার আগ্রহ নেই ওর। আমাকে উঠে দাঁড়াতে
দেখে এক দৌড়ে বালিকা-কবিতা শূন্যতায়। মেঘ নেমে আসে বুকের ভেতর।
ক’দিন পর রিকশায় যেতে যেতে ওর মতোই কাউকে দেখি আগুনের হল্কা-
ছড়ানো চৈত্রের রাস্তায়, রিকশাচালককে থামতে বলে পেছনে ফিরে তাকাই;
বাসস্ট্যান্ডে ব্যস্ত যাত্রীর ঠেলাঠেলি, ক’জন ভিখারী-সেই ভিড়ে তাকে খুঁজে
পেলাম না। রোদে-পুড়ে-যাওয়া নির্বাক কাক খুঁজছে গাছ, হয়তো কোনও
ডোবায় সেরে নেবে ত্বরিত স্নান। কোন্‌ মজা খালে বইবে আমার ভাবনার
স্রোত? এমনও তো হতে পারে, কোনও রাতে পালিয়ে-বেড়ানো সেই কবিতা
জ্যোৎস্নার ছোঁয়া লাগা আমার জানালায় বসে পা দোলাবে আর আমি ঘুমে
কাদা, অথচ কত রাত আমার নিদ্রাহীনতায় মরুভূমির মতো ধু ধু। আবার
কোনও দুপুরে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াবে, পেলব হাত রাখবে
কপালে; তখন ঝাঁ ঝাঁ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার গা, চোখ খুলে কোনও কিছু
দেখার শক্তি পর্যন্ত গায়েব। হায়, উদ্বাস্তু ইরাকী বালিকা ও তোমার কেমন
ধরন? তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে চাও এই শ্যামলিমা থেকে ইরাকের
পাথুরে জমিনে, যেখানে ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবো, ক্ষুৎ-
পিপাসায় কাতর? আর তুমি ‘কেমন মজা’ বলে ছুটবে আমার আগে আগে এক
নির্দয় কৌতুক।


আজ অব্দি, হ্যাঁ, এতদিন পরেও কিছুতেই তোমাকে বোঝানো গেল না
আমার নিঃসীম ব্যাকুলতা। কতবার চোখে সেই ভাষা এনে তাকিয়েছি তোমার
দিকে যা নিভৃততম উপলব্ধিকেও টেনে তোলে প্রত্যক্ষে, যেমন গহন ডুবুরি
সমুদ্রগর্ভ থেকে বয়ে আনে মূল্যবান, গুপ্ত সামগ্রী। আমার আঙুলগুলো কি
বাঙ্ময় হয়ে ওঠেনি কখনও? আমার ওষ্ঠে অনুরাগের ঢেউ আছড়ে পড়েনি
বারবার, এ আমি স্বীকার করি কীভাবে? আমার দিনরাত্রি নিবেদিত তোমার
উদ্দেশে, আমার সকল কাজে তোমারই ছায়া খেলা করে-এই সত্যের নগ্নতা
তোমার দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়ার আশাকে দাফন করেছি। কালেভদ্রে আমাদের
দেখা, মাঝে-মাঝে টেলিফোনে দ্বিধাজড়িত, সংক্ষিপ্ত আলাপ। বাজে,
এলোমেলো কথার ঝোপঝাড়ে কঞ্চির বাড়ি পড়ে, সবচেয়ে জরুরি কথাই
উচ্চারণের পরপারে থেকে যায়। কী করে সেসব কথা পৌঁছে দেব তোমার
কাছে। যদি বারান্দায় এসে দাঁড়াও অন্যমনস্কভাবে, তাকাও ভেসে-বেড়ানো
মেঘের দিকে, দেখবে সেখানে লেখা আছে আমার সেই কথাগুচ্ছ, যা
এতদিনেও বলা হয়নি তোমাকে; তুমি পড়ে নিও যদি ইচ্ছে হয়। যখন তুমি
দরজা খুলে বেরুবে কোথাও বেড়ানোর জন্যে তখন লক্ষ করলে দেখতে পাবে,
কাঠ কিংবা লোহা থেকে ঝুরঝুর ঝরছে আমার আকাঙ্ক্ষার অনূদিত ভাষা।
কখনও তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না সময়ের পায়ে বেলাগাম বুনো
ঘোড়ার ক্ষুর। আমাদের প্রেম একটি অসমাপ্ত কবিতার মতো, তুমি কি জান?


অন্ধকারে এ কার হাত ছুঁল আমাকে? হতেই পারে না, দুপুর রাতে তুমি
এসে ঘুম ভাঙালে আমার। কে আমাকে একবার স্পর্শ করে চলে গেল? আমার
শরীর ছাড়া কোনও আলোড়ন নেই ঘরের কোনওখানে। তোমার নিদ্রার
উদ্যানে যাওয়া হবে না আমার; এই মুহূর্তে তোমার শয্যার পাশে গিয়ে বসব,
তোমার চুল নিয়ে খেলব কিছুক্ষণ, নিদ্রিত স্তনকে জাগিয়ে তুলব চুমোয়, এমন
সাধ্য আমার নেই। আমার হৃৎপিণ্ড এখন তোমার নামের ধ্বনি জড়িয়ে বেজে
চলেছে দ্রুত, তুমি শুনতে পাবে না। তোমাদের রাস্তায় এখন হয়ত জিনস্‌ পরা
কোনও মাতাল যুবক গালি ছুঁড়ছে ল্যাম্পপোস্ট তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে
বলে। হয়ত গত রাতে ওর পিতার মৃত্যু হয়েচেহ প্রবল স্ট্রোকে; মাথায় একটা
গোটা সংসার নিয়ে মাতলামো করা পলায়বৃত্তিকেই এক ধরনের আস্কারা।
তোমার চুলের ঘ্রাণ, স্তনের গোলাপি চাউনি, আঙুলের চঞ্চল শোভা নিয়ে আজ
মধ্যরাতে আমিও বড় মাতাল। আমার নিঝুম ছোট ঘর দুলছে, যেন বুড়িগঙ্গায়
বজরা; লেখার টেবিল, বুক শেলফ, টেলিভিশন সেট জুড়ে দিয়েছে জিপসি-
নাচ। বোদলেয়ারের অমোঘ বিধান মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় কী? আমার
এই মাতলামো কারও কাছে শুদ্ধ শিল্প আখ্যা পাক, চাই না। তোমরা কেউ
কবিকে খুঁজো না তার রঙিন মওতায়, মানুষটিকে তুলে নাও বুকে।


খট্রাশ সমাজের গালে জোরসে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিলেই তো পার।
তোমার কি কখনও ইচ্ছে করে না আমার হাত ধরে খোলা রাস্তায় হেঁটে যেতে
ভ্রূক্ষেপহীন? রোজ তোমার ত্রিভুবন-ভোলানো চুম্বনের ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে থাকি,
এ-ও কি তোমার ইচ্ছার পরিপন্থী? তোমার বাক্যসমূহে ‘নায়ের আধিক্য
আমাকে পীড়িত করে। হঠাৎ কোনওদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজে এলে তুমি আঁচল
দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরবে, এরকম আশা
নিশ্চয় আকাশছোঁয়া নয়। অনিয়মের চৌখুপি চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসার
আগ্রহ আহত চিলের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এক কোণে। নির্ভুল
সামাজিকতা তোমার নখদর্পণে, আমি অবাক হয়ে দেখি। তুমি নির্ভর আমার
স্বপ্নগুলো গ্রীষ্মের কুকুরের জিভের মতো লক লক করুক, এই কি তোমার
প্রত্যাশা? তুমি কি চাও আমার শেষ পারানি কড়ি, ভালোবাসা, ভিক্ষুকের
ভঙ্গিতে সর্বদা হাত পেতে থাক? তাহলে সাফ সাফ বলে দাও, আমি আমার
প্রিয় বাসনাসমূহকে ফাঁসিতে লটকিয়ে কিংবা দাউ দাউ চিতায় তুলে দিয়ে
দশদিক কাঁপিয়ে হো-হো হেসে উঠি। অনন্তর এপিটাফ লিখে তোমাকে
শোনাতে আসব না।


অনেকক্ষণ ক্ষেতের আল-পথে হেঁটে আমি কি কখনও কোনও তরুণীকে
শেষরাতে আলুঘাটায় নৌকায় তুলে দিয়েছিলাম? স্তব্ধতা-চেরা বৈঠার শব্দে
চমকে উঠেছিলাম? জানি না কেন এই প্রশ্ন আজ হঠাৎ তোমাকে ভরদুপুরে
রিকশায় তুলে দিতে গিয়ে মনের গহন স্তরে ঝিকিয়ে উঠল! তোমার শাড়ির
আঁচল আটকে গিয়েছিল ত্রিচক্রযানের কোনও অংশে, আমি আলগোছে
ছাড়িয়ে দেয়ার সময় লক্ষ করি, তোমার মুখাবয়বে লজ্জার ঈষৎ রঙধনু।
তোমাকে নিয়ে রিকশা সদর রাস্তায়। ফিরে আসি ঘরে, পল এলুয়ারের
কবিতায় মন বসে না। আমার হৃদয় জুড়ে সারা দুপুর তুমি, বিকেলে তুমি
রাত্রিতেও তুমি। সন্‌জীদা খাতুনের ‘গীতাঞ্জলি’ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে
টেলিভিশন বন্ধ করে দিই। কিন্তু মনের পর্দার আলো কী করে নিভিয়ে দেব,
যেখানে তুমি বসে আছ, নিজস্ব পরিবেশের সম্রাজ্ঞী, চুল খোলা, ঈষৎ ভেজা
ঠোঁটে প্রজাপতির মতো উড়ছে কবিতার পঙ্‌ক্তি? তোমার রিকশা চলেছে
কালপুরুষের পাশ দিয়ে। তোমার মাথায় নক্ষত্রের মুকুট; তোমাকে শুভেচ্ছা
জানায় স্বাতী এবং অরুন্ধতী।


ভৌতিক জ্যোৎস্নায় ঘণ্টাধ্বনি শুনি; আমার যাবার সময় হয়ে এল।
মুগ্ধতাবোধ আছে, অথচ কোকিলের ডাক শুনি না বহুদিন। সুন্দরের মুখে
জলবসন্তের দাগ। কিছু কিছু কাজ অর্ধসমাপ্ত, অনেক কিছুই অসমাপ্ত, তবু চলে
যেতে হবে অনিবার্যভাবে, ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে যাবে একলা, ফাঁকা
নৌকা; অনিশ্চয়তার মুখে ক্রূর হাসি। কবিতার খাতার অনেকগুলো পাতা
শাদা, ডুকরে ডুকরে কাঁদবে নাকি? টেবিলে প্রুফের তাড়া পড়ে আছে
সংশোধনের অপেক্ষায়। তোমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা হয়ে ওঠনি। কী
করছ তুমি এই রাতে ভৌতিক জ্যোৎস্নায়? গভীর রাতে সফল সঙ্গম শেষে তুমি
কি তৃপ্তিকর ঘুমের মসলিনে আবৃতা। না কি বাথরুমে ঢোকার আগে বুক চিরে
বেরুল দীর্ঘশ্বাস অতীতের চৌকাঠে ঠোকর খেয়ে? কামকলার সাময়িক
অবসানে ভাবছ আধুনিক শিল্পকলার অগ্রযাত্রার কথা। আমি আকাশের দিকে
তাকিয়ে আছি; দেখছি নক্ষত্রের অস্পষ্ট উদ্যান; প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছায়াপ্রতিম
ট্রেন, আবছা গার্ড বাজাচ্ছেন অস্পষ্টশ্রুত হুইসেল। অকস্মাৎ মনে পড়ে,
পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে ইলেকট্রিক বিল সেই কবে থেকে চাপা পড়ে আছে।

ফ্ল্যাশব্যাক এবং …

শৈলাবাস, যা স্যানাটরিয়ামও বটে, ভিড়াক্রান্ত। এখন সেখানে প্রজ্ঞা
ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তপ্ত শলাকা দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে
বিবেকের চোখ; উপরন্তু ওর হাতে ভারী শেকল, পায়ে বেড়ি। বোধি
নির্বাসিত। মিথ্যার বারফট্রাই আর মাস্তানিতে সত্য গা ঢাকা
দিয়েছে। আমাদের কোনও কোনও স্বপ্ন বিশ্বাসঘাতকতায়
মেতে আমাদের বিদ্রূপ করে যখন তখন। এখানে অনেকে
একজনের নাম বলতে গিয়ে দিব্যি অন্যজনের নাম উচ্চারণ করে
সগৌরবে। সেজন্যে কারও বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই। অনুশোচনা তো
অনেক আগেই বেপাত্তা। পাড়াপড়শিরা শরমের মাথা খেয়ে বরং
কোমরে ঘুনসি এঁটে হাসির গিটকিরি ছড়ায় চৌরাস্তায়।
ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ঢের হ্যাপা আছে জেনে বড় মেজো সেজো অনেকেই
দল বদলের রঙে মাতোয়ারা, অনেক জাঁকালো চণ্ডীমণ্ডপের
ফরাসে বসে ফরাসি টানে। কেউ কেউ দেশ অ্যাকোরিয়াম হোক,
এই মতো স্বপ্ন দ্যাখে ভয়ে ভয়ে।

কয়েকটি কলহংস-শব্দ বাড়িটার পাছদুয়ার দিয়ে ভেতরে
আস্তেসুস্থে প্রবেশ করে। কলহংসগুলোর শরীরে রৌদ্র-জ্যোৎস্না,
জল-হাওয়ার দাগ, দীর্ঘশ্বাসের ছায়া কম্পমান। শেষ রাতের
প্রহরকে চমকে দিয়ে মীরা বাঈ-এর ভজনস্নিগ্ধ হাতের কঙ্কন
নগ্ন মেঝেতে গড়ায়। ছাদ, দেয়াল, সিঁড়ি মেঝে ফুঁড়ে
রক্তের ফোয়ারা। আলাওলের পুঁথি আর রবীন্দ্র রচনাবলী
রক্তবমনে অচেতন। আলাওলের পদ্মাবতী রক্তস্নান সেরে ওঠে গভীর
গভীরতর বেদনায়। সারা গায়ে আনারের দানার মতো রক্তফোঁটা
নিয়ে হু হু বুকে লেকের কিনারে ছুটে যায় ‘পদ্মাবতী’র কবির রাজহাঁসের
পালকে বানানো লেখনীর সঙ্গে জলে সহমরণের অভিলাষে। রক্তভেজা
অচিন পাখিকে দেখে ছেঁউড়িয়াতে আচমকা ছিঁড়ে যায় লালনের
একতারার স্তব্ধ অথচ সপ্রাণ তার।
অতিকায় এক সোনালি দেয়ালের পিঠ থেকে নেমে আসেন তিনি। তাঁর
চোখে যুগপৎ বেদনা আর কৃতজ্ঞতার অশ্রুকণা চিক চিক করে
শ্রাবণের শেষ রোদে। ক্ষতবিক্ষত মানচিত্রের মতো বুক চেপে তিনি
দেখছেন কি দ্রুত তাঁর প্রাণের বাংলাকে এক প্রকাণ্ড পাগলা
গারদে রূপান্তরিত করা হয়েচে। এখানে সবাই বড় বেশি
স্বাভাবিক সুস্থতার নাটুকে ঢঙ দেখিয়ে চলেছে। একটা বদ
হাওয়া এতকাল আচ্ছন্ন করে রেখেছে স্বদেশভূমিকে। দেখা
যাক, মনে মনে বলেন তিনি, আমার উত্তরাধিকার অতীতাশ্রয়ী
না হয়ে সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে কিনা। সারাক্ষণ শুধু
অতীতের দিকে মুখ রেখে চললে প্রগতির চাকা ডোবে
পিছল কাদায়। আমার উত্তরাধিকার পেছনে কিংবা সামনের
চোরাবালিতে পা রাখলে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হবেই হবে
স্বজনেরই হাতে।

অনন্তর তিনি অপেক্ষমাণ সোনালি দোয়েলটির দিকে খানিক
তাকালেন, তাঁর চোখে একটি প্রশ্ন নক্ষত্রমালা হয়ে
দুলতে থাকে।
১৩.৮.৯৭

ব্যক্তিগত হরতাল

আজ আমি কোনও কাজ করব না। আজ সকাল-সন্ধ্যা আমি
আমার ব্যক্তিগত হরতাল ঘোষণা করেছি। আমি নিঃসঙ্গ, সমিতিছুট;
পিকেটিং চালাবার মতো দলবল আমার নেই। যা কিছু করবার একা
আমাকেই করতে হবে। ভোরবেলার প্রথম আলো যখন গাছের
সবুজ ঠোঁটে চুমো খাবে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখব না।
অন্ধকার ঘরেই শুয়ে থাকব কিছুক্ষণ, জ্বালব না আলো শেষরাতের
স্পর্শলাগা জনহীন গলির সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানালার কাছে গিয়ে
দাঁড়াব না। বেলা বাড়তেই কয়েকটি প্রজাপতি উড়ে আসবে আমার ঘরের
ভেতর। ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব, আগেকার মতো জিগ্যেশ করব না
ওদের কুশল। খবরের কাগজ পড়ে থাকবে এক পাশে, চোখ পর্যন্ত বুলাব না
পাতায়। স্নানাহার থেকে বিরত থাকব আজ। দু’দিনের না-কামানো
দাড়িকে আরও একদিন বাড়তে দেব। বাংলা একাডেমীর সাহিত্য সভায় অথবা
আজিজ সুপার মার্কেটে আজ আমাকে দেখবে না কেউ। কোনও বই কিংবা লিটল
ম্যাগাজিন কেনার তাগিদ অনুভব করব না আমি। আজ কোনও কোনও আড্ডা হবে না
আমার ঘরে। না, ডাকঘরেও যাব না পোস্টকার্ড কিংবা এনভেলাপ কেনার জন্যে।
কোনও বই ছুঁয়ে দেখব না, বলে দিচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত হরতাল পুরোদমে
সফল হবে। সে আজ থেকে ক’দিন আমার এই জন্মশহরে তার অনুপস্থিতির ঘোর
অমাবস্যা ছড়িয়ে রাখবে। এই অসহনীয় অমাবস্যার প্রতিবাদে সকল কাজে
তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি।

হঠাৎ কবিতা সব কাঁটাতারের ব্যারিকেড ভেঙেচুরে আমার মগজের কোষে
কোষে গায় বীজবপনের সোনালি গান। কবিতা ধর্মঘটী কলমকে তুলে দিল
আমার হাতে। শুধু গৌরীর না-থাকার বেদনাকে আমার ভেতরে দ্বিগুণ করে
কবিতা ফুটতে থাকে নীলাক্ষরে শাদা পাতায়।
৩১.৮.৯৭

ভিন্ন ভুবনে

বহুদিন পর সন্ধ্যা রাতে আবার সেখানে। গেট পেরুতেই আমার
শরীরের অনেক দিনের আলো-ছায়া গান হয়ে যায় বাগানটিকে দেখি
বাড়িটার মুখ থমথমে। আমার দীর্ঘ না-আসা ওর অবয়বে ঝুলিয়ে
দিয়েছে অভিমানের মেঘ, যেন এখনই বইবে জলধারা। ওর গায়ে কতবারই না
চোখ বুলিয়েছি সস্নেহে, করেছি সানুরাগ করমর্দন। কতদিন তার
বুকের এক পাশে নিবিড় বসে স্বপ্নের উপত্যকায় ভ্রমণের বর্ণিল অভিজ্ঞতা
সঞ্চয়ের অবকাশ হয়েছে আমার। মুহূর্তগুলো এক মুঠো মুক্তো হয়ে উঠত।
বাগানের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা অধিক লতিয়ে ওঠে। মনে পড়ে,
সন্ধ্যামালতী, জিনিয়া আর রঙ্গনের উৎসুক দৃষ্টি কেমন নিবদ্ধ থাকত
আমার দিকে। কখনও কখনও চোখ ফেরাতে পারতাম না, আহ এমনই
বাহার। এক জ্যোৎস্নারাতে স্বর্ণচাঁপ গাছটিকে মনে হয়েছিল ছায়াপথ
বেয়ে নেমে-আসা এক অপ্সরা। গাছগুলোর পুঞ্জ পুঞ্জ গভীর সবুজ কবিতা
লেখার আগের মুহূর্তরূপে মন-মেঘে মেশে। যার স্নেহার্দ্র
পরিচর্যার যৌবনের গৌরবদীপ্ত এ বাগান, তার হাত ধরেই এখানে
প্রথম প্রবেশ আমার। এই উদ্যান তার অন্তর্লোকে কখনও সৃষ্টি করে
সপ্তসুর, কখনও জাগায় রঙধনু, কখনও-বা জ্যোৎস্না-প্লাবনে ভাসে
হৃদয়ের একূল ওকূল। আমি সর্বস্ব পণ করে সেই প্লাবনে
ভাসিয়েছি তরী। বাড়িটার মুখ থেকে অভিমানের মেঘ অপসারিত;
ওর ঠোঁটে ঘন ঘন হাসির ঝিলিক আর বাগান পুষ্পল তাকিয়ে
বলে, ‘কবি, আবার এসো আমাদের এই সান্ধ্য সভায়। প্রতীক্ষায়
থাকব।‘ আমি হাতে নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ চলি, পথের ধুলায়
স্বপ্নিল হরফে লেখা শুভেচ্ছাবাণী। আর মালঞ্চের যিনি অধিশ্বরী
তার হৃদয়ের গান, মননের আভা আমাকে পথ দেখায় সামনের
দিকে। মুঠোভরা নক্ষত্র মদিরার পাত্র হয়ে আমার ওষ্ঠ স্পর্শ
করে নিমগ্নতা বুলিয়ে, আমি প্রবেশ করি দিগন্ত-ছেঁড়া ভিন্ন ভুবনে।
১৯.৬.৯৭

ভোরবেলা চোখ মেলতেই

ভোরবেলা চোখ মেলতেই দেখি আকাশে কালো মেঘের
জটলা। মেঘ গলছে বৃষ্টি হয়ে, ঘুমের ঘ্রাণময় মন
ভিজতে থাকে। রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম তুমি এসেছ আমার কাছে
কদম কানন পেরিয়ে সেই নীল যমুনার তীর ঘেঁষে কত দূর থেকে।
জাগরণের এই মুহূর্তে হঠাৎ তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্যে আমার
হৃদয় হলো কদম ফুল। আকাশের ঘনকৃষ্ণ মেঘ আর রাধা-
বিদ্যুৎ দেখি। তারপর নেমে-আসা বৃষ্টিধারার দিকে তাকিয়ে থাকি
নিষ্পলক। কেমন ব্যাকুলতা ঠোঁট তোমার ঘুমের সরোবরে
কোনও ঢেউ জাগাতে পারবে না এখন। তুমি জানবেও না এই মুহূর্তে
তোমাকে দেখার জন্যে আমি কেমন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আমার চতুর্দিকে
জেগে-ওঠা মরুভূমিতে। এই যে আমার হৃদয় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে
তোমার নিদ্রিত শরীরকে একটু স্পর্শ করার জন্যে, এ-কথা তুমি বুঝবে
কী করে? আমার হৃদয়ের ওষ্ঠ তোমার ঠোঁটে মিলিত হওয়ার উদ্দেশে
পাখি হয়ে উঠতে চাইছে তুমি অনুভব করতে পারবে কি, যখন তোমার
শরীর থেকে ঝরে যাবে ঘুমের কুয়াশা?
৯.৭.৯৭

 মধ্যমার প্রতি

ক’দিন থেকে আমার ডান হাতের মধ্যমা এক অর্থহীন হরতাল
শুরু করেছে। কোনও কাজই করবে না আর। আজ সকালে
হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে
উদ্ধত ভঙ্গিতে। কোনও নেপথ্যাচারী স্বৈরাচারীর লেলিয়ে দেওয়া
দালালের মতো আমার বিরুদ্ধে লাগাতার শ্লোগান দিতে
শুরু করেছে। প্রেমের কবিতা লেখার সময় সে আমার কলম
স্পর্শ করবে না-এই ওর ঘরফাটানো দাবি। বুঝতে পারি না,
কেন এই না-হক দাবি মধ্যমার? আমার দিকে সরোষে এক
স্মারকলিপি ছুঁড়ে দিয়েছে সে। স্মারলিপি পড়ে হতবাক আমি ফ্যালফ্যাল
তাকিয়ে থাকি সেই লুম্পেনের দিকে। বিশেষত প্রেমের কবিতা লেখার
সময় সহযোগিতার দরজায় সে ডবল তালা ঝুলিয়ে দেবে। টেবিলে
দাঁড়ানো মধ্যমাকে বললাম, “দ্যাখো হে, বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু
করেছ। কী না করেছি আমি তোমার জন্যে? তোমার কষ্ট হবে
ভেবে কখনও কখনও লেখা মাঝ-পথে থামিয়ে দিয়েছি। তোমাকে
গোলাপের মখমল-পাপড়ি ছোঁবার, শিশুকে আদর করবার, আমার
দয়িতার গাল, গলা, স্তন, কোমর স্পর্শ করবার অধিকার দিয়েছি অকুণ্ঠচিত্তে।
‘গীতবিতানে’র পাতা সমুদয়, গ্রিক ট্রাজেডি, প্লেটোর ‘রিপালিক’, রিল্কের
‘ডুইনো এলিজি’, জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’-এর পাতা
ওল্টানোর অসামান্য সুযোগ কি দিইনি তোমাকে?”

হে প্রিয় মধ্যমা আমার, কে তোমাকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে
দিয়েছে আজ? আমার কোনও কোনও প্রবীণ বন্ধু প্রেমের কবিতার
সঙ্গে আমার এত লদকালদকি পছন্দ করেন না। ‘লদকালদকি’
শব্দটি অবিশ্যি তাদেরই মুখনিঃসৃত। ভাবলে কী করে তুমি অসহযোগ
আন্দোলন শুরু করলেই আমি প্রেমের কবিতার দেশ থেকে নির্বাসিত হব
হে মধ্যমা? তোমার অজানা নয় যে স্বদেশ, জ্ঞানান্বেষণ, কবিতা এবং
ভালোবাসার প্রতি চিরনিবেদিত। যার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখতে
না পেলে, যার সঙ্গে একদিন দেখা না হলেই হৃদয় হয় আহত পাখি,
যার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কবিতার ভাষা ভুলে যাই, তাকে
নিয়ে কবিতা লিখব না কারও ফরমানের ধমকে এমন উদ্ভট চিন্তা
তোমার মাথায় ঢোকাল কে?

দেখ, তোমার স্মারকলিপি কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি বাজে
কাগজের ঝুড়িতে। তুমি কোন্‌ ছার, তোমরা দশজন সঙ্গী ঐক্যজোট
বেঁধে ধর্মঘট করলেও মাথা নত করব না, মানব না হার। যত কষ্টই হোক
দাঁত দিয়ে কলম চেপে ধরে কবিতা লিখব, প্রেমের কবিতাই লিখব।
দেখে নিও, প্রেমের দেবতা হবেন আমার পরম সহায়। আমার
খাতার পাতা-জোড়া এক নন্দিনীর হরফে-গড়া প্রতিমার মুখের হাসির
ঝর্ণাধারা দেখে তোমাদের ধর্মঘটী মুখ চুন হয়ে যাবে। তোমাদের
ঘিরে ছেয়ে আসবে ঘোর অমাবস্যা।
১৭.৭.৯৭

মাঝে মাঝে মাটিতে

মাঝে মাঝে মাটিতে বুক রাখি। আমার হৃৎস্পন্দন আর
মাটির বুকের টিপটিপ শব্দের যুগলবন্দি চলে অনেকক্ষণ।
মাটিলগ্ন হয়ে থাকবার এই আনন্দ উত্তাল ঢেউয়ের ওপর নৌকো।
আজ গুচ্ছ গুচ্ছ ঘাস ভেদ করে আমার বুক যখন মাটিতে পেতে
দিলাম, জমি আমাকে শোনাল দীর্ঘ পদধ্বনি। ক’জন লম্বা, শক্ত
সমর্থ, কান্তিমান পুরুষের পদযাত্রা আমার পাশ ঘেঁষে। আমি
অনন্য কোনও উৎসব-উদ্‌ভাসিত বালকের মতো তাঁদের শনাক্ত করি
আমার পূর্বপুরুষ বলে। তাঁরা আমার উদ্দেশে কোনও বাক্য
উচ্চারণ না করেই হিলহিলে শস্য ক্ষেতে প্রবেশ করলেন। শস্যের
কোরাসে মুগ্ধ আমি মাটিকে আরও বেশি বুকে বাঁধি। খানিক পরে
দেখি, আমার মৃতা জননী হেঁটে যেতে-যেতে আমার দিকে তাকালেন
অবর্ণনীয় স্নিগ্ধতায়। তাঁকে নির্বাক দেখে আমার কম্পিত ঠোঁট উচ্চারণ
করে, ‘মাগো, তুমি আমার সঙ্গে একটি বারও কি কথা বলবে না আর?
মার নিশ্চুপতা জায়গাটিকে অধিকতর নির্জনতা নীরবতা দান করে।
অসহায় আমি মাটিতে মুখ ঘষি, যেমন শৈশবে ঘষতাম মার বুকে।

আমার ঢিপঢিপ বুক মাটিতে লগ্ন। হঠাৎ এ আমি কী অনুভব
করছি বুকের নিচে? প্রিয়তমা, এখন মনে হচ্ছে আমার বুকের নিচে
তোমার উদ্ভিন, স্ফুরিত স্তনদ্বয়। অথচ তুমি তো এখানে নেই কোথাও
এই মুহূর্তে। যখন তুমি ফিরে আসবে এই রুগ্ন আমার কাছে, হাসপাতালের
ফ্যাকাশে দেয়াল হয়ে উঠবে নববধূর গালের লালিমা। ফুটপাথ ফুঁড়ে
দেবশিশুর মতো দুলবে অজস্র ফুল। তোমার এই না-থাকা ক্রমাগত
কালো রঙ ছড়ায় আমার চিদাকাশে।

মাটি মাতৃস্নেহে আমার বুকে স্বপ্ন-শস্য ফলায়, টেনে নিতে চায়
সোঁদা কোলের গভীরে। জমি নিজের বুকে চিরে আমার ঠোঁটের
কাছে এক হাত মুলিবাঁশ তুলে ধরে। মুলিবাঁশে ফুঁ দিই বেনামি
ব্যাকুলতায়। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে সুরজাল। আমি সুরবিহ্বল
নৃত্যমোহিত ময়ূর।
৩.৯.৯৭

যদি বদলে দেয়া যেতো


যদি বদলে দেয়া যেতো নিছক এই ছকবাঁধা জীবন। প্রাতঃকৃত্য, খবরের
কাগজ শুঁকে শুঁকে কিছুসময় কাটানো, রুটি-তরকারি, ধোঁয়া-ওগরানো চা,
স্বল্পকালীন দরকারি গার্হস্থ্য কথাবার্তা, অফিসে দৌড়ানো, কাজ-অকাজ,
আড্ডা, নোংরা টয়লেটে আরশোলা পায়ে-মাড়ানো, মলমূত্রত্যাগ, কায়ক্লেশে
ঘরে ফেরা, নৈশ আহার, বেঁচে-থাকা না-থাকার ভাবনা, এই পৃথিবীতে কে
কাহার, নিদ্রা, যেন উন্মাদের লাগাতার কাগজ ছেঁড়া, মৈথুন, নিদ্রা, ভোরে
সদ্যচরের মতো জাগরণ-দুঃসহ এই পুনরাবৃত্তি। মরিয়া জুয়াড়িবৎ সর্বস্ব পণ
রেখে এক দানে জীবনকে পাল্টে ফেলার সাধ ময়ূরের পেখম। এমন কি পারে
না হতে আর নই গৃহী, নির্দিষ্ট কোথাও বারবার আওয়া নেই, নেই ফিরে আসা?
উপেক্ষিত নিসর্গের সঙ্গে আলাপ, শ্যামলিম উপত্যকায় শুয়ে-শুয়ে শ্লথগতি
মেঘের শোভা নিরীক্ষণ, অনূঢ়া, স্বাস্থ্যবতী, কামার্তা গয়লানীর সঙ্গে শয়ন
সুস্নিগ্ধ ঝোপের আড়ালে কিছুক্ষণ, ঘাগরা ওল্টানো, শ্বাসরোধকারী চুম্বন,
ক্ষমাহীন আলিঙ্গন, মিলন, পুনর্মিলন; অনন্তর পাহাড়-বেয়ে-ওঠা, অশ্লীল,
আক্রমণপরায়ণ মানবপিণ্ড থেকে দূরে ভ্রমণ, পাহাড়ি প্রাণীর বিধানবিরোধী
সহযাত্রী; নির্ধারিত বৃত্তিহীন ফলমূল ভক্ষণে ক্ষুধার নিবৃত্তি,-এসব কিছুই কি
সম্ভাব্যতার পরপারে? জীবনকে আত্মদ্রোহে স্থাপন করতে প্রবল ইচ্ছুক আমি
প্রথাছুট, বৈচিত্র্যময় চলমানতায়।


জগৎ-সংসারে কে আছে এমন যার শ্রুতি বিমোহিত নয় ঘন সবুজ পত্রালি
থেকে কিচ্ছুরিত সূর্যরশ্মির মতো কোকিলের সুর, ঝর্ণাজল আর নুড়ির মোহন
সংঘর্ষে উৎপন্ন মৃদু কলম্বর আর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির হৃদয় থেকে উৎসারিত
বংশীধ্বনিতে? এমন কারও সন্ধান কি পাব যে আবদুল করিম খাঁর যমুনা
তীরের স্বর্গীয়, চিরব্যাকুল ছলাৎছল, রবিশঙ্করের সেতারের নির্ঝর, য়ুহিদি
মেনহুইনের বেহালা-নিঃসৃত সুরধারায় অবগাহনে অনিচ্ছুক? বন্দনীয় এইসব
সুর থেকেও, হে মেয়ে অনেক মধুর তোমার প্রেমার্দ্রে কণ্ঠস্বর, যা আমার
ভেতরের চাপা আগুনকে উসকিয়ে কখনও দীপান্বিত শবে বরাত, কখনও বা
আবীর-ছাড়ানো বসন্তোৎসব।


সারা দিনমান ইট ভাঙার শব্দ, ঘাম-ঝরানো খাটুনি। আমার মুহূর্তগুলো
ভারী হাতুড়ির অবিরাম পিটুনিতে বিচূর্ণিত। হে মধ্যরাত্রির শান-বাঁধানো
ফুটপাথ, হে নিঃসঙ্গতার কালো সাঁড়াশি, মাঝ মেঘনার লাফিয়ে-ওঠা ডাগর,
রূপসী মাছ, নিষ্পাপ চুম্বনের স্মৃতি, অবসরের আঙুলে ঘূর্ণ্যমান আংটি, পুরানো,
শূন্য বাড়ির অভ্যন্তরীণ প্রতিধ্বনি, দিগন্তের শব্দহীন, ধূসর চিৎকার, দু’জনের
কল্পিত পলায়ন, সংসারবিহীন সংসার, খরার পরে বৃষ্টির তুমুল কত্থক,
নেশাতুর নানা প্রহরের সাইকেডেলিক চিত্রমালা, আঙুলের ডগার কাঠিন্য,
কুকুর কুকুরীর বেআব্রু প্রণয়, হে গা-গুলোনো, নিঃশ্বাস অপহরণকারী গার্হস্থ্য,
হে অন্তর্গত লতাগুল্মঢাকা সন্ন্যাস-তোমাদের কাছ থেকে বহুকাল কর্জ নিয়েছি
বিরল সম্পদ। ধারদেনা চুকিয়ে দেয়ার সাধ অনেক দিনের, অথচ নিষ্ফল শ্রম
আর খঞ্জ প্রেরণায় সতত আমি অধমর্ণ।


তুমি কি জান যখন দুষ্ট বালক আগুন ধরিয়ে দেয় নীড়ে, ছিন্নপালক,
শাবকহারা পাখির তখনকার অভিব্যক্তি? হতে কি পার নৌকো ডোবার মুহূর্তে
যাত্রীর অনুভূতির অংশীদার? জিভ বার করে দেয়া দেয়ালের আর্তনাদের সঙ্গে
তুমি পরিচিত, একথা ধরে নিয়ে বলি, উদ্যানের ফুল, ঝুঁকে-থাকা আকাশ,
আমার সংশয়াকুল মনে বইয়ে দেয় না সুবাতাস। অপরাহ্নের ক্রোড়ে সমর্পিত
ঘাসঘেরা করোটির ওপর প্রজাপতি আর ফড়িং-এর ওড়াউড়ি, প্রায়শ নির্ঘুম
রাতে, হে প্রধান সুন্দরী, তোমার বাসার দিকে ফেরানো আমার মুখ, সম্মোহিত,
তন্নিষ্ঠ, তুমি কি জান?


কী হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে? আয়ত তোমার চোখ, সেই জন্যেই
সপ্তর্ষিমণ্ডল, পর্যটক মেঘ, উদ্ভিন্ন গোলাপ। সোনালি তোমার বাহু, সেই জন্যেই
এই আলিঙ্গন, শূন্যতার খুনসুটি, হাওয়ার মাতলামি। স্ফুরিত তোমার ঠোঁট,
সেই জন্যেই তৃষাতুর কথা, অন্ধকারকে দীপান্বিতা-করা হাসি, মদির আগুন
ধরানো চুম্বন, বুজে আসা আমার চক্ষুদ্বয়। নিখুঁত তোমার গলা, সেই জন্যে
কাঁধ-বেয়ে-নেমে আসা চুলের জড়িয়ে ধরা, আমার নিঃসঙ্গতা আর
অনুপস্থিতিকে চুমুক-খাওয়া কণ্ঠস্বর, পথ-হাঁটার ওপর ছড়িয়ে পড়া গান। কী
হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে চিররৌদ্র, চিররাত্রিময় এই শহরে? কী
করব আমি, যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে দিগন্তে মিলিয়ে-যাওয়া পক্ষধ্বনির মতো
বিচ্ছেদ? সত্যি-সত্যি কুরে-কুরে-খাওয়া বিরহ কি ডিম পাড়বে আমার
অস্তিত্বের অতল গহ্বরে? চাবিফোকর দিয়ে বিশ্বদর্শন সম্ভবপর কিনা, এ নিয়ে
নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা গ্যাছে মাঝে মাঝে নানা কাজের ফাঁকে। কাটা
মুণ্ডু ভাসমান, বড় রকমের বিস্ফোরণে আসমান ভেঙে পড়বার উপক্রম।
কোথায় লুকিয়ে বাঁচবে, সে-পথ খুঁজতে খুঁজতে সবাই বেসামাল। আমার
চোখে শুধু চাবিফোকর আর তোমার বিপন্ন মুখ। একটি প্রশ্ন ঐন্দ্রজালিকের
মতো আমার নাক বরাবর ছুঁড়ে মারছে মুঠো মুঠো ঝিলিক-দেয়া তারা-কি
হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে? টোপর-পরা বিদ্রূপ ব্যালকনিতে বসে পা
দোলায় ঘন ঘন; ধপাস শব্দে চমকিত দেখি নিজেকে মেঝেতে, চোখ দুটো
উল্টে যাচ্ছে, জানলাভেদী সেবিকা জ্যোৎস্না চোখের পাতায় আঙ্গুল বুলোয়!
আমার সঙ্গে কেউ কি ধুলোয় খেলতে আসবে আবার ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও
কামড়ে-ধরা কোনও খেলা?


আর কড়া নেড়ে-নেড়ে ক্লান্তির ভারে-নুয়ে-পড়া নয়। এবার দড়াম ঢুকে পড়বো
দস্যুতার শিখায় প্রজ্বলিত। মনঃপূত নয় এই আচরণ, কিন্তু কি করা? নিষিদ্ধ ফল
ভক্ষণের পরে হতচকিত আদমের মতো পাতাময় ত্রিডাল নেব না ভিক্ষা;
জ্যোতির্ময় উন্মাদনা আমাকে উদোম করেছে। চার দেয়াল ডালকুত্তা, ধুলোমাখা
নিভন্ত বাল্বগুলো ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে, সোফা অতিকায় হাড়গিলা,
ভয়-ধরানো। হাওয়া ভূতুড়ে, শক্ত লতার মতো জাপটে ধরে, মটমটিয়ে ওঠে
হাড়গোড়, মাংস-মজ্জা খসে খসে পড়তে চায়। রামধনু পোশাক ছুঁড়ে দাও, ফিরে
যাই। আমার হৃদয় আঁচড়াচ্ছে বাজপাখি, সী মোরগের সৌজন্যে এখানে আসা না-
আসা। আমাদের দু’জনের মেঘমেদুর সম্পর্ক এখন ঘাতকের মারণাস্ত্রের ছায়া।
ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে বুনো জানোয়ারের জ্বলন্ত টিকাবৎ চোখের দিকে।


সুকৌশলে ছাঁটা অনেকখানি, সৈনিকের কদম-ছাঁট চুল যেন। হাওয়ায়
পালকের কুচি, নীলিমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়া মুনাসিব; ওড়া বারণ। স্পষ্ট
কোনও কারণ ওরা বলবে না সহজবোধ্য ভাষায়। ধারণা, হয়ত অমূলক নয়,
অনেক ওপরে, আকাশের জাজিমে আয়েশে গড়ানো অশোভন অভাজনের পক্ষে।
সেখানে সুনীল কক্ষের ফরাসে মখমলী তাকিয়ায় ঠেস্‌ দিয়ে যারা ফরাসি টানে
ফুড়ুক ফুড়ুক, দ্যাখে বাইজীর নাচ ঢুলুঢুলু লালচে চোখে লকলকে লালচে, তারা
শুধু বশংবদ তোতা পাখি পুষে তৃপ্তির ফোয়ারায় গা ভেজায়। সেখানে ঈগল পায়
না আমন্ত্রণলিপি। ওকে তপ্ত কড়াইতে ভেজে ভেজে অভ্যক্ষ কাবাব বানানো ছুঁড়ে
দেবে নোংরা বুদ্বদময় নর্দমায়। কী আশ্চর্য, সবাই দেখতে পায়, ভস্মরাশি থেকে
উত্থিত বিহঙ্গের অবাধ, বর্ণাঢ্য ওড়া মেঘের স্তরে স্তরে। অগ্নিগোলক নির্বাপিত
ওর ডানার ঝাপ্‌টায়, চূড়ান্ত নীলিমাকে সে ছোঁবেই। ওড়ো, হাওয়া কেটে-কেটে,
সূর্যের সোনালি চুলের ভেতর দিয়ে তার অনিঃশেষ ওড়া।

রাত আড়াইটার পঙ্‌ক্তিমালা

এখন রাত আড়াইটা। টেবিলে ঝুঁকে আমি লিখছি। মৃত্যুশয্যাপ্রতিম গলিতে
হঠাৎ কুকুরের হাসি না কান্না, বোঝা দায়। কান খাড়া করে কিছুক্ষণ বাইরের
অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি। আবার একটি বাক্যের খণ্ডাংশকে পুরো সাজিয়ে
তুলতে কলম ধরি। কয়েক মিনিট কাগজ আর কলমের মোহন ঘর্ষণ চলে,
এমন সময় আমার মার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি। এক শ’ পাঁচ ডিগ্রির জ্বরতপ্ত
কপালে ন্যস্ত শীতল পানিপট্রির মতো স্নেহার্দ্রে হাত আমার কাঁধে রেখে মা
বললেন, ‘বাচ্চু, তুই এত রাত জেগে লিখছিস? তোর চোখে না ভয়ঙ্কর অসুখ?
আজকাল তোর বাম ফুসফুস তো ঘন ঘন ভোগাচ্ছে তোকে। ফজর হতে
এখনও অনেক দেরি। যা, সূর্য না ওঠা পর্যন্ত ভালো করে ঘুমিয়ে নে। এভাবে
রাজ জেগে লিখলে তুই তো জলদি সব আন্ধার দেখতে শুরু করবি। চোখ
দুটোই খুইয়ে বসবি। বিমারি আরও বেশি খুবলে খাবে তোকে। আয় বাচ্চু,
তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিই যেমন দিতাম তোর সুদূর গোলাপ গাছের সবুজ
কোমল পাতা আর ভোরের কচি, মধুর রোদের মতো ছেলেবেলায়। অনন্তর
মা মিলিয়ে গেল রাতের হাওয়ায়।

মার মৃত্যুর পর দেখতে-দেখতে সাত মাস কেটে গেছে। তাঁর চলে যাওয়ার
পর কয়েকদিন গোরস্তানে গিয়েছি, দাঁড়িয়েছি তাঁর কবরের পাশে বিষণ্ন
হৃদয়ে। এর পর বহুদিন যাওয়া হয়নি। এক সময় এমন ছিল যখন একদিন
তাঁর জ্যোতির্ময়ী মুখ না দেখলে ভালো লাগত না আর আজকাল তাঁকে না
দেখে দিব্যি মেতে আছি নানা কাজে। হায়, তাঁর সমাধিও কেমন ধূসর হয়ে
উঠছে আমার স্মৃতির কবরস্তানে। প্রাণের স্পন্দনই মানুষের চির-কাঙ্ক্ষনীয়,
মৃত্যুর শৈত্য তাকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দেয়।

লেখার খাতা থেকে চোখ সরিয়ে দেখি, দিগন্তের অন্ধকারকে অধিক
অন্ধকারাচ্ছন্ন করে অ্যাপোকোলিপসের চার ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছে। ওদের
ঘোড়ার ক্ষুর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে সর্বব্যাপী সর্বনাশের হল্‌কা। কবরখানার
সমাধিগুলো ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে অগণিত মুর্দা জীবিতদের ঘরবাড়ি
জবরদখল করবার জন্যে। হে স্নেহময়ী মা আমার, এ কী দেখাচ্ছ তুমি
আমাকে! প্রতারক স্মৃতি-স্বপ্ন নিয়ে আর কতকাল থাকতে হবে আমাকে?

আম্মা, হে আমার জন্মদাত্রী, সাত মাস পর তোমাকেই আমি যন্ত্রণাকাতর
স্মৃতিগর্ভ থেকে জন্ম দিয়েছি আজ রাত আড়াইটায়। আর কতবার তোমার
জন্মদাতা হব বাস্তবের কাঁকর আর ধুলোবালিতে দাঁড়িয়ে, কে জানে? মা,
আমার এই পঙ্‌ক্তিমালায় তুমি কি কোনও এতিমের ফোঁপানি শুনতে পাচ্ছ?
১৮.৮.৯৭

 সারা জীবনই গোধূলির-আকাশ


জংধরা তোরঙের ঢোস্‌কা জঠর থেকে বের করে নেড়ে-চড়ে উল্টে-পাল্টে
দেখি ওদের। চমৎকার ঝনৎকাররহিত, উজ্জ্বলতা গানের, বহুকাল এক বিঘৎ
ডোবায় কচুরিপানার জটলায় ছিল মশক-ডিম্বের সংশ্রমে। রোদ্রে শুকিয়ে, ঘষে
ঘষে অনেক আগেকার রূপোর টাকার মতো বাজিয়ে দেখি, বোবা। শোভা না
ল্যক, ধ্বনির ও ধাত্রী নয়, এ তো ভারী মুশকিল। ঢিল ছুঁড়ি অন্ধকার রাত্রির
ঝিলে, কম্পন তোলে নিমজ্জিত নুড়ি। দৈবের উপহারের আশায় উপবিষ্ট,
তীর্থের কাক; খনি ভেবে নিজেকেই খুঁড়ি, মনে পড়ে আগুন-চুরির পরান। কী
দণ্ড শেষতক লভ্য? খণ্ড খণ্ড হবে হৃৎপিণ্ড, পুড়তে থাকব অষ্টপ্রহরাদ্রোহের
উপঢোকন। বাতাস ভূমিহীন চাষির দীর্ঘশ্বাস, পায়ের তলায় হিংস্র ঘাস;
মড়াখেকোদের নাকী চিৎকারে অস্তিত্বের ভিত কাঁপে গেরস্তের। মর্চেধরা
শব্দগুলো সাফ সুফ করে ওদের জংকৃত করার প্রয়াস গুলীবিদ্ধ বেলে হাঁস, চরে
মুখ থুবড়ে পড়ে। যা বলাতেই চাই ওদের দিয়ে, সাধ্যি নেই বলার। এই সময়ের
ছটফটানি, ধুকপুকানি, তর্জন গর্জন ধরাণের শক্তি ওদের লাপাত্তা। “এই
পেয়েছি” বলে ধরতে চাই কোনও শব্দকে, কিন্তু প্রতিবার যায় পিছলে, ভেজা
সাবান। প্রাণপণ খুঁজি যোগ্য শব্দ ভাসমান ঝাঁকে। খুঁজতে খুঁজতে সব
পুঁজিপাটা খুইয়ে দেখি সারা জীবনই গোধূলি-আকাশ।


যাবতীয় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে বসি নিভৃত প্রহরে, যেমন মেলায়
নিক্রেতা রকমারি খেলনা সাজিয়ে অপেক্ষমান। দাঁড়ানো সারে সারে, কখনও
ওলটপালট, সে এক যজ্ঞ। শালপাতা সামনে, বলা কওয়া নেই, অ-আ, ক-খ
বসে যায় পঙ্‌ক্তি ভোজনে। পেট পুরে খেয়ে দেয়ে প্রশ্ন করে, ‘বলো, কী বর
চাও?’ ওদের ঢেকুর, হাই, খুনসুটি আর রঙিন তামাশার ঝাঁকুনিতে আমার
চাওয়ার আইটাই। রাত নির্ঘুম? স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণের কোরিওগ্রাফ। রক্তচোষা
বাদুড় দূর থেকে লক্ষ করে আমাকে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ বাজায়
এই বিনিদ্রকে শিকার। অক্ষরমালা ওর সহযোগী, অথচ আমারও উদ্ধার। দুপুর
রাতে তরবারির ঝলসানি ওরা, চোখে চমক। অক্ষর নিমেষে জোনাকি, নেভে
আমার মুঠোয়। মুঠো খুললেই জ্বলে ওঠা পুনরায়, আলোবিন্দুসমুদয় খুব চেনা
একজন, যাকে বারবার স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা ছলাৎছল নদী। তার মুখ নেমে
আসে আমার উৎসুক মুখে ঘুমের আগে, ওর প্রেমার্দ্র ঠোঁট আমার ওষ্ঠে
মেঘনিবিড় ছায়া মাখে জাগরণের মুহূর্তে। রক্তচোষা বাদুড় অপসৃত।


যেখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, সেখানেই দখলি। আমার কান ঘেঁষে যাওয়া
পরিযায়ী পাখি এক লহমায় ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। চুলে নক্ষত্রের নাচ,
জ্যামিতিক গাছ ধারণ করে কোজাগরী জ্যোৎস্না, গলে গলে পড়ে সাধুর্য।
কয়েক ঘণ্টা পরে উঠবে টকটকে সূর্য, শিরায় টগবগানি। এক খণ্ড বড়সড়
পোয়াতি জমি অচিরে করবে প্রসব। ধান, পাট, গম, যব, ভুট্রা, আলু, আদা,
সর্ষে-কোনো ফসলসম্ভার নেবে সূর্যের চুম্বন, হাওয়ার আলিঙ্গন? সে জমি
আমার লক্ষ্যবস্তু বহু প্রহরের, তাকে দেখি জ্যোতির্বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে। নিয়মিত
নিড়াই, আগাছাগুলো মৃত সৈনিক। পানি গড়ায়, স্ফীতি-মৃত্তিকা-যোনি; হঠাৎ
জমির ওপর ধর্ষিতা নারীর ছিন্নদেহ, উনিশ শ’ একাত্তরটি সূঁচ-বসানো স্তন,
বৃদ্ধের বুলেটে ঝাঁঝরা বুক, বন্দুকের বাঁটে শিশুর থ্যাঁতলানো মুখ, গেরিলার
উত্তোলিত বাহু আর ফাঁকে ফাঁকে শৌর্যের সূর্যমুখী।


ওর টিমটিমে জীবনে চন্দ্রোদয় সেই তন্বী। লাগাতার খরার পর জলাধারের
পাড়-ভাঙা উচ্ছ্বাস, অজস্র ফুলের রঙবেরঙের চাউনি। সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকা
লোকজনের হট্ররোলে দু’জনের একান্ত ছাউনি, দোয়েল শ্যামার সুরে ঘেরা,
তারার ঝিলিকে ভরপুর। কখনও হৃদয় উপচেপড়া আনন্দ জোয়ার, কখনও
সত্তা-খাককরা যন্ত্রণার দাউ দাহ। সব ছেড়েছুড়ে ওরা এখন ভবিতব্যের
সাম্পানে সওয়ার। তরুণী ওকে হৃদয়ের রক্তোৎপল উপহার দিয়ে বলে, ‘এ
আমার বহু যুগের উত্তরাধিকার, গ্রহণ করো। তুমি কি জানো কেন তোমাকে
ভালোবাসি?’ লোকটার কথা, ‘কী করে জানবো? আগাগোড়া ব্যাপারটাই
রহস্যে-পোরা এক উদ্ভিন্ন তোড়া। ‘ঠিক তা’ নয়, তুমি স্বদেশের মাটিতে
ছড়িয়ে দিতে পারো তোমার সবগুলো হাড়, এ জন্যেই আমার এই
ভালোবাসা। তখন দিগন্ত ছোঁয়া খোলা পথে ঘরহারা, ছন্নছাড়া বাউলের গলা
থেকে ঝরতে থাকে উদাস দেহতত্ত্বের শিশির ফোঁটা।


জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। তপ্ত, শীতল, শুষ্ক, দ্রবীভূত।
কখনও আকাশ-ফাড়ানো তোলপাড়, কখনও বা দুধের শরবত স্তব্ধতা। মাঝে
মাঝে আলোর ঝকমকানি আর সাবেকি অন্ধকার পাশাপাশি। রাতবিরেতে
সাপের ফোঁসফোঁসানি, ডাকসাইটে মস্তানের অশ্লীল চিৎকার, ছোরা বসানো,
হাঁকডাক আর সাহিত্যিক পিম্পের নষ্টামির ভেতর দিয়ে আমার হাঁটা।
সদ্যোজাত আতঙ্কের কানাগলিতে আমি একা, হকচকানো; মেরুদণ্ডে
আলাস্কার ঈষৎ গলিত বরফ জলের চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া। বিশ্রাম আমাকে শাদা
অ্যাপ্রন পরা সেবিকার যত্নে শুইয়ে দেয় শয্যায়, অথচ অন্তর্গত গোঙানি ক্ষয়ে
যাওয়া রেকর্ডের একই রেখায় ঘূর্ণমান। বিছানায় বিষ পিঁপড়ে, কাঁকড়া বিছে,
শুঁড় দোলানো আরশোলা আর টিকটিকির ভিড়। চোখের পলকে খাট ছোঁয়
কড়িকাঠ, পলেস্তারা চেপে ধরে আমাকে, গনগনে আংটায় আটকানো গলা,
কণ্ঠস্বরে কখনো গ্যালাক্সির নিস্তব্ধতা কখনো আদিম মানবের বিনিদ্র গোঙানি।
ঘর আমাকে গিলতে আসে ডানাসরের আক্রোশে। কালো পাখি ঠোকর মারে
বারবার, দু’হাতে মুখ ঢাকি। কী করে এ ঘরে এতকাল আমার বসবাস?
আকাশ মুঠো মুঠো ঘাস, ঘাসে লেপ্টে থাকা নীরবতা। সহজিয়া শ্রমে ঘস্‌ ঘস্‌
কাটছে ঘাস বিদ্যুৎ রঙের কৃষক।


‘কবিতা শুনব’, একটি ফুটফুটে শিশুর ঝলমলে আব্দার বিস্ময়ের
ঢেউগড়ায় সত্তায় ওর মন ভোলানোর আশায় হাতে তুলে দিলাম লাল বল,
চিত্তহারী বল দ্রুত সোফার তলায়। পথ চলতি বানরঅলার সাত তালিমারা
ঝোলা আর ডুগডুগির প্রতি ওকে মনোযোগ করার চেষ্টাতেও নাকাল। ভাবি,

আমি কি নক্ষত্রের ঝাড়, জ্যোৎস্নার ঝালর আর মেঘের মেদুরতা দিয়ে মেটাবো
শিশুর দাবি? নাছোড় সে, কবিতা শোনায় ইচ্ছা বুলবুলির অবিরাম শিস।
আখেরে আমার অসমাপ্ত কবিতা আড়ালে রেখে শিশুটিকে খুব কাছে ডেকে ওর
চাঞ্চল্যের রঙিন পথে একটা শাদা কাগজ দোলনার মতো দোলাতে থাকি।


হাওয়ায় আমার আজন্ম অধিকার, কিন্তু ফুসফুস টেনে নিতে ব্যর্থ
প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। ধাত্রীর হাতে নাড়ি কাটার দিন থেকেই এই খুঁত। শ্বাস
হারানোর শঙ্কায় সকাল-সন্ধ্যা ছটফটে মুহূর্তগুলো কোনওমতে জড়ো করে
বাঁচা। কলকব্জায় রঙচটা খাঁচা, লোহা-লক্কড়, বসন্তকে নীরব করে দেয়া
কীটনাশক, লজ্‌ঝড় বাস-ট্রাকের পোড়া ডিজেলের অবিরত বমি; ব্যাপক
দূষণে প্রকৃতি সূতিকাগ্রস্ত, শোচনীয় নারী। ঘোর অমাবস্যায় মোগল বেগম
সাহেবাদের হাম্মামে ভীষণ হানিকর, উৎকট, পূতিগন্ধময় চটচটে নর্দমার
পানি, দ্রাবিড় যুগ থেকে ছুটে আসা। অগুনতি মুমূর্ষু মাছ আর পাখির ঝাঁক
স্তূপীকৃত। আমার আক্রান্ত ফুসফুস হাওয়া টানতে গিয়ে অপদস্থ, ফুলে ফুলে
ওঠে, জীর্ণ হাঁপর। কাপড় চোপড় ঠিকঠাক, মানানসই, অথচ অস্তিত্বের
কাকতাড়ুয়ার রং ঢং। অতিকায় মাকড়সার জালে আমি চিৎপটাং।
সাহসিকতার কোনও ভড়ং ছিল না, অথচ কতিপয় চামচিকা চক্কর কাটে
চতুর্দিকে, আঁটে লাথি মারার ফন্দি। এই বন্দিত্ব থেকে পরিত্রাণ পাব কবে?
স্বর্গীয় এক পাখি কানে কানে বলে, ‘ঝট্‌কা মেরে জাল ছিঁড়ে উঠে দাঁড়াও
সটান; এক্ষুণি তোমার অভিষেক। ফাঁকা পথে, সাক্ষী অন্তর্যামী, আমাকে
মৃদঙ্গের সুরে ক্রমাগত ডেকেই চলেছে আগামী। দোমড়ানো, মোচড়ানো
ফুসফুস এগোতে দিলেই হয়। যতদিন না কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস জরুরি, ততদিন
আমার ছুটে যাওয়া ম্যারাথন দৌড়বাজের ধরনে। বহুদূরে বিরাট দ্বীপাধার
প্রজ্বলনের আকাঙ্ক্ষায় আমার অপেক্ষায়। মশাল নিতে পারব কি ততদূর?


হাতকড়া একজোড়া হাতকড়া ঝন্‌ঝনিয়ে বেজে ওঠে, পক্ষীর ক্রেঙ্কার।
নাছোড় হাতকড়া ঝোলে, দোলে সারাক্ষণ, স্বপ্নের ভেতরেও। প্রতিবেশীরা
সবাই কম বেশি দ্যাখে এই দৃশ্য-আমার চক্ষুদ্বয় অপ্রকৃতিস্থ দ্যুতি নিয়ে নিবদ্ধ
সম্মুখে, নড়বে না এক চুলও, আর দু’টি অদৃশ্য বেখাপ্পা আলঙ্কার। আমার
হাতের কবজি প্রসারিত স্বেচ্ছাসেবকের ভঙ্গিতে যেন হাতকড়ায় স্থাপিত
সেবাশ্রম। হাতকড়া অতিকায় করোটির ফাঁকা অক্ষি কোটরের মতো নেচে
বেড়ায় এখানে সেখানে। আমি, অচিকিৎস্য স্বপ্নচর, ধ্বংস আর সৃজনের মধ্য
দিয়ে হেঁটে যাই ষড়ঋতুতে। সঙ্গে সঙ্গে যায় এক জোড়া হাতকড়া।


রাজকীয় বেলেল্লাপনা, হট্রগোল, সংশয়ের ফণা, বিশ্বাসের অট্রালিকায়
ভয়ঙ্কর সব ফাটল, যে-কোনও মুহূর্তে ধস কিংবা সংহারী ঢল নামতে পারে,
নেমেই গ্যাছে, শহরবাহারী পশুদের উল্লাস। নিজেরাও যাবে তলিয়ে, জানে
না। প্রাক্তন বিশ্বাস আঁকড়ে ধরি যখন তখন, যদিও এই প্রায় প্রলয়তুল্য
ভাঙচুরের মত্ততায় নিঃশ্বাস নেয়া অসাধ্য। যত তাণ্ডবই চলুক, তেড়ে আসুক
পিশাচের দল, এখুনি ভদ্রাসন ছেড়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। দুর্বহ
নিঃসঙ্গতা একশ’ আট ডিগ্রি রৌদ্রে পড়ে থাকা শবের ফাটা ত্বকের মতো
চড়চড় করছে। নিজের সঙ্গেই কথা বলা জোরে জোরে, মাথা ঘোরে, মগজের
ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ করে অমানিশা। বেদিশা ঘুরি আলোছুট ঘরে; বাঁচার কী
সার্থকতা? আমি কি লাগছি কারও কোনও কাজে? কলিংবেল বাজে দরজা খুলে
দেখি, শূন্যতার ছায়া। স্যুইচ জমাট, স্পর্শহীন। অদূরে এক চিলতে জনশূন্য,
প্যাচপেচে মাঠ। গেটে ড্রাইভারহীন বেবি ট্যাক্সি ধুঁকছে, কোথাও যাবার কেউ
নেই। ম্যাক্সিপরা কে একজন ছায়ায় বিলীন, এই দিন মেফিস্টোফিলিসের মতো
মুখোশধারী, আত্মাচোর। ইশ্‌ ব্যাটাচ্ছেলে মরেও না, শক্রদের আক্ষেপ
দিনভর, রাতভর। লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়া, বেসিনে হাতমুখ ধোয়া, পাতাল
থেকে অবিশ্বাস্য কবিতার পঙ্‌ক্তি ছেঁকে তোলা, পরবাস্তবতার ভাষ্য রচনা,
মাঝে-মধ্যে উপহাস্য হওয়া, রাত্রির পর রাত্রি জাগা, দূরের যাত্রী হওয়া
কখনও, এই বেঁচে থাকা কী জন্যে? কার জন্যে? আবছা স্মৃতিকে অনুসরণ করে
দিন যায়।

স্বপ্ন জাগরণের সীমানায়


‘ঢের হয়েছে, আর নয়, ছাঁটো, ছাঁটো ক্ষয়া খর্বুটে শব্দাবলি। বাতিল করো
হরিণ, রাজহাঁস আর ঝাড়বাতি; তোমার কবিতায় এসব পড়ে পড়ে হাঁসফাঁস
লাগে। একই উপমা কেন ঘুরে ফিরে আসবে সকল ঋতুতে? এবার চেনা পথ
ছেড়ে ধরো অচেনা রাস্তা, বসিয়ে দাও চেকপোস্ট। জ্যোৎস্নাধোয়া ঝিলে
খিলখিলে হাওয়ায় মুখ ডোবায় হরিণ, কেন এই পুনরুক্তি? কেন তুমি বলবে
না জ্যোৎস্নার চাদর বিছানো প্রান্তরে ক্যাঙারুর পাল লাফিয়ে লাফিয়ে নষ্ট
করছে ফসল? কেনই বা তোমার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে না যে, যা’ কিছু মহৎ,
সুন্দর, সহজ আর সরল তার দিকেই তিরিক্ষি মেজাজে তাকায় বন্দুকের নল।
কোনও তন্বী হাসলেই কেন দুলে উঠবে বারবার ঝাড়বাতি। উটের কুঁজোর
মতো বাড়তি চর্বি ঝেড়ে ফ্যালো। তীক্ষ্ণ, ছিপছিপে হোক পঙ্‌ক্তিমালা।
আগ্রাসী মরুভূমিতে তোমার কবিতা হোক এমন মরুদ্যান, যেখানে তুমিই
প্রথম মুসাফির’, বললো এক তরুণী কথায় কথায়। এভাবেই টেলিফোনে
সেদিন আমাকে সে কবিতা লেখার সহজ পাঠ শেখালো।


অসম্ভব তাকে ভালোবাসা, অসম্ভব তাকে ভালো না বেসে জীবনলগ্ন থাকা।
এই রেশনবৎ কথাবার্তা, মাঝে-মাঝে বদখৎ ক্রস কানেকশন, টেলিফোনে
খণ্ডকালীন বসবাস, গৃহকোণে দুঃস্বপ্নের হামলে পড়া, সামলে সুমলে
চলাফেরা, সত্যমিথ্যার জটাজালে বন্দিদশা, কোত্থেকে আচমকা খসে আসা
কিছু পঙ্‌ক্তিকে ঘষা-মাজা টেবিলে, ভাঁড় সাজা কখনও সখনও, খোদাই ষাঁড়ের
গজরান, শক্রর ইতর খিস্তি খেউড়, গতরে জ্বালা-ধরানো, পেছনো, ঢেউয়ের
আনাগোনা-এসব নিয়েই আছি। প্রায়শঃই এরকম থাকি। যেন অপারেশান
টেবিলে শোয়ানো হয়েছে, অ্যানস্‌থেসিয়া একটু একটু করে ঢুকছে নাকে।
কাছাকাছি কেউ নেই; অকস্মাৎ কারো হাঁচিতে চটকা ভাঙে। বহুদূরে গহীন
গাঙে রঙিলা নায়েরমাঝি দাঁড় বায়, খাটায় পাল মসলিনের, কোথাও টিনের
ঘরের চালে চাঁদিমা বিছানো, দুধের পাতলা সর। মাঝে-মাঝে খুচরো কাজের
ঠেলাঠেলিতে বেলাবেলি তার কণ্ঠস্বর শুনে বাঁচি। পিটপিটে নক্ষত্র চোখ মারে;
আরে, শোনোই না, ভর সন্ধ্যেবেলা কোথায় যাচ্ছো? কোনও কথা কেউ শোনে
না, আলতো তাকায় ফিরে, বোনে যে যার স্বপ্নের শৌখিন শাড়ি অন্তহীন, কত
টানাপোড়েন। সসপ্যানে বাস্তবতার ঈষদুষ্ণ অমলেট, ঘরে ঘরে ছেলেমেয়ে
মানুষ করার হৈ-হুল্লোড়। পাড়ায় পাড়ায় চোর ছ্যাঁচোড়ের উৎপাত, ডাকাতের
দল নানা ছলছুতোয় উপর তলায় সমাসীন। কবিতার জন্মদ্বারে কালো
বেড়ালের ছোঁক ছোঁক। কবিপুরুষ ঢোঁক গিলে তড়িঘড়ি কবিতার ভ্রুণ সামলে
দ্যাখেন, নগ্ন পায়ে ফিরে যাচ্ছে ভালোবাসা।


দীপ জ্বালাতে গিয়ে আঙুল ঝলসে যায়। দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নতুন
কুলোয়, ছিপছিপে শরীর অর্ধেক ময়ূর হাতে এগোয় স্বপ্নের সীমানায়, রূপ
আমাকে গিলে খাবে। যাব কোন্‌ চুলোয়? হাসি, কাচের বাসন চূর্ণ মোজেইক
করা মেঝেতে। চুপচাপ থাকি, কাছের শেলফ থেকে বই টানি; পড়তে পড়তে
রাত বাড়ে। কে অমন আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘুম কাড়ে? অতীতের ঘানি টেনে ক্লান্ত,
আপাততঃ থাক ধারাদেনার ভাবনা। রাগ সাপের মতো ফোঁসে, মাথার ভেতর
লকলকে আগুন। বেনামি আক্রোশে কুকুর মাটি খুঁড়তে থাকে গুম করা লাশ
বের করবে বলে। দুপুর রাতে শূন্য হাতে উড়ে এসে বসে ডুমুর; তার সরুঙ্গে
নোখে মেরুন পালিশ ছিল কি বিকেলে? ওর কাছে গেলে ভ্রূকুটি-অলা মেঘ
কেটে যাবে, রঙ-বেরুঙের পাখি কুড়াবে রুটি-বিস্কুটের টুকরো বারান্দায়,
ঝরাবে সুর চেতনায় নিমগ্ন স্তরে। কোন্‌ পথ ধরে যাব নিবাসে তার? পথগুলি
শয়তানের নাড়িভুঁড়ি; অলিতে গলিতে ঘুরি, উড়ি ময়ূর-নীল মেঘে। সে আছে
অজ্ঞাতবাসে। যা-কোনও রাস্তা ভাবি। স্বর্ণতালার দাবি, ‘খোলো,
দ্বার খোলো। কোথায় কবে হারিয়ে ফেলেছি চাবি। কী করে বইব বিচ্ছেদের
ভার? পূর্ব-পুরুষদের কেউ বিরহকাতর প্রহরে আমার মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কেঁদেছেন রহস্যের গুহায়? নাকি বনবাদাড়ে পিছল আঁধারে কুপিয়ে কেটেছেন
হিজল গাছ ভুলতে অন্তর্জালা? বন্যবরাহ তেড়ে আসে যখন তখন অকারণ।
হেঁড়ে গলায় দশকওয়ারী ফিচেল ফতোয়া ঝাড়ে নানাবয়েসী মস্তান। কেন
টেলিফোন বেজে ওঠে না এখনও? যখন অতিশয় ব্যাকুল হয়ে সে ঘোরাবে
ডিজিট, তখন থাকব তো?


সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা খোঁয়াড়, লম্বাচওড়া, তারকাঁটার বেড়া দিয়ে
ঘেরা। শুয়োর, শুয়োর,শুয়োর। মদ্দা শুয়োর, মাদি শুয়োর। ডানে শুয়োর,
বামে শুয়োর। প্রচণ্ড গাদাগাদি, গুঁতোগুঁতি। উত্তরে শুয়োর, দক্ষিণে শুয়োর,
পূর্বে শুয়োর, পশ্চিমে শুয়োর। চারদিকে ছুটোছুটি, কাদায় লুটোপুটি। ঘোঁৎ,
ঘোঁৎ, ঘোঁৎ, কী শীত কী গ্রীষ্মে শুয়োরের গীত। কত মাদি শুয়োরের মাথায়
ঘোমটা, গলায় লাল কিংবা নীল রিবন শুয়োরেরা ফার্সি পড়ে হদ্দ হয়, আরশি
নগরে ক্লান্ত হয় সব্জির আঁটির মতো গুচ্ছের পদ্য পড়ে। কোনও কোনও শুয়োর
শোলার টোপর পরে ঘুরে বেড়ায় চরকি হয়ে। শুয়োর, শুয়োর, শুয়োর।
দিনরাত্রি নামে শুয়োরের ঢল। ফূর্তিমাতাল দাঁতাল শুয়োরের কেতাদুরস্ত
বুর্জোয়া চালে মাথা নাড়ে, মাদি শুয়োরের নজর কাড়ে, নিয়ে যায় নাচের
ফ্লোরে, যখন সূর্য অস্তাচলে। মোহকবলিত শুয়োর, যন্ত্রচালিত শুয়োর, শবলিত
শুয়োর। শুয়োরকে শূকর নামে ডাকলে অনেক শুয়োর যারপরনাই আহ্লাদিত
হয়। অতএব শূকর-শূকরী, শূকর-শূকরী, শূকর-শূকরী। শূকর-শূকরীর
রোদালো, ঝাঁঝালো, জ্যোৎস্না চমকিত জীবন বাঁশের বল্লম আর অজানা
জোয়ারের অপেক্ষায়। ভরাট খোঁয়াড়। শূকর, শূকর, শূকর। শূকরের
কামড়াকামড়ি, লালসা, শাঠ্যে আমরি নাট্যে রুমালে ঘন ঘন মুখের চামড়া
মোছে সূত্রধর।


স্বপ্নের ভর্তুকি নিয়ে কতকাল চলবে আর? একটি স্বপ্নাদ্য কবিতার
বিতিকিচ্ছি রূপ দেখে এজন কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন। একজন তোবড়ানো-
গাল কেরানি বাসে ঝুলতে ঝুলতে ভাবেন, আহা, সারা জীবন যদি গল্‌ফ খেলে
কাটিয়ে দেয়া যেত। গলা ফাটিয়ে এ-কথা দশ দিকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে
তার। ভদ্রলোক যদি দয়া করে দশ পয়সার বদলে, খোদার ফজলে, একটি দশ
টাকার কড়কড়ে নোট দিতেন, একজন নুলো ভিখিরির ভাবনা। একজন
রিক্‌শা-অলা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে মনে মনে আওড়ায়, হায়, এমন কি
হয় না যে, প্রতিটি রাস্তা খুব ছোট, অথচ ভাড়া দিব্যি চড়া। কবির মৃত্যু হলো
অনিয়মের অঙ্কুশাঘাতে, কেরানি অকূলে ভাসিয়ে সংসার গেল অন্তরীক্ষে
অচিকিৎস্য রোগের হাড়িকাঠে মাথা রেখে, রিকশা চালক ওর চঞ্চল পা দুটো
হারিয়ে হয়ে গেল আরও বেশি সর্বহারা, আর নুলো ভিখির আজও খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে দশ টাকার কড়কড়ে নোটের আশায় ভিক্ষা করে বেড়ায় সাত ঘাটে।


বেখাপ্পা লোকটা বারবার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালায় আর নেভায়, বিড়ি
সিগারেট ধরায় না। সাধ ছিল তার ঐন্দ্রজালিক গালিচায় বসে পা দোলাতে
দোলাতে বিশ্ব ভ্রমণে উঠবে মেতে। দু’চারটি শালিক চড়ুই, কাকাতুয়া মুনিয়া
সঙ্গী হবে ওর আর থাকবে একজন, তামাম দুনিয়ায় যার নেই জুড়ি। প্রসন্ন
ছায়াবীথিতে সেই বিবাহিতা তরুণীর সিঁথিতে হঠাৎ পরিয়ে দেবে সিঁদুর, ইচ্ছে
নাচতো পুষ্ট লোকটার অন্তরে। ফুসমন্তরে ভোলায়নি, হৃৎমন্ত্র শুনিয়ে
সকালসন্ধ্যা প্রণয়ের বন্ধ্যাকালে দিয়েছে ডাক। জানাজানি হলে পাড়ায় ঢিঢি
পড়ে যাবে’ দুজনকেই গিলে খাবে সামাজিক রাক্ষুসে বোয়াল। সংস্কারের
কাঁকড়ার ভয়ে সিঁটিয়ে তরুণী কামনার মায়াবৃক্ষে চড়েনি, সিঁথিতে পরেনি
গোধূলিবেলায় বিয়ে-বিয়ে খেলার সিঁদুর। লোকটার কিছু হলে বিধবার
অপবাদ কী করে সইবে? দুর্বিষহ বিষাদকে পোষ্য নিয়ে পথ চেয়ে থাকে সেই
বিবাহিত-অবিবাহিতা তরুণী, চিরুনি কোলে আলস্য পোহায় এবং সারা শহর
জুড়ে খাপছাড়া লোকটার শুধু টো টো। কোনও বিলাপ নেই, নেই প্রলাপ;
উজাড় বাগানে ফুল ফোটানোর ব্রত ওর, অথচ ওকে কেবলি ঘিরে ধরে কিছু
ভীমরুল। ডাকাবুকো, বিটকেল লোকজন পিছু নেয়, লাগায় চড় চাপড়, দ্যায়
রুক্ষ মাটিতে ঘষটে তার স্বপ্নের মুখ।


বাতি নিভিয়ে শুয়ে যায় সে; কী তাজ্জব, রাতারাতি দু’হাতে গজায় ভৌতিক
ফণিমনসা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়, নিজের ঘর ক্যাপ্টেন আহারের
কেবিন, মৃত্যুর পদহীন পদচারণায় অতিশয় নিস্তব্ধ। দেয়ালে মরা কুকুরের
নাড়িভূঁড়ি লেপ্টে আছে, একাকীত্বের একাঘ্নি ওর দিকে ধাবমান। হাত নিয়ে
নাজেহাল। মাথার একরাশ চুল শিশু নাগ, ওষুধের বাক্স তোলপাড় করে খায়
ঘুমের বড়ি। বারবার পাশ ফিরে শোয়, দুচোখে তপ্ত শলাকা ঢোকায় কে?
ঘুণপোকায় ধরেছে সত্তা; মূত্রাশয়ে বেরহম জ্বালা, বৃক্ক আক্রান্ত হলো বুঝি।
গলায় নরমুণ্ডের মালা পরে আসে কেউ বসে তার পাশে। ব্লাটিং পেপারে গড়া
মুখ চোখে রক্ত কিডনী ফেলে দিতে হবে মূর্গির বাতিল মাংসের মতো? ফের
কাটাছেঁড়া? বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস। ভোরেও রাত্রির জের, চেতনায় অমানিশার
ঘোর, ভবিষ্য ধুধু মরীচিকা। চোদিক থেকে আগুনের শিখা ধেয়ে আসে,
ছায়াচ্ছন্ন দিশা, তলপেটে হাজার হাজার সুঁচের হামলা, বৃশ্চিকের কামড়; প্রাণ
সামলানো দায়। মাটির তলায় পোকা মাকড়ের অধীর অপেক্ষা। বাঁচার বাসনা
অত্যধিক তৃষ্ণাকাতর মরুচারীর পাথরঘেঁরা পান্থপাদপ। খুনের নেশায়
তলোয়ার মাছ তার সমস্ত শরীর ছিঁড়ে ফেড়ে এঁকে বেঁকে চলে অতলে আর
আহত কত প্রার্থনা করে জীবনের রস। অসুখ এবং ওষুধের কলহান্তে আরেক
সকালে সে বসন্ত বাহার।

স্বপ্নের স্বায়ত্তশাসন


যাবার সময় সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে পা রেখে পেছনে ফিরে তাকায় সে;
দোরগোড়ায় স্মিত মুখ, এক জোড়া চোখে ইদিশ ভাষার প্রাচীনতা। এগোনো
মুশকিল, তবু নেমে যাওয়া, হাত নাড়া। নেমে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে, নিচে হা
করা পাতাল। মনের ভিতর উথাল পাতাল।

এখন রিকশায়; ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ট্রাফিক রাগী জন্তুর মতো গজরাচ্ছে। ওর
বসে থাকা, উঠে দাঁড়ানো, চায়ের পেয়ালা বাড়িয়ে দেয়া, হাসি, ওড়না
সামলানো, কিছু কথা, ফুলের ঝরে পড়া-মনে পড়ে। সে কী করবে এই মেঘলা
দুপুরে একা একা?

সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, কোনও চিলেকোঠা নয়, ফ্ল্যাট বাড়ির ঘরের আশ্রয় খোঁজা
চুপিসারে। নারকেল গাছের অশ্রু জানালার গাল বেয়ে নামে। কে যেন
ফিসফিস স্বরে প্রাচীনকালের কবিতা পড়ে। এখুনি অফিসের ডাক, যাওয়ার
তাড়া। ঝাড়া চার ঘণ্টা কবিতার অনুলিপি তৈরি করা, চা খাওয়া, আড্ডা দেয়া,
সম্পাদকীয় লেখা না-লেখার দোটানা। হঠাৎ তাতারী তরবারির মতো ঝলসে
উঠে হানা দেয় সদ্য-অতীত। ঈষৎ শীত, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা বন্ধুর
গাড়িতে।

বিছানায় শুয়ে ঘুমের প্রতীক্ষা; বলা-নেই না হওয়া কবিতার অবুঝ
গুঞ্জরণ মাথার ভেতর। ডুবে যাচ্ছে চোরাবালিতে, চিৎকার স্তব্ধ, কোনও দড়ি
কিংবা লতা নেই আশ-পাশে। মধ্যরাতে কাঁপুনি, কাকে ডাকবে? রাতের শেষ
প্রহরের প্রবল ঝাঁকুনি। ঠাণ্ডা বশ্যতা করে না স্বীকার কাঁথার, কম্বল, খোঁজে,
মাথা গোঁজে বালিশের নীড়ে। বশ্যতা ডেকে উঠবে কি?
রাত্রির মশক থেকে চলকে চলকে পড়ে তরল সোনা।


লোকটাকে ওরা ক্রমান্বয়ে ক্ষেপিয়ে তুলছে। কারও পাকা ধানে মই দেয়া
তার কাজ নয়। নিজের হালেই আছে, হৈ চৈ থেকে দূরে থাকার বাসনা কাচের
বাসনের মতো চূর্ণ। তাই ওর মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা। উঠে দাঁড়ালেই,
অনেকে ভাবে একটা হট্রগোল বাঁধাবে লোকটা, অথচ তেমন কোনও উদ্দেশ্য
গরহাজির। আস্তিন গোটানো ওর ধাতে নেই।

মেপে মেপে কথা বলা, অট্রহাসিতে ফেটে না পড়া, সময় বুঝে আস্তে সুস্থে পা
ফেলা, কোনও দিকে মাটির ঢেলা না ছোঁড়া এসব যাবতীয় খুঁটি নাটি
লোকটার কাছে প্রত্যাশা ছিল সবার। এতো ভারি মজার আব্দার। সবাইকে
ঘুম পাড়িয়ে রাখার দায়িত্ব সে তো নেয়নি কখনও। সে চায় ধাক্কা দিয়ে ঘুমে
ঢুলুঢুলু লোকগুলোকে জাগিয়ে রাখতে, যখন জেগে থাকাটাই সবচেয়ে
জরুরি।

ওকে নাস্তানাবুদ করার রাস্তা তৈরি করছে কেউ কেউ। ফেউ লাগানো হয়েছে
ওর পেছনে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার লোকের অভাব নেই
পাড়ায় পাড়ায়। গেরস্থবাড়ির কুকুর ভেউ ভেউ করে রাত দুপুরে তাড়ায় চোর
বাটপাড়। পুকুর চুরি বিরতিবিহীন উৎসব এখন।

লোকটা ভাবে একবার নিথর চাকাটা ঘুরিয়ে দিলেই হলো, তারপর নিজের
গতিতে চলবে ঠিকঠাক। যে যাই ভাবুক, ইচ্ছা করলেই চাকা ঘোরানো যায়
না, পাহারাদাররা সেটা অচল রাখার জন্যে মোতায়েন। মগজে কাদা নিয়ে
যারা গাদা গাদা বই লেখেন, সৌন্দর্যের শরীরে যারা কুষ্ঠের জীবাণু ঢোকাতে
আগ্রহী, যারা মধ্যযুগীয় টিউমার সাজিয়ে দিচ্ছে সমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, তাদের
হাত থেকে সবাইকে বাঁচানোর তাগিদে ধুকপুকে বুক নিয়ে লোকটা জেগে
আছে লাল কমলের মতো।


আহত করো, যত পারো। সইতে পারব, কোনও আঘাতই আমাকে আর
কাবু করতে পারে না। সেই কবে তোমার হৃদয়ের কাছে তাঁবু ফেলেছি, মেলে
দিয়েছি আমার হৃদয় নীলোৎপলের ধরনে। একে একে সবগুলো পাপড়ি
তোমার দীর্ঘ নীখে তুলে নাও, হৃদয় থাকবে প্রতিবাদহীন।

বলেছিলাম, তুমি কেমন সুদূর যেন বিষণ্ন প্রতিমা। এই শব্দগুচ্ছ তোমাকে ঈষৎ
রাগান্বিত করেছিল বলে মনে হলো। বুঝি আজও জের চলছে তার। না কি
আমি নিজেই বানিয়ে তুলছি মনে-মনে এমন কিছু, যা তোমার ভাবনার
ত্রিসীমানায় অনুপস্থিত?

‘ভালো থেকো;, বলেছিলে রিসিভার ক্রেডলে রাখার মুহূর্তে। কিন্তু কী করে
ভালো থাকি যখন তুমি, হ্যাঁ, তুমিই আমার মনের স্তরে স্তরে কালো মেঘ
ছড়িয়ে দাও বারবার। তোমাকেই ঘিরে আমার সকল ভাবনা আর স্বপ্ন।
ভোরবেলা হেঁটে যাওয়ার সময় দেখি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো পথের মোড়ে,
বইয়ের দোকানে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তোমাকে দেখতে পাই বিদেশী
কাব্যগ্রন্থের জ্যাকেটে, রাতে শুতে গেলে দেখি তুমি আমার চেয়ারে বসে পা
দোলাচ্ছো মাত্রাবৃত্তে। ছুঁতে গিয়ে তোমার ছায়াকেও পাই না। তোমার
অনুপস্থিতিতে ক্রমাগত অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।

কেন তুমি অমন করে তাকাও আমার দিকে? তুমি কি জান না আয়ত এই দৃষ্টি
আমার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিতে পারে? তোমার হাসির মাধুর্যে আমার হৃদয়ের
আরশি নগরে যে পড়শি বসত করে সে দোতারা বাজাতে বাজাতে দূরে
কোথাও যাত্রা করতে চায়, তুমি কি বুঝতে পারো?

যত পারো আহত করো। এই পরিণতি সেদিনই মেনে দিয়েছিলাম, যেদিন
প্রথম তোমার চোখে চোখ নয়, হৃদয় স্থাপন করেছিলাম। এ হৃদয় তুমি ছিঁড়ে
খুঁড়ে ফেলে দাও পথের ধারে, যেখানে মানুষ আর পশুর পায়ে দলিত হবে
হৃৎপিণ্ডের টুকরোগুলো। কেউ জিগ্যেশও করবে না, কে ধারণ করেছিল এই
রক্তাক্ত খণ্ডসমূহ?


আঃ, আমাকে বাঁচাল এই বিকেল। সকাল বেলা থেকে, বলা যায়, ছিলাম
প্রায় মৃত। বাসায় রোবটের মতো ঘোরাফেরা সারাক্ষণ। অকস্মাৎ ঘরে বসন্তের
প্রবেশ বাসন্তী রঙের ঝলক এক পলকে রোবটের মধ্যে করল প্রাণ সঞ্চার।

বসন্ত চেয়ারে বসে বলে, ‘এলাম চলে। শোনো তো, এই বিবর্ণ ফুলগুলো
ফেলে দাও। শুকনো ফুল দেখতে আমার একেবারে ভালো লাগে না।
অতিশয় ম্লান ফুলগুলোর পাশে ওকে মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত।

‘অন্তত আজ থাক ওরা এখানেই’, নিষ্প্রাণ ফুলগুলোর গায়ে হাত বুলোতে
বুলোতে দিলাম জবাব। ইচ্ছে হলো ওকে, বসন্তকে, বলি, ‘আমিও তো বিবর্ণ,
জীর্ণ। তা বলে তুমি কি আমাকে ছুঁড়ে দেবে আঁস্তাকুড়ে?’ শেষ অব্দি বলা হলো
না, নিশ্চুপ পান করে চলি বসন্তের সৌন্দর্য।

বিদায়ের ঘণ্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বসন্ত। যে
যাবেই চলে তাকে ফেরানোর মন্ত্র আমি শিখিনি। একটা হাহাকার বারবার
আমাকে উদাস, বিষণ্ন জলাশয়ে ডুবোতে থাকে। ভুলে ছিলাম এই বিকেল
আমার শিরায় কোরামিন সঞ্চারিত করেছিল। এখন অন্ধকারে ইঁদুরের দল
আমাকে খেতে শুরু করলেও, ওদের তাড়ানোর ধৈর্য আমার ভগ্নপক্ষ, নখর ও
চঞ্চুবিহীন ঈগল।


ফল কাটার ছুরি আমূল বিদ্ধ হৃৎপিণ্ডে। হাতলে দু’টি প্রজাপতি। স্বপ্নে-দেখা
শল্যচিকিৎসক দাঁড়ানো কফিনের গা ঘেঁষে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চেটে কখন
যে তিনি ঘাসফড়িং, বুঝতে অক্ষম। হৃৎপিণ্ড থেকে ছুরি কনক চুড়ি রূপসীর
হাতে। আজকাল কী যে হচ্ছে, কখনও শুক্রবারকে মনে হয় সোমবার, কখনও
বুধবার রোববারের আদল ধরে। একটা ব্রেসলেট তার হাতে পরাতে গিয়ে
দেখি, পলঙ্কার নয়, সাপ জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে হটতেই পিঠ দেয়ালে,
সাপিনী মোহিনীর রূপে এগোয় আমার দিকে। একঝাঁক প্রজাপতি আমাদের
মাঝখানে দোদুল্যমান ঝালর। ঘাসফড়িং পুনরায় দক্ষ শল্যচিকিৎসক, বাইপাস
অস্ত্রোপচারের জন্যে তৈরি বৈরী ঋতুতে। ঋতু বদলের প্রতীক্ষায় বসে আছি
ঝড় বাদলে, লম্বা করিডোরে, মেঘের মাদলে মিয়া কি মল্লার। দূর পাল্লার যাত্রী
কেউ আছে কি এখানে। হাসপাতালের বেডের শিথানে পাশে। খেলে একজন,
পরনে তার কালো আলখাল্লা। ঠাণ্ডা পাথর বিছানায় উঠে আসে, কবি পাথর
বুকে টেনে ঘুমান। পাখির গানেও তার ঘুম ভাঙবে না। তার শরীর থেকে
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে আঙুরের রস। শল্যাচিকিৎসক খস খস করে কী যেন
লিখছেন টুকরো কাগজে ঝোড়ো বাতাসে নার্সের ত্র্যাপ্রন এখন গাঙচিল।
কবির বুকের পাথর সরিয়ে দাও।


ভেঙে ফ্যালো, আর নয় কালক্ষয়। হাতে তুলে নাও হাতুড়ি ও ছেনি।
এতকাল শুধু গড়েছ এলেবেলে ভুল পুতুল। এবার গড়ো আনকোরা সৌন্দর্য,
কালের ধুলোর স্পর্শাতীত। মাইকেলেঞ্জলো থেকে হেনরি মূর-যুগেশ্বর সবার
জন্যে লাল গালিচা; তুমি হেঁটে যাবে ঘেসো অথবা এবড়ো থেবড়ো পথে।

সময় মোমবাতির মতো দ্রুত গলছে, হাত চালাও জোরেশোরে। পাথরের কুচি
ঢেকে ফেলুক তোমাকে, তবু বিশ্রামের মদে চুর হয়ো না। এই তো অদূরে
সত্য আর পবিত্রতা তোমার রূপায়ণের অপেক্ষায়। ঠাঁই দাও পাথরে, অমর্তের
সঙ্গীত হোক মর্মরমুর্তি। সে গানের মূর্ছনা শ্যাওলা ছিঁড়ে বিশ্বের সকল সীমান্ত
পেরিয়ে যাক।

গত রাতে স্বপ্নে আমাকে কেউ ভাঙার গান শুনিয়েছিল। এখনও অটুট স্বপ্নের
স্বায়ত্তশাসন, দেয়ালে ডানা যুগ্মতায়, উড়ে যাব, প্রফুল্ল ঘুড়ি আকাশে আকাশে
ফিসফিসানি।


ধাপ্পা, অনাস্থা, ধান্দা মর্গে যায় না, কাটা ছেঁড়া নেই। বিদেশ থেকে কফিন
উড়ে আসে মেঘের নানা স্তর ভেদ করে। আশশ্যাওড়ার বনে সবুজ টিয়ে
চওড়া অ্যাভিনিউতে বিয়ের গাড়ি। টিয়ে ফুটপাতে বান্ডিলের মতো পড়ে
থাকে, মর্গে যাবে না। ময়না তদন্তের প্রয়োজন নেই ওর। পাখির জগতেও
ফিরবে না আর। কফিনে এক জোড়া শাদা হাত, ছড়িয়ে-পড়া চুল, কফিন শুষে
নেয় ক্রন্দন। কারা ভুল করে যেপথে যাওয়া উচিত ছিল, সেপথে না গিয়ে
ডোবায় পড়ে হাবুডুবু খায়। একজন চৌরাস্তায় ক’খানা হাড় নিয়ে মাদারির
খেল দেখায়। ‘সব কিছুই মস্ত ধাপ্পা’, হনহনিয়ে চলে যায় অন্যজন।
সমস্ত শহর কী দ্রুত কাদায়, বিষ্ঠায় ডুবে যাচ্ছে। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার
করার মতোও কেউ রইল না। তবে কীসের ধ্বনি যাচ্ছে শোনা? ন্যালাক্ষ্যাপা
একজন কাদায় ডুবতে ডুবতে বাজাচ্ছে মাউথ অর্গান। ওকে তুলে ধরো, বলছে
সিংহের কেশরের মতো মেঘ, বলছে দূর দিগন্ত। করুণ সুর সূর্যাস্তে মিলিয়ে
যেতে থাকে, যেমন নাট্যমঞ্চে যবনিকা পতনের সময়ে হয়।

 স্বেচ্ছানির্বাসিত

তিনি, অকৃতদার প্রৌঢ় অধ্যাপক, কির্কেগার্ডের ‘আইদার অর’ গ্রন্থে
নিমগ্ন সেই কখন থেকে। দুপুর মিশে গেছে বিকেলে। টেবিলে চা
জুড়িয়ে পানি। তশতরিতে একটি করুণ টোস্ট বিস্কুট ফ্যালফ্যাল
তাকিয়ে আছে অধ্যাপকের দিকে। তিনি, নিঃসঙ্গ পাঠক, বই থেকে
দৃষ্টি সরিয়ে জানলার বাইরে তাকান। হলদে বিকেল হেলান
দিয়েছে আকাশে। অধ্যাপকের মনে হলো কী এক ধূসরতা তাকে
ঘিরে ধরেছে। ঘরের চারদিকে ধূসরতা, ঘরভর্তি বই ধূসর, তার
চশমা-আঁটা চোখ দুটো ধূসর, এমনকি তার মনেও রাজ্যের
ধূসরিমা জড়ো হয়েছে যেন একটা কুণ্ডলীপাকানো চাদরের মতো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার এখনও বেশ কিছু সময় বাকি, অথচ তার মনে
হচ্ছে জমাট অন্ধকার তাকে ভেংচি কাটছে। হাতের বই টেবিলে রেখে
তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। চোখে অতিরিক্ত পুস্তক পাঠের
ক্লান্তি, বুক জোড়া কেমন অস্বস্তি। হার্ট ত্র্যাটাক হবে না তো!
বহুদিন থেকে বহাল আছে উচ্চ রক্তচাপের উৎপীড়ন।
হঠাৎ তিনি দেখতে পান, কোত্থেকে একটি রঙিন প্রজাপতি এসে বসল
টেবিলে রাখা কির্কেগার্ডের ‘আইদার অর’ মলাটের ওপর।
প্রজাপতির উপস্থিতি নিমিষে সরিয়ে দেয় অধ্যাপকের অন্তর্গত
ধূসরিমা। প্রজাপতি নেচে বেড়ায় ঘরময়। বুকের অস্বস্তি কোথায়
মিলিয়ে যায়। এক সময় জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায় ধূসরতা-তাড়ানো
প্রজাপতি। তিনি প্রায় ছুটে যান জানলার দিকে, তার দৃষ্টি কী ব্যাকুল
অনুসরণ করতে চায় প্রজাপতিটাকে। সেই রঙিন চাঞ্চল্য
আর দৃষ্টিগোচর নয়। নিচে, দোতলা থেকে তিনি দেখছেন, ফ্রকপরা এক
ছোট্র ফুটফুটে মেয়ে সামনের ফাঁকা জায়গার কৃপণঘাসের ওপর
ছুটোছুটি করছে। মেয়েটিকে দেখামাত্র তার অন্তরের জন্ম নেয় বিকেলের
রৌদ্রস্নাত ঝর্ণাধারা, যার অন্য নাম মমতা। অকৃতদার প্রৌঢ় অধ্যাপক
আগে কখনও মেয়েটিকে দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।

সেই ক্রীড়াময়ীকে বুকে টেনে নিতে ভারি সাধ হলো তার। ততক্ষণে চঞ্চলা
ফ্রক মিলিয়ে গেছে যেন বৈকালী আলোয়। আর সেই মুহূর্তে তার
নিজেকে মনে হলো প্ররিত্যক্ত এই চরাচরে বড় নিঃসঙ্গ, ভয়ঙ্কর একা
এবং এক জ্যোতির্বলয় থেকে স্বেচ্ছানির্বাসিত।
১.১১.৯৭

Exit mobile version