- বইয়ের নামঃ মানব হৃদয়ে নৈবদ্য সাজাই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ কারবালা
এখানে কোথাও শরজর্জরিত দুলদুল নেই,
ফোরাতের কুলু কুলু ধ্বনি নেই, নেই কাশেমের
লাশ নিয়ে নতুন মেহেদি রাঙা হাতে মুখ ঢেকে
বিবি সখিনার বুকফাটা করুণ বিলাপ, তবু
রাজধানী শহরের অলি গলি, জীর্ণ বস্তি, প্রায়
সর্বত্র কেবলি, ধূ ধূ কারবালা। হাহাকার ওঠে
ঘরে ঘরে; চতুর্দিকে শূন্য কলস, বালতি, ঘড়া।
কারো কারো চোখে মরুভূমি, মরীচিকা, আর্ত তাঁবু,
ফোরাতের রক্তাপ্লুত তীর জেগে ওঠে আর
‘পানি দাও, পানি দাও’ আওয়াজে বাতাস ভারী হয়
প্রহরে প্রহরে। এই যাঞ্চা রবীন্দ্রনাথের বৌদ্ধ
ভিক্ষু আনন্দের ‘জল দাও’ নয়, বিপুল গোষ্ঠীর
আর্তনাদ জলসত্র লক্ষ ক’রে কোন্ চন্ডালিকা
ঘড়াভরা জল দেবে এনে শত শত পিপাসার্ত
মানুষের আঁজলায়? চৈত্রের দুপুরে যারা আজ
বিশুষ্ক, অপেক্ষমান, তারা কি করবে পান এই
নর্দমার কালো পানি পথচারী পশুদের মতো?
বস্তুত নগরবাসী কারবালা প্রান্তরে দাঁড়ানো!
অনিশ্চয়তার প্রান্তরে
সূর্য পাকা ফলের মতো টুপ ক’রে পড়ল
দিগন্তের ওপারে। অন্ধকারের জিভ
লেহন করছে পৃথিবীকে। তোমাকে দেখলাম দাঁড়ানো
এক বিশাল প্রান্তরে হু হু হাওয়ার মধ্যে।
তোমার খোঁপার বেলফুলগুলো দূরের আকাশের তারা,
হাওয়ার তোড়ে শাড়ি
আরো বেশি লেপ্টে যাচ্ছিলো শরীরে। মনে হ’লো,
তুমি তাকিয়ে আছো অনন্তের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে।
সেই মুহূর্তে তোমার মুখ চুম্বন করতে পারতাম, অথচ
এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা আমাকে শাসন করছিলো
শুরু থেকেই; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
শুধু দেখছিলাম তোমাকে। উদ্দাম হাওয়া
নিস্তব্ধতা এবং নৈশ রাগিনী
আমাকে আমন্ত্রণ জানালো তোমার সৌন্দর্য পানের জন্যে।
রাত্রির পেয়ালা উপচে পড়েছিলো
মদিবার চেয়েও মদির এক পানীয় যা আমাকে
প্রতিশ্রুতি দেয় অমরতার। তুমি সরাইখানার দরজার
আড়ালে দাঁড়িয়ে বাড়ালে হাত। অকস্মাৎ একটি কালো
বেড়াল, যার চোখ দু’টো সবুজ, আমাকে ‘অবুঝ’ ব’লে
দিলো লাফ ধূ ধূ শূন্যতায়। তোমার চোখে ফসফরাসের আলো।
তুমি, আমি খোলা আকাশ,
নগ্ন সমুদ্রতীর, নানা রঙের নুড়ি, রাত্রির ঠোঁটে
কিসের ঝিলিক, কে এক কংকাল
আমার শরীর ঘেঁষে চলে যায়, তার ঠান্ডা নিঃশ্বাস
লেগে থাকে আমার গ্রীবায়। আমরা দু’জন,
তুমি আর আমি, পরস্পর হাত ধরে হাঁটতে থাকি
সামনের দিকে, পেছনে পড়ে থাকে
সরাইখানার নিস্তেজ আলো, মাতালদের
কোলাহল। সেই কর্কশ কম্বল-জড়ানো কংকাল
বাদুড়ের মতো উড়ে যায়। অনিশ্চয়তা
আলেয়া হয়ে হাতছানি দেয়, হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া
ধুলো ছুঁড়ে দেয় আমাদের চোখে, চাঁদ
আত্মহননের গান শোনায়, আমরা
একে অন্যকে আরো বেশি জড়িয়ে ধরি জন্ম-জন্মান্তরের আকর্ষণে।
৭/৫/৯৫
আমাকে এভাবে তুমি
আমাকে এভাবে তুমি বসিয়ে রেখো না প্রতীক্ষায়।
আমি কি বসেই থাকি? না, না, ঠিক নয়, উঠে পড়ি
মাঝে মাঝে, করি পায়চারি ঘরময়, বারান্দায়
যাই, পুনরায় ঘরে ফিরে আসি, দেয়ালের দিকে
চোখ রাখতেই টিকটিক দেখা যায়; হাতে নিই
কবিতার বই, রেখে দিই পাতা উল্টিয়ে আবার
চেয়ারে আশ্রয় খুঁজি, বসে থাকি দীর্ঘ প্রতীক্ষায়।
আমাকে এভাবে তুমি বসিয়ে রাখবে কতকাল?
যারা কারো পদধ্বনি, কণ্ঠস্বর শোনার আশায়
পথ চেয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ, কেবল তারাই জানে
প্রতীক্ষার দাঁত কত ধারালো, নিষ্ঠুর, বসে যায়
সহজেই অন্তর্গত মাংসের ভেতর, চোখ ফেটে
জল আসে, সেই জলে বর্তমান, ভাবীকাল ভাসে।
১৬/৪/৯৫
আমাকে বাঁচায়
নিউইয়র্কের নিঝুম এলাকা উডসাইডে ক’দিন
আছি স্বদেশের মুখ না দেখে; পাশেই
অনেক মার্কিন পরিবার। দেখাশোনা,
সুপ্রভাত ব’লে কোনো আলাপের রেণু
ওড়াবার অবকাশ নেই।
নিজের মধ্যেই আছি ডুবুরীর মতো।
কখনো স্বপ্নের জলমগ্ন লতা-গুল্ম ক্ষিপ্র মাছ, কারো স্মিত মুখ
সত্তা ছুঁয়ে যায়।
কেন এই পরবাসে শ্বেতাঙ্গ কি প্রবল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের
অন্তরঙ্গ আসরে আমার নেই ঠাঁই? কেন আমি
বহিরাগতের চিহ্ন নিয়ে
ম্যানহ্যাটানের পথে হাঁটি,
সাবওয়ে পাড়ি দিই আলো আঁধারিতে? কেন কেউ
‘এসো ভাই’ ব’লে্
বসায় না পাশে? মৃদু হেসে
নিমেষে ওঠে না মেতে মধুর আলাপে? এরকম
নৈর্বক্তিক পরিবেশে কীভাবে নিঃশ্বাস নিই? এই বিচ্ছিন্নতা
কেবলি গুমরে ওঠে মনের ভেতর।
ফেরাই স্বদেশে মুখ ক্ষণে ক্ষণে, স্মৃতিসমুদয়
আমার হৃদয় ঘিরে রঙিন মাছের মতো কেলিপরায়ণ
ধানমন্ডি, শ্যামলী, মাহুৎটুলি, আওলাদ হোসেন লেনের
রূপ কী স্নেহার্দ্র ফুটে ওঠে
নিউইয়র্কের প্রেক্ষাপটে। ভালোবাসা
এমন হৃদয়হীনতায় আমাকে বাঁচায়।
নিউইয়র্ক, ৭ সেপ্টেম্বর ৯৫
আমার হৃদয়
সত্যি বলতে কী, কখনো একরত্তি ভয় পাইনি
কোনো স্বৈরাচারীর ভ্রূকুটি দেখে। এক ভিড় চাটুকার
আর পদলেহী পরিবেষ্টিত সমারূঢ় মহিলার আকাশ-ছোঁয়া
স্পর্ধা আমাকে হাসির খোরাক জুগিয়েছে।
সশস্ত্র মৌলবাদীদের মূর্খ উচ্ছ্বাসময় হুঙ্কার
বারবার তাচ্ছিল্য করেছি, সকল দুঃখ-দুর্দশা
আমার ঘাড় ধরে নুইয়ে
আমাকে ধুলো চাটাতে ব্যর্থ হয়েছে।
অথচ প্রিয়তমা, তোমাকে দেখতে না পাওয়ার
দীর্ঘ কষ্টে সর্বক্ষণ অন্ধ পাখির বিলাপ আমার হৃদয়।
নিউইয়র্ক, ৯ সেপ্টেম্বর ৯৫
একজন ঈগলের কথা
সাদা মাথা-অলা ঈগল আমি,
আমার নিজস্ব নিঃসঙ্গতার সুউচ্চ চূড়ায়
অধিষ্ঠিত। সম্প্রতি ক্ষীণদৃষ্টিহেতু উড়ালে
অবাধ গতি নেই, নিচে খুব তীক্ষ্ম নামার কালে
কণ্ঠ চিরে বেরোয়া না জোরালো চিৎকার। শীতের
কনকনে হাওয়ায় আমার পালকগুলো থরথর
কাঁপে বাঁশপাতার মতো। কাদাজলে
পড়ে-থাকা গাছের পাতার গন্ধের মতো
কী একটা আমাকে নিয়ত বিরক্তির
উৎকট বৃত্তে ঘোরায়।
দৃষ্টির প্রাক্তন উজ্জ্বলতা কমলেও চাঁদ ঝলসে ওঠে
আমার চোখে, চাঁদকে ফুঁ দিয়ে কয়েকটি রূপালি বুদ্বুদ
সৃষ্টি করি; কিছু নক্ষত্র টাকশালের নতুন মুদ্রা হয়ে ঝনঝনায়
চৌদিকে আমার আহ্বানে। কখনো মেঘের ছায়া
ভেসে যায় আমার উপর, কখনো
সাপের মতো বিদ্যুৎ ঝলসায় আকাশে। মাঝে মাঝে
ঝিমুনি ধরে। কী যেন একটা পাশ দিয়ে
চলে যায়, টের পাই, স্পষ্ট দেখি না। শক্তি
অবসিত প্রায়, অথচ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা
নাছোড় সঙ্গী। চলে কোনোমতে শ্বাসটানার সংগ্রাম নিরন্তর। মাঝেমাঝে
অনুভবে আসে লাস্যময়ী তৃণের নাচ। বুকের কাছে রেশমি ফুলের উন্মীলন আর
আমার মাথার ভেতর বিভিন্ন ঋতু
স্বপ্ন তৈরি করে, স্বপ্নেরা আমার ডানায় জাগায়
উড়ালের অদম্য স্পৃহা, ধারালো চিৎকার
পূর্ণিমার নিশীথের তৃতীয় প্রহরে
বুকে তোলপাড় করে প্রণয়িনীর সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়,
যে এখন অনুপস্থিতির ঘেরাটোপে বন্দিনী।
দুঃসহ বেদনাপ্রতিম প্রণয় আর বিচ্ছেদের
প্রহারে কাতর আমি এই নির্দয় চূড়ায় আঁধারে
ক্ষুধার্ত নিঃসঙ্গতাকে আহার জোগাই অন্তর-ছেঁড়া
গান দিয়ে, এই গান কী করে উৎসারিত, জানি না।
এ কি এক ধরনের দেহমনের যুদ্ধ?
এ কি প্রকৃত শান্তি? জানি না, জানি না, জানি না।
ফ্লোরিডা,২৫ সেপ্টেম্বর ৯৫
একটি উত্তর-আধুনিক কবিতা
কবিতা লিখতে না-পারার দীর্ঘ খরা দেখে দেখে
চোখ পুড়ে যায়,
চোখ ফেটে রক্ত ঝরে। হে মধুর, কখনো কখনো
তোমার নিবাসে গিয়ে দ্বিপ্রহরে অথবা সন্ধ্যায়
বলি, মনোকষ্টে আছি, যেহেতু কবিতা
পালিয়ে বেড়ায় ঘন বনে।
কবিতা লিখতে না পারার কষ্ট জানি
তোমার চুম্বন থেকে বহুকাল নির্বাসনে থাকা
যেন; তুমি হাত ধরে আমাকে এক্ষুনি
কবিতার যমুনার ঘাটে পৌঁছে দাও; জল পান ক’রে তিয়াস মিটাই।
যখন তোমাকে দিকে প্রগাঢ় তাকাই,
বলো তুমি আচঁল গুছিয়ে,
‘কী দেখছো কবি? দ্যাখো চর্যপদের হরিণী ছোটে
এখন উত্তর-আধুনিক জামানায়
পায়ে দলে আন্ধাধুরা পঙক্তিমালা আর
গৈরিক ডাঙায়
চিবোয় হরিৎ তৃণ। সে তোমার কানে কানে কিছু অনুপম
পংক্তি বলে দেবে, লিখে নাও।
এমন চুম্বনহীন শ্রাবণের দিন, হায়, ক্যায়সে গোঙাইব
এ ভরা বাদরে বিদ্যাপতি এসে দেবেন কি বলে?
বাইরে শীতল জলধারা,
আমার ভেতরে বয় মোহন আগুন। তুমি পাশে
দাঁড়ালে অথবা দূরে সোফায় এলিয়ে দিলে প্রতিমা-প্রতিম
দেহখানি তোমার অজ্ঞাতেয়ামি মদন বাউল হ’য়ে নাচি,
সবুরে মুকুল ভাজি, অকস্মাৎ কবিতা আমাকে
বেড় দিয়ে ধরে, তুমি দ্যাখো, তোমাকেই বুকে বাঁধি।
২১/৭/৯৫
একটি কবিতা লিখে
একটি কবিতা লিখে ছিঁড়ে ফেলাটাই সমীচীন;
কিন্তু একটি কি দু’টি বাক্যবন্ধ, কোনো চিত্রকল্প,
কোনো উপমার প্রতি কী রকম মায়া জন্মে যায়
ব’লে শব্দক্রীড়ার সময় ছিঁড়ে ফেলতে পারি না
সদ্যোজাত কবিতাটি। লেখা শেষ ক’রে পুরোপুরি
যদি কেটে দিই কিংবা কুটি কুটি ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলি
বাজে কাগজের সঙ্গে হৃদয়-নিংড়ানো কিছু কথা,
আমার সত্তার অংশ, যাকে এত বেশি ভালোবাসি,
তার হাসি, চোখের চকিত চাওয়া, সন্ধ্যার আঁধারে
সোনালী বাহুর আভা ঝরে যাবে পরাগের মতো।
ফলত নিজের দুর্বলতা হেতু, যতই নিষ্ফুল
হোক এই শব্দক্রীড়া, রচিত কবিতা রেখে দিই।
১২/৪/৯৫
একটি প্রশ্ন
ফ্লোরিডার কিসিমি শহরের এক নিঝুম অ্যাপার্টমেন্টে
বসে আমি লিখছি। আমার
মেজো মেয়ে ফাওজিয়া গ্যাছে এক প্রতিবেশিনীর
অ্যাপার্টমেন্টে; ওর বর গ্যাছে কাজে। ওদের তিন ছেলে
হৃদয়, উপল এবং জেহিন ইশকুল। একলা
ঠান্ডা ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম জালিম রোদ বেদম চাবকাচ্ছে
গাছপালা, বিনীত অ্যাপার্টমেন্ট এবং
একটি কি দু’টি মোটর কারকে। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে
দুপুরের বুক। নিঃসঙ্গতা আমাকে নিয়ে কেলিপরায়ণ; যেমন
বেড়ালের থাবা জব্দ ইঁদুরকে নিয়ে খেলায় মত্ত।
মনে পড়ল চার বছর ছুঁই ছুঁই আমার পৌত্রী নয়নাকে, যাকে
রেখে এসেছি ঢাকায়। তার দুটি কালো চোখে
দিগন্তে নেমে-আসা শ্রাবণ মেঘের গাঢ়, টলটলে মায়া।
জানি না, সে এখন কী করছে। হয়তো ভোরবেলা
বারান্দায় লুটিয়ে-পড়া
এক ফালি গাছের ছায়া নিয়ে খেলায় মেতেছে,
হয়তো চিলের ছোঁ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে
নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছে কবুতরছানাকে, হয়তো জীবজন্তুর
ছবি-অলা একটি বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে আপন মনে।
আজ টেলিফোনে কথা হলো নয়নার সঙ্গে।
মধুর কণ্ঠে সে জিগ্যেস করল আমাকে, ‘তুমি কেমন আছো দাদাভাই?
তুমি কবে আসবে?’ ‘শিগগিরই চলে আসবো,’ জানালাম ওকে।
ভবিষ্যতে একদিন নয়নার সত্তায় ক’টি বসন্তের ঘ্রাণ সঞ্চিত হবে, জানব না।
সে ব্যাকুল প্রশ্ন করবে,
‘দাদাভাই, তুমি কবে আসবে?’ সেদিন
তাকে জবাব দেওয়ার জন্য আমি কোথাও থাকব না।
ওর প্রশ্ন ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে যাবে
নির্দয় শহরের কৃপণ নিসর্গে, দালানে, পথের ধুলায়।
ফ্লোরিডা, ২৯ সেপ্টেম্বর ৯৫
একটু পরেই যাত্রা
একটু পরেই যাত্রা আমার, অথচ ফ্লোরিডার
কিসিমি শহর রইল চুপচাপ, নির্বিকার;
বলল না, কেন যাবে? থাকো না এখানে
আরো ক’টা দিন। বলল না,
এলোমেলো চুলে চালাও চিরুনি যত্ন ক’রে, শার্টে
লাগাও বোতাম ঠিকঠাক, দেখে নাও সফেদ ক্লসেট থেকে
ট্রাউজার ভরেছো তো স্যুটকেসে, ফেলে
যাচ্ছো না তো কিছু?
আইড্রপগুলো পুরোছো পকেটে না কি রয়ে গেলো
টেবিলের কোণে জন অ্যাশবেরিসহ?
সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছো? চলে যাবে তুমি?
কিসিমির কণ্ঠে এ রকম প্রশ্ন হয়নি ধ্বনিত,
অথচ আমিতো এর সতেজ সবুজ গাছপালা,
টলটলে হ্রদ, বৃষ্টিধোয়া রাত, জ্বলন্ত দুপুর
গোধূলিতে বাগানের ফুল,
ভোরবেলাকার পাখিদের কলতান
এবং ডিজনি ভিলেজের প্রতিবেশ
ভালোবেসে ক্ষীণদৃষ্টি দু’ চোখকে সজল করেছি।
আখেরে বিদায় বেলা আসে, বিমানন্দরে পৌঁছে
আত্মজা আমাকে মমতায় ব্যাকুল জড়িয়ে ধরে।
ওর প্রতি অশ্রুকণা বলে, ‘চলে যাবে?
সত্যি তুমি চলে যাবে, বাবা?
নিরুত্তর আমি তার কপালে একটি চুমো এঁকে
স্নেহপাশ ছাড়িয়ে এগোই।
নিউইয়র্ক ৬/১০/৯৫
ও বাংলার পাখি
ও বাংলার পাখি, শ্যামা পাখি, রামপ্রসাদের গান
হয়ে তুমি এমন বিহানে
এখানে কী করে এলে? এই জানালায়
বাংলার সবুজ ঘ্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে নিরিবিলি
ঝরিয়ে সুস্নিগ্ধ সুর। কে তোমাকে পাঠালো
আমার একান্ত কাছে হু হু পরবাসে? বলবে না
তুমি সুনিশ্চয় মাথা খুঁড়ে মরলেও
কঠিন দেয়ালে, তবু জানি ও বাংলার পাখি, ওগো
শ্যামা পাখি, আমার অন্তরে জানি, যার
ছলছল দু’টি চোখ তোমাকে করেছে বাধ্য আজ
দূর দূরান্তের নানা মেঘে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিউইয়র্কের এই কংক্রীটের জঙ্গলে গোপনে
এড়িয়ে সকল ফাঁদ হে রামপ্রসাদী সুর, হে অমল স্মৃতি
ও বাংলার পাখি, শ্যামা পাখি, তুমি বোলো গিয়ে তাকে
এই পরবাসে
আমার বিরস দিন যায়- যেন আমি
নিষ্ঠুর মরুর বুক পাড়ি দিয়ে চলেছি, কোথাও
মরুদ্যান নেই, ফণিমনসার ঘায়ে চোখ ফেটে রক্ত ঝরে;
বুঝি বা হারাবো দৃষ্টি অচিরেই! শ্যামা পাখি, বোলো তাকে
তার বিচ্ছেদের চৈত্রে আমি পুড়ে যাচ্ছি, এ অনল
কী করে লুকাবো আমি? কীভাবে নেভাবো? কোথায় সে জলধারা?
ও বাংলার পাখি, শ্যামা পাখি, কাছে এসো, খুব কাছে
তোমার কোমল বুকে মুখ রেখে খানিক জুড়াই অন্তর্জ্বালা।
১৮/৮/৯৫
ও ভ্রমর
ও ভ্রমর, ভ্রমর রে তারে কইও গিয়া
আমার রাধার বিচ্ছেদের অঙ্গারে আমি ফুইট্রা মরি
খইয়ের মতো। কত দিন কত রাত যায়
আমি মাথা কুইট্রা মরি কংক্রীটে, তবু
দিদার পাই না তার; ও ভ্রমর
তারে কইও গিয়া কানে কানে নিরালা নিশীথে।
ও ভ্রমর, ভ্রমর রে আমার চক্ষের পিদিম
নিভু-নিভু জ্যোতি নিভবার আগে
তারে দেখতে না পাইলে
আমার পরাণ ফাইট্রা যাইবে ভ্রমর গো।
ভ্রমর, তুমি আমারে এই পাষাণ নগরে
একবার দেইখ্যা যাও,
দেইখ্যা যাও কী হালতে আছি আমি
পোড়া অঙ্গ লইয়া।
ও ভ্রমর, ভ্রমর রে তোমারে ডাইক্যা মরি পাতালে,
পাথরের জঙ্গলে, আইসো আমার ধারে, আমার
শেষ কথা শুইন্যা তুমি তারে কইও গিয়া
ও আমার ভ্রমর রে।
ও আমার ভ্রমর, ভ্রররে আমার রাধারে আইজ
খুঁইজ্যা পাই না কাছে-ধারে, কোনোখানে।
ভ্রমর গো, কী কইরা আইবারে তুমি অ্যাত্ত দূরে
পরাণের বাংলা ছাইড়া? কইয়া যাও, ও ভ্রমর, কইয়া যাও রে।
নিউইয়র্ক, ২৫/৮/৯৫
কবি আক্রান্ত হ’লে
এই গ্রহের যে-কোনো অঞ্চলের যে-কোনো
স্বেচ্ছাচারী শাসক যখন কারাবন্দী করে
একজন প্রকৃত কবিকে, যখন একজন কবি
আক্রান্ত হন মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হাতে,
অথবা তাকে যে-কোনো উৎপীড়ন তাড়া করে, লাঞ্ছিত করে,
তখন কি লতাগুল্ম, গাছপালা, পশুপাখি, পাহাড়,
পথরেখা, নদীনালা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে? বিলাপধ্বনিতে
ভরে ওঠে ভূমন্ডল আর আকাশের পর আকাশ?
না, এমন কিছুই ঘটে না। যখন কোনো স্বৈরাচারী শাসক
একজন প্রকৃত কবিকে
অন্ধকার সেলে পোরে জন্তুর মতো,
কিংবা সন্ত্রাসী ধর্মান্ধরা কোনো কবির
জীবন দাবি করে, বোমা ফাটায় তার ঘরে, অথবা
দেশছাড়া করে উচ্ছৃঙ্খল কোলাহলে, তখন লক্ষ্মী প্যাঁচার
ঘাড়ের লোমগুলো ফুলে ওঠে, রক্ত ঝরে কোকিলের স্বরে,
জলপাই গাছের পাতাগুলো
অঙ্গার ঝরায় এখানে-সেখানে,
আকাশের মেঘগুলো হয়ে যায় রাগী সিংহের কেশর,
ফোঁসে নদী, রুদ্ররোষে আদিম দেবতার মতো মাথা ঝাঁকায় অনড় পাহাড়।
নিউইয়র্ক, ৯ সেপ্টেম্বর ৯৫
কবিতার একটি পঙক্তি
বহু বছর আগে লিখেছিলাম এক সনেটে-
‘যে-তুমি আমার স্বপ্ন, অন্নজল, অস্তিত্বের গান।
কার উদ্দেশে রচিত হয়েছিল সেই পঙক্তি,
আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। কোন এক কুহকিনী
সেই পঙক্তি গলায় দুলিয়ে দমকা হাওয়ার মতো
মিলিয়ে গেছে ঘন কুয়াশায়। আমার কয়েকটি দিন
লুট করে সে উধাও। তার অনুপস্থিতি পারেনি
আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে অশ্রুকণা অথবা দীর্ঘশ্বাস।
আজ এতকাল পরে তুমি, হ্যাঁ তুমি,
পা রেখেছে আমার ধূসর প্রাঙ্গণে, রঙ বেরঙের
অনেক পাখি উড়িয়ে দিয়েছ আমার আকাশে, তোমার শরীর
বীণা হয়ে বেজে উঠেছে আমার অন্তরে।
প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম আমার জীবনের
সবচেয়ে আশ্চর্য বিকেলে, সেদিনই মনে হলো
আমার পুরনো কবিতার সেই পঙক্তি, সেই নৈবেদ্য
একান্ত তোমারই প্রাপ্য, আর কারো নয়। কেন আমি আগে
সেই শব্দমালার অপব্যবহারে মেতে উঠেছিলাম? আমার সেই
উপব্যবহার মার্জনায় ধুয়ে পঙক্তিটি তুমি নিত্যনতুনরূপে গ্রহণ করো প্রিয়তমা।
নিউইয়র্ক, ২৫/৮/৯৫
কবির কুকুর
‘সে আজ বিষাদে আছে, আজ সে বিষাদে আছে খুব,
কিছুদিন থাকবে এমন’-লিখে কবি
জানলার বাইরে তাকায়
রাধাচূড়া গাছটির দিকে।
আজকের ভোরবেলা, কবি ভাবে, হৃদয়চারিণী
প্রিয়তমা গৌরীর মতোই সুলক্ষণা
পা ফেলে এসেছে, তারই দেহশ্রীর আভা
বিশদ ছড়ানো যেন কবিতার উৎসুক খাতায়।
আজ কি গৌরীর সঙ্গে দেখা হবে বিকেল ফুরালে?-
এই প্রশ্ন ব্যাকুল গুঞ্জন তোলে কবির হৃদয়ে;
তার বিষাদের মুখোমুখি
কী ভাবে দাঁড়াবে? হবে না কি কম্পমান
সত্তার কাঠামো? কবি তার অসমাপ্ত কবিতার
প্রতি চোখ রাখে, পঙক্তিগুলো
অসহায়, অপলক কাতর দৃষ্টিতে
স্রষ্টার বয়েসী মুখে তাকিয়ে রয়েছে।
কেউ কেউ নির্বাসনে যাবে, কারো কারো
সংস্কারের প্রয়োজন হবে হয়তো-বা
কোথায় সে মনোমুগ্ধকর অস্থিরতা, যার বিমূর্ত প্রভাবে
খুলে যায় অকস্মাৎ মস্তিষ্কের দক্ষিণ দুয়ার? শব্দ মৃগয়ায় কবি
সর্বদা অপেক্ষমান ক্ষুধার্ত বাঘের মতো আর
আহরণে ক্ষিপ্র অগোচরে জাগরণে, এমনকী
নিদ্রাও নিষ্ফল নয় কখনো কখনো।
অবচেতনের স্তর ভেসে ওঠে; বারান্দার অন্ধকার থেকে
একটি কুকুর চলে আসে আদরের প্রত্যাশায়
কবির পায়ের কাছে, লালাসিক্ত জিভ, লেজ নাড়ে,
ঘুমায় কুণ্ডলী হ’য়ে, নাছোড় কুকুর
আলাভোলা প্রভুটির পায়ে পায়ে ঘোরে। কবি ওকে
অর্ফিয়ুস নামে ডাকে। মাথায় বুলিয়ে হাত আস্তে
ছন্দতাল ঠিক ক’রে নেয় মাঝে মাঝে।
প্রভু তাকে সেদ্ধ মাংস খেতে দেয় রোজ। ডাক শুনে
অর্ফিয়ুস কান খাড়া করে, ছুটে আসে ত্বরিৎ গতিতে।
‘সে আজ বিষাদে আছে’ শিরোনামা যে-পদ্যের,
এখনো হয়নি শেষ; কখনো হবে কি?
শেষ স্তবকটি রচনার আগে মৃত্যু হ’লে তার, তবে কার
কী এমন ক্ষতি হবে? নিথর থাকবে শুয়ে খাটে,
ঘুরবে সিলিং ফ্যান বন বন, হাওয়ায় উড়বে উদাসীন সাদা চুল।
লেখার টেবিলে রইবে প’ড়ে বই, নিস্তব্ধ কলম।
বেলা হ’লে কারো কারো ফোঁপানি হাওয়ায় খাবে পাক,
গহীন গাঙের ঢেউ হয়ে ঘরদোরে পড়বে আছড়ে
ক্রন্দনের রোল,
স্টাফ রিপোর্টার তথ্য সংগ্রহে তৎপর আর রোগাটে, একাকী
অফির্য়ুস শুধু বারান্দার এককোণে
প্রস্তর-মূর্তির মতো ব’সে রইবে স্থির।
৮/৬/৯৫
কিন্তু কেন তুমি চলে গেলে
(বন্ধু শক্তি চট্রোপাধ্যায় স্মরণে)
নমস্কার অথবা আদাব কোনো কিছুরই দরকার
হয় নি, যখন আমাদের দেখা হয় কলকাতায়।
শুধু করমর্দনের উষ্ণ চাপ, মৃদু হাসি, কিছু
কথা বলা, কিছু নীরবতা আমাদের বন্ধুতার
শেকড়ের টান অনুভব করেছিল অগোচরে।
কবির নিঃসঙ্গ যাত্রা, তবু তার ডানে বামে থাকে
কত কিছু –উজ্জ্বল সফল পঙক্তিমালা, অসার্থক
কোনো চিত্রকল্প, এক পাত্রের ইয়ার কতিপয়।
হাওয়া, মেঘ, রৌদ্র-ছায়া, গাঢ় অন্ধকার, নিদ্রাতুর
নারীর চোখের পাতা থেকে কী সহজে পেয়ে যেতে
আশ্চর্য কবিতা নিত্য। নিজেকে হেলায় স্বেচ্ছাচারী
ব’লে একা চলে যেতে নদীর কিনারে দেখে নিতে
চিতার জ্বলন্ত কাঠ। একে একে আমরা সবাই
যাবো, কিন্তু কেন তুমি চলে গেলে এই অসময়ে?
২৭/৩/৯৫
কী আর আমি করতে পারি?
কী আর করতে পারি আকাশ-আঁচড়ানো
অট্রলিকার ভিড়ে দাঁড়িয়ে? ইএ বিপুল জনস্রোত, এই সুদীর্ঘ
বেগানা ফুটপাত, এই সারি সারি গাড়ির ঢলের ধারে
ম্যানহাটানে দাঁড়িয়ে
কী আমার করার থাকতে পারে এই মুহূর্তে? কোনমতে
পাতাল-ট্রেনের শীতল কামরায় ঢুকে চলে যেতে পারি
সাময়িক ডেরায়। চোখের নাছোড় অসুখ নিয়ে
বেশি ঘোরাঘুরি দায়। কৌশিক, এহসান, আলম, নিজাম,
ড্যানি সঙ্গ দিয়েও
আমার অন্তর্গত নিঃসঙ্গতা ঘোঁচাতে ব্যর্থ। এই মুহূর্তে
আমার একাকিত্বের নিথর মূর্তির মুখোমুখি বসে আছি।
হঠাৎ অদূরে ডেকে ওঠে কাক। কাকের ডাক আমার
নিঃসঙ্গতাকে আরো বেশি গাঢ়, আরো দুঃসঙ্গ
ক’রে তোলে। কী আমি করব তুমিহীনতায়? আমার চোখের
পাতায় কানে কানে কে যেন বলল, ‘স্বপ্ন দ্যাখো,
এখন বড় ক্লান্ত তুমি, স্বপ্নের খুব প্রয়োজন তোমার। আস্তে-আস্তে
আবার চারদিকে ঝলমলে। কিছু মুদ্রার মতো
স্বপ্ন নৃত্যপর আমার প্রতিটি রোমকূপ পল রবসনের
কণ্ঠস্বর হয়ে প্রেমের গান গাইতে শুরু করে।
দেখতে পেলাম, আমার বাড়ির পাশের গোলাপের নার্সারিতে
নয়না ফুল তুলেছে গোধূলিতে, ওর সাইকেলে ব’সে
পা দোলাচ্ছে ডানা-অলা পরী। আর কী আশ্চর্য, তুমি
সারা শরীরে মেঘ, রোদ, জ্যোৎস্না আর
নক্ষত্রের ঘ্রাণ নিয়ে, বাংলার উদ্ভিদ আর জলধারার সপ্রাণ
মাধুর্য নিয়ে এসেছ আমার কাছে।
আমার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে
তুমি বললে, ‘বলো তো কেমন আছো? আমাকে ছেড়ে
কী ক’রে থাকতে পারো এমন উদাসীন?
আমি কিছু বলার আগেই
তোমার জায়গায় ঝুলে আছে ঘোর অমাবস্যা। অতিকায়
ইয়াঙ্কির জবরদস্ত চেঁচানি ঝাঁকুনি দেয় আমাকে।
স্বপ্ন দ্যাখো, স্বপ্ন দ্যাখো সুর বাজতে থাকে কানে।
তোমাকে আবার প্রবল আনতে চাই
স্বপ্নের চৌহদ্দিতে। দেখি, আগাগোড়া চকচকে ইস্পাতে গড়া
এক আততায়ী আমাকে অনুসরণ করছে সর্বক্ষণ, পটভূমিতে
ডিস্কো সঙ্গীতের উন্মাদনা আর
উত্তর বঙ্গের এবড়োথেবড়ো রাঙামাটি ছোঁয়া ভাওয়াইয়া।
তোমার সন্ধ্যানে সাবওয়ে, রুজভেল্ট আইল্যান্ড
রকফেলার সেন্টার, হাডসন নদীর তীরে হেঁটে বেড়াই প্রহরে-প্রহরে,
অথচ কোথাও তোমার উপস্থিতি
জ্বলজ্বল করে না। কোথাও তুমি দাঁড়িয়ে নেই আঁধারে।
আমি চাইকোভস্কির সুর-তরঙ্গকে অনুরোধ করি
তোমাকে আমার কাছে ডেকে আনার জন্য
লালনের গান এবং গীতবিতানের অনুপম ঐশ্বর্যময়
পঙক্তিমালাকে মিনতি জানাই
আমার কাছে তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
অথচ চিরদিন অব্যর্থ ওরা আজ চরম
ব্যর্থতায় মুখ লুকায় পাতালের অন্ধকারে এবং
কয়েকটি ছন্নছাড়া পাখি ফেটে পড়ে অট্রহাসিতে।
এভাবে স্বপ্ন দেখা ছাড়া কী আর করাতে পারি আজ রাতে
ম্যানহাটানের আকাশ-ছোঁয়া ভয়ঙ্কর সুন্দরের মুখোমুখি?
নিউইয়র্ক, ২৫/৮/৯৫
কৃষিকাজ করি না, তবুও
পিতামহ কিংবা পিতা করেন নি কৃষিকাজ, যদিও তাঁদের
চাষাদের বিষয়ে জ্ঞানের
অভাব ছিল না কোনো গ্রামীণ হওয়ার হেতু। আমি
জন্মেছি শহরে, তবু কিছু শুনে কিছু নিজে দেখে
পতিত জমিন আর চষা
ক্ষেতের ফারাক জেনে গেছি।
দেখেছি কী ক’রে রৌদ্রে পুড়ে
লাঙল চালায় ক্ষেতে কর্মঠ কৃষক, বীজ বোনে
ফসলের প্রত্যাশায়। যখন ধানের শীষ চোখ
মেলে নবজাতকের মতো,
কৃষকের চোখে ফোটে অগণিত তারা।
মেঠো ইঁদুরের উৎপাতে অথবা পঙ্গপাল
অকস্মাৎ হানা দিলে ক্ষেত্রের
কৃষকের বুক ফাটে আর
ঘোর অমাবস্যা নামে চোখে;
কৃষকের ভেতর প্রবেশ ক’রে এ-কথা জেনেছি।
কৃষিকাজ করি না, তবুও অনুরূপ কর্মে আমি নিবেদিত
বহুকাল। বর্ষণের করুণা এবং
খরার দারুণ স্বৈরাচার, ফসলের বিনষ্টির
অভিজ্ঞতা আমার অজানা নয়, যেহেতু আমিও শ্রমে ক্লিষ্ট
ভিন্নতর জমিন কর্ষণ করি, বীজ বুনি, আগাছা নিড়াই
গোলায় ফসল তুলি উদ্ভাসিত মুখে।
নিউইয়র্ক, ৯ অক্টোবর ৯৫
কেন এরকম হয়?
কেন এরকম হয়? হবে? কেন তুমি অভিমানে
স্তব্ধ হয়ে যাবে? কেন এতক্ষণ করবে না ফোন?
আমার সুবিধে নেই, টেলিফোনও কিছু বিগড়ে আছে।
এই যে মুহূর্তগুলি, ঘন্টাগুলি আমাকে চিবিয়ে
খাচ্ছে হিংস্র বিড়ালের মতো, তুমি কি বোঝো না? হায়,
এ বয়সে আমি আর কত কষ্ট পাবো? কী আমার
অপরাধ, বুঝতে অক্ষম। গাছ হ’য়ে জন্মানোই
ছিল ঢের ভালো, বিষাদের লেশমাত্র থাকতো না।
তোমাকে উপেক্ষা করি, এই মতো ভাবনায় তুমি
সম্প্রতি কাতর নাকি! অথচ আমি যে সারাক্ষণ
জপছি তোমাকে, এমন কী স্বপ্নের ঘোরেও করি
উচ্চারণ ভালোবাসা তোমার উদ্দেশে। আলিঙ্গনে
বাঁধি তোমাকেই মাঠে, নদী তীরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে।
কীভাবে তোমার রোষ, প্রিয়তমা, অস্তমিত হবে?
১২/৪/৯৫
ক্যামেলিয়ার প্রতি
ক্যামেলিয়া, কী সুন্দর ফুটে আছো যুবতীর মতো
আমার পুরনো এই লেখার টেবিলে। কী বিশদ
নির্জনতা ঘিরে আছে তোমাকে, আবেশে চোখ বুজে
আসে, কিন্তু বারবার তোমাকেই চেয়ে দেখি, জানি,
তুমি থাকবে না বেশিক্ষণ লেখার টেবিলে। ম্লান
হতে শুরু করেছে তোমার রূপ, পরে তুমি যাবে
আবর্জনা-স্তূপে; এভাবেই সুন্দর বিষণ্ন চলে
যায়, মনে লগ্ন থাকে তার কিছু নিভৃত সুবাস।
তোমাকে সরিয়ে ফেলবার পর কেমন শূন্যতা
আমার হৃদয় জুড়ে আছে। যেদিন প্রথম এলে
আমার এ ঘরে তুমি, মনে পড়ে, আনন্দ কলাপ
মেলেছিল, তোমার শরীরে ছিল কোমল, মধুর
স্পর্শ যার, তারও রূপ তোমার মতোই ঝরে যাবে
কোনোদিন? যদি যায়, ততদিন আমি থাকব না।
১৭/৪/৯৫
ছায়া গোধূলির আড়ালে
এই পরবাসে ছায়া গোধূলির আড়ালে
তুমি কি হঠাৎ মনের খেয়ালে দাঁড়ালে?
একটু আগেও ভাবিনি তোমার উপস্থিতি
এখানে আমার হৃদয়ে আনবে নতুন তিথি।
কত যে আকাশ কত সমুদ্র পেরিয়ে
এই ছোট ঘরে তোমার চরণ বাড়ালে।
কাছে এসে তুমি বসলে নম্র আঙ্গিকে,
তারই আভা ফোটে বেগানা প্রহরে চারদিকে,
যমজ চোখের কালো বিদ্যুৎ ছড়িয়ে
আমার মনের শঙ্কা, নিরাশা তাড়ালে।
ক্ষীণ দৃষ্টিতে দেখিনি তোমাকে পুরোপুরি;
কালো হাওয়া এসে হঠাৎ তোমাকে করে চুরি।
ছুঁইনি তোমাকে; কে যেন বলল আড়ালে
‘হায়, কবি তুমি বুঝলে না কী-যে হারালে!’
নিউইয়র্ক, ৮ সেপ্টেম্বর ৯৫
ছায়ার পুতুল
যখন আমরা দু’জন সন্ধেবেলা
কোথাও নিবিড় বসে থাকি মুখোমুখি,
বুঝি না কী ক’রে সময় যে ব’য়ে যায়,
সময়ের দানে আমরা তবুও সুখী।
হাতে হাত রেখে, চেয়ে থেকে, কথা ব’লে,
এবং নীরবে কাটে বিহ্বল বেলা;
কখনো হঠাৎ কী-যে হয় নিমেষেই
ছায়ায় মলিন দীপ্ত মিলন মেলা।
আমার অতীত কখনো সখনো কালো
প্রেতের মতোই চেপে ধরে শ্বাসনালী;
তোমার একটি কি দু’টি ঘটনা ক্রূর
দংশনে করে আমাকেই ফালি ফালি!
বুঝি এই সব ছায়ার পুতুল শুধু,
তবু কেন মিছে এমন মুষড়ে পড়ি?
আমার প্রহর কেন হাহাকার হয়?
কেন বারবার বেঁচে উঠি, বেঁচে মরি?
কখনো কখনো এমন নিঃস্ব লাগে,
যেন মরুভূর বুকে প’ড়ে থাকি একা
কিন্তু হঠাৎ কোন্ সে ইন্দ্রজালে
ক্ষুধিত আঁধারে উদিত চন্দ্রলেখা।
ছায়া-পুতুলেরা আমার জগৎ থেকে
নেবে কি ছিনিয়ে ঋদ্ধ সোনালী দিন?
এই যে এখনো রয়েছে তোমার প্রেম,
কী ক’রে শুধবো সেই দুর্লভ ঋণ?
এক রাতে তুমি বললে, ‘ছায়ারা নেই,
কবর দিয়েছি; আমরা দু’জন আছি।
যতদিন জ্বলে আমাদের প্রেম-দীপ,
এসো ততদিন নিজেদের মতো বাঁচি।
২০/৩/৯৫
জন্মদিন, ১৯৯৫
আমার ভেতরে থাকে সর্বক্ষণ একজন পাখি
নিবিড় একাকী।
নড়ে চড়ে; রোদের রঙের মতো, আঁধারের মতো
নরম পালক খসে, আবার গজায় ক্রমাগত
কে জানে কেমন ইন্দ্রজালে! নড়লে গাছের পাতা
অথবা ফুটলে ফুল সে পাখির মাথা
নত হয় কৃতজ্ঞতা হেতু,
কার কাছে জানা নেই তার, হাওয়ায় বিপুল সেতু
গড়ে ওঠে চোখের পলকে, লোক পারাপার চলে
অবিরাম। পাখি কী অনলে
জ্বলে মাঝে-মাঝে, অগ্নিপুষ্প হ’য়ে যায়,
হ’তে পারে মেঘ খন্ড, বুক-চেরা ঘোরে গান গায়।
আমার ভেতরকার পাখিটিকে আহারের অছিলা ছাড়াই
বাহিরে সম্পূর্ণ আনি, পক্ষী রূপে পাহাড়ে দাঁড়াই
সাবলীল, স্বর্ণপক্ষ ঈগলের সঙ্গে সখ্য গড়ি, মেঘে উড়ি,
ঝর্ণাতলে গেলে পায়ে লাগে পাথরের কিছু নুড়ি
সূর্যোদয়ে কি সূর্যাস্তে, এ মুহূর্তে ভেসে যেতে পারি
বিদেশের মমতার তাঁবু ছেড়ে ছুঁড়ে তোমার আপন বাড়ি,
তোমার অন্তরে চঞ্চু ঘষে যদি বলে ফেলি, ‘আজ এ দীনের
জন্মদিনে কোন্ উপহার দেবে, প্রিয়তমা? তুমি তো দিনের
আলোকে অধিক আলো ক’রে
উৎসুক পাখির হৃদয়ের কানা ভ’রে
বলবে গভীর স্বরে, ‘মনপ্রাণ যাহা ছিল সবই
তোমাকেই না চাইতে কবে দিয়ে ফেলেছি, হে কবি।
নিউইয়র্ক, ২০ অক্টোবর ৯৫
জ্যাকসন হাইটস-এর কবুতরদের মাঝে
অক্টোবরের প্রায়-দুপুরে জ্যাকসন হাইটস-এর
ত্রিভুজের মতো এক জায়গায় দাঁড়ালাম এক ঝাঁক
ধূসর-নীল কবুতরের মাঝে। আমার হাতে ছোট পলিথিনের
থলিতে কিছু চাল। আমাকে দেখেই
কবুতগুলো ডানায় শব্দ তরঙ্গ তুলে উড়ে গেল
অদূরে। থলি থেকে চাল ছিটোই
পাথুরে চত্বরে, সঙ্গে সঙ্গে কবুতরদের অনেকেই ফিরে
আসে আমার কাছ ঘেঁষে। চত্বরে ছড়ানো
বিস্কুট আর পাউরুটির টুকরোগুলোকে আপাতত উপেক্ষার ছায়ায় রেখে
ওরা আগ্রহে চঞ্চু দিয়ে খুঁটে খেতে থাকে সরু চাল।
আমি গভীর তন্ময়তায় দেখি ওদের
চঞ্চল আহার; মাঝে-মাঝে কবুতরদের
সরে যাওয়া, আবার আমার খুব কাছে ফিরে আসা
চাল কুড়ানোর আশায়। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে কালো
চামড়ার জ্যাকেট-পরা দীর্ঘকায় এক লোক
হেঁটে আসার সঙ্গে সঙ্গে কবুতরগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত
ওড়ে আমার মাথার উপর। লোকটা চলে গেলে আমি আবার
চাল ছিটোই। কবুতরের ঝাঁক নেমে আসে ত্রিকোণ চত্বরে।
জ্যাকসন হাইটস-এর কবুতরগুলো জানে না বিশ্বের
এক মহান চিত্রকর পিকাসো শান্তির শপক্ষে
এঁকেছিলেন ভুবনবিজয়ী এক পায়রা, ওরা জানে না
দেশে-দেশে আজ শান্তি কপোত নিষাদের শরাঘাতে ভীষণ কাতরাচ্ছে।
জ্যাকসন হাইটস-এর ত্রিকোণ চত্বরে দাঁড়িয়ে দেখছি কবুতরগুলোকে
গাঢ় মমতায়। ইতিমধ্যে ওরা জেনে গেছে আমি কোনো হন্তারক নিষাদ নই।
নিইয়র্ক, ৯ অক্টোবর ৯৫
তার উদ্দেশে নিয়ে যাই
ষাটোর্ধ বয়স তবু হঠাৎ উদয় শঙ্করের
শিবশঙ্করের রূপে হাওয়ায় তরঙ্গ
তুলে প্রিয়তমা
গৌরীকে বুকের কাছে নিয়ে
নতুন মুদ্রায় সীমাহীন রুক্ষতায়
অকাল বসন্ত সৃষ্টি করবার সাধ জাগে আর
কী সহজে হয়ে যাই বড়ো গোলাম আলীর মালকোশ
নিশীথের দ্বিতীয় প্রহরে।
যে আমার গৌরী, সে আমাকে প্রতিদিন প্রতিরাত
স্বপ্নের খেয়ায়
কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কী উদ্দাম,
সমুদ্রের নীল জলে ভিজে যাই ক্ষণে ক্ষণে, মাথার উপর
অপূর্ব পাখিরা ওড়ে, তাদের ডানায়
দুপুরের আনন্দাশ্রু, সন্ধ্যার বিষাদ-বিন্দু কাঁপে।
মুহূর্তে মুহূর্তে সে আমাকে
প্রেমের প্রভায় টেনে করে দান তরুণের সতেজ আঙ্গিক।
সে পাতালকন্যা হয়ে অনেক গভীরে ডুব দিয়ে
ভেসে ওঠে পুনরায়, আমার বয়েসী শীর্ণ হাতের তালুতে
তুলে দেয় অপরূপ মণিরত্ন; নিঃস্ব আমি, তাকে
কোনো পরিচ্ছদ
কোনো অলঙ্কার কিংবা অনুরূপ কিছু
নয়, তার উদ্দেশে কেবলি কিছু হৃদয়-নিংড়ানো পদাবলী নিয়ে যাই।
নিউইয়র্ক, ১৩ সেপ্টেম্বর ৯৫
তোমার জন্মদিনের তীরে
যেদিন তুমি জন্ম নিলে
এক মধ্যবিত্ত ঘরে সেদিন বাংলার সবচেয়ে সুকান্ত মোরগ
ডেকে এনেছিল সর্বাধিক প্রসন্ন প্রত্যুষ। সেদিন
গাছের পাতাদের ভিড়ে ধ্বনিত হয়েছিল
অর্ফিয়ুসের বংশীধ্বনি, রঙ বেরঙের ফুলগুলো এরকম
হেসে উঠেছিল যা আগে
কেউ দ্যাখেনি। সেদিন রোদ অনিন্দ্য আবীর হ’য়ে
ঝরেছিল শহরে আর একজন জ্বলজ্বলে তরুণ কবি
তার সবচেয়ে সেরা কবিতাটি রচনা করেছিল। সেই কবিতা
সে তোমাকেই উৎসর্গ করেছিল তোমার অস্তিত্ব বিষয়ে কিছু না জেনেই।
আজ তুমি আর অস্তিত্বহীন নও সেই কবির কাছে,
যে এখন বয়সের মার খেতে খেতে
এখন অবসন্ন, যার সত্তায় সময়ের অজস্র নখরাচিহ্ন।
সে তোমার পরিচয় জানে, সে মালা পরায় তোমার গলায়, জানে
কখন তুমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলে। এখন তো তার
তোমার অনেক কিছুই জানা, প্রায় মুখস্থ।
আজ সেই কবি যখন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন সে তোমার
ফ্রক-পরা শৈশব, প্রথম শাড়ি পরা কৈশোরকে দ্যাখে। দ্যাখে,
যৌবনের সমুদ্র থেকে প্রফুল্ল নগ্নতায় জলবিন্দু এবং
ফেনা নিয়ে উঠে আসছিলে আফ্রোদিতির মতো।
এখন সে যখন তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে
নিবিড় ভালোবাসায়, তখন তার আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে
তোমার শৈশব, কৈশোর আর থরথর পরথম যৈবন। সে ভাবে,
তার আগে কেউ তোমাকে প্রকৃত চুম্বন করেনি।
আজ তোমার জন্মদিন ফিরে এসেছে আরো একবার নিভৃতে
বিকশিত গোলাপের ঘ্রাণ হয়ে, দোয়েলের
গান হয়ে, জ্যোৎস্না স্নাত নদীর ঢেউয়ের নাও হয়ে। এসেই বাসন্তী ভোরে
কবিকে জড়িয়ে ধরল দু’হাতে। বুকে তুলে নিলো
তার কবিতার খাতা, উদ্ভিন্ন আবেগে
মুখ চুম্বন করল তার বহুকালের লেখনীর
তারপর কী মনে হলো, তোমার জন্মদিন
বলল কবিকে, ‘তোমার এই কবিতার খাতাটা
দেবে আমাকে? দুই মলাটের অন্তর্গত এই’ পাতাগুলি
সুখে আআম্র রাখবে। কবি মৃদু হেসে অক্ষরবৃত্তকে
ঈষৎ পাল্টিয়ে উচ্চারণ করে, এই খাতার আরশি নগরেই
বসত করো তুমি। তোমার অবয়বের সৌন্দর্য, তোমার
জন্মলগ্ন থেকেই। তোমার জন্মদিন জলকন্যা হ’য়ে
সাঁতরাতে থাকে কবির মানস সরোবরে।
উচ্ছৃত জলকণাসমূহ রূপান্তরিত কবিতার পংক্তিমালায়। সত্যি বলতে কী,
এই খাতা তোমাকেই অর্পণ করেছি, কবি বলে উদ্দীপ্ত স্বরে,
এর ওপর অধিকার তোমার চেয়ে বেশি আর কার?
তোমার জন্মদিন তাকে এত সঙ্গ দিচ্ছে ভেবে
কবি বিস্ময়ের মধ্যপথে থেকে দেখল,
তোমার জন্মদিন এক ঝাঁক প্রজাপতি নিয়ে
মেতে আছে খেলায়, কয়েকটি পায়রা আর বনদোয়েল
ঘিরে ধরেছে ওকে আদরের প্রত্যাশায়। তোমার জন্মদিনকে
কবি খুব কাছে টেনে নিয়ে জানায় অভিবাদন।
তুমি, হে সুপ্রিয়ার জন্মদিন, কবির কণ্ঠস্বর স্তব্ধতাকে বাঙ্ময় করে,
বার বার ফিরে আসবে। আমি যখন সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে
বিদায় নেবো, তখনও তোমার সত্তায় আলোচ্ছটায়
উদ্ভাসিত হবে গাছের পত্রালি; তোমার দৃষ্টির স্পর্শে
জেগে উঠবে শূন্য, নিদ্রিত পথ। তুমি প্রতিবার
এসে দাঁড়াবে এক চিলতে বারান্দায়, হাত রাখবে সেই
জানলার গ্রিলে, যেখানে একজন দৃষ্টিকাতর কবি
খুব কষ্ট করে দেখতে চাইতো শহুরে,
কৃপণ নৈসর্গিক শোভা।
তোমার জন্মদিনের তীরে বয়সী কবি
বাঁধল তার ভাঙা নৌকো। তোমার জন্মদিন চতুর্দিকে
আনন্দের রেণু ছড়াতে ছড়াতে তার রাঙা চরণ
রাখল সিএ নায়ে। আয়ত দু’টি চোখ মেলে
বলল, ‘ও রঙিলা নায়ের মাঝি, ভাসাও তোমার নাও
অকুল দরিয়ায়। একবারও ভেবে দেখল না, আকাশময়
ঘোর আন্ধার নেমে আসতে পারে,
তলিয়ে যেতে পারে ভগ্ন তরী। অনুপ্রাণিত নাইয়া তোমার
জন্মদিনের অপরূপ সৌন্দর্যে লীন হ’য়ে অপটু
দু’হাতে বাইতে লাগল বৈঠা।
কখন যে ওরা পৌঁছে গেল অভিনব সুবর্ণ রেখার তীরে
আসমানে গোধূলি ছড়িয়ে পড়ার আগে, বুঝতেই পারল না।
তোমার জন্মদিন আর সেই সাদা চুলের নাইয়া
পারুল বিছানো মাটিতে নেমে
পুঁতে দিলো একটি নিশান। উদ্দাম হাওয়ায় পত পত উড়তে
শুরু করে পতাকা, যাতে নক্ষত্রের হরফে লেখা ‘ভালোবাসা চিরঞ্জীব।
৪/৩/৯৫
দেয়াল আমাকে বলে
দেয়াল আমাকে খুব শান্ত স্বরে বলে নানা কথা;
কিছু তার বুঝি সোজাসুজি, কিছু বা বুঝি না। তবু
কান পেতে থাকি যতক্ষণ পারি, দিই মনোযোগ,
পাছে কোনো গূঢ় কথা শ্রুতির ওপারে চলে যায়
উপেক্ষিত অতিথির মতো। দেয়াল শোনায় এক
বালকের বিষাদ কাহিনী, যে হাওয়ায় কথকের
মুদ্রা এঁকে দূর দিগন্তের কোলে মেঘে মেঘে নেচে
বেড়াবার সাধ মনে জ্বালিয়ে রাখতো অগোচরে।
মাঝে মাঝে দেয়ালের কণ্ঠস্বরে ভাসে অতিদূর
নবীন যুবক এক, যার শরীরে দেবতা কিছু
বুলিয়েছে হাত স্নেহ ভরে; সে যুবক কী সহজে
কখনো প্রবেশ করে নীল পদ্মে, কখনো দোয়েল
তার খুব কাছে এসে দেখায় গলার ক্ষত, যেন
শুশ্রূষা প্রার্থনা করে। সেই সদ্য যুবা মধ্যরাতে
অকস্মাৎ জেগে উঠে অদেখা নারীর ধ্যান করে,
রাত জেগে স্থাপত্য গড়ে তোলে নিরিবিলি
খাতার কুমারী পাতা জুড়ে। কখন যে সে যুবক
নেপথ্যে স্বপ্নের কাচ-গুঁড়ো নিয়ে খেলা তার ভোলে,
রাখে না খেয়াল কোনো যেমন বনের পাখি আর
প্রস্ফুটিত ফুল কারো তারিফের মুখাপেক্ষী নয়।
দেয়াল হাজির করে আমার সম্মুখে একজন
প্রৌঢ়কে, জীবন যাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে
চেয়েছে নোওয়াতে খুব ঠেলে নিয়ে বার্ধক্য সীমায়,
অথচ সে, প্রায় বুড়ো, উঁচু রেখে জেদী মাথা হেঁটে
যায় তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে সত্তায় কথা বলে
রহস্যের আঁধারের সঙ্গে, ভালোবাসে কী গভীর।
দেয়াল দেখায় তাকে বহুকাল পরে অনুপমা
গৌরীকে, যে স্নান সেরে সরোবরে উঠে আসে ঘাটে;
প্রায়-বুড়ো লোকটা তাকেই পেতে এতকাল শুধু
হেঁটেছে অধীর প্রতীক্ষায় প্লাটফর্মে দীর্ঘ পুড়ে পুড়ে।
নিউইয়র্ক, ২১ সেপ্টেম্বর ৯৫
দোষী
চাই না করুণা ক’রে তাকিয়ে থাকুক লোকজন
কখনো আমার দিকে। আমি কারো কৃপাপ্রার্থী নই,
ছিলাম না কোনদিন। মাথা নত করা, হাঁটু মুড়ে
বসা কোনো প্রতাপশালীর দরবারে অনাগ্রহী।
কবি আমি; শব্দ গড়ি, শব্দ ভাঙি, চিত্রকল্প খুঁজি
অথবা নির্মাণ করি গোলাপ এবং প্রিয়তমা
রমণীর মুখের আদলে, ভগ্নস্বাস্থ্য, ক্ষীণ দৃষ্টি
নিয়ে দিনরাত মেতে থাকি দীপ্র নিজস্ব সৃষ্টিতে।
কেউ কেউ নিদ্রূপের বাণে বিদ্ধ করে, কারো কারো
চক্ষুশূল হ’য়ে আছি দীর্ঘকাল। আমাকে নাকাল
করার ফিকিরে ঘোরে সর্বক্ষণ কিছু লোক, যদিও জানিনা
কী আমার অপরাধ। যদি সত্য-সুন্দরের ধ্যানে
মগ্ন থাকা, নারীর হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া কসুরের
খাতায় চিহ্নিত হয়, তাহ’লে অবশ্য দোষী আমি।
২৫/২/৯৫
নৈবেদ্য সাজাই
মাঝে মাঝে যাই, দেশ ছেড়ে বহুদূরে চলে যাই
আমন্ত্রণে, আমিতো আনাড়ি
পর্যটক, পথ হারানোর ভয় বাদুড়ের মতো
ঝুলে থাকে সর্বক্ষণ। পদপ্রদর্শক ছাড়া কোথাও বেরুনো
অসম্ভব। কোন্ দিকে যাবো?
নিরাপদ আশ্রয় কোথায়, ভেবে মরি।
তবুও বেরিয়ে পড়ি, ভূদৃশ্য দেখার লোভে? নতুনের স্বাদ
চেখে নিতে? বিচিত্র খাদ্যের আকর্ষণে? এই সব
কখনো করি না অস্বীকার। তবু সবচেয়ে বেশি
মানুষেরই টানে উড়ি, ঘুরি দেশ-দেশান্তরে।
ভিন্ন মুখ, নানা বর্ণ, ভিন্ন ভাষা নানা দেশে, একটু আধটু
বুঝি, সিংহভাগ অজানার
অন্ধকারে ডুবে থাকে। কিছু বা ইঙ্গিতে
বুঝে নিই। যখন বিকেলে একজন শ্বেতাঙ্গিনী
একটি শিশুর হাত ধ’রে হেঁটে যায় পথে,
চকিতে আমার মনে পড়ে জোবেদার কথা। কখনো বা
সাবওয়ে জুড়ে বয় বাউলের সুর। ট্রেন থেকে
বিদেশিনী নয়, যেন আমার দয়িতা নেমে পড়ে।
বহু মানুষের কদাকার মুখ আমি দেখেছি প্রত্যহ। কতবার
কতজন মানুষেই ঘরে দিয়েছে আগুন দ্বিধাহীন; হিংসা
উলঙ্গ উন্মাদ হয়ে নেচে বেড়িয়েছে
দ্বিগ্ধিদিক নাগা সন্ন্যাসীর মতো। কি ব্যাপক বোমার আঘাতে
বহু লোকালয়, হায়, হয়েছে শ্মশান। তবু আমি
নিত্যদিন মানুষেরই দিএক বাড়াই দু’হাত
কথা বলি, আলিঙ্গনে বাঁধি, বারবার প্রতারিত,
উৎপীড়িত হয়েও সমুদ্র তীরে, উন্মুক্ত প্রান্তরে
অথবা ড্রইংরুমে মেলামেশা করি, আমার আপনকার স্বপ্ন
উচ্চারণ করি অনুরাগে। অচেনাকে ভালোবাসি।
কতবার স্বপ্নভঙ্গ হলো, ইতিহাস রুদ্ররোষে
কখনো কখনো দেয় সাজা; কত না নকল রাজা দিনরাত
অগণিত মানুষের সঙ্গে আঁধারে খেলেছে পাশা
এবং করেছে প্রতারণা। কত মতাদর্শ বিভ্রান্তির ঝড়ে
সুপ্রাচীন হাবেলির মতো ধুলায় লুটায়। কিন্তু আমি
মানবতন্ত্রের পায়ে অকম্পিত সাধনার নৈবেদ্য সাজাই।
নিউইয়র্ক, ১৩ আগস্ট ৯৫
পরাগের মূর্তি
একটু আগেও মগজের সীমানায় কিছুই তো
ছিল না বস্তুত জমা, এমনকি কুয়াশা অথবা
তুলোর রোঁয়ার মতো ভেসে বেড়ায়নি কোনো কিছু।
অকস্মাৎ কী যে হয়; বলা নেই কওয়া নেই, কার
পদপাত চেতনায় আলোড়ন তোলে অন্ধকারে,
বিশীর্ণ নিষ্পত্র ডালে জন্মায় গুল্মের থলোথলো।
যে হরিণ স্বপ্নে দিয়েছিল দেখা জ্যোৎস্নারাতে, তার
দুটি চোখ কথা বলে রাধার ভাষায়, যেন আমি
বৃন্দাবনে কাজল দিঘির ধারে বাঁশি হাতে একা
বসে আছি, এখনই জাগবে সুর চারদিকে ফুঁয়ে
ফুঁয়ে; পরমুহূর্তেই ট্রাউজার আর চেক শার্ট
পরা-আমি কবিতা আবৃত্তি করি পানমত্ত ক্লাবে
ক্ল্যারিওনেটের তালে তালে। অনন্তর বাউলের
বেশে আমাকেই দেখা যায় গৈরিক প্রান্তরে নেচে
বেড়ানোর ভঙ্গিতে, আমার পাশে দেখি না কাউকে,
ডাঙায় নদীর ধ্বনি, আসমানে তারার বৈভব।
চেয়ে দেখি অগ্নিবর্ণ এক বাঘ আমার স্বপ্নের
হরিণের গ্রীবা ছিঁড়ে ফেলে জঙ্গলে মিলিয়ে যায়
নীল কুয়াশায়, আমি ফেলে-আসা পুরানো বাড়ির
পাশ দিয়ে একা হেঁটে চলে যাই, যেন সে নিবাস
ছিল না সেখানে কোনোদিন। যে আমার কবিতার
জীবন সম্প্রতি, তার পদধ্বনি জাগে বৃষ্টির শব্দের
অন্তরালে, আমি তার দিকে হাত বাড়াতেই দেখি
পরাগের অসামান্য মূর্তি এক সমুখে দাঁড়ানো।
১০/৪/৯৫
প্রত্যাহারের পালা
সে এক ভ্রামণিক, অনেক পথের স্মৃতি তাকে
কখনো আনন্দিত, কখনো বা
বিষণ্ন, উদাসীন ক’রে তোলে। একদিন সে আখেরে এসে
পৌছলো এক প্রান্তরে। এমন ধূসর জায়গা অন্তর্গত নয়
তার অভিজ্ঞতায়। উপরে তাকিয়ে দ্যাখে,
খরা-দীর্ণ জমিনের মতো আসমান, পায়ের তলায়
অসমান রুক্ষ মাটি আর তখুনি নিজেকে
লোলচর্ম বৃদ্ধের প্রতিনিধি ব’লে শনাক্ত করলো।
কে যেন খুব কাছে থেকে নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
তোমার রসনা, যা বহুকাল আস্বাদন করেছে
চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়, এখন থেকে বঞ্চিত হবে স্বাদ থেকে।
তোমার দু’টি চোখ, যারা এতকাল দেখেছে আকাশের
তারা, নদীর খরস্রোত, বনরাজি নীলা, পাখির উড়াল,
নারীর সৌন্দর্য, এখন থেকে
হারিয়ে ফেলবে জ্যোতি। তোমার নিকট থেকে
প্রত্যাহার করা হলো রতিক্রিয়ার
আনন্দানুভূতি; ভ্রামণিক প্রত্যাহারের
প্রতিটি তীরের যন্ত্রণা সহ্য করলো মুখ বুঁজে।
যখন সেই নির্বিকার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
এখন প্রত্যাহার করা হবে
তোমার ভালোবাসবার ক্ষমতা,
সেই মুহূর্তে প্রতিবাদে ফেটে পড়লো
বুড়োসুড়ো ভ্রামণিক, ‘না, তা আমি মেনে নেবো না।
নারী, নিসর্গ, সারা বিশ্বের মানুষের প্রতি
আমার নিবিড় ভালোবাসার ক্ষমতা
কাউকেই কেড়ে নিতে দেবো না। ব’লে দিচ্ছি, কিছুতেই না।
১৬/৩/৯৫
প্রবাসে একটি সকাল
চকচকে দিনারের মতো ভোরবেলা ঝলসাচ্ছে
চতুর্দিকে, প্রতিবেশী স্বাস্থ্যবান প্রৌঢ় মেতেছেন
জগিং এ প্রত্যুষ থেকে। সবেমাত্র আমি এক পাতা
ডায়েরি লিখেছি আর খেয়েছি পরিজ,দুটো টোস্ট
আস্তে সুস্থে। আবার নতুন ক’রে পড়ি মুগ্ধাবেশে
ইয়েটস্-এর পংক্তিমালা, সধূম চায়ের বাটি কাছে
রাখা আছে, সানন্দ চুমুক দিই মাঝে মাঝে আর
দূরগামী মেঘ দেখি কখনো কখনো, ধীরে বয়
আমার সময়; কাল বারোটায় চক্ষু চিকিৎসক
দেখবেন আমাকে, কৌশিক সঙ্গে যাবে। এরই মধ্যে
বাংলাদেশ কী ব্যাকুল করে টেলিফোন। কণ্ঠস্বরে
তার মমতার রেণু ঝরে, বসে থাকি একা-একা
ঠাণ্ডা ঘরে। স্বপ্নের ভগ্নাংশগুলো জড়ো করি শুধু
ধু-ধু প্রতিবেশ থেকে। তোমার অনুপস্থিতি আজ
কালো গোলাপের মতো তীব্র ফুটে আছে সত্তা জুড়ে;
দেহমন হলো কালি, হাড় থেকে ওঠে কালো ধোঁয়া!
১৫/৮/৯৫
বদলাতে থাকে
ত্রয়ী কথাশিল্পী রশীদ করীম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার বন্ধুতা দীর্ঘকালের, অথচ
তাঁরা উপন্যাস দেখার সময় মূল কাহিনী একটু-আধটু ক’রে
বদলে ফেলেন কিনা, এতদিনেও তাঁদের জিগ্যেস করা হয়নি।
কত কথাইতো হয় আমাদের, হয়তো
এই কথাটি ঢাকা প’ড়ে থাকবে অনেক কথার আড়ালে। তবু
অনুমান করি, তারা সম্ভবত লিখতে লিখতে ভাবেন,
ভাবতে ভাবতে লেখেন আর বদলে ফেলেন অনেক কিছু।
জীবন সব সময় একই রকম থাকে না,
আমাদের সবারই জীবন কমবেশি, কারো অতি শ্লথ কারো খুব দ্রুত,
বদলাতে থাকে। কখনো কখনো টের পাওয়াই ভার।
তোমরা আমার দিকেই তাকাতে পারো, তোমরা যারা
আমার বিষয়ে অল্প বিস্তর জানো(সবটুকু কে-ই বা জানতে পারে?)
তারা বলতে পারবে কী রকম বদলে গিয়েছি আমি। আমার
শারীরিক ভূগোলের পরিবর্তন এত বেশি
দৃষ্টিগোচর যে, অনেকেই কেমন নজরে তাকায়, যেন ওরা কোনো
কাকতাড়ুয়া দেখছে! আমার যৌবনের জামা কাপড়
এখন আমার গায়ে লাগবে না, হবেনা মানানসই।
বহুকাল আমি খোলামকুচি আর কাচের টুকরো নিয়ে
খেলায় মেতে থেকেছি, এই তো কিছুদিন আগে
এই আশ্চর্য মণিরত্ন দেখা দিয়েছে আমার চলার পথে আর
আমার জীবন বদলে গ্যাছে সম্পূর্ণভাবে। আমার মধ্যে
ভালোবাসার সেই দ্যুতি ঝিকিয়ে উঠেছে যা,’ মানবতার অনুপম
ঐশ্বর্যের সন্ধান দেয়, ঝর্ণাতলার নুড়িকে নক্ষত্রে
রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ধরে। আজ সহজেই বিশ্বের
সর্বকালের মহাকবিদের আসর ব’সে যায়
আমার দহলিজে। কেউ কেউ আমাকে লক্ষ করেন ঈষৎ কৌতূহলে,
কেউ কেউ আমার কবিতার খাতা নিয়ে খানিক
নাড়াচাড়া ক’রে রেখে দেন টেবিলে। কেউ হেসে
দেখিয়ে দেন ক্রটিগুলো।
একজন শ্বেত শ্মশ্রুমন্ডিত অমিতকান্তি কবি
আমাকে একধারে এনে
চুপিসারে বলেন, “তোমার কাব্যভাষায় সেই স্পর্শ আনতে
চেষ্টাশীল হও যা’ সমকালীন বাংলা কবিতায় গরহাজির।“
“কী ক’রে আনবো? আমি কি পারবো, হে কবিগুরু?”
আমি প্রশ্ন দু’টি শেষ করতে না করতেই মহাকবিদের আসর
মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। আমি বদলে যাওয়ার প্রত্যাশায়,
প্রতীক্ষায় কম্পমান কোনো বয়স্ক মৎস্য শিকারীর মতো।
নিউইয়র্ক, ৩/১০/৯৫
ব্রাইটন বীচে
জুতোয় পালিশ আছে কি নেই, শার্টের কলারের
ভাঁজ খুঁতময় নাকি চুল এলোমেলো
এ নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ ছিল না মোটেই
ব্রুকলীন ব্রাইটন বীচের সুউচ্চ সাততলা
অ্যাপার্টমেন্টের বড় জানালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
এ কী? এ কী? সমুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ে বুঝি
ঘরের ভেতর খল খল হেসে।
একটি কি দু’টি গাংচিল বেড়ায় ভেসে ঢেউ ছুঁয়ে,
কখনো বা জানালার কাচ প্রায় ছোঁয়
অবারিত ডানার উল্লাসে।
মাঝে-মাঝে কয়েকটি গাংচিল পোহায়
রোদ সুখে নিরিবিলি ব্রাইটন বীচের বালিতে।
জানালার কাছে ব’সে দূর থেকে দেখি
ফেনিল সমুদ্রতটে টপলেস স্নানার্থিনী ঘোরে,
কেউ গা ভাসায় নীল জলে। অকস্মাৎ
মনে হয়, মলুয়া সুন্দরী আর বেহুলা সাগরে নামে আর
আফ্রোদিতি সমস্ত শরীরময় সাদা ফেনা নিয়ে
ব্রাইটন বীচে উঠে আসে।
পরমুহূর্তেই দেখি, ওরা কেউ নয়, প্রিয়তমা শুধু তুমি
কী সুন্দর রয়েছ দাঁড়িয়ে আর শরীর ছড়াচ্ছে বিন্দু বিন্দু মুক্তো-জল।
নিউইয়র্ক, ৮ অক্টোবর ৯৫
ভূমিদাস
মধ্যরাতে অকস্মাৎ একজন বীর, দীর্ঘকায়,
বর্মাবৃত, দুধসাদা ঘোড়ায় সওয়ার,
মহাকাব্য থেকে নেমে আসে
শহরে প্রধান সড়কে।
তার শিরস্ত্রাণের আড়ালে
দু’টি চোখ যেন
খাঁচাবন্দী পাখি;
প্রায় ফাঁকা পথ,কয়েকটি লোক ঘুমন্ত রাস্তায়।
কী স্বপ্ন দেখছে ওরা? হাওয়া ব’য়ে যায় নিরিবিলি
ওদের ওপর, কেউ অবছা শব্দ করে স্বচ্ছ ঘুমের ভেতর,
বর্মাবৃত বীর সূর্যোদয় আনে বর্শার ডগায়;
তাকে দেখে বহু লোক পথে জড়ো হয়।
কে সে, কে সে, কে সে-
এই প্রশ্ন প্রত্যেকের চোখে পরিস্ফুট।
কেউ কেউ কিছুটা সমুখে গিয়ে পিছু হ’টে আসে
অজানার ঘ্রাণ পেয়ে। লোকদের
আচরণ দেখে বর্মাবৃত বীরটির
ঠোঁটে কৌতুকের হাসি খেলে যায়; হায়, এরাই কি
অন্ধকার চিরে জ্যোতির্ময় দ্বীপরেখা এঁকেছিল?
স্বেচ্ছায় হারাবে ওরা আত্মদানে লব্ধ রত্নদ্বীপ?
মহাকাব্য থেকে নেমে-আসা বীর টগবগে ঘোড়া
ছুটিয়ে অনেক দূরে পৌঁছে যায় নদীর কিনারে,
ফিরে আসে শস্য থই থই মাঠে, দ্যাখে
কারা বুকে নিবিড় জড়িয়ে ধানচারা
নতুন স্বপ্নের টানে নীলিমাকে ছোঁয়;
যৌবনের গানে নাচে তালে তালে স্বর্ণপ্রসূ মাটির ওপর
সুন্দর স্পর্ধায়; ফসলের প্রভু ওরা,
অথচ নিরন্ন ভূমিদাস।
১/৮/৯৫
যখন টেলিফোনে তুমি
নিউইয়র্কের উডসাইডে এক তেতলা অ্যাপার্টমেন্টে
ভোরবেলা এলো তোমার টেলিফোন। হাজার হাজার মাইল
উজিয়ে-আসা তোমার কণ্ঠস্বর
মর্মমূলে পৌঁছতেই আমার চিত্ত ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর
সেতারের বসন্ত বাহার। তোমার কণ্ঠস্বর আমাকে
চুম্বন করার সঙ্গে সঙ্গেই
বিশ্বের সকল রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয়
আমার একচ্ছত্র অধিকার,
জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্রদূত
আমাকে কুর্ণিশ করেন এক সারিতে দাঁড়িয়ে।
টেলিফোনে তোমার উচ্চারিত কথামালা
সাঁতার কাটছিল জলকন্যাদের ধরনে আর তক্ষুণি
ভ্রাম্যমাণ দরবেশ শামস্-আল তাবরেজ
তাঁর মরমী উষ্ণীষ অর্পণ করলেন আমাকে, লালন শাহ
আমার হাতে তুলে দিলেন তাঁর নিজস্ব দোতারা
এবং দুনিয়ার তাবৎ প্রধান কবি
আমাকে পাঠালেন রাশি রাশি পুষ্পস্তবক।
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কীটস, ইয়েটস, রিল্কে এলুয়ার আর
নেরুদার পঙ্ক্তিমালা আমাকে ঘিরে
এক অপরূপ ব্যালে রচনা করে, যখন
তোমার কথা পুষ্পিত হতে থাকে টেলিফোনে।
যখন তোমার টেলিফোন আসে কোনো রূপসী
স্নানার্থিনীর মতো সরোবর-তীরে আলতো পা ফেলে,
যেন ব্যালোরিনা, তখন সকল যুদ্ধবাজ
রাষ্ট্রের সমর নায়কেরা সই করে শান্তির দলিলে,
তখন সকল সন্ত্রাসের নির্দয় বেলেল্লাপনা,
বুলেটের বেহায়া রকবাজি নিভে যায় এক ফুৎকারে, তখন
নিদারুণ অপুষ্টিজনিত জীবন্ত সকল শিশু-কংকাল
হয়ে ওঠে জ্বলজ্বলে স্বাস্থ্যবান, অন্ধজন ফিরে পায় আলো,
তখন হাসপাতালসমূহে সকল অসুস্থজন আরোগ্য লাভ করেন, তখন
হায়নাগুলো হরিণ হয়ে বিচরণ করে হরিৎ শোভায়।
তখন ধর্মান্ধদের হিংস্র উন্মত্ততা পোকামাকড়ের উঠরে যায়,
প্রতিক্রিয়াশীলদের অমাবস্যা রাতের ষড়যন্ত্র থাকে মুলতবি।
হে আমার হৃদয় নন্দনবনচারিণী, টেলিফোনে
তোমার কণ্ঠস্বর নিয়ে আসে বাংলার হৃদয়ের ধ্বনি।
কখনো কখনো মুহূর্তের জন্যে মনে হয়, কে তুমি?
কে তুমি আমার চেতনায় বইয়ে দিচ্ছ অমিয়ধারা?
তুমি কি স্বর্গীয় কোনো পাখি, যার কণ্ঠসুর
আমি ছাড়া অন্য কেউ শোনেনি কখনো
এই চরাচরে? যখন তুমি আমার উপস্থিতির
বহুদূরের ওপার থেকে কথা বলো, নীরবতা
আমাকে জাপটে ধরে, কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে আমার।
আমার নিভৃততম ভেতরে জালালউদ্দিন রুমি
হয়ে উঠতে চান দুর্বার কথক।
নিউইয়র্ক, ১১ অক্টোবর ৯৫
যে বাগান
যে-বাগান আমরা দু’জন অনুরাগে দিনরাত
অনুপম শিল্পের মতোই
গড়েছি বৃষ্টিতে ভিজে, রৌদ্রে পুড়ে, যেখানে ফুটছে
নিত্যদিন অজস্র রঙিন ফুল সৌরভে, গৌরবে
ঈর্ষনীয়, সেখানে কি আজ
আগাছার ভিড়? কোন দূষিত হাওয়ার
স্বেচ্ছাচারে শুধু
রিক্ত শাখাগুলি গুরুতর
রোগীর বিশীর্ণ কালো আঙুলের মতো কম্পমান? কোনো পাখি
সহজে আসে না আর এ বাগানে ভুলেও কখনো,
গায় না মধুর কোনো গান। কোন্ ভ্রম আমাদের
দু’জনের সৃষ্টিকে করেছে নষ্ট হঠাৎ অকালে?
জালালউদ্দিন রুমি যে-বাগান নিয়ে ভেবেছেন সুগভীর
করেছি সন্ধান তার এখানে সেখানে, তবু পেলাম কোথায়?
আমার অঙ্গনে যদি না শুনি তোমার পদধ্বনি,
তোমার মধুর কণ্ঠস্বর যদি কানে
ঢেউ না জাগায়, যদি ছিন্ন হয় সব যোগাযোগ
তাহলে আমার এই কবিতা লেখার
কী অর্থ দাঁড়ায়?
তোমার নীরব ওষ্ঠে যদি আমার উদ্দেশে ‘ভালোবাসি’ শব্দ
বারবার উচ্চারিত না হয়, এবং
আমাদের দু’জনের গড়া বাগানের শোভা যদি
পোকার উদরে কিংবা ধুলায় বিলীন হয়, তবে
আমার এ বেঁচে থাকবার, বলো, তাৎপর্য কোথায়?
ফ্লোরিডা ২৭ সেপ্টেম্বর ৯৫
শব্দের আকাঙ্ক্ষা
শব্দের আকাঙ্ক্ষা সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্তের সীমা
নিমেষে পেরিয়ে যায়, বস্তুত শব্দের
বাসনা অপরিসীর। শব্দ
আকাশ এবং সমুদ্রের
নীল হ’তে চায়, হতে চায়
রঙিন পাখির নীড়, কৃষকের বিনীত কুটির
কামিনীর চোখ। শব্দ হ’তে চায় বাঘ
এবং হরির্ণ, সৌরলোক।
শব্দ হ’তে চায় বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক আর
কোরান শরিফ।
শব্দ হতে চায় ‘মেঘদূত’, ‘হ্যামলেট,’ ‘ম্যাকবেথ’
মহাকবি দান্তের নরক,
মিল্টনের স্বর্গ-মর্ত্য, রুমির অম্লান মসনবি।
শব্দ হতে চায়
দেশপ্রেমী মানুষের প্রতিটি
মহান নেতার নেরুদার কল্লোলিত
কবিতার মতো দীপ্র ব্যাপক আহবান।
শব্দ হতে চায়
রাধিকা, লায়লা, শিঁরি, বেহুলা এবং
আমার আপন দয়িতার কতো মধুর বচন।
নিউইয়র্ক, ১৪ সেপ্টেম্বর ৯৫
সন্ধানের পরেও
বহু চেষ্টা, বহু অনুসন্ধানের পরেও মানুষ
কোথাও পায় না খুঁজে অভীষ্ট জিনিশ
কখনো কখনো। খরতাপে
পুড়ছে চৌদিক, দুপুরের বুক ছিঁড়ে ক্রমাগত
ডেকে যায় পিপাসার্ত কাক।
গরু, মোষ অসহায় তাকায় রক্তিম চোখে এদিক ওদিক
জলহীনতায়,
মানুষের বুক জুড়ে ধূ ধূ হাহাকার,
অথচ কাছেই রয় স্নিগ্ধ জলধারা অবিরাম,
তালাশের পরেও পায় না খোঁজ পশু-পাখি এবং মানুষ।
শহরে শহরে বোমা ফাটে, অস্ত্র নাচে, রক্ত ছোটে
শহরে শহরে আততায়ীর মোচ্ছব, মানবতা
খুন হয় প্রহরে প্রহরে
ধর্মান্ধ খাঁড়ার কোপে। মৌলানা রুমির
কবিতার চোখ
জলে ভাসে যূথচারী বক ধার্মিকের আস্ফালনে।
রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে, উত্তর দক্ষিণে
পূর্ব ও পশ্চিমে,
ঘর পোড়ে হিংসার আগুনে
শান্তির পাড়ায়, নারী আর শিশু কাঁদছে নিয়ত।
বর্বরের অট্রহাসি ম্লান করে দেয় প্রতিদিন
জ্ঞানীদের মুখ।
বহু চেষ্টা, বহু অনুসন্ধানের পরেও মানুষ
পায় না সে বাগানের খোঁজ,
যেখানে গোলাপ
চকিতে প্রেমের পদাবলী হ’য়ে যায়,
ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতি ওড়ে,
শিশুরা কোমল হাত ধরাধরি ক’রে নাচে, প্রেমিক প্রেমিকা
জ্যোৎস্নারাতে অলৌকিক, কথোপকথনে মেতে ওঠে,
আহত কবির বুকে প্রলেপ বুলায় পুষ্পঘ্রাণ।
৭/৫/৯৫
সৃজনে উন্মুখর
এই তো বিষাদ ভোরবেলা হেঁটে গেল একাকিনী
সুষময়; রাখাল আসেনি আজ এই খোলা পথে
ভুল ক’রে ফেলে রেখে বটমূলে বাঁশি তার। নেই
অন্য কেউ এ মুহূর্তে উদাস গলিতে। দোতলার
ছোট ঘর থেকে একজন অসুস্থ মানুষ দ্যাখে
আকাশ, গোলাপ, কাক, শালিকের নাচ, ভেজা গাছ।
লোকটা নিভৃতে ব’সে ছবি দ্যাখে, ছবি আঁকে আর
মাঝে-মাঝে আঁক কষে হিজিবিজি কী জানি কিসের
ঘোরে, ফের মুছে ফ্যালে। নীরবে তাকায় ছবিটির
নৈর্ব্যক্তিক ভগ্নাংশের দিকে। ভাবে, সে, শৈশব তার
কেটেছে পাখির ডিম সংগ্রহের বাসনায় আর হারিকেন
জ্বেলে নামতার নূপুরের তালে দিব্যি দুলে দুলে।
কৈশোরে লোকটা জেনেছিল ক্রমে পাটীগণিতের
উজ্জ্বল যাদব চক্রবর্তী নন তত ভীতিপ্রদ,
যত তাঁর হাত ধ’রে ঘুর সিঁড়ি ভাঙার সময়
মনে হয়। শুধু অভিনিবেশের কেন্দ্রে ঈগলের
চোখ রাখলেই বেশ দীক্ষা মিলে যায়। লোকটার
হিশেবের খাতা তবু প্রমাদের কাঁটার মাদুর।
লোকটা অসুস্থ বড়, বিশেষ চেয়ারে একজন
বিজ্ঞানের প্রভু লগ্ন সারাক্ষণ ঘাতক পীড়ায়,
যিনি শুদ্ধ গণিতের দেয়ালি জ্বালিয়ে সময়ের
ইতিহাসে জাগান নতুন শিহরণ। গণিতের
কিরণে নির্মম ব্যাধি স্বৈরাচার ভুলে থাকে;
আজো তিনি ক্রীড়াশীল মোহনীয় সংখ্যার খেলায়।
বিশ্বময় সংখ্যাগুলো হীরের কুচির মতো নাচে
প্রতীকের রূপ ধ’রে। এ গ্রহ ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে
সাইবারনোটিকস্ তত্ত্বের স্ফুরণে; সে লোকটা
কেমন বিস্ময়ে দ্যাখে বিবাগী কবির মানসীও
তীক্ষ্ম নাক, আয়ত চোখের নম্র বিভাবরী নিয়ে
পরিস্ফুট গণিতের ঔরসের মোহন আভায়।
লোকটা নিমগ্ন সুন্দরের ধ্যানে, ভেসে ওঠে তার
দু’চোখে, সুদূর নীলিমার বীথিকায় পরস্পর
হাত ধ’রে নাচে অবিরত সঙ্গীত, কবিতা আর
বিশুদ্ধ গণিত, শোনে গোলাপ বলছে মৃদু স্বরে
‘আমিই গণিত আর গণিতই গোলাপ গূঢ় এক
ঝলসিত তরঙ্গের ভেতরে সৃজনে উন্মুখর!
২৮/৬/৯৫
সে এক কিশোরী
একজন কিশোরীকে চিনি যার চুল খাটো,
ঠোঁটে খেলা করে মধুর হাসি; মুখে সৌন্দর্যের আভা।
প্রজাপতির মতো সে ঘুরে বেড়ায়
এ-ঘর থেকে ও-ঘর। ওকে দেখলেই
মমতার ঢেউ জাগে মনে, ইচ্ছে হয়, ওর
মাথায় হাত রেখে কোনো কল্যাণময় বাণী উচ্চারণ করি।
বৃদ্ধি তার তীক্ষ্ম; পড়ার পাট চুকলেই
সেই কিশোরী প্রায় সেঁটে থাকে টিভি সেটে। আচার
খেতে খেতে দ্যাখে নানা অনুষ্ঠান। কবিতার প্রতি
তার কোনো টান নেই, অথচ তার ঘরে
চটকিলা গানের টেপ বাজে প্রত্যহ। কিশোরীর
অজান্তেই তার সত্তা ক্রমে ক্রমে
হাত বাড়াচ্ছে
যৌবনের বসন্ত বাহারের দিকে।
কয়েক মাস আগে কিশোরী মেতে উঠেছিল
ত্র্যাকুরিয়ামের মাছ নিয়ে। বালিকা বয়সে তার
শখ ছিল সারা দিনমান
খরগোশের সঙ্গে খেলা করবার এখন সে
খাঁচায় পোষে রঙ বেরঙের পাখি। পাখির খাঁচার পাশে
শুয়ে ব’সে সে চুপ ক’রে মুগ্ধাবেশে দ্যাখে
পাখিগুলোর রূপ, শোনে
ওদের ঐকতান। জানি না সে তার মায়ের মতো
ঘন ঘন আকাশ, বৃষ্টি জ্যোৎস্না দ্যাখে কিনা অথবা
নক্ষত্র চেনার উৎসাহ ওর কতটুকু।
এখন সে পাখিদের যত্নে বিভোর,
নিয়মিত খাবার দেয় ওদের। পাখিদের
ওড়া উড়ির সাধ মেটাবার জন্যে নীলাকাশকে
পুরে দিতে চায় খাঁচায়। যখন তখন সে
সস্নেহেহ তদারক করে পাখিদের, কথা বলে
ওদের সঙ্গে। কী কথা সেসব, কে জানে। কিশোরী কি ভাবে
কোনো নিষাদ আড়ালে লুকিয়ে আছে
পাখিদের বধ করার মতলবে? না কোনো শিকারী
খাঁচাবন্দী পাখি শিকার করে না। পাখি মারার লালসা ওরা
চরিতার্থ করে খালে বিলে, নদীতে, ঝিলে জঙ্গলে। তবে
অদৃশ্য অশুভ জীব তো থাকতে পারে ওঁৎ পেতে। কোনো
ভর সন্ধেবেলা কিশোরী যদি দ্যাখে খাঁচাময় পাখিদের
সব পালক ছেঁড়া, তছনছ, তাহলে তার সন্ত্রস্ত
বুকের ভেতরে বইবে কোন্ ঝড়?
১০/৭/৯৫
সে-রাতে তোমার চোখ
সে-রাতে তোমার চোখ আমাকে ভর্ৎসনা করেছিল
নীরবে, হয়নি কষ্ট বুঝে নিতে সে চোখের ভাষা।
কখনো কখনো খুব ভুল করে ফেলি। তিন দিন
তিন রাত্রি পরে তুমি এসেছিলে আমার নিবাসে।
তিনটি শতাব্দী বয়ে গেছে আমার উপর আর
আমি উপদ্রুত কয়েদির মতো মুক্তি-প্রত্যাশায়
পেয়েছি তোমার দেখা সে-রাতে হঠাৎ। প্রাণে ছিল
রঙিন ফোয়ারা, তুমি নিশ্চিত করেছ অনুভব।
সে-রাতে আমার করোটিতে ঘোড়ার পা ঠোকা ছিল
অবিরত, বুঝি তাই আমি অহেতুক সতর্কতা
মেনে নিয়ে করিনি তোমার মুখ চুম্বন, ধরিনি
ব্যাকুল বাড়ানো হাত। ফলত তোমার দু’টি চোখ
আমার ভীরুতা আবিষ্কার ক’রে ভর্ৎসনা-মুখর
হয়েছিল আআর আমি বিষাদে ছিলাম সারা রাত।
১২/৪/৯৫
সেন্ট্রাল পার্কে
ম্যানহ্যাটানের বুকের ভেতর জেগে-ওঠা নিসর্গ-ধনী
সেন্ট্রাল পার্কের কিছু মরা পাতা
আমার মোকাসিনের তলায় আর্তনাদ ক’রে ওঠে।
লেকের ধারে সবুজাভ কাঠের বেঞ্চিতে বসে। কয়েকটি
কবুতর ইতস্তত কী যেন খুঁটছে ঘাসে।
অদূরে গাছতলায় একজন যুবক
গলা ছেড়ে গান গাইছে গীটার বাজিয়ে।
আমার পাশ দিয়ে এক জোড়া তরুণ-তরুণী পরস্পর
হাত ধরে যাওয়ার সময় আড় চোখে
দেখে নেয় মামুনের কর্মলগ্ন ভিডিও ক্যামেরা।
শাদা, ধুলোটে মেঘগুলো ভেসে যায়
মানুষের প্রতি উদাসীন। হেনরি মুরের ভাস্কর্য
অমরতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথা বলে
এই নম্র রৌদ্র ছায়ায়
পড়ল তোমাকে মনে। যেভাবে তুমি
আমার পাশে বসতে কিংবা কিছুদূরে ব’সে
বলতে নানা কথা হাসির আভা ছড়িয়ে, তোমার
চোখের অতল চাওয়া আমাকে করতো আদর
এই সব এই মুহূর্তে সেন্ট্রাল পার্কে হলো উদ্ভাসিত।
লেকের প্রসন্ন কিনার আমাকে হঠাৎ
স্মরণ করিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে তুমি বলতে একটি ঝর্ণা আর
তার নুড়িগুলোর কথা, যেগুলো এখন
আমার হাতের তালুতে এক স্বপ্নপুরী হ’য়ে বাজে সেন্ট্রাল পার্কের
দুপুরে; তুমি জানলে না।
নিউইয়র্ক, ১৫ সেপ্টেম্বর ৯৫
স্বদেশে ফেরার পর
তিন মাস পর শ্যামলীর গলিতে ঢুকতেই
মনে হলো রাধাচূড়া গাছটা তরুণীর মতো হেসে উঠল
শরীর ঢেউ তুলে। গোলাপের নার্সারি জানালো অভিবাদন,
কয়েকটি গোলাপ লাফিয়ে আমার বুকে মাথা রাখতে চাইল
গভীর অনুরাগে। একটু এগোতেই আমার
বসতবাড়ির পেয়ারা গাছ স্বাগত ভঙ্গিতে
আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় হাত। ওর পাতাগুলো
আমাকে জড়িয়ে নেয় সংলাপে। পেয়ারা গাছ আর আমি
পরস্পর কথা-স্রোতে ভাসি, যেমন দুই কবি। আমার উদ্দেশে
অনাবিল আনন্দে হৃদয় খুলে ঘর-দুয়ার।
নিঃসঙ্গতার চোরাবালিতে ডুবতে-ডুবতে লক্ষ করি,
দোতলায় ওঠার সিঁড়িগুলো বহুদিন
অপেক্ষায় ছিল আমার। অধীর আগ্রহে একে-একে
ওরা সবাই আমার পদচুম্বন করে। কৃতজ্ঞচিত্তে ওদের দিকে
তাকাতে তাকাতে দেয়ালের ফটোগ্রাফগুলোর
আদর কুড়িয়ে, আপনজনের বিকশিত আনন্দে ডুব সাঁতার কেটে
প্রবেশ করি নিজের ঘরে, যেখানে অপেক্ষমান
আমার লেখার টেবিল, বুক শেলফ আর
পুরনো দিনের বিশ্বস্ত এক চেয়ার। কয়েকটি নতুন সোফা
আমাকে দ্যাখে উৎসুক দৃষ্টিতে আপন করে নেওয়ার
তীব্র ইচ্ছায়। আমি আমার কবিতার খাতার মুখ চুম্বন ক’রে
ওর অন্তরের ঘ্রাণ নিই বার বার।
আমার ভেতরের নিভৃততম সত্তা
কিছুক্ষণ কল্পনার নুড়ি কুড়ায়, এক পেয়ালা চা খেতে খেতে
বাইরের দিকে চোখ মেলে তাকায় আর ভাবে
যার প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে আমার স্মৃতি, স্বপ্ন, বর্তমান
এবং ভবিষ্যৎ ঢেউয়ের প্রদীপের মতো জ্বলে, দোলে
সে এখন তার অনুপস্থিতিকেই এখানে জাজ্বলমান করে রেখেছে।
১/১১/৯৫
হও নীলকণ্ঠ
বাইরে ভীষণ কোলাহল, অনেকের চড়া গলা
প্রজ্ঞার গভীর বাণী নিয়ত ছাপিয়ে ওঠে, কারো
কারো কিছু ইতর, অশ্লীল ভঙ্গি ভব্যতাকে করে
বিদ্রূপ; কলহপরায়ণ লোকগুলো অকারণ
ক্ষেপে ওঠে, তাড়া ক’রে বেড়ায় ধীমান ব্যক্তিদের
যখন তখন, পথে পথে ঘোরে দাঁতাল শুয়োর!
তুমি কি ভন্ডামি, ডাহা মিথ্যা, কপটতা, উচ্ছৃংখল
ধর্মান্ধ ভিড়ের কাছে স্বীকার করবে নতি? ম্লান
মুখে বসে থাকবে একা? ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ আর
প্রগতির নেতাদের পিঠটান দেখে হতাশায়
নিয়ত থাকবে ডুবে? তোমার চৌদিকে গজরাচ্ছে
বটে হিংস্র অন্ধকার, তবু নিজেকে আলোর ধ্যানে,
সত্য-সুন্দরের সাধনায় মগ্ন রাখো নিত্য হও
নীলকণ্ঠ ভালোবাসো, যাকে গাঢ় ভালবাসা যায়।
২০/৪/৯৫
হাসান হাফিজুর রহমানকে মনে রেখে
যখন হঠাৎ কোনোদিন তোমার স্বাক্ষরময়
কবিতার বই হাতে নিই, মন কেমন যে করে,
কী ক’রে জানাই? মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বিদ্যুল্লতা
খেলে যায় আজ এই বয়সের ধূসর প্রান্তরে।
মনে পড়ে যৌবনের জয়োল্লাস, পলাশের দিন-
মিটিং মিছিল, জনসভা, মধুদা’র ক্যান্টিনের
যুক্তি, তর্ক, গপ্পো, সবচেয়ে বেশি কবিতার রাত
মনে পড়ে। মাথা তোলে ভার্সিটির স্নিগ্ধ আমতলা।
আজ তুমি জনপথে নেই, মিছিলেও কোনোদিন
তোমার শ্যামল মুখ ঝলসে ওঠে না, তুমি আর
লেখার টেবিলে ঝুঁকে বসবে না, সন্তানের প্রতি
তাকাবে না মমতায়। তোমার নিবাস থেকে সাড়া
না পেয়ে পদ্যের পঙ্গক্তিমালা চলে যাবে বহুদূরে;
বন্ধু, তবু তুমি তরঙ্গিত আমাদের চেতনায়।
২৯/৩/৯৫