ফ্ল্যাশব্যাক এবং …
শৈলাবাস, যা স্যানাটরিয়ামও বটে, ভিড়াক্রান্ত। এখন সেখানে প্রজ্ঞা
ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তপ্ত শলাকা দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে
বিবেকের চোখ; উপরন্তু ওর হাতে ভারী শেকল, পায়ে বেড়ি। বোধি
নির্বাসিত। মিথ্যার বারফট্রাই আর মাস্তানিতে সত্য গা ঢাকা
দিয়েছে। আমাদের কোনও কোনও স্বপ্ন বিশ্বাসঘাতকতায়
মেতে আমাদের বিদ্রূপ করে যখন তখন। এখানে অনেকে
একজনের নাম বলতে গিয়ে দিব্যি অন্যজনের নাম উচ্চারণ করে
সগৌরবে। সেজন্যে কারও বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই। অনুশোচনা তো
অনেক আগেই বেপাত্তা। পাড়াপড়শিরা শরমের মাথা খেয়ে বরং
কোমরে ঘুনসি এঁটে হাসির গিটকিরি ছড়ায় চৌরাস্তায়।
ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ঢের হ্যাপা আছে জেনে বড় মেজো সেজো অনেকেই
দল বদলের রঙে মাতোয়ারা, অনেক জাঁকালো চণ্ডীমণ্ডপের
ফরাসে বসে ফরাসি টানে। কেউ কেউ দেশ অ্যাকোরিয়াম হোক,
এই মতো স্বপ্ন দ্যাখে ভয়ে ভয়ে।
কয়েকটি কলহংস-শব্দ বাড়িটার পাছদুয়ার দিয়ে ভেতরে
আস্তেসুস্থে প্রবেশ করে। কলহংসগুলোর শরীরে রৌদ্র-জ্যোৎস্না,
জল-হাওয়ার দাগ, দীর্ঘশ্বাসের ছায়া কম্পমান। শেষ রাতের
প্রহরকে চমকে দিয়ে মীরা বাঈ-এর ভজনস্নিগ্ধ হাতের কঙ্কন
নগ্ন মেঝেতে গড়ায়। ছাদ, দেয়াল, সিঁড়ি মেঝে ফুঁড়ে
রক্তের ফোয়ারা। আলাওলের পুঁথি আর রবীন্দ্র রচনাবলী
রক্তবমনে অচেতন। আলাওলের পদ্মাবতী রক্তস্নান সেরে ওঠে গভীর
গভীরতর বেদনায়। সারা গায়ে আনারের দানার মতো রক্তফোঁটা
নিয়ে হু হু বুকে লেকের কিনারে ছুটে যায় ‘পদ্মাবতী’র কবির রাজহাঁসের
পালকে বানানো লেখনীর সঙ্গে জলে সহমরণের অভিলাষে। রক্তভেজা
অচিন পাখিকে দেখে ছেঁউড়িয়াতে আচমকা ছিঁড়ে যায় লালনের
একতারার স্তব্ধ অথচ সপ্রাণ তার।
অতিকায় এক সোনালি দেয়ালের পিঠ থেকে নেমে আসেন তিনি। তাঁর
চোখে যুগপৎ বেদনা আর কৃতজ্ঞতার অশ্রুকণা চিক চিক করে
শ্রাবণের শেষ রোদে। ক্ষতবিক্ষত মানচিত্রের মতো বুক চেপে তিনি
দেখছেন কি দ্রুত তাঁর প্রাণের বাংলাকে এক প্রকাণ্ড পাগলা
গারদে রূপান্তরিত করা হয়েচে। এখানে সবাই বড় বেশি
স্বাভাবিক সুস্থতার নাটুকে ঢঙ দেখিয়ে চলেছে। একটা বদ
হাওয়া এতকাল আচ্ছন্ন করে রেখেছে স্বদেশভূমিকে। দেখা
যাক, মনে মনে বলেন তিনি, আমার উত্তরাধিকার অতীতাশ্রয়ী
না হয়ে সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে কিনা। সারাক্ষণ শুধু
অতীতের দিকে মুখ রেখে চললে প্রগতির চাকা ডোবে
পিছল কাদায়। আমার উত্তরাধিকার পেছনে কিংবা সামনের
চোরাবালিতে পা রাখলে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হবেই হবে
স্বজনেরই হাতে।
অনন্তর তিনি অপেক্ষমাণ সোনালি দোয়েলটির দিকে খানিক
তাকালেন, তাঁর চোখে একটি প্রশ্ন নক্ষত্রমালা হয়ে
দুলতে থাকে।
১৩.৮.৯৭
ব্যক্তিগত হরতাল
আজ আমি কোনও কাজ করব না। আজ সকাল-সন্ধ্যা আমি
আমার ব্যক্তিগত হরতাল ঘোষণা করেছি। আমি নিঃসঙ্গ, সমিতিছুট;
পিকেটিং চালাবার মতো দলবল আমার নেই। যা কিছু করবার একা
আমাকেই করতে হবে। ভোরবেলার প্রথম আলো যখন গাছের
সবুজ ঠোঁটে চুমো খাবে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখব না।
অন্ধকার ঘরেই শুয়ে থাকব কিছুক্ষণ, জ্বালব না আলো শেষরাতের
স্পর্শলাগা জনহীন গলির সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানালার কাছে গিয়ে
দাঁড়াব না। বেলা বাড়তেই কয়েকটি প্রজাপতি উড়ে আসবে আমার ঘরের
ভেতর। ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব, আগেকার মতো জিগ্যেশ করব না
ওদের কুশল। খবরের কাগজ পড়ে থাকবে এক পাশে, চোখ পর্যন্ত বুলাব না
পাতায়। স্নানাহার থেকে বিরত থাকব আজ। দু’দিনের না-কামানো
দাড়িকে আরও একদিন বাড়তে দেব। বাংলা একাডেমীর সাহিত্য সভায় অথবা
আজিজ সুপার মার্কেটে আজ আমাকে দেখবে না কেউ। কোনও বই কিংবা লিটল
ম্যাগাজিন কেনার তাগিদ অনুভব করব না আমি। আজ কোনও কোনও আড্ডা হবে না
আমার ঘরে। না, ডাকঘরেও যাব না পোস্টকার্ড কিংবা এনভেলাপ কেনার জন্যে।
কোনও বই ছুঁয়ে দেখব না, বলে দিচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত হরতাল পুরোদমে
সফল হবে। সে আজ থেকে ক’দিন আমার এই জন্মশহরে তার অনুপস্থিতির ঘোর
অমাবস্যা ছড়িয়ে রাখবে। এই অসহনীয় অমাবস্যার প্রতিবাদে সকল কাজে
তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি।
হঠাৎ কবিতা সব কাঁটাতারের ব্যারিকেড ভেঙেচুরে আমার মগজের কোষে
কোষে গায় বীজবপনের সোনালি গান। কবিতা ধর্মঘটী কলমকে তুলে দিল
আমার হাতে। শুধু গৌরীর না-থাকার বেদনাকে আমার ভেতরে দ্বিগুণ করে
কবিতা ফুটতে থাকে নীলাক্ষরে শাদা পাতায়।
৩১.৮.৯৭
ভিন্ন ভুবনে
বহুদিন পর সন্ধ্যা রাতে আবার সেখানে। গেট পেরুতেই আমার
শরীরের অনেক দিনের আলো-ছায়া গান হয়ে যায় বাগানটিকে দেখি
বাড়িটার মুখ থমথমে। আমার দীর্ঘ না-আসা ওর অবয়বে ঝুলিয়ে
দিয়েছে অভিমানের মেঘ, যেন এখনই বইবে জলধারা। ওর গায়ে কতবারই না
চোখ বুলিয়েছি সস্নেহে, করেছি সানুরাগ করমর্দন। কতদিন তার
বুকের এক পাশে নিবিড় বসে স্বপ্নের উপত্যকায় ভ্রমণের বর্ণিল অভিজ্ঞতা
সঞ্চয়ের অবকাশ হয়েছে আমার। মুহূর্তগুলো এক মুঠো মুক্তো হয়ে উঠত।
বাগানের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা অধিক লতিয়ে ওঠে। মনে পড়ে,
সন্ধ্যামালতী, জিনিয়া আর রঙ্গনের উৎসুক দৃষ্টি কেমন নিবদ্ধ থাকত
আমার দিকে। কখনও কখনও চোখ ফেরাতে পারতাম না, আহ এমনই
বাহার। এক জ্যোৎস্নারাতে স্বর্ণচাঁপ গাছটিকে মনে হয়েছিল ছায়াপথ
বেয়ে নেমে-আসা এক অপ্সরা। গাছগুলোর পুঞ্জ পুঞ্জ গভীর সবুজ কবিতা
লেখার আগের মুহূর্তরূপে মন-মেঘে মেশে। যার স্নেহার্দ্র
পরিচর্যার যৌবনের গৌরবদীপ্ত এ বাগান, তার হাত ধরেই এখানে
প্রথম প্রবেশ আমার। এই উদ্যান তার অন্তর্লোকে কখনও সৃষ্টি করে
সপ্তসুর, কখনও জাগায় রঙধনু, কখনও-বা জ্যোৎস্না-প্লাবনে ভাসে
হৃদয়ের একূল ওকূল। আমি সর্বস্ব পণ করে সেই প্লাবনে
ভাসিয়েছি তরী। বাড়িটার মুখ থেকে অভিমানের মেঘ অপসারিত;
ওর ঠোঁটে ঘন ঘন হাসির ঝিলিক আর বাগান পুষ্পল তাকিয়ে
বলে, ‘কবি, আবার এসো আমাদের এই সান্ধ্য সভায়। প্রতীক্ষায়
থাকব।‘ আমি হাতে নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ চলি, পথের ধুলায়
স্বপ্নিল হরফে লেখা শুভেচ্ছাবাণী। আর মালঞ্চের যিনি অধিশ্বরী
তার হৃদয়ের গান, মননের আভা আমাকে পথ দেখায় সামনের
দিকে। মুঠোভরা নক্ষত্র মদিরার পাত্র হয়ে আমার ওষ্ঠ স্পর্শ
করে নিমগ্নতা বুলিয়ে, আমি প্রবেশ করি দিগন্ত-ছেঁড়া ভিন্ন ভুবনে।
১৯.৬.৯৭