ক্ষণকাল
ঘুমভাঙা চোখে দেখি, হাতঘড়িতে ভোর ছ’টী। আকাশ-ঝারি
শহরময় অবিরল জল ছিটোচ্ছে রাতের শেষ প্রহর থেকেই। শ্রাবণ-
ধারায় আমি হয়ে উঠি গুণীর সেতারের আলাপ। আমার মনের
গহনে চকিতে কদম ফুল ফোটে। এই ফুল ফোটালে তুমি, অথচ
নিজেই জানলে না। জানি, এখন তুমি ঘুমের গহীন গাঙে স্বপ্নময়
ডুবসাঁতারে নিমগ্ন, ছুঁয়েছ জলজ গুল্ম আর কয়েকটি রঙিন শঙ্খ
গাঙের তলদেশ। তোমার ঘুমন্ত ঠোঁটে হাসির কুঁড়ি চোখ মেলছে
তোমার অজ্ঞাতে। তোমার নিত্যদিনের সুপ্রভাত আর শুভ রাত্রিগুলো
আনন্দমেলা হয়ে আমাকে ঘিরে দুলছে এক স্বপ্নিল
ঘোর-লাগা নাগরদোলায়। কৃতজ্ঞতায় ছলছলে আমার চোখ। মনে
পড়ে, কাল রাতে হঠাৎ তোমার ক্ষণিকের আবির্ভাবে অনন্তের কয়েকটি
বুদ্বুদ দেখেছিলাম। অনৈতিহাসিক অথচ ব্যক্তিগত তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তের
মুকুল আমার অসুস্থতার কালোয় আলো ছড়িয়েছিল অকপট অকার্পণ্যে।
সেই ঝলক তোমারই দান জেনে জ্যোৎস্নারাতের সোনালি মাছ হয়ে
তুমি ঝলসে উঠছিলে ক্ষণে ক্ষণে। আজকের ভোরবেলা গত রাতের
কয়েকটি মিনিট লাল চেলী গায়ে আমার বুকে মাথা রাখে। উন্মাতাল
আমি দু’বাহুর নীড়ে টেনে নিই বিগত ক্ষণকালকে।
২৭.৭.৯৭
ছায়ার ত্রিভুজ
এখন আমি আগেকার মতো নেই আর। ক’দিন থেকে আমার
বুকের ভেতর একটা ছায়ার ত্রিভুজ জেগে উঠেছে। সেই ত্রিভুজের
শীর্ষবিন্দুতে কালো ঝুঁটি-অলা আজনবি এক বিষণ্ন পাখির
বসবাস। ওর দু’ফোটা কালো চোখ ঘিরে সিঁদুর রঙের
বাহার। পাখিটাকে কথা বলাবার জন্যে, নিদেনপক্ষে একটি
কি দু’টি শিস যাতে শোনায় আমাকে, কত যে সাধ্য-সাধনা করেছি
সে জন্যে। অথচ সে নিস্তব্ধতার কঠিন মোড়ক ছিঁড়তে প্রবল
অনাগ্রহী। মধ্যে-মধ্যে শুধু কালো ঝুটি নাচায় আর কেমন আড়চোখে
তাকায় আমার দিকে। যখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি, যখন
আমার কণ্ঠ থেকে আবেগবিহ্বল মুহূর্তে রৌদ্র জ্যোৎস্নাময় এবং
ঘনঘোর মেঘবিদ্যুৎ ভরা পদাবলীপ্রতিম কিছু বাণী নিঃসৃত
হয়, তখন পাখিটি সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে কখনও আমার ফুসফুস,
কখনও ওর নিজের বুক ঠোকরাতে থাকে জন্মান্ধ আক্রোশে।
আমি তার বিরুদ্ধে কোনও নালিশ রুজু করছি না কারও কাছে।
ভেব না, ওর লাগাতার জুলুমের কেচ্ছা রটিয়ে ফিরিস্তি
সাজিয়ে আমি তোমার সহানুভূতি কিংবা করুণার কোমল
ছায়ায় দাঁড়াতে চাই। হঠাৎ কোনও কোনওদিন দুপুরে
অথবা সন্ধ্যায় তোমাকে দেখলে আমার ভেতরকার ছায়ার
ত্রভুজবাসী কালো ঝুঁটি-অলা পাখিটির অস্তিত্ব ভুলে থাকি।
ডাকহরকরা বিলি করলেও
১
ডাক-হরকরা বিলি করলেও রাজা রামমোহন রায়ের পত্র ঘরে ঘরে
পৌঁছেনি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখে জবাব না পেয়ে আখেরে নিজেকে
আবৃত করেছিলেন নিঃসঙ্গতায়, অশ্রদ্ধা তাঁর মুখাবয়বে বসিয়ে দিয়েছিল
কাঠিন্যের রেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পত্রাবলী রচনায় অনলস, এমনকি শেষ
বয়সের গোধূলিতে কম্পিত হস্তে রচনা করেছেন বিস্তর চিঠি। টেলিগ্রাম
পাঠিয়েছেন বারবার। মনে হয় না, সেসব চিঠি কেউ পড়েছে। পড়লেও
মর্মোদ্ধারে ব্যর্থ অনেকে, কেউ কেউ বুঝলেও তেমন আমল দেয়নি, অনেকে
খাম পর্যন্ত খোলেনি। অবশ্যি অধিকাংশ লোকের কাছে ক-অক্ষর হারাম বলে
তারা শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়েছে। সেসব চিঠি মানবচিত্তে মনুষ্য ধর্মকে
পদ্মের মতো প্রস্ফূটিত করতে চেয়েছিল। এখন সেই প্রাতঃস্মরণীয় ত্রয়ীর
সুসমাচার ফাঁপা পথচারীদের কাছে ইলেকট্রিকের তারে আটকে থাকা কাটা
ঘুড়ির ছিন্নাংশ কিংবা নর্দমার পানিতে ভাসমান ছেঁড়াখোঁড়া কাগজের নৌকা,
যা বস্তির ছেলেমানুষদের তৈরি।
২
যখন বয়স ছিল কম, তখন ক্ষীণায়ু কীটস্ এবং তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো
মৃত্যুবন্দনায় ছিলাম উচ্ছ্বসিত। ভাবতাম জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কোনও চৈতীরাতে
আবেগাতুর কবিতা পাঠকালীন আমার ওপর মৃত্যু যদি নেমে আসত, সুশীল
পাখির মতো কি ভালোই না লাগত আমার। মৃত্যুকে দয়িতা ভেবে মরণের
প্রেমে পড়েছিলাম তারুণ্যে। অথচ আজ ষাটের ধূসরতায় বিবর্ণ হয়েও বেঁচে
থাকার সাধ তীব্র সুরার মতো উদ্দীপিত করে আমাকে। কেননা, এই তো
সেদিন দেখলাম তোমাকে-তন্বী এবং সুন্দর।
৩
ভেবেছিলাম নাছোড় অভিমান এক আমাকে রাখবে লোকালয় থেকে
বহুদূরে নুড়িময় ঝর্ণাতলায় সুখে বুঁদ। বুনো ছাগ-যূথে, গাছগাছালির ভিড়ে,
পাখাপাখালির রাজ্যে জীবনযাপন মাধুর্যে মোড়া চিরদিন, ছিল আশা। পাথর
আর জলধারার ভাষা শেখা হবে। সুখের সংজ্ঞা কখনও কখনও ভাবায়।
গাছতলায় শুয়ে পাখির গান শোনা, বৃষ্টিধোয়া আকাশে রঙধনুর পেখম দেখা,
সূর্যের আলোয় নেয়ে ওঠা, চৈতালি জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়ানো, সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে দাঁড়ানো-এসবই তো সুখকর; তবু কেন মানুষের মুখ দেখার
ব্যাকুলতা? লোকালয়ের উত্তাপ ফিরে না পেলে টইটম্বুর হবে না আমার সুখের
কলস।
৪
কখনো সেজেগুজে, পরিপাটি দাড়ি কামিয়ে সুগন্ধি মেখে, কখনও বা
উশ্কো খুশ্কো ৩ দিনের না কামানো দাড়ি নিয়ে তার নিবাসে গিয়ে কড়া
নাড়ি। ব্যাকুলতা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ। যতক্ষণ না ওর ড্রইং
রুমের সোফায় বসি, কথা বলি এলোমেলো, তাকাই বারান্দায় লুটিয়ে পড়া
রৌদ্রের দিকে, ততক্ষণ আমার স্বস্তি নদারৎ। আলবৎ ওকে ভালোবাসি,
এরকম ভালোবাসিনি কোনও নারীকে। আমাকে সে ভালোবাসে কিনা, সঠিক
জানি না। যেমন জন্মান্ধের অজ্ঞাত চৈত্ররাত্রির জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য। সন্দেহের
কাল বেড়াল ফিরোজা চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে, ভীত আমি
উদাসীনতায় ডুবে থাকার ভান করি। কোনও কোনওদিন আমার ঠোঁট থেকে
লতার মতো দুলতে থাকে একটা প্রশ্ন, ‘তুমি কি সত্যি ভালোবাস আমাকে?’
কখনও নিরুত্তর সে নোখ দিয়ে খুঁটতে থাকে সোফার হাতল কিংবা বলে,
‘চাই, চা করে আনি। কখন কি খেয়াল হয়, আমার দিকে না তাকিয়েই
ফ্লাওয়ার ভাস সাজাতে উচ্চারণ করে, ‘ভালোবাসি’। সেই মুহূর্তে
তার কণ্ঠস্বরে যেশাসের জন্মের আগেকার সুদূরতা। প্রাচীনতম লেখনের
পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় ক্লান্ত আমি বর্তমানকে মুছে ফেলি নিজেরই অজান্তে। এর
পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকে আমার অনুভুতিগুলো, জড়ো করার উৎসাহ সবুজ
শিখার মতো জ্বলে ওঠে না। আমার ভেতরকার দুরন্ত যুবার অবয়বে বৃদ্ধের
মুখচ্ছন্দ দোদুল্যমান।
৫
তার কাছে পৌঁছেই বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আমি। সে নিমেষে ফ্রিজের বোতল
থেকে এক গ্লাস পানি হাজির করে আমার সামনে। ঢক ঢক খেয়ে ফেলি
সবটুকু পানি। একটু পরে বলি, ‘বড় তৃষ্ণার্ত আজ। আবার এক গ্লাস পানি,
আর ধোঁয়াওঠা চায়ের পেয়ালা। পানির গ্লাস এবং চায়ের বাটি উজাড় করেও
আমার তৃষ্ণা মেটে না। উসখুস করি, যেন পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। জালালউদ্দীন
রুমির মতো নিজের শরীরের উদ্দেশে বলি, ‘হে দেহ, এই তো তুমি বিটকেল
যুবরাজ। অধৈর্য আমি শেষটায় বলি, ‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
ঘরের ভেতর তখন এক হাজার একরাত্রির রহস্যময়তা আর পারস্য গালিচার
সৌকর্য; অথচ সে দিনানু-দৈনিক কাজে মশগুল, হঠাৎ ব্যেপে আসা
অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের প্রতি উদাসীন। আখেরে আরও এক গ্লাস পানি গলায়
ঢেলে আমি পথচারী, একা, স্পর্শহারা, চুম্বনবিহীন। বুকজোড়া দাউ দাউ তৃষ্ণা
আর হাহাকার, যা আমার একাকিত্বকে আরও দুঃসহ করায় ব্রতী। কি করে
তৃষিত পায়রার ঘাড় মটাকে হয় বারবার, সে ভালো করেই জানে।
৬
এখনও আছো, পরে থাকবে না। ভালোই, তখন আমি এই পৃথিবীর কেউ
নই। দর্পণে বিম্বিত নিজেকে উপভোগ করা চমৎকার খেলা তোমার। একদিন
ফুরাবে খেলা, তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে আদমসুরত। আবার বন্দনায় যে
সৌন্দর্য অক্ষরের পরতে পরতে ধৃত, সংরক্ষিত, তা হারানোর বুকজোড়া
হাহাকার কে আর শুনবে তুমি ছাড়া? কাকের ডাকে চমকে উঠে তুমি নিরর্থক
তরুণী পরিচারিকাকে করবে ভর্ৎসনা। হয়ত মনে পড়বে তাকে, যে তোমার
খুব কাছে আসতে চেয়ে ফিরে গেছে বারবার ব্যর্থ, অসহায়। কোনও কোনও
মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নে কুরূপার বীভৎসতা, করোটিতে সাপের ফণা দেখে জেগে
উঠবে। তখনও দর্পণে ছায়া, আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল। ভূতুড়ে জ্যোৎস্নায় স্তব্ধতা
চিরে ডেকে উঠবে যুগপৎ কাক ও কোকিল।
৭
বৃষ্টি নেই, রোদও নয় চড়চড়ে। তবু যাই না। আজকাল ইচ্ছে করেই
তোমার নিবাসে আমি অনুপস্থিত। তোমার কাছ থেকে দূরে থাকার সাধনায়
গলায় অন্যমনস্কতার রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে ঔদাস্যের তস্বি। তবুও
কোনও কোনওদিন তোমাকে দেখতে যাব বলে গলির মোড়ে উঠে পড়ি
রিক্শায়। রিক্শাচালক ঠিকানা জানতে চাইলে বলি, ‘নীলিমায় উড়ে যেতে
পার? আরোহীকে উন্মাদ ঠাউরে শীর্ণকায় লোকটা প্যাডেলে অসাবধানতা
ছড়ায় দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্দেশে বলি,
‘হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চলো।
কেন সেখানে যেতে হবে, নিজেই জানি না। শুনেছি তুমি বেশ ভালোই আছ,
তৃপ্তিতে টইটম্বর। আগের চেয়ে ফরসা, স্বাস্থ্যে স্বর্ণলতার সজীবতা। আর
যেখানেই হোক তুমি এ শহরের কোনও হাসপাতালে, ক্লিনিকে নেই। তোমার
কাছ থেকে বহুদূরে টেনে টুনে রেখেছি নিজেকে এবং তোমাকে তিল তিল করে
গড়ে তুলছি পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তিতে। সেই হরফের মূর্তি তোমার মতোই অথচ
তুমি নও। তোমার চেয়েও নমনীয়, দয়াময়ী। তার হাত দৈনন্দিনতায় নয়,
নক্ষত্রপুঞ্জে মিশেছে। কখনও সে আমাকে পাতালে টেনে নেয়, কখনও বা
তুমুল মন্দিরা বাজিয়ে নিয়ে যায় প্রাণবন্ত জীবজগতে।
৮
নিস্তব্ধ বাড়ি ধ্যানী দরবেশের মতো জেগে আছেন, তার মাথা আকাশকে
স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে, হাত লাগে দেয়ালে,
যেখানে রক্তের দাগ। বিছানায় বেনামী ভয় লেপ্টে থাকে, নিজেকে মনে হয়
ছন্নছাড়া আগন্তুক; আর ক’দিনই বা আছি এই ডেরায়? আজ আমি যে জায়গায়
খাট পেতেছি, সাজিয়েছি টেবিল, বুকশেলফ-এসব কি এরকমই থাকবে
অবিকল বহুবছর পর? এ জায়গায় ভিন্ন কোনও খাটে, কবোষ্ণ শয্যায় হয়ত
ঘুমোবে আমার কোনও ষাটপেরুনো বংশধর। তার নিদ্রিত হাত কি জেগে
উঠবে দেয়ালের স্পর্শে? তাকেও কি ডালকুত্তার মতো কামড়ে ধরবে এমনি
কোনও চিন্তা যা আমাকে এই মুহূর্তে গ্রাস করেছে? সে কি আমার মতোই
ভুগবে অর্থকষ্টে নাকি দু’হাতে ওড়াবে টাকা? সে কি কোনও অধ্যাপকের পদ
অলংকৃত করবে, অথবা হবে আমৃত্যু দুঃখের জোয়াল বয়ে বেড়ানো কোনও
কবি?