এভাবে কতক্ষণ বসে থাকব
এভাবে কতক্ষণ বসে থাকব চোখ দুটোকে প্রতীক্ষা-কাতর
করে? তুমি কি চাও আমার শরীর হয়ে উঠুক বল্মীকময়?
আমার নিজস্ব ধ্যানে কেবল তোমাকেই ধ্রুবতারা মেনে ঠায়
বসে থাকব মাসের পর মাস উপবাসে শীর্ণ? নিদ্রাহীনতায়
রুক্ষ, জীর্ণ? যদি জানতে পারতাম তোমার প্রকৃত ইচ্ছা, আমি
নিজেকে প্রস্তুত করে নিতাম সেই অনুসারে। এখন আমি সারাক্ষণ
গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছি; তোমার মন জুগিয়ে চলার পথ
খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। কখনও প্রজাপতি এসে আমাকে জিগ্যেশ
করে আমি কেন এমন দিশেহারা? কখনও দোয়েল আমার কাঁধে
এসে বসে, উদ্বিগ্ন সুরে জানতে চায় আমার মনের খবর আর কখনও
জানলার পাশের গাছের ডালটি গ্রীবা বাড়িয়ে আমাকে সবুজ
সমবেদনা জানায়। কী বলে ওদের উদ্বেগের ছায়া মুছে দেব, ভেবে
পাই না। ওদের কাছ থেকে কিছু শব্দ সংগ্রহ করে নিজের
নিঃসঙ্গতাকে তোমার পৌনঃপুনিক বিরূপতার কাঁটাগুলোকে
সহনীয় করে তোলার জন্যে কয়েকটি পঙ্ক্তি রচনায় উদ্যোগী হই
আষাঢ়ের এই গোধূলি বেলায়। বাল্মীকি হওয়া আমার সাধ্যাতীত।
আমার হাতে তাঁর বীণা নেই। আমি একতারা বাজিয়ে বাজিয়ে
সময় কাটাই। এই সুরে মুগ্ধ হবে গৌড়জন, এই অসম্ভব দাবি কি
আমাকে সাজে? আমার এই একতারার সুর যদি তোমার শরীরে
শস্য ক্ষেতের ঘ্রাণ বুনে দিতে পারে, যদি তোমার বিরূপতার
অমাবস্যায় আনতে পারে জ্যোৎস্নার ঝলক, ঠোঁটের রুক্ষতায়
ফোটাতে পারে গোলাপ, তবেই এই শূন্য ঘরে আমার বাউল-নাচ।
একবার তুমি তোমার অভিমানের ধূলিঝড় থামিয়ে এই আমাকে
একটিবার এসে দেখে যাও।
২৫.৬.৯৭
কবি
যাদের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয় তারা কেউই আর
ফিরে আসে না আমার কাছে। আমার বাবা, কোনও
কোনও ভাই, বোন, এক ছেলে-যারাই আমাকে ছেড়ে
গ্যাছে তারা কেউই ফিরে আসেনি। এই তো ক’মাস হলো
আম্মা গেলেন, তিনি প্রত্যাবর্তন করে মমতামগ্ন হাত
রাখেন নি আমার শাদা চুলময় মাথায়। আমি দেয়ালে
মাথা খুঁড়ে মরলেও তিনি আসবেন না আর। আমার কোনও
কোনও বন্ধু নিজেদেরই অপরাধে আমার কাছ থেকে দূরে
সরে গেছেন। তাদের সঙ্গে মামুলি কুশল বিনিময় তো দূরের
কথা, সুখদর্শনও নাস্তি। ওরা কেউ কেউ দুয়ো দেয়, কেউ
কেউ সাধে শক্রতা।
অথচ আমার বারান্দায় ভোরবেলা টাটকা মাখন-রোদ
গায়ে নিয়ে খেলতে আসে তিন-চারটি আদরণীয় অতিথি
চড়ুই। আমার ঘরে কখনও কখনও দুপুর কিংবা বিকেলে
ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। দোয়েল আমার হাঁটুর ওপর বসে,
কাঁধে ঠাঁই নেয় চঞ্চল প্রজাপতি। পায়ের কাছে পায়ের কাছে পায়রা-যুগল
সাবলীল প্রেম করে। বিরলদৃষ্ট যে কোকিল সে-ও সামনে
হাজির হয়ে প্রায়শ আমাকে অন্তরঙ্গ গান শুনিয়ে যায়। আর
আমার এই ছোট ঘরে মাঝে মাঝে দেখা দেয় এক মানবী
সত্তায় অনুপম বসন্তের বর্ণচ্ছটা নিয়ে। কথা এবং আচরণের
রোদ-জ্যোৎস্নাধারায় আমার খরাগ্রস্ত জীবনকে স্নিগ্ধ স্নান
করায়। আমরা দুজন গড়েছি এক প্রণম্য মনোজ বসতি। যদি
সে কোনও দিন আমাকে ছেড়ে ঠাঁই-নাড়া হয়, তাহলে দুনিয়া
আমার অ্যান্ধার, যেমন কবিতা আমাকে ত্যাগ করলে।
২
কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে জলবালিতে নয়, ইটখোলার ইটের
টুকরোটাকরা অথবা আমাদের এই গলির ধুলোকাঁকরেও
নয়, মাঝে মাঝে সকাল-দুপুর, গোধূলি-সন্ধ্যা কিংবা মধ্যরাতে
ঘরের মেঝে আর বিছানায় কোথাকার পাথরের নুড়ির ওপর
গড়াগড়ি দিই। আজকাল রাতে ঘুম প্রায়শই লাপাত্তা। জানি,
চিকিৎসাশাস্ত্রের বরাত দিয়ে লোকে ইনসমনিয়া বলে এই উপসর্গকে।
নির্ঘুম রাতে আমার কণ্ঠনালী দিয়ে জঠরে ঢুকে যায় বালিকণা,
বেবি ট্যাক্সি, ট্রাক-বাসের কালো ধোঁয়া, ইটের ভগ্নাংশ, মরা পাতা,
বাতিল বিয়ার ক্যানের খণ্ড, পুরনো টুথব্রাশ, কাঁকর, ছেঁড়া
চিঠি, বাৎস্যায়ন ঋষির ‘কামসূত্রে’র একটি মলিন পাতা, আর
পাথরের অনেকগুলো নুড়ি। কখনও কখনও কয়েক দিন পর,
আবার হয়ত সে-রাতেই আমার ভীষণ বিবমিষা হয় আর
আমি বমন করি পূর্বাষাঢ়া, রেবতী, বিশাখা, স্বাতী,
শতভিষা, জোহরা সিতারা, সপ্তর্ষি মণ্ডল আর কিছু অচেনা
মণিমুক্তো। সংবিং ফিরে এল আমি বিস্মিত-থরথর হাতে
সেগুলো কুড়াতে থাকি।
১৯.৮.৯৭
কী করে করবো বসবাস
সকাল থেকেই আমার হৃদয় জুড়ে প্রখর তৃষ্ণা। বুক পুড়ে যাচ্ছে অনবরত।
ভাদ্রের জলধারা মুছতে ব্যর্থ হবে এই দাউ দাউ তেষ্টা জুড়োতে।
বনপোড়া শিঙঅলা হরিণের মতো অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই এদিক
ওদিক। যেন চলেছি বেঢপ চালে এক মরু পথে। নেকড়ের
মতো খেঁকিয়ে ওঠা রোদ আমাকে ভাজছে কাবাব রূপে।
দু’চোখে ক্ষুধার্ত পশুর জঠরজ্বালা। পথে পড়ে থাকা ঘোড়ার
কংকাল, রুক্ষ গাছের ডালে ঝুলন্ত বিষধর সাপ, বালিতে
লুণ্ঠিত পুরানো রক্ত চিহ্নময় পোশাক, আর অতিকায় মরু কাঁকড়া
আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। হোঁচট খেয়ে বারবার বালিতে মুখ
থুবড়ে পড়ি। আমার চোখের তৃষ্ণা আর বুকের তেষ্টা এক যোগে
আর্তনাদ করে মরু নদীর মতো।
আজ তোমাকে দেখার সঙ্গেই হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে
জেগে ওঠে তৃষ্ণানিবারণী জলময়তা। আমাদের
দুজনের দু’টি হাত পরস্পর চুম্বন ধারায় ভাসতে থাকে
কিছুক্ষণ। আমার মুখাবয়বে আন্দোচ্ছাসের ঝাপটা দেখে
তুমি মুগ্ধ হলে। কয়েক মিনিট পরেই আমার মুখের বিষণ্নতার
উকিঝুঁকি দেখে তোমাকে স্পর্শ করে মন খারাপের নীলাভ
আঙুল। তুমি আমার বিষণ্নতার উৎস জানতে চাইলে আমি
নিজের অসুস্থতার কপট উচ্চারণ করি। অথচ তোমাকে ক’দিন
এখানে দেখতে পাব না ভেবেই আমার হৃদয় ধুলোয়
লুটিয়ে পড়েছে আহত দোয়েলের মতো।
তোমাকে আবার দেখার জন্যে নিরুপায় হয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও
সাতদিন। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার নিষ্করুণ ঘরে কী করে করবো বসবাস?