আমাদের ভালোবাসায় সন্তান
ক’দিন একটানা আঁধিঝড়ের পর, পাখির নীড়-পোড়ানো
দহনে হৃদয় ঝলসে যাওয়ার পর আষাঢ়ের ঘন মেঘ নামে
আমার অন্তর ছেয়ে। তোমার হৃদয়-কূলের উদ্দেশে জোয়ারে
ভাসিয়েছিলাম যে-তরী তার চোখে কি তুমি আমার অথই
ব্যাকুলতা পাঠ করতে পেরেছিলে? সে-চোখের ভাষা
অস্পষ্ট দেখলে তুমি তোমার অন্তরের পুশিদা পাখিটিকে
জিগ্যেশ করে নিলেই পারতে। আমি তো রবীন্দ্রনাথের গান,
বিটোভেনের সিস্ফনি, স্বর্ণচূড়ার রঙ, ভ্যান-গগের ছবি,
সন্ধ্যার পাখির উড়ে-যাওয়া, মায় ঘাসের শিশিরে কী সহজে
তোমার বার্তা পেয়ে যাই। যা-কিছু সুন্দর তাতেই দেখতে
পাই তোমাকে। আহ্, কী চোখ-জুড়ানো রূপ।
আষাঢ়ের প্রায় সন্ধ্যাপ্রতিম মন-কেমন-করা দুপুর।
বিছানায় শুয়ে পড়ছিলাম হাল আমলের কবিতার
বই; আমাকে খানিক চমকে দিয়ে টেলিফোনে বেজে
উঠল। ‘ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম নাকি’, তোমার কণ্ঠস্বর।
‘মোটেই না, আমি তো জেগেই আছি। ‘তবু অসময়ে
টেলিফোন করে ফেললাম বলে দুঃখিত। কেমন অস্থির
লাগছিল, তাই…,’ তুমি বললে কণ্ঠে ঝর্ণাধারা বইয়ে
দিয়ে। কী-যে বলছ তুমি, আমার সকল সময় তোমাকেই
অর্পণ করেছি। তোমার জন্যে আমার কোনও বেলাই
নয়, অবেলা, আমার স্মিত উত্তর। তুমি বললে, ‘তোমাকে
আমার মতো করে চাইছিলাম এই লগ্নে, তোমার কথা
আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিল নিমেষে। আমার অস্থিরতা
মিলিয়ে গেছে আষাঢ়ী মেঘে। এখন তুমি বিশ্রাম করো
কবি; ইচ্ছে হলে বই পড়ো কিংবা কবিতা লেখো; পরে
কথা হবে।
আমি চাই তুমি আমাকে জাগিয়ে তোলো সবসময়। পথ চলতে
যখন জড়িয়ে আসে আমার চোখের পাতা তখন তোমার কণ্ঠস্বর ক্লান্তিপ্রসৃত
জড়তা-কুয়াশা ছিঁড়ে ফেলুক। তোমার ডাক আমাকে ফিরিয়ে
আনুক ভুলভ্রান্তির চোরাটান থেকে, আমি চাই। চাই তোমার
কথার সেই মোহন স্পর্শ, যা গাইবে জাগরণী গান। একদিন তো
এমন আসবে, যখন আমার সত্তা জুড়ে নামবে রক্ত-জমানো
বরফের পানিভেজা হিমশীতল কালো চাদরের মতো এক দুর্ভেদ্য
নিদ্রা। হায়, সেই ঘুমপাথর তোমার অমন মধুর কণ্ঠস্বরের
আলোড়নেও নড়বে না কিছুতেই।
আপাতত যাক সেদিনের কথা; এখন সে-কথার বিষপিঁপড়ে
তোমার অন্তরে ছড়িয়ে বিরূপতার কর্কশকাচে মুখ ঘষে রক্তাক্ত
হতে চাই না। আমাদের ভালোবাসার সন্তান এক ফুটফুটে স্বপ্ন, যে
কখনও রোদে, কখনও জ্যোৎস্নায় খেলছে, এখন এটাই হোক প্রিয় ভাবনা।
২৭.৬.৯৭
আমার অসমাপ্ত কবিতা
আকাশের কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ পাড়ার নার্সারির কচি ঘাস
চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের চোখে তৃপ্তির কুয়াশা আর গোলাপগুলি
ঈষৎ লাজনম্র আর ভয়কাতর। এখানে তোমার দৃষ্টি পড়েনি ক’দিন।
আকাশ থেকে এক অতিকায় পাখি এসে নামলে, তুমি তার জঠর থেকে
বেরিয়ে আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে। মনের চোখে দেখব তোমাকে।
তুমি কি এলে বহু যুগের স্মৃতি জড়িয়ে তোমার সত্তায়? তোমার চোখে যেন
সুদূরতার ছায়ানিঝুম আত্মপ্রকাশ। জানলার শার্সি ধরে সেই কবে থেকে
দাঁড়িয়ে আছি। ঘণ্টা দেড়েক আগে বৃষ্টি এক পশলা চুমো ঝরিয়ে
গেছে আশেপাশে দরদালানে, গলিতে, নার্সারিতে। কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ,
যেগুলি চরছিল নার্সারিতে, চিবোচ্ছিল কচি ঘাস, এখন উধাও। তুমি তোমার
ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছ মধ্যরাত্রির শয্যায়। আমার বাসনাগুলি পুরুষ
মৌমাছি হয়ে উঠছে তোমার ক্লান্ত যৌবনের মৌচাক ঘিরে, তুমি না
জেনেই ঘুমিয়ে পড়বে।
এখন আমার অসমাপ্ত কবিতা তোমাকে ভাবছে কয়েকটি সড়ক, বইয়ের
দোকান, ট্রাফিক-লাইট, মসজিদ, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান
আর সিনেমা হলের ওপার থেকে। আমার অসমাপ্ত কবিতার রঙিন মাছগুলি
ডুবসাঁতার দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তোমার মেহগলি কাঠের খাটের কিনারে
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোমল নিদ্রায় তোমার শরীর অন্যায়বিহীন আর
কী নির্মল। অন্য কোনও পুরুষের স্পর্শের কালো কখনও তোমার শরীরে
ছড়িয়েছে কি না, এ নিয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা এখন তেমন ভাবিত নয়।
সে এখন গাঢ় অনুরাগে এই নিঝুম প্রহরে তোমার অধরে, গালে, স্তনযুগলে
আর নাভিমূলে মন্দিরে পুরোহিতের মতো প্রসাদ-রেণু ছিটিয়ে দিচ্ছে অবিরল।
রাত্রির টাইম-পিসে এই মুহূর্তে কটা বাজে, খেয়াল নেই। তোমার ঘুম, একটি
রাতজাগা পাখি, হাওয়ো-মাতাল গাছ, জনহীন গলি, এতিমখানার অন্ধ নীরবতা
আমার মধ্যে কী এক অস্থিরতা ডেকে আনে। অন্ধকারের আড়ালে ঢাকা-পড়া
নক্ষত্র আর ভাসমান মেঘের গলা জড়িয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা গন্তব্যের
প্রায় সীমান্তে পৌঁছে যায়। দ্রুত হতে থাকে বুকের স্পন্দন। এই যাত্রা কে জানে
কোথায় থামবে? কোনও পুরানো কবরস্তানে নাকি নতুন কোনও পুষ্পল উদ্যানে?
৫.৯.৯৭
ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে ডাকছি
দাঁড়িয়ে এক মহান উৎসবের মুখোমুখি। ভিড়, কোলাহল, আনন্দোচ্ছ্বাস,
আলোকসজ্জা ইত্যাদির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে। এই
আনন্দ, এই হাস্যরোল কি স্পর্শ করছে না আমাকে? উদ্যাপিত হচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী। আমাদের গৌরবের বিপুল সূর্যোদয় সারা দেশের
নরনারী এবং শিশুকে চুম্বন করছে। আমি সেই চুম্বনের স্বাদ পাচ্ছি আমার সমগ্র
সত্তায়। এখন আমি গোলাপ, বুলবুল, ভ্রমর এবং স্বর্ণলতাকে ডেকে আনতে
পারি এখানে। আমার ঈষৎ সঙ্কেতে ওরা কথা বলে উঠতে পারে, গাইতে পারে
অনিন্দ্য গান। ওদের ঐকতানে আজকের এই উৎসব পাবে স্বতন্ত্র মাত্রা। এই
তো ওরা উপস্থিত হয়েছে বরণীয় অতিথির মতো। ওরা আমার ইশারার জন্য
অপেক্ষমাণ। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না ওদের। আমার ইঙ্গিত এখনি,
এই মুহূর্তেই, পৌঁছে যাবে ওদের কাছে। বেজে উঠবে বিউগল, ওস্তাদের
সেতার, রাখালের বাঁশি। আমার চোখ, আমার ওষ্ঠ, কাঁধ, বুক, দু’টি হাত
উৎসবের আলোয় উদ্ভাসিত, আমি রূপান্তরিত হচ্ছি একটু-একটু করে। আমি
কি এখন মিকেলেঞ্জোলোর গড়া কোনও ভাস্কর্য যা অপরূপ সৃজনশীলতায়
দেদীপ্যমান, জীবনের ছন্দে স্পন্দিত? আমি নিজেই এক অনন্য উৎসব, যেমন
গুণী সুরের ঝরনা বইয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে যান কোনও তান?
মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী উৎসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, আমি
কি কথা বলাতে পারবো গত সিকি শতাব্দীকে? পঁচিশটি বছর কি ফোয়ারা হয়ে
উঠবে অপ্রতিরোধ্য উচ্ছ্বাসে? পঁচিশটি বছর কণ্ঠ থেকে কোনও কথা ঝরানোর
আগেই ঈশান কোণ থেকে এক খণ্ড মেঘ আমার ওপর ঝুঁকে বললো, “যে
মানুষটি একজন উৎকৃষ্ট মৃৎশিল্পীর মতো স্বদেশকে প্রতিমা করে তুলতে
চেয়েছিলেন, চার বছর অস্তমিত না হতেই তাঁকে গ্রাস করল তাঁরই সৃষ্টি!” আজ
উৎসবের আনন্দমুখর প্রহরে এই সত্য ভুলে থাকা অপরাধ, গ্রীবা বাড়িয়ে
বললো সরোবরের শ্বেতশুভ্র রাজহাঁস। বাঁশবনের আড়াল থেকে গহিন গাঙের
ঢেউয়ে শব্দের মতো কণ্ঠস্বরে কে যেন বললেন, ‘দুর্ভাগা দেশে এরকমই হয়।
আমাদের কি মনে নেই তাঁর কথা, যিনি মানবগণের অন্তরে ভিন্ন এক রাজ্য
প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন? তাঁরই মাথায় কাঁটার মুকুট পরিয়ে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ
করা হয়েছিল গলগোথায় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে। স্বর্নরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের
এই তো পুরস্কার।
সোনার বাংলা ছেয়ে গেছে গুণ্ডায়-নিখাদ গুণ্ডা, রাজনৈতিক গুণ্ডা, ধর্মীয় গুণ্ডা,
সাহিত্যিক গুণ্ডা আর সাংস্কৃতিক গুণ্ডার তাণ্ডবে উৎকৃষ্টগণ গা ঢাকা দিয়েছেন
অন্তরালে। তাঁদের কথামালা, পরামর্শ গড়াগড়ি যায় আবর্জনার স্তূপে, পশুর
মলে। প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন যেসব
লেখক তাঁদের কলম ছিনিয়ে নেওয়া ষড়যন্ত্র চলছে। রাজনীতি-বিদ্বেষী
বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক কেউ কেউ বস্তাপচা ধোঁয়াটে থিওরি কপচিয়ে কেউ
কেউ ধর্মীয় আখড়ায় ফতোয়া বিতরণ করে চমৎকার মশগুল। অনেকে আবার
‘ফুলচন্দন পড়ুক তাদের মুখে’ বলে ঢোলক বাজাচ্ছে ঋতুতে ঋতুতে।
যে-দেশে রজব আলী চাষির সানকিতে আজ কী শাদা কী লাল কোনও ভাতই
ফুটে থাকে না ফুলের মতো, রজব আলীর বউ রাহেলা ছেঁড়া শাড়ি পড়ে হি
হি কাঁপে শীতে যে-দেশে, যে-দেশে নাছোড় অপুষ্টিতে দৃষ্টি হারায় অগণিত
শিশু, যে-দেশে ফতোয়াবাজদের মধ্যযুগীয় উৎপীড়নে, পাথর ও দোররার
আঘাতে সিলেটের নূরজাহান এবং তারই মতো আরও কোনও কোনও বঙ্গ-
দুহিতার মৃত্যুকালীন আর্তনাদ রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, বেনো জলে
ভাসে, যে-দেশে ইয়াসমিনের মতো কোমল মেয়ে পুলিশের পৈশাচিক হি-হি
হা-হা ধর্ষণের পরে খুন হয়, সে-দেশে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা
নিয়ে বুধবৃন্দ ও কবিকুলের বাহাস এক তুমুল তামাশা ছাড়া আর কিছুই মনে
হয় না। যে-দেশে নকল নায়কের স্তবে অনেকে মাতোয়ারা, ভুল নেতা নিয়ে
হৈ-হুল্লোড়, নাচানাচি যে-দেশে লক্ষণীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্রমাগত নীরব
নিষ্ক্রমণ, যে-দেশে শহীদ জননীর ভাবমূর্তিতে বিষ্ঠা ছুঁড়ে দেয় দালালের দল,
সে-দেশে কোনও উৎসব উদ্যাপন কেমন খাপছাড়া মনে হয়।
তবু মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত মহান উৎসবের
বড়ো প্রয়োজন আমাদের। এই শহর, যাকে আমি আবাল্য ভালোবাসি, এই
স্বাধীন, প্রিয় শহর আমাকে ঠেলে দিচ্ছে বিপন্নতায়, বুঝিবা পাঠাতে চায়
নির্বাসনে, যেমন মহাকবি দান্তেকে পাঠিয়েছিল তাঁর নিজের শহর। চৌদিক
থেকে নিরাপত্তাহীনতার আঁকশি ঘিরে ধরছে আমাকে, তবু আমি আজও অসীম
সাহসে টিকে আছি আপন বসতিতে। এই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি এই
আলো-ঝলসিত শহরে পঁচিশ বছরকে কথা বলানোর আশায়। আমার চৌদিকে
প্রবল জনস্রোত। সুপ্রিয়া গৌরী, তুমি এসে দেখে যাও এই অতুলনীয়
দৃশ্যাবলি। আমি আজ ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে ডাকছি। আমাদের
এগিয়ে যেতে হবে সকল বাধা ডিঙিয়ে, পশ্চাৎপদতার কুহকের হাতছানি
এড়িয়ে নতুন সভ্যতার দিকে। বিজয়োৎসব আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে
অনির্বাণ মশাল।