ভোরবেলা চোখ মেলতেই
ভোরবেলা চোখ মেলতেই দেখি আকাশে কালো মেঘের
জটলা। মেঘ গলছে বৃষ্টি হয়ে, ঘুমের ঘ্রাণময় মন
ভিজতে থাকে। রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম তুমি এসেছ আমার কাছে
কদম কানন পেরিয়ে সেই নীল যমুনার তীর ঘেঁষে কত দূর থেকে।
জাগরণের এই মুহূর্তে হঠাৎ তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্যে আমার
হৃদয় হলো কদম ফুল। আকাশের ঘনকৃষ্ণ মেঘ আর রাধা-
বিদ্যুৎ দেখি। তারপর নেমে-আসা বৃষ্টিধারার দিকে তাকিয়ে থাকি
নিষ্পলক। কেমন ব্যাকুলতা ঠোঁট তোমার ঘুমের সরোবরে
কোনও ঢেউ জাগাতে পারবে না এখন। তুমি জানবেও না এই মুহূর্তে
তোমাকে দেখার জন্যে আমি কেমন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আমার চতুর্দিকে
জেগে-ওঠা মরুভূমিতে। এই যে আমার হৃদয় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে
তোমার নিদ্রিত শরীরকে একটু স্পর্শ করার জন্যে, এ-কথা তুমি বুঝবে
কী করে? আমার হৃদয়ের ওষ্ঠ তোমার ঠোঁটে মিলিত হওয়ার উদ্দেশে
পাখি হয়ে উঠতে চাইছে তুমি অনুভব করতে পারবে কি, যখন তোমার
শরীর থেকে ঝরে যাবে ঘুমের কুয়াশা?
৯.৭.৯৭
মধ্যমার প্রতি
ক’দিন থেকে আমার ডান হাতের মধ্যমা এক অর্থহীন হরতাল
শুরু করেছে। কোনও কাজই করবে না আর। আজ সকালে
হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে
উদ্ধত ভঙ্গিতে। কোনও নেপথ্যাচারী স্বৈরাচারীর লেলিয়ে দেওয়া
দালালের মতো আমার বিরুদ্ধে লাগাতার শ্লোগান দিতে
শুরু করেছে। প্রেমের কবিতা লেখার সময় সে আমার কলম
স্পর্শ করবে না-এই ওর ঘরফাটানো দাবি। বুঝতে পারি না,
কেন এই না-হক দাবি মধ্যমার? আমার দিকে সরোষে এক
স্মারকলিপি ছুঁড়ে দিয়েছে সে। স্মারলিপি পড়ে হতবাক আমি ফ্যালফ্যাল
তাকিয়ে থাকি সেই লুম্পেনের দিকে। বিশেষত প্রেমের কবিতা লেখার
সময় সহযোগিতার দরজায় সে ডবল তালা ঝুলিয়ে দেবে। টেবিলে
দাঁড়ানো মধ্যমাকে বললাম, “দ্যাখো হে, বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু
করেছ। কী না করেছি আমি তোমার জন্যে? তোমার কষ্ট হবে
ভেবে কখনও কখনও লেখা মাঝ-পথে থামিয়ে দিয়েছি। তোমাকে
গোলাপের মখমল-পাপড়ি ছোঁবার, শিশুকে আদর করবার, আমার
দয়িতার গাল, গলা, স্তন, কোমর স্পর্শ করবার অধিকার দিয়েছি অকুণ্ঠচিত্তে।
‘গীতবিতানে’র পাতা সমুদয়, গ্রিক ট্রাজেডি, প্লেটোর ‘রিপালিক’, রিল্কের
‘ডুইনো এলিজি’, জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’-এর পাতা
ওল্টানোর অসামান্য সুযোগ কি দিইনি তোমাকে?”
হে প্রিয় মধ্যমা আমার, কে তোমাকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে
দিয়েছে আজ? আমার কোনও কোনও প্রবীণ বন্ধু প্রেমের কবিতার
সঙ্গে আমার এত লদকালদকি পছন্দ করেন না। ‘লদকালদকি’
শব্দটি অবিশ্যি তাদেরই মুখনিঃসৃত। ভাবলে কী করে তুমি অসহযোগ
আন্দোলন শুরু করলেই আমি প্রেমের কবিতার দেশ থেকে নির্বাসিত হব
হে মধ্যমা? তোমার অজানা নয় যে স্বদেশ, জ্ঞানান্বেষণ, কবিতা এবং
ভালোবাসার প্রতি চিরনিবেদিত। যার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখতে
না পেলে, যার সঙ্গে একদিন দেখা না হলেই হৃদয় হয় আহত পাখি,
যার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কবিতার ভাষা ভুলে যাই, তাকে
নিয়ে কবিতা লিখব না কারও ফরমানের ধমকে এমন উদ্ভট চিন্তা
তোমার মাথায় ঢোকাল কে?
দেখ, তোমার স্মারকলিপি কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি বাজে
কাগজের ঝুড়িতে। তুমি কোন্ ছার, তোমরা দশজন সঙ্গী ঐক্যজোট
বেঁধে ধর্মঘট করলেও মাথা নত করব না, মানব না হার। যত কষ্টই হোক
দাঁত দিয়ে কলম চেপে ধরে কবিতা লিখব, প্রেমের কবিতাই লিখব।
দেখে নিও, প্রেমের দেবতা হবেন আমার পরম সহায়। আমার
খাতার পাতা-জোড়া এক নন্দিনীর হরফে-গড়া প্রতিমার মুখের হাসির
ঝর্ণাধারা দেখে তোমাদের ধর্মঘটী মুখ চুন হয়ে যাবে। তোমাদের
ঘিরে ছেয়ে আসবে ঘোর অমাবস্যা।
১৭.৭.৯৭
মাঝে মাঝে মাটিতে
মাঝে মাঝে মাটিতে বুক রাখি। আমার হৃৎস্পন্দন আর
মাটির বুকের টিপটিপ শব্দের যুগলবন্দি চলে অনেকক্ষণ।
মাটিলগ্ন হয়ে থাকবার এই আনন্দ উত্তাল ঢেউয়ের ওপর নৌকো।
আজ গুচ্ছ গুচ্ছ ঘাস ভেদ করে আমার বুক যখন মাটিতে পেতে
দিলাম, জমি আমাকে শোনাল দীর্ঘ পদধ্বনি। ক’জন লম্বা, শক্ত
সমর্থ, কান্তিমান পুরুষের পদযাত্রা আমার পাশ ঘেঁষে। আমি
অনন্য কোনও উৎসব-উদ্ভাসিত বালকের মতো তাঁদের শনাক্ত করি
আমার পূর্বপুরুষ বলে। তাঁরা আমার উদ্দেশে কোনও বাক্য
উচ্চারণ না করেই হিলহিলে শস্য ক্ষেতে প্রবেশ করলেন। শস্যের
কোরাসে মুগ্ধ আমি মাটিকে আরও বেশি বুকে বাঁধি। খানিক পরে
দেখি, আমার মৃতা জননী হেঁটে যেতে-যেতে আমার দিকে তাকালেন
অবর্ণনীয় স্নিগ্ধতায়। তাঁকে নির্বাক দেখে আমার কম্পিত ঠোঁট উচ্চারণ
করে, ‘মাগো, তুমি আমার সঙ্গে একটি বারও কি কথা বলবে না আর?
মার নিশ্চুপতা জায়গাটিকে অধিকতর নির্জনতা নীরবতা দান করে।
অসহায় আমি মাটিতে মুখ ঘষি, যেমন শৈশবে ঘষতাম মার বুকে।
আমার ঢিপঢিপ বুক মাটিতে লগ্ন। হঠাৎ এ আমি কী অনুভব
করছি বুকের নিচে? প্রিয়তমা, এখন মনে হচ্ছে আমার বুকের নিচে
তোমার উদ্ভিন, স্ফুরিত স্তনদ্বয়। অথচ তুমি তো এখানে নেই কোথাও
এই মুহূর্তে। যখন তুমি ফিরে আসবে এই রুগ্ন আমার কাছে, হাসপাতালের
ফ্যাকাশে দেয়াল হয়ে উঠবে নববধূর গালের লালিমা। ফুটপাথ ফুঁড়ে
দেবশিশুর মতো দুলবে অজস্র ফুল। তোমার এই না-থাকা ক্রমাগত
কালো রঙ ছড়ায় আমার চিদাকাশে।
মাটি মাতৃস্নেহে আমার বুকে স্বপ্ন-শস্য ফলায়, টেনে নিতে চায়
সোঁদা কোলের গভীরে। জমি নিজের বুকে চিরে আমার ঠোঁটের
কাছে এক হাত মুলিবাঁশ তুলে ধরে। মুলিবাঁশে ফুঁ দিই বেনামি
ব্যাকুলতায়। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে সুরজাল। আমি সুরবিহ্বল
নৃত্যমোহিত ময়ূর।
৩.৯.৯৭