ভূমিদাস
মধ্যরাতে অকস্মাৎ একজন বীর, দীর্ঘকায়,
বর্মাবৃত, দুধসাদা ঘোড়ায় সওয়ার,
মহাকাব্য থেকে নেমে আসে
শহরে প্রধান সড়কে।
তার শিরস্ত্রাণের আড়ালে
দু’টি চোখ যেন
খাঁচাবন্দী পাখি;
প্রায় ফাঁকা পথ,কয়েকটি লোক ঘুমন্ত রাস্তায়।
কী স্বপ্ন দেখছে ওরা? হাওয়া ব’য়ে যায় নিরিবিলি
ওদের ওপর, কেউ অবছা শব্দ করে স্বচ্ছ ঘুমের ভেতর,
বর্মাবৃত বীর সূর্যোদয় আনে বর্শার ডগায়;
তাকে দেখে বহু লোক পথে জড়ো হয়।
কে সে, কে সে, কে সে-
এই প্রশ্ন প্রত্যেকের চোখে পরিস্ফুট।
কেউ কেউ কিছুটা সমুখে গিয়ে পিছু হ’টে আসে
অজানার ঘ্রাণ পেয়ে। লোকদের
আচরণ দেখে বর্মাবৃত বীরটির
ঠোঁটে কৌতুকের হাসি খেলে যায়; হায়, এরাই কি
অন্ধকার চিরে জ্যোতির্ময় দ্বীপরেখা এঁকেছিল?
স্বেচ্ছায় হারাবে ওরা আত্মদানে লব্ধ রত্নদ্বীপ?
মহাকাব্য থেকে নেমে-আসা বীর টগবগে ঘোড়া
ছুটিয়ে অনেক দূরে পৌঁছে যায় নদীর কিনারে,
ফিরে আসে শস্য থই থই মাঠে, দ্যাখে
কারা বুকে নিবিড় জড়িয়ে ধানচারা
নতুন স্বপ্নের টানে নীলিমাকে ছোঁয়;
যৌবনের গানে নাচে তালে তালে স্বর্ণপ্রসূ মাটির ওপর
সুন্দর স্পর্ধায়; ফসলের প্রভু ওরা,
অথচ নিরন্ন ভূমিদাস।
১/৮/৯৫
যখন টেলিফোনে তুমি
নিউইয়র্কের উডসাইডে এক তেতলা অ্যাপার্টমেন্টে
ভোরবেলা এলো তোমার টেলিফোন। হাজার হাজার মাইল
উজিয়ে-আসা তোমার কণ্ঠস্বর
মর্মমূলে পৌঁছতেই আমার চিত্ত ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর
সেতারের বসন্ত বাহার। তোমার কণ্ঠস্বর আমাকে
চুম্বন করার সঙ্গে সঙ্গেই
বিশ্বের সকল রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয়
আমার একচ্ছত্র অধিকার,
জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্রদূত
আমাকে কুর্ণিশ করেন এক সারিতে দাঁড়িয়ে।
টেলিফোনে তোমার উচ্চারিত কথামালা
সাঁতার কাটছিল জলকন্যাদের ধরনে আর তক্ষুণি
ভ্রাম্যমাণ দরবেশ শামস্-আল তাবরেজ
তাঁর মরমী উষ্ণীষ অর্পণ করলেন আমাকে, লালন শাহ
আমার হাতে তুলে দিলেন তাঁর নিজস্ব দোতারা
এবং দুনিয়ার তাবৎ প্রধান কবি
আমাকে পাঠালেন রাশি রাশি পুষ্পস্তবক।
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কীটস, ইয়েটস, রিল্কে এলুয়ার আর
নেরুদার পঙ্ক্তিমালা আমাকে ঘিরে
এক অপরূপ ব্যালে রচনা করে, যখন
তোমার কথা পুষ্পিত হতে থাকে টেলিফোনে।
যখন তোমার টেলিফোন আসে কোনো রূপসী
স্নানার্থিনীর মতো সরোবর-তীরে আলতো পা ফেলে,
যেন ব্যালোরিনা, তখন সকল যুদ্ধবাজ
রাষ্ট্রের সমর নায়কেরা সই করে শান্তির দলিলে,
তখন সকল সন্ত্রাসের নির্দয় বেলেল্লাপনা,
বুলেটের বেহায়া রকবাজি নিভে যায় এক ফুৎকারে, তখন
নিদারুণ অপুষ্টিজনিত জীবন্ত সকল শিশু-কংকাল
হয়ে ওঠে জ্বলজ্বলে স্বাস্থ্যবান, অন্ধজন ফিরে পায় আলো,
তখন হাসপাতালসমূহে সকল অসুস্থজন আরোগ্য লাভ করেন, তখন
হায়নাগুলো হরিণ হয়ে বিচরণ করে হরিৎ শোভায়।
তখন ধর্মান্ধদের হিংস্র উন্মত্ততা পোকামাকড়ের উঠরে যায়,
প্রতিক্রিয়াশীলদের অমাবস্যা রাতের ষড়যন্ত্র থাকে মুলতবি।
হে আমার হৃদয় নন্দনবনচারিণী, টেলিফোনে
তোমার কণ্ঠস্বর নিয়ে আসে বাংলার হৃদয়ের ধ্বনি।
কখনো কখনো মুহূর্তের জন্যে মনে হয়, কে তুমি?
কে তুমি আমার চেতনায় বইয়ে দিচ্ছ অমিয়ধারা?
তুমি কি স্বর্গীয় কোনো পাখি, যার কণ্ঠসুর
আমি ছাড়া অন্য কেউ শোনেনি কখনো
এই চরাচরে? যখন তুমি আমার উপস্থিতির
বহুদূরের ওপার থেকে কথা বলো, নীরবতা
আমাকে জাপটে ধরে, কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে আমার।
আমার নিভৃততম ভেতরে জালালউদ্দিন রুমি
হয়ে উঠতে চান দুর্বার কথক।
নিউইয়র্ক, ১১ অক্টোবর ৯৫
যে বাগান
যে-বাগান আমরা দু’জন অনুরাগে দিনরাত
অনুপম শিল্পের মতোই
গড়েছি বৃষ্টিতে ভিজে, রৌদ্রে পুড়ে, যেখানে ফুটছে
নিত্যদিন অজস্র রঙিন ফুল সৌরভে, গৌরবে
ঈর্ষনীয়, সেখানে কি আজ
আগাছার ভিড়? কোন দূষিত হাওয়ার
স্বেচ্ছাচারে শুধু
রিক্ত শাখাগুলি গুরুতর
রোগীর বিশীর্ণ কালো আঙুলের মতো কম্পমান? কোনো পাখি
সহজে আসে না আর এ বাগানে ভুলেও কখনো,
গায় না মধুর কোনো গান। কোন্ ভ্রম আমাদের
দু’জনের সৃষ্টিকে করেছে নষ্ট হঠাৎ অকালে?
জালালউদ্দিন রুমি যে-বাগান নিয়ে ভেবেছেন সুগভীর
করেছি সন্ধান তার এখানে সেখানে, তবু পেলাম কোথায়?
আমার অঙ্গনে যদি না শুনি তোমার পদধ্বনি,
তোমার মধুর কণ্ঠস্বর যদি কানে
ঢেউ না জাগায়, যদি ছিন্ন হয় সব যোগাযোগ
তাহলে আমার এই কবিতা লেখার
কী অর্থ দাঁড়ায়?
তোমার নীরব ওষ্ঠে যদি আমার উদ্দেশে ‘ভালোবাসি’ শব্দ
বারবার উচ্চারিত না হয়, এবং
আমাদের দু’জনের গড়া বাগানের শোভা যদি
পোকার উদরে কিংবা ধুলায় বিলীন হয়, তবে
আমার এ বেঁচে থাকবার, বলো, তাৎপর্য কোথায়?
ফ্লোরিডা ২৭ সেপ্টেম্বর ৯৫
শব্দের আকাঙ্ক্ষা
শব্দের আকাঙ্ক্ষা সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্তের সীমা
নিমেষে পেরিয়ে যায়, বস্তুত শব্দের
বাসনা অপরিসীর। শব্দ
আকাশ এবং সমুদ্রের
নীল হ’তে চায়, হতে চায়
রঙিন পাখির নীড়, কৃষকের বিনীত কুটির
কামিনীর চোখ। শব্দ হ’তে চায় বাঘ
এবং হরির্ণ, সৌরলোক।
শব্দ হ’তে চায় বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক আর
কোরান শরিফ।
শব্দ হতে চায় ‘মেঘদূত’, ‘হ্যামলেট,’ ‘ম্যাকবেথ’
মহাকবি দান্তের নরক,
মিল্টনের স্বর্গ-মর্ত্য, রুমির অম্লান মসনবি।
শব্দ হতে চায়
দেশপ্রেমী মানুষের প্রতিটি
মহান নেতার নেরুদার কল্লোলিত
কবিতার মতো দীপ্র ব্যাপক আহবান।
শব্দ হতে চায়
রাধিকা, লায়লা, শিঁরি, বেহুলা এবং
আমার আপন দয়িতার কতো মধুর বচন।
নিউইয়র্ক, ১৪ সেপ্টেম্বর ৯৫