প্রত্যাহারের পালা
সে এক ভ্রামণিক, অনেক পথের স্মৃতি তাকে
কখনো আনন্দিত, কখনো বা
বিষণ্ন, উদাসীন ক’রে তোলে। একদিন সে আখেরে এসে
পৌছলো এক প্রান্তরে। এমন ধূসর জায়গা অন্তর্গত নয়
তার অভিজ্ঞতায়। উপরে তাকিয়ে দ্যাখে,
খরা-দীর্ণ জমিনের মতো আসমান, পায়ের তলায়
অসমান রুক্ষ মাটি আর তখুনি নিজেকে
লোলচর্ম বৃদ্ধের প্রতিনিধি ব’লে শনাক্ত করলো।
কে যেন খুব কাছে থেকে নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
তোমার রসনা, যা বহুকাল আস্বাদন করেছে
চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়, এখন থেকে বঞ্চিত হবে স্বাদ থেকে।
তোমার দু’টি চোখ, যারা এতকাল দেখেছে আকাশের
তারা, নদীর খরস্রোত, বনরাজি নীলা, পাখির উড়াল,
নারীর সৌন্দর্য, এখন থেকে
হারিয়ে ফেলবে জ্যোতি। তোমার নিকট থেকে
প্রত্যাহার করা হলো রতিক্রিয়ার
আনন্দানুভূতি; ভ্রামণিক প্রত্যাহারের
প্রতিটি তীরের যন্ত্রণা সহ্য করলো মুখ বুঁজে।
যখন সেই নির্বিকার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
এখন প্রত্যাহার করা হবে
তোমার ভালোবাসবার ক্ষমতা,
সেই মুহূর্তে প্রতিবাদে ফেটে পড়লো
বুড়োসুড়ো ভ্রামণিক, ‘না, তা আমি মেনে নেবো না।
নারী, নিসর্গ, সারা বিশ্বের মানুষের প্রতি
আমার নিবিড় ভালোবাসার ক্ষমতা
কাউকেই কেড়ে নিতে দেবো না। ব’লে দিচ্ছি, কিছুতেই না।
১৬/৩/৯৫
প্রবাসে একটি সকাল
চকচকে দিনারের মতো ভোরবেলা ঝলসাচ্ছে
চতুর্দিকে, প্রতিবেশী স্বাস্থ্যবান প্রৌঢ় মেতেছেন
জগিং এ প্রত্যুষ থেকে। সবেমাত্র আমি এক পাতা
ডায়েরি লিখেছি আর খেয়েছি পরিজ,দুটো টোস্ট
আস্তে সুস্থে। আবার নতুন ক’রে পড়ি মুগ্ধাবেশে
ইয়েটস্-এর পংক্তিমালা, সধূম চায়ের বাটি কাছে
রাখা আছে, সানন্দ চুমুক দিই মাঝে মাঝে আর
দূরগামী মেঘ দেখি কখনো কখনো, ধীরে বয়
আমার সময়; কাল বারোটায় চক্ষু চিকিৎসক
দেখবেন আমাকে, কৌশিক সঙ্গে যাবে। এরই মধ্যে
বাংলাদেশ কী ব্যাকুল করে টেলিফোন। কণ্ঠস্বরে
তার মমতার রেণু ঝরে, বসে থাকি একা-একা
ঠাণ্ডা ঘরে। স্বপ্নের ভগ্নাংশগুলো জড়ো করি শুধু
ধু-ধু প্রতিবেশ থেকে। তোমার অনুপস্থিতি আজ
কালো গোলাপের মতো তীব্র ফুটে আছে সত্তা জুড়ে;
দেহমন হলো কালি, হাড় থেকে ওঠে কালো ধোঁয়া!
১৫/৮/৯৫
বদলাতে থাকে
ত্রয়ী কথাশিল্পী রশীদ করীম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার বন্ধুতা দীর্ঘকালের, অথচ
তাঁরা উপন্যাস দেখার সময় মূল কাহিনী একটু-আধটু ক’রে
বদলে ফেলেন কিনা, এতদিনেও তাঁদের জিগ্যেস করা হয়নি।
কত কথাইতো হয় আমাদের, হয়তো
এই কথাটি ঢাকা প’ড়ে থাকবে অনেক কথার আড়ালে। তবু
অনুমান করি, তারা সম্ভবত লিখতে লিখতে ভাবেন,
ভাবতে ভাবতে লেখেন আর বদলে ফেলেন অনেক কিছু।
জীবন সব সময় একই রকম থাকে না,
আমাদের সবারই জীবন কমবেশি, কারো অতি শ্লথ কারো খুব দ্রুত,
বদলাতে থাকে। কখনো কখনো টের পাওয়াই ভার।
তোমরা আমার দিকেই তাকাতে পারো, তোমরা যারা
আমার বিষয়ে অল্প বিস্তর জানো(সবটুকু কে-ই বা জানতে পারে?)
তারা বলতে পারবে কী রকম বদলে গিয়েছি আমি। আমার
শারীরিক ভূগোলের পরিবর্তন এত বেশি
দৃষ্টিগোচর যে, অনেকেই কেমন নজরে তাকায়, যেন ওরা কোনো
কাকতাড়ুয়া দেখছে! আমার যৌবনের জামা কাপড়
এখন আমার গায়ে লাগবে না, হবেনা মানানসই।
বহুকাল আমি খোলামকুচি আর কাচের টুকরো নিয়ে
খেলায় মেতে থেকেছি, এই তো কিছুদিন আগে
এই আশ্চর্য মণিরত্ন দেখা দিয়েছে আমার চলার পথে আর
আমার জীবন বদলে গ্যাছে সম্পূর্ণভাবে। আমার মধ্যে
ভালোবাসার সেই দ্যুতি ঝিকিয়ে উঠেছে যা,’ মানবতার অনুপম
ঐশ্বর্যের সন্ধান দেয়, ঝর্ণাতলার নুড়িকে নক্ষত্রে
রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ধরে। আজ সহজেই বিশ্বের
সর্বকালের মহাকবিদের আসর ব’সে যায়
আমার দহলিজে। কেউ কেউ আমাকে লক্ষ করেন ঈষৎ কৌতূহলে,
কেউ কেউ আমার কবিতার খাতা নিয়ে খানিক
নাড়াচাড়া ক’রে রেখে দেন টেবিলে। কেউ হেসে
দেখিয়ে দেন ক্রটিগুলো।
একজন শ্বেত শ্মশ্রুমন্ডিত অমিতকান্তি কবি
আমাকে একধারে এনে
চুপিসারে বলেন, “তোমার কাব্যভাষায় সেই স্পর্শ আনতে
চেষ্টাশীল হও যা’ সমকালীন বাংলা কবিতায় গরহাজির।“
“কী ক’রে আনবো? আমি কি পারবো, হে কবিগুরু?”
আমি প্রশ্ন দু’টি শেষ করতে না করতেই মহাকবিদের আসর
মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। আমি বদলে যাওয়ার প্রত্যাশায়,
প্রতীক্ষায় কম্পমান কোনো বয়স্ক মৎস্য শিকারীর মতো।
নিউইয়র্ক, ৩/১০/৯৫
ব্রাইটন বীচে
জুতোয় পালিশ আছে কি নেই, শার্টের কলারের
ভাঁজ খুঁতময় নাকি চুল এলোমেলো
এ নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ ছিল না মোটেই
ব্রুকলীন ব্রাইটন বীচের সুউচ্চ সাততলা
অ্যাপার্টমেন্টের বড় জানালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
এ কী? এ কী? সমুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ে বুঝি
ঘরের ভেতর খল খল হেসে।
একটি কি দু’টি গাংচিল বেড়ায় ভেসে ঢেউ ছুঁয়ে,
কখনো বা জানালার কাচ প্রায় ছোঁয়
অবারিত ডানার উল্লাসে।
মাঝে-মাঝে কয়েকটি গাংচিল পোহায়
রোদ সুখে নিরিবিলি ব্রাইটন বীচের বালিতে।
জানালার কাছে ব’সে দূর থেকে দেখি
ফেনিল সমুদ্রতটে টপলেস স্নানার্থিনী ঘোরে,
কেউ গা ভাসায় নীল জলে। অকস্মাৎ
মনে হয়, মলুয়া সুন্দরী আর বেহুলা সাগরে নামে আর
আফ্রোদিতি সমস্ত শরীরময় সাদা ফেনা নিয়ে
ব্রাইটন বীচে উঠে আসে।
পরমুহূর্তেই দেখি, ওরা কেউ নয়, প্রিয়তমা শুধু তুমি
কী সুন্দর রয়েছ দাঁড়িয়ে আর শরীর ছড়াচ্ছে বিন্দু বিন্দু মুক্তো-জল।
নিউইয়র্ক, ৮ অক্টোবর ৯৫